প্রজেক্ট সাইটে সরস্বতী পূজা ও অপরূপা
অসীম সাহা, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সেটা ১৯৮০ সাল। কাজ করি National Dairy Development Board (NDDB) এ আমাদের সিকিম জোরথাং চিলিং প্লান্ট প্রজেক্টে। আমাদের সেই পাহাড়ি সাইটকে প্রকৃতি যেন ঢেলে সাজিয়েছে। একদিকে পাহাড়ি রঙ্গিত নদী। চারিদিকের জঙ্গলে নানান রকমের নাম না জানা গাছ আর ফুল। সকালে ঘুম ভাঙে পাখীদের কিচির মিচির আওয়াজে। আবার সন্ধ্যায় পাখীরা বাসায় ফিরে এসে গানের আসর বসায়।
সেই সাইটে আমরা কয়েকজন বাঙালি মিলে ঠিক করলাম যে সরস্বতী পুজো করবো। রঙ্গিন কাগজ, কাপড়, ফুল, পাতা দিয়ে সুন্দর করে সারা রাত জেগে প্যান্ডেল করা হলো। শিলিগুড়ি থেকে ছোট ট্রাকে করে সরস্বতী ঠাকুর আনিয়ে বসানো হলো আমাদের নিজেদের হাতে বানানো প্যান্ডেলে। স্থানীয় রান্নার ঠাকুরকে অনেক কষ্টে বোঝানো হলো কি কি রান্না করতে হবে এবং কি ভাবে করতে হবে। ভোর রাতে আমরা শুতে গেলাম। পরের দিন খুব সকালে উঠে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে যথাসাধ্য মাঞ্জা দিয়ে পুজোর প্যান্ডেলে পৌঁছেও গেলাম। আমি একজন প্রধান উদ্যোক্তা, তাই পূজোর ভালোমন্দের দায় অনেকটাই আমার উপরেই আসবে।
আমাদের ওখানে ডক্টর প্যাটেল নামে একজন ভেটেনারি ডাক্তার ছিলেন। অল্পবয়সী গুজরাটি ছেলে, সম্প্রতি বিয়ে করেছে। কিন্তু তখন সে ফোর্সড ব্যাচেলর কারণ তখনো ঐ সাইটে ফ্যামিলি নিয়ে থাকার মতন খুব ভালো ব্যাবস্থা ছিলো না। হটাৎই দেখি আমাদের সেই ডক্টর প্যাটেল প্যান্ডেলে আসছে আর ওর সঙ্গে এক সুসজ্জিত এবং সুন্দরী মহিলা। দূর থেকে মহিলাকে আমাদেরই বয়সী মনে হচ্ছে। পড়েছেন গাঢ় বেগুনি রঙের শাড়ি, সুন্দর একটা সাদা সোয়েটার, আর গলায় স্ট্রাইপ করা মাফলার। কানের দুল, হাতের কঙ্গন এমনকি হাতের ঘড়ির ব্যান্ড পর্যন্ত সব ম্যাচিং করা। অপরূপ সুন্দরী লাগছিলো। প্রাকিতিক পরিবেশে পাহাড়ের সবুজ, ফুল, নদী সবই যেন এই সুন্দরীর কাছে মলিন হয়ে গেলো।
শুধুই সৌন্দর্য নয়, যা আমাকে আকর্ষণ করেছিলো সেটা ওঁনার বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা আর স্মার্টনেস। চলাফেরাতে সুন্দর একটা ছন্দ আছে। দেখার শুরুতে অনেকটাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আবেশ কাটতেই স্বভাবতই আমি উঠে দাঁড়ালাম আর আমাদের এই উৎসবে যোগদানের জন্য হাত জোর করে অভ্যর্থনা জানালাম। আমি জানতাম না যে ডক্টর প্যাটেল নিজের স্ত্রীকে সাইটের অস্থায়ী কোয়ার্টারে নিয়ে এসেছেন।
পূজোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। লোকজনের ভিড় শুরু হয়েছে। লাউড স্পিকারে গান চলছে। ভাবতেই পারিনি এইরকম একটা নির্জন জায়গায়, পাহাড়ি গ্রামের মধ্যে এত সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারবো। লোকজন নিজেদের মতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। আমি একজন উদ্যোক্তা, তাই ভীষণই ব্যস্ত। সবাই যাতে বসার জায়গা পায়, অঞ্জলি দিতে পারে, প্রসাদ পায়, ভোগের খাওয়া পায়, সবদিকেই আমাকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
