মহাশ্বেতা
বন্দনা মিত্র, ১৯৮২ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
বসন্ত পঞ্চমী রাতে ব্যস্ত স্টেশনে
দেখেছি বালিকাটিকে।
দেখেছি আলোর নীচে একমনে
ঝুঁকে পড়া একাগ্র শরীর,
খোলা বই, বাসি কাগজের কাটা খাতা।
ভ্রূকুঞ্চিত উজ্জ্বল বাদামী মুখে
পলাশরেণুর মত গুঁড়ো মাখা
জ্ঞা পূর্বক সন প্রত্যয়।
প্রত্যয় দেখেছি আমি অপুষ্ট চিবুকে তার,
শক্ত পেন্সিল ধরা শীর্ণ হাতে
দেখেছি অদৃশ্য বীণা, অনুপম মীড়
চোখের আড়াল করা দেদীপ্য ত্রিনয়ন –
বসন্ত পঞ্চমী তিথি, শীতার্ত সন্ধ্যায়
দেবীকে দেখেছি আমি
স্টেশনের ম্লান আলো মেখে
সকরুণ জ্ঞানস্বরূপিনী।
চলন্ত জানলা থেকে কৌতূহলে প্রশ্ন করি,
“কে তুমি! কি নাম তোমার?”
উচ্ছল কৌতুক স্বর দূর থেকে ভেসে আসে
“সরস্বতী মুর্মু বটে।”
ইতিপূর্বে কুলায় ফেরা ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত
মা ভাবেন লোকে মেয়েকে তাঁর আদর করে লক্ষী বলে, সরস্বতী বলে না কেন? লক্ষীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধন, শ্রী, সম্পদ এবং সবার ওপর ঘরকন্নার চাবিকাঠিটি। সুগৃহিণী হওয়ার আশীর্বাদ। লক্ষীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সঞ্চয়, ধানের ছড়া, খড়ের আঁটি, ঝাঁপিতে এক মুঠো চাল, সিঁদূর মাখানো একটি দুটি টাকা – অসময়ের ভরসা। লক্ষী হলেন নারায়ণের সহধর্মিণী, তাঁকে নিয়ে কত ব্রতকথা, কত পুরাণ, কত গল্প। মেয়েকে তো মানুষ করা হয় পরের ঘরে যাবার জন্য, অভাবের সংসারে উপবাসে থেকে পানের রসে ঠোঁট লাল করে অতিথি অভ্যর্থনা, ভালো মন্দ পাঁচটা কথা শুনে সকলকে মানিয়ে নিয়ে ঘরকন্না করা – এসব তো মা লক্ষীরাই করে থাকেন।
আর সরস্বতী ? তিনি যেন কেমনতর! একে তো সাদা শাড়িতে ঢাকা সর্বাঙ্গ, গয়নাগাঁটি আছে কি নেই বোঝা যায় না, হাতে দিব্যাস্ত্র নেই, টাকার ঝাঁপি নেই, থাকার মধ্যে আছে বই আর বীণা । মেয়েমানুষ ও দুটো অকাজের জিনিষ নিয়ে করবে কি? ঠাকুরুণটি সধবা না বিধবা নাকি পতি পরিত্যক্তা ডিভোর্সী – তাও তো বোঝা যায় না! কেউ বলেন ব্রহ্মার ঘরণী আবার কেউ বলেন নারায়ণের। ঘরণী যাঁরই হোন না কেন, ঘর যে কারোরই করেন না সেতো দেখলেই বোঝা যেয়। কেমন অহংকারী টরটরে দাঁড়িয়ে থাকেন ড্যাম কেয়ার দৃষ্টি ফেলে। বাহন দেখুন – রাজ হাঁস – সারাদিন সাঁতার কেটেও যার একটা পালকও জলে ভেজে না! বোঝাই যায় এ দেবী অসুরদলন করে সংসারের জঞ্জাল