সাহিত্যিকা

পালতে (অমিত পালিত, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল) স্মরণে

পালতে (অমিত পালিত, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল) স্মরণে
সোহম দাশগুপ্ত (১৯৭৭ মেকানিক্যাল),
হিমাংশু নাথ (১৯৭৭ ইলেকিট্রিক্যাল)

বন্ধু অমিতের জীবনে এমন আকস্মিক যবনিকা পতন সহপাঠিদের কাছে এতোটাই মর্মান্তিক যে কয়েকটা দিন প্রসঙ্গটাকেই এড়িয়ে চলছিলাম। মন না চাইলেও ধীরে ধীরে জীবনের এই অমোঘ শর্তটাকে একসময়ে মেনে নিতেই হয়। ধাতস্ত হতে হতে নানা কথার মধ্যে মনে পড়ল, অমিত, মানে আমাদের পালতে আন্তরিক ভাবে একজন কবিতা প্রেমীও ছিল। কবিতা পড়তে ভালবাসতো শুধু নয়, মাঝে মধ্যে সুন্দর কবিতা লিখে আমাদের চমকও লাগিয়ে দিত! ওর অধিকাংশ কবিতার মূল ভাবনাই ছিল গভীর জীবন বোধ। তাই আজ অমিতের স্মৃতিতে লর্ড টেনিসনের একটা কবিতার অনুবাদ উৎসর্গ করলাম। এই মুহুর্তে নিজের মনের কথাটা জানাতে পারলে অমিত হয়তো টেনিসনেরই প্রতিধ্বণি করত!

সকল সীমানা শেষে

অস্তে চলেছে রবি, ফুটেছে সাঁঝের তারা,
স্পষ্ট শুনেছি আমি- এসেছে সে আহ্বান;
আজই ভাসাবো তরী কেটে সব দড়িদড়া,
গা’সনেরে তীরে বসে বিদায় বেলার গান।

তন্দ্রা মগ্ন যেন নীরব জলোচ্ছ্বাস,
চলেছে উতল বেগে বিপুল অমোঘ টানে।
অতল পাতাল হতে, বুকে ভরে নিঃশ্বাস,
তীর ছুঁয়ে যায় ফিরে, আপনার গেহ পানে।

প্রদোষের ক্ষীণ আলো, সন্ধ্যা আরতি-ধ্বণি,
মিলাবে ক্ষণিক পরে, গভীর অন্ধকারে!
তরী দেব যবে খুলে, বিদায়ের বাঁশীখানি
বাজাসনে আজ তোরা বিষাদ ব্যাকুল সুরে।

দেশ, কাল, চরাচর, পিছে ফেলে দেবো পাড়ি,
তরঙ্গ পরে ভেসে অনন্ত উদ্দেশে,
একটাই শুধু আশা, আমার সে কান্ডারী,
সমুখে দাঁড়াবে এসে, সকল সীমানা শেষে।

পালতে আমাদের অনেকের মতোই খুব পড়াশুনো করা ছাত্র ছিলো না। কিন্তু অনেক ব্যাপারেই উৎসাহটা বেশিই ছিলো। অতো লম্বা চেহারার মধ্যে একটা হাসিখুশি ছটফটে স্কুলের ছেলে লুকিয়ে থাকতো। সেটা পরিনত বয়সেও। বিতর্কিত ‘মোবাইল অদৃশ্য রহস্য’ তেও দেখা গেছে।

আমার সঙ্গে হোস্টেলে থাকতে একটু আলাদা যোগাযোগ হোতো কুইজ প্রতিযোগিতা নিয়ে। তখন Bournvita quiz contest বলে একটা জনপ্রিয় রেডিও প্রোগ্রাম হতো রবিবার দুপুরে। আমরা দুজনেই শুনতাম। একজন না শুনলে প্রশ্নগুলো অন্যকে বলতাম। অন্য দেশের রাজধানী, কারেন্সি এসব আলোচনাও হতো। দুজনেরই খুব ঘুরে বেরানোর শখ ইচ্ছে ছিলো। তখন অবশ্য ‘দি-পু-দা’ বেশ বড়ো সীমানা।

হোস্টেলের শীতের বিকেলে ভলি খেলায় অদম্য উৎসাহ। যতটা না খেলার পারদর্শিতা, বেশি উৎসাহ ছিলো কোন বল লাইনের ভিতরে না বাইরে, এই ব্যাপারে অক্লান্ত তর্কে! (এক পয়েন্টের জন্য একটা কিডনি সহজেই দিতে রাজি থাকতো!)।