যদিও আমি পুজোয় ব্যাস্ত, তবুও ভেবেছিলাম, আজ সরস্বতী পুজোর দিনে আমার প্রিয়া বাসন্তী রঙের শাড়ী পড়ে কলকাতার কোন এক নির্দিষ্ট জায়গায় অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করবে, তা আর হলো না। অন্যদিকে আমার চোখের সামনে এক অপরূপা সুন্দরী বারংবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। মনটাও চঞ্চল হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে আমি নিজের হাতেই অনাম্নী সুন্দরীকে প্রসাদ দিয়ে এসেছি। পূজোয় অঞ্জলি দিতে গাইড করেছি। যেটুকু মন্ত্র জানি বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহী নমস্তুতে, জোড়াতাপ্পি দিয়ে এসব মন্ত্রগুলোর মানেও বুঝিয়ে দিয়েছি।
দুপুর বেলায় সবার শেষে আমরা কয়েকজন যখন খেতে বসেছি তখন দেখলাম মিসেস প্যাটেল আমার পাশেই এসে বসলেন আর ওনার অন্যপাশে ডক্টর প্যাটেল। মনে হলো ডক্টর প্যাটেল আমার সম্বন্ধে নিজের স্ত্রীকে নিজেদের ভাষায় কিছু বলছে। দু’একটা কথায় বুঝলাম যে প্যাটেল বলছে, আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার, এই প্রজেক্টের সাইট ইনচার্জ, এইসব। শুনে ভালো লাগলো, প্যাটেল আমার পরিচয়টা তৈরি করে দিচ্ছে। মন্দ কি? তারপর প্যাটেল উঠে গিয়ে নিজের ইয়ার দোস্তদের সাথে আড্ডায় জমে গেলো।
এদিকে আমি বুঝতে পারছি না আমার পাশেই বসা এই সুন্দরী তরুণীর সাথে আমি কি কথা বলবো? কিভাবে শুরু করবো? ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু শুরু করতে পারছি না। সুন্দরীর গায়ের মিস্টি পারফিউমের গন্ধটাও পাচ্ছি। বাংলায় একেই বোধহয় বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেই সংকট মূহূর্তে সুন্দরীই আমাকে বাঁচিয়ে দিলো। বললেন খুব সুন্দর পুজোর আয়োজন হয়েছে। আর আমি যদি একটু ফ্রি থাকি, তাহলে সে কি আমার সাথে একটু কথা বলতে পারে?
পরিচয়ে সুন্দরীর নাম জানলাম। বাড়ির নাম, মানে আমরা যেটাকে ডাকনাম বলি, তা হলো মেঘা। নিজের ভালো নাম আমাকে বললো না, বললো আমি স্বচ্ছন্দে মেঘা নামে ডাকতে পারি। সে একজন আৰ্কিটেক্ট, এখন আপাতত পুনাতে থাকে। বাবার বিজনেস দেখে। আর তারসাথে কন্সালটেন্সিও করে। আমি ইঞ্জিনিয়ার, আর সে আর্কিটেক্ট, মোটামুটি একই ধরনের কাজ করি। তাই আমার সাথে আলাপচারিতা শুরু করতে সময় লাগলো না।
ভদ্রমহিলা (জানি না, কি বলবো? ভদ্রমহিলা? না তরুণী? না সুন্দরী?) আমাকে বললেন যে এর আগে গুজরাটে, আর পুণেতে সরস্বতী পূজো দু’একবার দেখেছেন। কিন্তু প্যান্ডেলে গিয়ে সামান্য কিছু সময়ের জন্য। এই প্রথম সামনে থেকে অনেকটা সময় নিয়ে দেখলেন। জানালেন বাতাসা খুব ভালো লেগেছে। শুনে আমি উঠে গিয়ে আরও কিছু বাতাসা নিয়ে এলাম। উঃ, এতনা লায়া মেরে লিয়ে? Ok, no problem, let’s share. আমাকে জোর করে কিছু বাতাসা গছিয়ে দিলেন। মিথ্যা বলবো না, ওনার এই জোর করে বাতাসা গছিয়ে দেওয়া আমার ভালোই লাগলো। দুজনে ভাগাভাগি করে পুজোর বাতাসা খেলাম। মনে পড়ে গেলো, আমি ভিক্টোরিয়ার বেঞ্চে বসে আমার প্রিয়ার সাথে কতদিন আইসক্রীম, ঝালমুড়ি ভাগাভাগি করে খেয়েছি। সে ছিলো একরকম, আর সুদূর সিকিমে সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেলে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক অপরূপার সাথে বাতাসা খাওয়া আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। বাতাসা আমার খুব একটা পছন্দ নয়, কিন্তু সেদিন খুব তৃপ্তি করেই বেশ কয়েকটা বাতাসা খেয়ে নিলাম।