সাফও করবেন না আবার টাকার ছালা নিয়ে সারা রাত ঘুর ঘুর করে দেখতেও যাবেন না যে কে জেগে পাশা খেলছে। জোর জবরদস্তি করলে বড়জোর অসুরদের হাতে গোটা কয়েক বই টই তুলে দিয়ে গান টান শোনাতে বসতেন। সেই শুনে রত্নাকরের মত হয়তো অসুর দানবরাও ধনরত্নের বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দেবভাষায় গেয়ে উঠতো –
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।[৯]
প্রেমের পবিত্র মিথুনমূহূর্তে প্রাণকে হত্যা করা পাপ। এই পাপের ক্ষমা হয় না।
বিষ্ণু, শিব, ইন্দ্র, বরুণ সবাই চিরদিন পাপীর বিনাশ করে এসেছেন, দৈত্য দানব অসুরকে বজ্র, চক্র, গদা হেনে ধ্বংস করেছেন । কিন্তু দস্যু রত্নাকরকে ঋষি বাল্মীকি – না মশাই এই সৃষ্টিছাড়া কাজটি আমাদের এই সৃষ্টিছাড়া ঠাকুরুণ বই আর কেউ করেছে বলে শুনিনি। শরীরী মিলনকে একান্ত পবিত্র বলে ডিক্লেয়ার করা – সেও তো এই শুভ্রবসনা , প্রিম অ্যান্ড প্রপার, শান্ত, গম্ভীর বাগদেবীর জাজমেন্ট।
সৃষ্টির ঊষালগ্নে কে জানে কোন কৌতুকপ্রিয় বিধাতা বিদ্যা, জ্ঞান ও সঙ্গীতের দায়িত্ব চাপিয়ে দিল এই আমাদের বাউন্ডুলে, সাদামাটা, ঘরকন্নায় অপটু, মেধাবী, মনস্বিনী দেবীটির উপর! হয়তো এলেবেলে বলে কোন গ্রাম্ভারী দেবতা নিতে চায় নি এই পোর্টফোলিও। কি ভাগ্য আমাদের, এ দেশের মেয়েদের। তাই তো প্রথম প্রতিশ্রুতির সত্যবতী সদর্পে বলতে সাহস পায় – পড়াশোনা শিখলে মেয়েদের পাপ হবে কেন? বিদ্যের দেবী সরস্বতীই তো মেয়েমানুষ। তাই তো অনেক যুদ্ধ করে মেয়েদের হাতে আংটি কি কাঁকনের বদলে বর্ণপরিচয় তুলে দেওয়া এক “ফলারে বামুন” আজ বেঁচে থাকলে কি খুশিই না হতেন। মেয়েরা শুধু দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা বা সংসারে শ্রী, সম্পদ আনয়নী দেবী লক্ষী হয়ে আর খুশি থাকছে না। তারা বীণা পুস্তক রঞ্জিত হস্তে মহাশ্বেতা সরস্বতী হতেও চাইছে।
মা তাঁর মেয়ের হাতে চক খড়ি তুলে স্লেটে লেখাচ্ছেন অ আ আর গুণগুণ করছেন
“বুদ্ধিমতী বিদ্যেবতী
খুকু আমার সরস্বতী। “
বলছেন আমাদের লক্ষী মেয়ে আর চাই না। ঘরে ঘরে সরস্বতী জন্মাক।
সম্পাদকীয় সংযোজন :- (মূল শ্লোক)
मा निषाद प्रतिष्ठां त्वमगमः शाश्वतीः समाः ।
यत्क्रौञ्चमिथुनादेकमवधीः काममोहितम् ।।
করোনা, করোনা প্রতিষ্ঠা লাভ, হে নিষাদ, চিরকালের তরে,
দু’টি পাখি ছিল প্রেমে বিহ্বল, একটিরে তার হানিলে শরে।।
Add comment