আমরা যখন 3rd year এ, পালতের দাদা (তখন সদ্য MBBS পাশ করেছেন) ম্যানিলা গেছিলেন একটা প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য। দাদা ফিরে আসার পরে পালতে শনিবার সাপ্তাহিক বাড়ি গিয়ে রবিবার রাতে ফিরে আসার সময় একটা বিদেশী সাবান নিয়ে ফিরলো। পরের দিন হোস্টেলে যা হয়, পুরো ২৮ জনের গণ স্নান (৮ নং পুরো ব্যাচ) ওই সাবান মেখেই হলো। বেশ উত্তেজনা সবারই – জীবনে প্রথম বিদেশী সাবান মাখা বলে কথা! সে যাহোক দু’একজন একটু কিন্তু কিন্তু করে বললো সাবানের বিশেষ ফেনা হয় নি, এছাড়া গন্ধটাও যেন কেমন কেমন – পছন্দের নয়! এই বিরুদ্ধ লবি বিশেষ পাত্তা পেলো না। সবজান্তারা বললো সাহেবদের সাবান এরকমই হয়। সাবান সেদিনই গণ স্নানের ঠ্যালায় শেষ।

এরপরের শনিবার পালতের সাপ্তাহিক বাড়ি যাওয়া ও রবিবার রাতে ফেরা। দেখলাম একটু গম্ভীর। কি ব্যাপার ? চাপাচাপিতে বললো – একটু ইয়ে হয়ে গেছে। সাবানটা Dog soap. পালতে বুঝতে পারে নি। সম্ভবতঃ বাড়ির কুকুরের জন্য দাদা এনেছিলেন, পালতের হাত সাফাই তে হোস্টেলে !!

পালতের বাবা ছিলেন কেনিসন জুট মিলের চিফ মেডিক্যাল অফিসার। সমাজে বেশ পরিচিতি ও সম্মান ছিলো। কিন্তু একদিনের জন্যও সেই নিয়ে কোনো বাগাড়ম্বর শুনিনি। এক পুজোর সময়ে পালতের মামা এসেছিলেন ওদের ব্যারাকপুরের বাড়িতে। বাড়িতে হুলুস্থুল। পালতে এবং তার দাদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পালতের মা এর কান্নাকাটি, সারা বাড়ি বিচলিত। মামা শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পরেই দু’ভাইকে নিয়ে হাজির। কোথায় ছিলো? সেটা মামার অভ্রান্ত অনুসন্ধানে প্রকাশিত হোলো। পাশের পাড়াতে কাঙালি ভোজনে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলো। দুই ভাই পাশাপাশি সতরঞ্চিতে বসে খিচুড়ি খাচ্ছিলো।

২০১৮ তে একসঙ্গে আসামের কয়েকটা জঙ্গল ঘুরেছিলাম। মধুমিতার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হোলো। দেখলাম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক মিল। দুজনেরই ঢক্কানিনাদ একদমই না-পসন্দ!

আমরা জানি পালতের প্রফেশনাল কৃতিত্ব ও সাফল্য। এছাড়াও কতটা লোকের সঙ্গে মিশতে পারে যেটা দুর্গাপূজা উদ্যোক্তা, আবাসনের আইনি ব্যাপার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া এরকম আরো কিছু ওকে সবার প্রিয় করে তুলেছিলো। পালতের চলে যাবার পরে অনেকে ওর সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু লেখা, কবিতায় শেষ বিদায়ের একটা ইঙ্গিত কারো কারো চোখে পড়েছে। খুবই স্পর্শকাতর ব্যাপার, কিছু মন্তব্য করা ঠিক হবে না আমার থেকে। তবে যেটুকু দেখেছি পরিনত বয়সে, সেরকম কিছুই দেখি নি। সেই ছটফটে কিশোরই আমার চোখে আসতো। যাকে বলে Full of life. কোনই আক্ষেপ নেই – জীবন নিয়ে। অবশ্যই চলে যাবার তাড়াহুড়ো কিছুই ছিলো না – বরং ওর অতি সুখের সংসারের তাপ ওকে উষ্ণ, প্রাণবন্ত রাখতো।

গত বছর আমার উৎসাহে জাপান অলিম্পিক দেখা এক কথায় রাজি। পরে কোভিডের জন্য বাতিল। এই বছরই মার্চ- এপ্রিলে ফোন -‘হিমু, কাতার যাবি?’ আমার নিরুৎসাহে ওরও হয়তো উৎসাহে ভাঁটা পরলো। তখন ঠিক হোলো সুস্থ থাকলে ২০২৬ WC দেখবো একসঙ্গে। ওর দাদা থাকেন, এই সব আলোচনা।

এরকম অফুরন্ত স্মৃতি, অফুরন্ত হয়েই থেকে যাবে।
পালতে, কোথায় যেনো পড়েছিলাম – তীব্রভাবে কিছু চাইলে সেটা পাওয়া যায়।
হয়তো একসঙ্গেই খেলা দেখবো ২০২৬ এ – টিকিট ও লাগবে না।

Sahityika Admin

Add comment