ইতিমধ্যে সুন্দরী আমাকে “তুমি” সম্বোধন শুরু করে দিয়েছে। শুনো না, মেরে লিয়ে থোড়া চায় জুগার হোগা? প্লিজ। তখন আমার অগ্নিপরীক্ষা, সুন্দরী চাইলেন, সুতরাং যে করেই হোক চায়ের ব্যবস্থা করতেই হবে। যেখানে রান্না হচ্ছে, সেখান থেকে দু’গ্লাস চা নিয়ে এলাম। তার সাথে একটু বেসন দেওয়া বেগুন ভাজা। চা তো জীবনে কত খেয়েছি, কিন্তু সেদিনের চা অন্যরকম ছিলো। আমরা দুজনে একসাথে আরও অনেক ধরণের গল্প করলাম। মাঝে আরও এক রাউন্ড চা হয়ে গেলো। আমরা কে কোথায় পড়াশোনা করেছি, হবি কি, গান বা কবিতা কেমন লাগে, কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছি, পাহাড়ে ট্রেকিং করার শখ আছে কিনা, বন্ধু বান্ধব, বাড়ির লোকজন সমন্ধে বিভিন্ন কথা। ইতিমধ্যে সুন্দরী আমাকে ওসীম নামে সম্বোধন শুরু করে দিয়েছে। আমার নামের সঠিক উচ্চারণ করতে পারছে না, ওসীম ওসীম বলছে। আর আমি ম্যাডাম বলতেই ধমক খেলাম। বোলা না? মেরা নাম মেঘা। মেঘা বলনেমে কুছ প্রব্লেম হ্যায় ক্যায়া?
হঠাৎ সুন্দরীর কি যে খেয়াল হলো, বায়না ধরলো প্রজেক্ট সাইট ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। যদিও নিজেকে যথেষ্ট পুলকিত করার মতনই সুযোগ, কিন্তু এভাবে তো আর সাইটে ঘুরে বেরানো যায় না। একটা ড্রেস কোড আছে, মাথায় হেলমেট দিতে হয়, চোখে আইগ্লাস দিতে হয়। বলার সাথে সাথে আমাদের সামনেই একজন লেবার জ্যাকেট আর হেলমেট পরে পূজো দেখছিলো। সে নিজেই গিয়ে তাঁর কাছ থেকে সেগুলো চেয়ে নিলো। আইগ্লাসও চেয়ে নিলো। সেই লেবার তো হতভম্ব। বাধ্য হয়ে আমিও নিজের সাইট কোট আর হেলমেট পড়ে নিলাম। এদিক ওদিক উদ্দেশ্যহীন হয়ে অনেক ঘুরলাম। সুন্দরী কখনো আমার হাত ধরে টানছে, ওসীম, উধার চলো। আমিও উধারের রাস্তা নিলাম। একবার গিয়ে ড্রয়িং দেখতে চাইলো। “আরে ইয়ার, ম্যায় নে আর্কিটেকচার মে ডিগ্রি কিয়া, ইয়ে মত সমঝো ম্যায় অনপড় হু।” যারা ডিউটিতে আছে, আমাদের দুজনের সাইট ড্রেস আর সুন্দরীর কথা শুনে ভাবছে সাইট ইন্সপেকশন চলছে।
উধারের রাস্তায় চলার পথে যত রাজ্যের লাগামহীন বিষয়ের আলোচনা আর ছোটখাটো হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়েই দুপুর থেকে বিকাল হয়ে গেলো। অধিকাংশই আমাদের চালু ভাষায় “ভাট” বকা। ইতিমধ্যে আমি একবার ঝোঁকের বশে বলে ফেলেছিলাম যে কলেজে আমার জ্যোতিষচর্চায় উৎসাহ ছিলো। আর যাই কোথায়? সে নিজের হাতখানা বাড়িয়ে দিলো, ওর হাত গুনে বলতে হবে। আমি যতই বলি যে আমি এই বিষয়ে সামান্য কিছু বই পড়েছি মাত্র, সেরকম জ্ঞান কিছুই নেই, কিন্তু সে শুনবে না। ওর চাপে ওর ফর্সা নরম হাতটা আমার হাতের মুঠোয় নিতেই হলো। মিনিট কয়েক ওর কোমল হাতটি আমার হাতেই ছিলো। জ্যোতিষচর্চা তখন আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আটভাট কিছু বলে নিস্তার পেলাম।
আর বলেছিলাম, আমি খানিকটা রান্না জানি। সে আমাকে ছাড়বেই না। শুনেছে বাঙালী লুচি আলুর দম নাকি স্পেশাল, সেটা শেখাতেই হবে। আচ্ছা, হো যায়েগা বলে সেযাত্রায় ছাড়া পেলাম।
