জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ
রমু বড়াল, ১৯৭৬ আর্কিটেকচার ও প্ল্যানিং
আজ শুক্রবার, ২০২২ সালের আগস্ট মাসের ২৬ তারিখ, বিকাল পাঁচটা। নাসার তৈরি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সম্বন্ধে পড়াশোনা করছিলাম। খেয়াল ছিলো না, আবিস্কার করলাম যে আমি আমার মহাকাশযানে ঘুরতে ঘুরতে এসে গেছি মহাকাশের কৃষ্ণগহ্বরের কাছে।
হঠাৎই এক প্রবল আকর্ষণে আমার মহাকাশযান প্রচন্ড গতিতে ঢুকে পড়লো কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে। স্কুলে নিউটনের ল’জ অফ মোশন পড়েছিলাম। মনে হলো সেই কারনেই হবে। তখনই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ তার সবকটি আয়না মেলে ধরলো। আর চারপাশের নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে তরঙ্গায়িত ওঁম কার ধ্বনি ভেসে ভেসে এলো। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো কয়েক শত কোটি আলোকবর্ষ দূরের অচেনা অজানা গ্রহের পানে। মানে জিপিএস দেখে সেরকমই মনে হলো। ঠিক তখনই রেডিওতে বহু যুগের ওপার থেকে যেন একটা ক্ষীণ বেতার তরঙ্গ ভেসে এলো। যেন বলতে চাইলো “সুস্বাগতম, তোমায়, হে পৃথিবীর মানুষ”।
সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল। মনটাও আনন্দে ভরে গেল। নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম, “এ কোথায় এসে পৌঁছলাম রে বাবা?” এদিকে আমার যান প্রচন্ড বেগে ছুটে কৃষ্ণগহ্বরের গহ্বর থেকে বেড়িয়ে মহাশূণ্যে এসে পড়লো। টেলিস্কোপের আয়নাতে শত কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রপুন্জ তাদের বিচ্ছুরিত আলোকরাশি সহ প্রতিভাত হল। দেখি, নানান বর্ণের আলোকচ্ছটায় চারিদিক যেন বর্ণময় হয়ে উঠেছে। মহাজাগতিক এই অপূর্ব দৃশ্যে আমি বাক্যহারা হয়ে গেলাম। এরকম অপূর্ব দৃশ্য আমি এর আগে কখনোই দেখিনি।
এবার অনেক দূর থেকে একটা ক্ষীণ তরঙ্গ ভেসে এলো। আমার সুপার কম্পিউটার সেটাকে বেতার তরঙ্গে অনুবাদ করে জানালো যে আমরা পৃথিবীর মতোই একটা গ্রহের কাছাকাছি এসে পড়েছি। যদিও কিছুই বুঝতে পারছি না, কি হচ্ছে, কোথায় এসে পড়েছি, বা কোথায় যাচ্ছি, তবুও অদম্য একটা ইচ্ছা জাগলো সেই গ্রহটাকে একটিবার অন্তত চাক্ষুষ করি। কারণ পৃথিবীতে ফিরে লোকজনকে আমার মহাকাশ পাড়ির অভিজ্ঞতার কথা বলতে তো হবে!! এতো আর আমাদের পৃথিবীর এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে বেড়াতে যাওয়ার মতো ব্যাপার নয়। এ হলো রীতিমতো মহাশূন্যের মহাকাশে, অন্য সৌরজগতে,পৃথিবী থেকে কয়েক শত আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহের হাতছানি।
আকাশযানের জানলার মধ্যে দিয়েই নীল সমুদ্রের মতন দেখতে একটা গ্রহ রেডিওতে আবার একটা গ্যাস তরঙ্গ পাঠালো। আমার ট্রান্সলেটর সুপার কম্পিউটার মেসেজ ডিকোড করে জানালো যে ওই গ্রহ আমাকে সেখানে যেতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ওয়েব টেলিস্কোপের আয়নাতে দেখতে পেলাম এক নীলাভ আলো এই গ্রহকে মায়াবী করে তুলেছে। স্কুলের এটলাসে পৃথিবীর ছবি দেখেছি। মনে হলো এই নতুন গ্রহ যেন আমাদের পৃথিবীর যমজ ভাই। মহাজাগতিক এই রহস্য আমাকে উৎসুক করে তুললো এই অচেনা অজানা গ্রহে নামার জন্য।
আবার তরঙ্গ ভেসে এল, আমার মনের ভাষা সে যেন পড়ে ফেলেছে। রেডিও মেসেজ দিয়ে জানাচ্ছে, আমরা তোমাদের চেয়ে কয়েকশত কোটি বছর এগিয়ে আছি। আমাদের দেখলে তোমরা তোমাদের নিজেদেরই ভবিষ্যৎ দেখতে পাবে। তোমাদের পৃথিবীর ভাষায় আমার নাম ‘এইচ আর আই পি 65426বি’ গ্রহ। কিন্ত আমাদের নিজেদের গ্রহের ভাষায় আমি হলাম “বিশ্বরূপ দর্শন”। যার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্রম্মান্ড দর্শন করা যায়। আমাদের এই সৌরজগতে অগুনতি নক্ষত্র আছে, আছে আরও কিছু গ্রহ। তোমাদের মতো আমাদের সৌরজগতেও আছেন দুজন সৌররক্ষক অর্থাৎ সূর্যদেব। যিনি এই সৌরমন্ডল কে বাঁচিয়ে