সাহিত্যিকা

ষাটের দশকে প্রেম

ষাটের দশকে প্রেম
নারায়ণ প্রসাদ মুখার্জী, ১৯৬৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

আমাদের সময়ে অর্থাৎ ষাটের দশকে বিই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রেম বা মাখামাখি সেরকম চোখে পড়ত না। তখন মেয়ের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। এদের মধ্যে অপূর্ব সুন্দরী বা ডানাকাটা পরীদের সাধারণত দেখা যেতো না। যে কারনে কোন সুন্দরী মেয়েকে ক্যাম্পাসে দেখা গেলেই বুভুক্ষু জনতার উল্লাস শোনা যেতো।

শুভ্রা বোস আমাদের সময়ের বহুল উচ্চারিত একটি নাম। আকর্ষনীয় ব্যাক্তিত্ব। জুনিয়র সিনিয়র সকল ছাত্রদের চোখের মণি। কলেজে থাকাকালীন শুভ্রাদির সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। কোন ছুতো করে অনেকেই কথা বলার চেষ্টা করত। যাই হোক শুভ্রাদির পেছনে অনেকেই লাইন দিয়েছিল।

একদিন দেখলাম শুভ্রাদিকে, মেট্রোয় সিনেমা দেখতে গেছে, সঙ্গে এক সিনিয়র দাদা। খুব সম্ভবত ইলেকট্রিক্যালের। আরেকদিন দেখলাম সিভিলের এক দাদার সঙ্গে ক্যান্টিনে বেশ অনেকক্ষণ ধরে আড্ডা দিতে। এরকমভাবে শুভ্রাদি অনেকের সাথেই সহজ সম্পর্ক নিয়ে মেলামেশা করতো। মনে রাখতে হবে, ষাটের দশকে এটা সহজ ছিলো না। তাই শুভ্রাদি ছিলেন ব্যাতিক্রমী। আর শুভ্রাদি কখনোই করোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতো না। সেই শুভ্রাদি কলেজ থেকে পাশ করে আরও পড়াশোনা করেছিলো।

আমার মেকানিকালের বন্ধুরা কেউ কেউ ওদের নিজেদের প্রেমের গল্প শোনাত। এই প্রেমিকারা কেউ পাশের বাড়ির, কেউ ছোট বেলার বন্ধু, কেউ বা বৌদির বোন আবার কেউ বন্ধুর বোন। এইসব প্রেমকাহিনী শুনে আমাদের সময়টাও আশা-নিরাশা-হতাশায় মিলিয়ে মিশিয়ে ভালোই কাটতো।

কালি ন্যাপা জংলী ঝুনো এরা মেয়েদের পেছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত হাত তুলে দিয়েছিল। জ্যাঠা, খুড়ো, চিদু, বাচ্চু, ভোম্বল এরা প্রত্যেকেই এক একটি ব্যার্থ প্রেমিক প্রমানিত হয়েছিলো। এদের প্রেমিকারা কিছু দিন প্রেমে গদগদ হয়ে ঘুরে সিনেমা টিনেমা দেখে চপ কাটলেট মোগলাই সাঁটিয়ে তারপরে হঠাৎই উধাও হয়ে যেতো।

সুরেশ ভাটপাড়ায় পাশের বাড়ির সুদেষ্ণার সঙ্গে সাত সাতটি বছর ধরে জমিয়ে প্রেম করল। ওরা ছাদে উঠে প্রেম করতো। লাভ লেটার লিখে ঢিলে বেঁধে একে অন্যের বাড়ির ছাদে ছুঁড়ে দিত। এরপর সুরেশ পাশ টাশ করে কয়েক বছর বাদে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ চলে গেল। এই প্রেমের কি পরিনতি হয়েছিলো সেটা সহজেই অনুমেয়।

নিলয় প্রেম করতো বন্ধুর বোন রত্নার সঙ্গে। নিলয় রত্নাকে নিয়ে একদিন রেল লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। একটা বকুল গাছ তলায় হাত ধরাধরি করে বসে প্রেম নিবেদন করছিল। সন্ধের সময় তিন চারটে মস্তান টাইপের ছেলে এসে খারাপ ভাষায় নিলয়ের পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই নিলয় খুব ভয় পেয়ে নিজের মিথ্যে পরিচয় দিল। শুনেছি অনেক অনুনয় বিনয় করে ছাড়া পেয়েছিল। তারপর যখন রত্নার সঙ্গে আবার দেখা হলো রত্না ওকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল তার মতো ভিতু মেরুদন্ডহীন ছেলের সঙ্গে সে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। এই একটা ঘটনার পরে রত্না নিজেই সরে গেল।

গোপাল ও সোনালী একই টিউটরের কাছে অঙ্ক পড়ত। দুজনেই সাইকেল চালিয়ে টিউসনে যেতো। একদিন মাঝরাস্তায় সোনালীর সাইকেলের চাকা পাংচার হয়ে গেলে সেদিন গোপাল সোনালীর সাইকেলটা দোকানে নিয়ে গিয়ে সারিয়ে নিয়ে এসেছিল। তারপর থেকেই ওদের মধ্যে ভাব ভালবাসা ধীরে ধীরে গড়ে উঠে। পরে ওরা বিয়ে করে সুখীও হয়েছিলো।