সুন্দরী জানে বাঙালী মেয়েরা উৎসবে পার্বণে মাথার খোঁপায় সাদা ফুলের মালা পড়ে। সে দেখেছে যে সেদিন আমাদের পুজায় সাদা ফুলের মালা এসেছে। আমার কাছে সেরকমই একটা চেয়ে বসলো, “ওসীম, প্লিজ, মেরে লিয়ে এক লে আও না” । আমি তো অনুরোধ শুনেই ধন্য হয়ে গেলাম, কিন্তু সাদা ফুলের মালা আমি পাই কোথায়? অন্যদিকে, এই অনুরোধটাই বা ফেরাই কি করে? যা হবার হবে, মন্ডপে গিয়ে দেখি পুজোর থালায় কয়েকটা ছোট্ট সাদা ফুলের মালা পড়ে আছে। সম্ভবত স্থানীয় মহিলারা পুজোর জন্য এনেছিলো। তার থেকে বেছে দু’টো এনে দিতেই, Osim, Oh my God, such a beautiful garland, for me? You are so nice, Osim. So nice. আমি তো ধন্য আমি ধন্য হে হয়ে গেলাম।
আমরা দু’জনেই ইংরেজি আর হিন্দী মিশিয়ে কথা বলছি। আমার হিন্দী একদমই আসে না, বুঝতে পারি, বলতে পারি না। অথচ সুন্দরী অনর্গল হিন্দী বলে যাচ্ছে। আমার হিন্দী ও যাহোক করে বুঝে নিচ্ছে। বলেছিলাম দুপুরমে খিচুড়ির সাথ বাঁধাকপি কা শুকনো ডালনা হোগা। বেচারা “বাঁধাকপি কা শুকনো ডালনা” কিছুই বুঝলো না। আমি বললাম, আইয়ে মেরে সাথ। যেখানে দুপুরের ভোগের রান্না হচ্ছে, সেখানে নিয়ে গিয়ে দেখালাম কি রান্না হচ্ছে। আমাদের রান্নার ঠাকুর তো প্রবল উৎসাহ নিয়ে সুন্দরীকে বোঝাতে শুরু করলো, আর আমার সমস্যা হয়ে গেলো রান্নার ঠাকুরের সিকিমিজ ভাষা আমাকে প্রথমে বুঝে নিয়ে সেটা তারপর সুন্দরীর জন্য হিন্দীতে বা ইংরেজিতে বোঝাতে হবে। সুন্দরী আমার হিন্দী শুনে বলে, ওসীম, তুম যব হিন্দী বলোগে, সাথ মে এক interpreter ভী রাখ দেনা। যদিও সুন্দরী আমাকে “আপনি” থেকে “তুমি”তে নামিয়ে এনেছে, আমি কিন্তু তখনও ‘আপনি” চালিয়ে যাচ্ছি। সুন্দরী হাল্কা চিমটি কেটে আমাকে বলেই দিলো “ওসীম, তুম ক্যায়া ইয়ার? কব সে তুম আপ আপ চালা রহে হো? বোলা না মেরা নাম মেঘা? ভুল গয়ে? আউর তুম বারবার ক্যায়া ম্যাডাম ম্যাডাম বোল রহে হো। Come on Osim, be OK with me.” কথাটা শুনে যতটাই না ভালো লাগলো, মনে মনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম, ততটাই অপ্রস্তুত। আর সত্যি বলতে, সেই মধুর চিমটিও ভোলার নয়। বলার জন্যই বললাম কিউ চিমটি কাটতে হো? সে তো চিমটি মানেই বুঝতে পারে না। চিমটি ক্যায়া হ্যায়? উত্তরে আমিও ওঁর হাতে একটা চিমটি কেটে বললাম, ইয়ে হামারা বঙ্গালী কা চিমটি হ্যায়।
বিকেলের চায়ের সময়েও দেখি ডক্টর প্যাটেল তখনও নিজের ইয়ার বন্ধুদের সাথে মশগুল। আমাদের দুজনের কানেই খবর এসে গেছে যে প্যাটেল তাঁর ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে কলচি নামের স্থানীয় মদসেবন করছে। এই কলচি সেখানের লোকাল ব্র্যান্ড, গাঁয়ের লোকেরা ঘরেই বানায়, আর পালাপার্বনে সেবন করে।
চা-পর্ব শেষ হতেই সুন্দরী প্রস্তাব দিলো আমাদের সাইটের পাশেই নদীর দিক থেকে ঘুরে আসি। আমি তো একবাক্যে রাজী। তবে ইচ্ছে না থাকলেও প্যাটেলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলাম। সুন্দরী হেসেই উড়িয়ে দিলো। “ওসীম, তুম ক্যায়া সোচতে হো? ও তুমহারা প্যাটেল আভি দারু ছোড়কে হামারে সাথ নদী কে কিনারে টহল মারে? Come on Osim, leave him with his daru.”