রেখেছেন। একজন দীর্ঘ দিন ধরে জ্বলে এখন খানিক স্তিমিত। কিছুদিন পরেই সে “বেতার লোবের” মতো ফসিল হয়ে যাবে। তাঁর থেকেই জন্ম নিয়েছে দ্বিতীয় রবি। আমাদের এখানে তাঁর নাম “প্রজ্জ্বলিত কিরণ”। সে আছে এখান থেকে বহু যোজন দূরে, কিন্ত অসম্ভব তাঁর তেজ। সে হলো বিভিন্ন গ্যাসের জ্বলন্ত একটা পিন্ড। এই সৌরমন্ডলের চারিদিক দুরন্ত গতিতে সে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এই গ্যাসের প্রচন্ড চাপে সৃষ্টি হল তরঙ্গ। আর মহাজাগতিক চৌম্বক ও বৈদ্যুতিক গতির ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বেতার তরঙ্গ। তার আলোয় নক্ষত্র পুঞ্জ, ও গ্রহও আলোকিত হয়ে উঠছে।
এতটাই সফর হয়ে গেলো, কিন্ত এখনও কোথাও কোন প্রাণের স্পন্দন পেলাম না। বুঝতেই পারছিলাম না এই গ্রহের অধিবাসীরা কেমন? বেতার তরঙ্গ তখন জানালো যে, তাঁরা পৃথিবীর প্রাণীদের আত্মার আত্মীয়। এটা শুনে আমার সারা শরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হলো, আমার পূর্বপুরুষদের এখানেই হয়তো দেখতে পাবো।
অবশেষে আমার আকাশযান নীলগ্রহের ভূমি স্পর্শ করলো। এ এক অদ্ভুত সৌরমন্ডল। গ্রহ ঘিরে কোনও বায়ু মন্ডল নেই। চারিদিকে কিছু অশারীরিক, কায়াহীন তরঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে। তারাই সব সংবাদ আদান প্রদান করছে। গ্রহে পদার্পণ করার আগে আবার একটা সাবধান বাণী ভেসে এলো, “আমাদের এই বায়ুমন্ডল তোমাদের পৃথিবীর মতো দূষিত নয়। এখানে তোমাদের ওখানের মতন কোন দূষণ নেই। তাই কোনভাবে এখানে দূষণ সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে না। আর কিছুদিনের মধ্যেই তোমাদের পৃথিবী তার দূষণের জন্য লুপ্ত হয়ে যাবে। মানুষ তাই এখন ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা হতে চাইছে। এখন থেকেই গবেষণা করছে মঙ্গল, বৃহস্পতি ইত্যাদি গ্রহে বসবাস করা যায় কি না। তোমাদের বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কার ক্রমশঃ মানুষকে যন্ত্রে পরিনত করে তুলছে। এভাবেই একদিন মানুষের আর মনুষ্যজীবন থাকবে না। ধীরে ধীরে সকলেই আত্মায় পরিনত হবে। সৃষ্টি হবে কিছু নতুন তরঙ্গ। মানুষ তখন তার দ্বারা চালিত হবে। এই মহাজাগতিক মহাশূন্যে বিচরণ করছে অসংখ্য ইলেকট্রন, প্রোটন ও আরো অনেক সূক্ষ সব কণা যাদের দুরন্ত গতি মহাজাগতিক চৌম্বকের ক্রিয়ায় সৃষ্টি করছে শক্তিশালী তরঙ্গ।“
ভাবতে লাগলাম প্রাণের সৃষ্টির রহস্য কি এর মাঝেই লুকিয়ে আছে? আজও এই গভীর রহস্যের সমাধান আমাদের বিজ্ঞানীরা খুঁজে পায় নি। এই ভাবনার মধ্যেই আবার একটা তরঙ্গ ভেসে এলো, “কি ভাবছো পৃথিবীর মানুষ? প্রাণের সৃষ্টির রহস্য কি?”
বেতার তরঙ্গ আরও বলে চলেছে, “মহাজাগতিক এই মহাশূন্যের মাঝেই আছে এর উত্তর। আর কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ তা প্রমাণ করবে। কিন্ত তার এই বৈজ্ঞানিক আবিস্কার নিয়ে আসবে চরম এক অভিশাপ। তোমরাই ধ্বংস করবে তোমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে। তার কারণ তোমাদের এই আবিস্কার যে সব রোবট কাজ করার জন্য সৃষ্টি হবে, তারাই তাঁদের সৃষ্টিকর্তাকে শেষ করে ফেলবে। যন্ত্র স্থান নেবে মূল চালকের ভূমিকায়। এই রোবটই সব কিছু চালনা করবে। তার নিজের প্রয়োজন মতো সে প্রাণের সৃষ্টি করবে। আত্মাকে তরঙ্গে পরিণত করবে, ছড়িয়ে দেবে এক সৌরজগত থেকে আরেক সৌরমন্ডলে। মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব আছে কি না, বা তরঙ্গে পরিণত হয় কি না, বা তার পুনর্জন্ম হয় কি না, সে উত্তর ও ভবিষ্যতে জানিয়ে দেবে।”…..
হঠাৎই প্রচন্ড একটা ঝাঁকুনি আর মায়ের বকুনি শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। মাকে জিজ্ঞেস করলাম “আমি কি ব্ল্যাক হোল থেকে বেরিয়ে এসেছি”? .
একটা থাপ্পড় ও কানমলা খেয়ে বাস্তব জগতে ফিরলাম।
সন্ধ্যার অন্ধকার অনেকক্ষণ হয়েছে। তাই শাস্তি প্রাপ্য ই ছিল।
Add comment