সুবীরের প্রেমিকার আসল নামটা আমার জানা নেই। ওদের পাশের বাড়িতে থাকত। ও মোনালিসা বলে ডাকত কারন তাঁর হাসি ওকে পাগল করে দিয়েছিলো। সুবীরের বাবা ছিলেন ডাক্তার। বাবা’মার শরীর খারাপ হলে মোনালিসা ডাকতে আসত। এরপর অনেকবছর বাদে সুবীর ওর বৌকে নিয়ে আমার কোয়ার্টারে বেড়াতে আসে। ও তখন দুর্গাপুরে এলয় স্টীল প্লান্টে চাকরি করে। আর আমি ছিলাম CMERI তে। ওর বৌয়ের হাসি দেখে আমার মনে সন্দেহ হচ্ছিল এই কি সুবীরের যৌবনের মোনালিসা?
“আচ্ছা তোর মোনালিসা র কথা মনে আছে?” কৌতুহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম আমি। হো হো করে হেসে উঠলো সুবীর আর পাল্টা প্রশ্ন করলো আমাকে “তোর কি মনে হয়?”
সোজাসুজি উত্তর পাইনি। তবে ভদ্রমহিলার সলজ্জ হাসি দেখে মনে হয়েছিল এই সেই মোনালিসা।
এই একটি প্রেমের ঘটনা, যার সঙ্গে আমিও প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষী হয়ে জড়িয়ে গিয়েছিলাম।

১৯৬০ সাল। উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমার স্কুলের এক বন্ধু্র দিদি ‘বেবি’দি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এবং ম্যাথেমেটিক্সে লেটার মার্ক্স পেয়ে দারুন রেজাল্ট করেছে। এবার বেবি’দির ইচ্ছে বাবার মতো ইঞ্জিনিয়ার হবে। কাকু DVC র চিফ ইঞ্জিনিয়ার। শিবপুরেরই প্রাক্তন ছাত্র। শিবপুরের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ভালো ভাবে সফল হয়ে বেবি’দি ইলেকট্রিকালে ভর্তি হয়ে গেল। সেই বেবি’দি আমাকে নিজের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতো। আমাকে ডেকে বলল তুইও চেষ্টা কর, একই কলেজে পড়ব, খুব ভালো লাগবে।

১৯৬২ সালে বেশ ভালো ভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বিই কলেজের এনট্রান্স পরীক্ষায় বসে গেলাম। কলেজে চান্সও পেয়ে গেলাম। জিনিসপত্র বোঝাই ট্রাঙ্ক এবং বিছানা হোল্ডল নিয়ে Downing হোস্টেলের সতেরো নম্বর ঘরে আমার নতুন জীবন শুরু হয়ে গেল।
সন্ধ্যবেলায় এক দল সিনিয়ার দাদা এসে ঢুকল আমাদের ঘরে। এক দাদা আমার নাম ধরে খোঁজ নিচ্ছিল। একটু অবাক হয়ে আর কিছুটা ভয়ে ভয়ে আমি নিজের পরিচয় দিলাম ‌।
“শোন আমার নাম সৌরভ – সৌরভ ব্যানার্জী। থার্ড ইয়ার ইলেকট্রিকাল। অরুনিমা ভট্টাচার্য্য আমার ক্লাসমেট। কাল তার সঙ্গে দেখা করিস বিকেল পাঁচটায় সেকেন্ড গেটে।”
পরদিন বিকেলে যথারীতি আমি পোঁছে গেলাম সেকেন্ড গেটে ঠিক পাঁচটায়। দেখলাম বেবি’দির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সৌরভ ব্যানার্জী। অনেকক্ষণ কথা হলো ।
“সৌরভকে বলেছি দেখতে তোকে যেন কেউ রাগিং না করে।”
বেবিদির এই কথায় আমি আশ্বস্ত হলাম।
একদিন আমি আর অশোক ক্যান্টিনে আড্ডা দিতে গেছি। দেখলাম সৌরভদা এবং বেবি’দি গভীর মনোযোগ দিয়ে কি আলোচনা করছে।
পরে আমি বেবি’দিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “তোমরা কি এতো সিরিয়াসলি আলোচনা করছিলে?”
“আর বলিস না সৌরভকে বলছিলাম বিদেশ গিয়ে higher studies করতে। আর ও বলছে পাশ করেই চাকরি করবে। আমি চাই আমরা দুজন ই higher studies করে academic লাইনে যাবো।”
আমি বলেছিলাম “সৌরভ’দা তো brilliant student, ওনার মতো ছাত্রদের teaching profession এই যাওয়া উচিৎ।”
যাই হোক বেবি’দির কথা রাখতে সৌরভ’দা অবশেষে পড়াশোনা করতে আমেরিকা পাড়ি দিল। বেবি’দির বাবা হঠাৎ মারা যান ঐ সময়। তাই বেবি’দির আর আমেরিকা যাওয়া হলো না। অনেকদিন পর্যন্ত বেবি’দি বিয়ে করে নি বলেই জানি। সৌরভদা শেষ পর্যন্ত এক মেমসাহেব কে বিয়ে করে সংসার পেতেছিল। বেবি’দি সৌরভদার প্রেমের এই বিয়োগান্তক পরিণতি কেন হলো আজও বুঝতে পারিনি।

Sahityika Admin

Add comment