তখন সন্ধ্যা হবে, তার ঠিক আগের সময়টাতে। আঁধার নেমে আসছে। আমরা দুজনে নদীর দিকে পাশাপাশি হেঁটে চলেছি। হিন্দী ইংরেজি মেশানো কথাবার্তা চলছে। আমি হিন্দী বলতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছি, আর সেটা বুঝতে গিয়ে তিনিও হোঁচট খাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সুন্দরী গায়ের সোয়েটার খুলে ফেলেছে। এখন সর্বাঙ্গে সকালের সেই বেগুনি শাড়ি, আর সজ্জা বলতে চুলে দু’টো সাদা ফুলের মালা জোড়া দিয়ে একটা সুন্দর খোঁপা। সেই মালা যা আমি সকালে জোগাড় করে দিয়েছি। চারিদিকে ঘন গাছপালা। সন্ধ্যায় পাখীরা বাসায় ফিরে আসছে। কানে শুধুই কিচির মিচির শব্দ। একসময় সুন্দরী রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলো। সামনের গাছের দিকে আঙ্গুল তুলে একটা পাখীর নাম জিজ্ঞেস করলো। আমার খেয়াল নেই, নিজের অজান্তেই আমি ওঁর কাধে হাত রেখে দিয়েছি। কিন্তু সুন্দরীর কোনো জড়তা নেই। সুন্দরীর প্রশ্ন শুনেছি, কিন্তু আমি তো গাছ ছাড়া কোন পাখীই দেখতে পাচ্ছি না। নাম কি বলবো? কি মনে এলো, কিছু না দেখেই বলে দিলাম, সায়দ ইস পঞ্ছিকে নাম মেঘা হোগা। বলে একটু হেসে দিলাম। সুন্দরী শুনলো। আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তরও দিলো, চলো, ইস বাহানামে তুম মেরা মেঘা নাম তো লে লিয়া।
নদীর পাড়ে একটা পাথরের ওপর গিয়ে একদম পাশাপাশি আমরা বসলাম। তখনো কিছুটা আলো আছে। আকাশের নীল রঙ একটু একটু করে আঁধারে মিলিয়ে আসছে। একফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। সামনেই নদীর হাল্কা স্রোতের আওয়াজ। সেই আঁধারের মাঝাই ছুটে গিয়ে সে পাহাড়ি নদীর বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট নুড়ি কুড়োতে লাগলো। আমি ভাবছি আমাদের রুপকথার পরী আকাশ থেকে যেন মাটিতে নেমে নদীর তীরে ছুটে বেড়াচ্ছে, পাথরের নুড়ি নিয়ে খেলা করছে।
সুন্দরী এখন আবার আমার একদম পাশে। ওর শরীরের মিস্টি পারফিউমের গন্ধটাও আমি অনুভব করতে পারছি। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছি, প্রায় মিনিট পাঁচেক হবে। সুন্দরী একবার আমার দিকে ফিরে বললো, ওসীম, ক্যায়া সাচ উসি পঞ্ছি কা নাম মেঘা হ্যায়? আমি আর কি বলি! সত্যি কথাটা বলতেই হলো। শুনো মেঘা। হামনে তো উস পঞ্ছিকো দেখাই নেহি যো তুমনে দিখানেকা চেষ্টা কিয়া। ম্যায়নে তো স্রিফ তুমহারা নাম সোচকে বোল দিয়া উস পঞ্ছি কা নাম মেঘা হ্যায়। সুন্দরী আবার আমার দিকে কপট ক্রোধে তাকিয়ে আমার হাতে একটা চিমটি কেটে দিলো। আর প্রশ্ন করলো, ইয়ে তুমনে বোলা চেস্টা কিয়া। ইয়ে চেস্টা কেয়া চিজ হ্যায়?
– ইয়ে চেষ্টা মানে, তুম হামকো পঞ্ছি দিখানেকা try কিয়া।
– বাপরে, ইয়ে হিন্দী তুম কাহাঁ শিখা? তুমহারা বংগালী চেস্টা হিন্দীমে কৌশিশ হোগা।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, মেঘা। ইস নামকা এক হিন্দী ফিল্ম দেখা। সঞ্জীবকুমার।
– সঞ্জীব নেহি, সঞ্জীভ। ভ ভ। ভ বোলো।
এমন সময় হটাৎই সুন্দরী বলে, “ওসীম, ম্যায়নে টেগোর সং কভি শুনা নেহি। মেরেকো এক দো টেগোর সং শিখাও না, প্লিজ। আমি তো থ। আমি গান শেখাবো?
– মেঘা, আগর হাম গানা গায়েগা, তো ইয়ে চারিদিককা সব পঞ্ছি কা ঘুম টুট জায়েগা?
– কেয়া টুট জায়েগা?
– ঘুম, ঘুম টুট জায়েগা। ঘুম মতলব sleeping, at night.
একদম খিলখিল করে ও হেসে উঠলো। তুমনে ক্যা বোলা, ঘুম? আরে ইয়ার বোলো নিঁদ টুট যায়েগা। ওসীম, তুম really so funny. And your Hindi, উফ বাপরে।
রাত প্রায় সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আমরা ওখানে ছিলাম। অর্থাৎ প্রায় দেড় ঘন্টা। প্যান্ডেলে ফিরে দেখি তখনো কিছু লোকজন আছে, তবে অধিকাংশই এবার তাঁদের নিজের নিজের বাড়ি ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত। দেখলাম প্যাটেল দুপুরে যেখানে ছিলো, বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে ওখানেই একইভাবে জমাটি আড্ডায় বসে আছে। ধীরে ধীরে সবাই প্রায় চলে গেলো। রয়ে গেলাম শুধুমাত্র আমাদের ঘনিষ্ট কয়েকজন বাঙালী, অফিসের কয়েকজন। প্যাটেল আর সুন্দরীও থেকে গেলো। সব মিলিয়ে জনা কুড়ি।
আমাদের অফিসের সবার অনুরোধে প্যান্ডেলেই রাতের খাবার ব্যবস্থা হলো। আবার একটু গপ্পো, সঙ্গে চা আর কিছু ভাজাভুজি। আর আমাদের বাঙালী সিনহা’দার গানে এই পরিবেশ আরও আনন্দমুখর হলো। সুন্দরীও একটা গান গাইলো, নিজের গুজরাটি ভাষায়। সবাই মিলে সুন্দর একটা সন্ধ্যা উপভোগ করলাম।
বাড়ি ফিরে ঘুম আসতে চায় না। সারাটা দিন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে। আবার কি সুন্দরীর সাথে দেখা হবে? এবার দেখা হলে কি কথা বলবো তাই নিয়েই ভাবতে থাকলাম। রাত বারোটা বেজে গেছে। তবু ঘুম আসে না। বারান্দায় গিয়ে একবার বসলাম। নদীর পাড়ের সেই দেড় ঘন্টার কথাগুলো মনে পড়তে লাগলো। ওর হাসি মেশানো অভিযোগ, ওসীম, তুম ক্যায়া ইয়ার? আর বলছে, মেরা নাম মেঘা হ্যায়, মেঘা।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেলো। প্যান্ডেলে গেলাম। উদ্যোক্তারা, অধিকাংশই অফিসের, সবাই এসে গেছে। দধিকর্মা আর ভাসানের ব্যাবস্থা করতে হবে। আমার চোখ বিশেষ একজনকে খুঁজছে, কিন্তু সেই নেই। খবর পেলাম, প্যাটেল অফিসের জিপ নিয়ে ছুটে গেছে শিলিগুড়িতে। কারণ ওর বৌ খুব ভোরের বাস ধরে শিলিগুড়ি চলে গেছে আজই কোন ট্রেন ধরে পুনে বা কলকাতায় ফিরে যাবার জন্য। ওর পাশের কোয়ার্টারের বিহারি ভদ্রলোক ডক্টর ওঝা, যিনি আমাদের পুজোর অন্যতম সক্রিয় উদ্যোক্তা, জানালেন যে কালকে প্যান্ডেল থেকে কোয়ার্টারে ফিরে যাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত দুজনের ঝগড়া শুনেছেন। হয়তো তারই ফল স্বরূপ আজ ভোরে সুন্দরী গৃহত্যাগ করেছেন।
দুপুরের দিকে প্যাটেল একাই ফিরে এলো। অনেক চেষ্টা করেও বৌকে শিলিগুড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে নি। সন্ধ্যাবেলায় আমার কাছে এসে স্বীকার করলো যে গতকাল রাতে বাড়ি ফিরে মদের নেশায় সুন্দরীকে অনেক আজেবাজে কথা বলেছে। এখন তাঁর শত অনুতাপেও সুন্দরীকে ফেরাতে পারলো না। আমাকে সুন্দরীর ফোন নম্বর দিয়ে অনুরোধ করলো আমি যদি একবার ওঁকে বুঝিয়ে বলি। প্যাটেলের বিশ্বাস যে সুন্দরী আমার কথা শুনবে। বললাম, এখন নয়। দু’দিন পরে অভিমান কমলে তখন বুঝিয়ে বলবো।
আমার নিজেকেও কিছুটা অপরাধী মনে হলো, যদিও আমার মনে কোনরকম কুচিন্তাই ছিলো না। আমি ভেবে দেখলাম, যদি আমার একটা ফোনে দু’জনের জীবনে শান্তি ফিরে আসে, আমি নিশ্চয়ই চেস্টা করবো। তখন আমাদের সাইটে একটা হটলাইন ফোন ছিলো, আমারই তত্ত্বাবধানে। প্রয়োজনে আমরা সাইটের লোকজন হেডঅফিস, ঠিকাদার বা কখনো সখনো বাড়িতেও ফোন করতাম।
প্যাটেলের থেকে নম্বর নিয়ে দু’দিন পরে ফোন করলাম। সুন্দরীই ফোন ধরলো। আমি গলা শুনেই বুঝলাম, সেই ফোন ধরেছে। একদম পরিস্কার বাংলায় বললাম, মেঘা, আমি তোমার বন্ধু ওসীম বলছি।
– আরে, আরে, ওসীম, ক্যায়সে হো?
– নেহি, ঠিক নেহি হ্যায়। তুম হঠাত কিউ চলা গয়া?
– হথাট? ইয়ে হথাট ক্যায়া? আচানক?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, without notice. That’s bad. আর প্যাটেল এতনা দুখী হো গয়া। ইয়ে তুম অচ্ছা নেহি কিয়া মেঘা। তুমকো ফেরত, মতলব return আনা চাহিয়ে।
সুন্দরী একটু চুপ করে রইলো। ওসীম, he was drunk, and we had a bad argument. লেকিন তুমনে আজ ফোন কিয়ে, প্যাটেল কিউ নেহি কিয়া?
– মেঘা, প্যাটেল মেরেকো রিকুএস্ট কিয়া। that’s why I am talking.
সুন্দরী আবার চুপ। বললাম, ক্যায়া মেঘা, কুছ তো বোলো।
ফোনে বুঝতে পারছি, সুন্দরী কাঁদছে। Osim, I would like to return, please forgive me, and help me to meet him again.
– Don’t cry Megha, let me try.
একটু থেমে বললাম, লেকিন এক কন্ডিশন হ্যায়। অব তুম আকে কম সে কম one month রহোগে।
– সিওর ওসীম, I would. মেরেকো তুমহারা গাঁও বহুত অচ্ছা লগা।
প্যাটেলকে সব বললাম, সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে দিয়ে ফোন করালাম। আমি ফোনের থেকে দূরে চলে গেলাম। ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলুক। প্যাটেল অনেকক্ষণ কথা বলেছিলো। প্রায় আধ ঘন্টা। আমি সামনে ছিলাম না, তাই কি কথা হয়েছে জানি না। ফোনের পর প্যাটেল দেখলাম কাঁদছে। বললো, মেঘা আসতে রাজি হয়েছে, তবে আমাকে পুণে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমি বললাম, আভি মেরা জীপ লো, and rush for Siliguri, then Pune, immediately. Don’t bother for you leave, just rush.
ঠিক ছ’দিনের মাথায় দুজনে ফিরে এলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ওদের বাড়িতে আমার তলব পরলো। তখন অফিস টাইম, তবুও আমি গেলাম। গিয়ে শুধু বললাম, now it’s your own time, your private time. Please don’t invite me or any third person now, প্যাটেল বললো, সাহা (আমাকে এই নামেই ডাকতো), প্লিজ আজ ইভনিং টি প্লাস ডিনার কে লিয়া আ যাও।
সন্ধ্যাবেলা গেলাম। খুব সুন্দর অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম। অনেকদিন পরে আবার সুন্দরীর সেই হাসি দেখলাম। প্যাটেল নিজেই বললো, Saha, I know Megha for last 9 years, from her school days. I don’t know উস রাতমে মেরেকো ক্যায়া হো গয়া, I was just a mad that night.
সুন্দরী জানালো, প্যাটেল প্রমিস কিয়া, জিন্দেগী মে আউর কভি দারু নেহি পিয়েগা।
রাতে খেয়ে বাড়ি ফিরবার সময় একটা সুন্দর উপহার পেলাম। একটা মূর্তি, মাঝখানে একটি মেয়ে, দু’পাশে দুটি ছেলে। ক্যাপশন দেওয়া, ফ্রেন্ডশিপ।
এরপর সুন্দরী সাইটে একমাস ছিলো। নিজের কন্সালটেন্সির কাজ আটকে আছে, তাই আর থাকতে পারলো না। মাঝে মাঝে রবিবার আমি জিপ নিয়ে শিলিগুড়ি যেতাম, টুকটাক কেনাকাটার জন্য, আর সাইটের দিনের পর দিন একঘেয়েমি থেকে দূরে একটু ঘুরে আসাও হয়ে যেতো। প্যাটেল আমাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলো যে মেঘাও যেতে চায়, শপিং করবে। সেইমতন প্যাটেলকে খবর দিতাম। একদিন প্যাটেল গ্রামের ইন্সপেকশনে যাবে। সে গেলো না। আমরা সাইটের চার-পাঁচজন গেলাম, সুন্দরীও দলে ছিলো। সুন্দরী টুকটাক কেনাকাটা করলো, আমি সারাক্ষণ তাঁর ছায়াসঙ্গী। ইংরেজি আর দুর্বোধ্য হিন্দী মিশিয়ে কথাবার্তা চলছে। একসময় বললো, সোয়েটার কিনতে হবে। আমিও বললাম, ইধার অচ্ছা ভুটানী সোয়েটার মিলেগা। সোয়েটারের দোকানে গিয়ে ডীপ হলুদ লাল রঙের খুব সুন্দর একটা সোয়েটার কিনলো। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করলো, ইয়ে প্যাটেলকা পসন্দ হোগা? আমি মজা করে বললাম, তুম প্যারসে জিসকো gift করোগে, ওহ ধন্য হো জায়েগা।
– ক্যা হো জায়েগা?
– ধন্য হো জায়েগা। মানে difficult to explain মেঘা, মতলব বহুত খুশ হোগা।
আরও কিছু কেনাকাটা করে, আমরা সবাই জীপে করে সাইটে ফিরে এলাম। জিপ থেকে যেই নেমেছি, সুন্দরী আমাকে সোয়েটারের প্যাকটটা দিয়ে বললো, ইয়ে তুমহারে লিয়ে। আমি তো অবাক! কিছুতেই রাজি নই। সুন্দরী বললো, ওসীম, listen. প্যাটেল খুদ নে বোলা তুমহারে লিয়ে এক সোয়েটার খরিদ নে কে লিয়ে। So, it’s our joint gift, আউর তুমকো লেনে হি পড়েগা।
মেঘা (এতক্ষন সুন্দরী বলেছি) যেদিন চলে গেলো, আমারও চোখে জল প্রায় এসে গিয়েছিলো। সাইটের ঐ সরস্বতী পূজার দিনে সে আমার জীবনে এক তুফান তুলে দিয়েছিলো। আমার ক্ষুদ্র জীবনে এটি একটা অকল্পনীয় ঘটনা। সেই সরস্বতী পূজার দিনটা আজও ভুলতে পারছি না। ওসীম, তুম ক্যায়া ইয়ার? মেরা নাম মেঘা হ্যায়, মেঘা।
Add comment