জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক)
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি।। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।
১. কর্মক্ষেত্র
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনে যে বিশাল অকাল মৃত্যুর মিছিল দেখেছেন তা নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুজতবা আলী বলেছেন যে আমরা যারা অতি সাধারণ মানুষ তারা প্রিয়জন বিয়োগে কি ভাবেই না ভেঙে পড়ি। কিন্তু আমাদের থেকে সহস্রগুণ অনুভূতিপ্রবণ রবীন্দ্রনাথের কাছে সেই সব অকাল প্রয়াণ নিশ্চয় কি নিদারুণ আঘাত হানতো। কিন্তু তাঁকে কেউ সেই অর্থে ভেঙে পড়তে দেখেন নি। তিনি স্তব্ধ হয়ে যেতেন। নীরবে পায়চারি করতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। তাঁর রচনার মধ্যে ফুটে উঠতো তাঁর হৃদয়ের বেদনা।
তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সাজাদপুরে (এখন বাংলাদেশে)। সেখানকার খানসামা একদিন আসতে দেরি করেছিল। রবীন্দ্রনাথ বেশ রেগেই গিয়েছিলেন। তাঁর স্নানের জল তোলা হয় নি। তাঁর পরিষ্কার কাপড় কোথায় আছে তিনি জানেন না। রাগ হওয়া স্বাভাবিক। খানসামাটি এলো বেশ দেরি করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ওপর রাগ দেখিয়ে দেরির কারণ জানতে চাইলেন। কিছুটা ধরা গলায় খানসামাটি জানালো কাল রাত্রে তার আট বছরের মেয়েটি মারা গেছে। এই বলে নিত্যদিনের সেলাম ঠুকে বিছানাপত্র ঝাড়পোঁছ করতে লেগে গেল। রবীন্দ্রনাথ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। পরবর্তীকালে এই ঘটনাটির উল্লেখ করে তাঁর ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে শিলাইদহ (এখন বাংলাদেশে) থেকে তিনি একটি চিঠি লেখেন (১৮৯৫, ৩০ শ্রাবণ)। ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে তিনি লেখেন ” …কঠিন কর্মক্ষেত্রে মর্মান্তিক শোকেরও অবসর নেই। অবসর নিয়েই বা ফল কি? কর্ম যদি মানুষকে বৃথা অনুশোচনার হাত থেকে মুক্ত করে সম্মুখের পথে প্রবাহিত করে নিয়ে যেতে পারে, তবে ভালোই তো। …..।” তবে এই ঘটনার পর পরই তাঁর মননজগতে বোধহয় একটা পরিবর্তন আসে। তিনি এই ঘটনাটিকে উল্লেখ করে ‘কর্ম’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি নিচে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলুম না। তাঁর পরবর্তী কবিতাগুলি (চৈতালি কাব্য) যেন এই শহুরে যান্ত্রিক সভ্যতা, ঘড়ি-ধরা, অফিসের নিয়মে বাঁধা কাজের থেকে মুক্তি নিয়ে প্রাচীন ভারতের দিকে ফিরে গেল। চৈতালির পরবর্তী কবিতাগুলি হল ‘সভ্যতার প্রতি’, ‘বন’, ‘তপোবন’, ‘বনে ও রাজ্যে’ ইত্যাদি।
কর্ম
ভৃত্যের না পাই দেখা প্রাতে।
দুয়ার রয়েছে খোলা, স্নানজল নাই তোলা,
মূর্খাধম আসে নাই রাতে।
মোর ধৌত বস্ত্রখানি কোথা আছে নাহি জানি,
কোথা আহারের আয়োজন!
বাজিয়া যেতেছে ঘড়ি বসে আছি রাগ করি —
দেখা পেলে করিব শাসন।
বেলা হলে অবশেষে প্রণাম করিল এসে,
দাঁড়াইল করি করজোড়।
আমি তারে রোষভরে কহিলাম, “ দূর হ রে,
দেখিতে চাহি নে মুখ তোর। ”
শুনিয়া মূঢ়ের মতো ক্ষণকাল বাক্যহত
মুখে মোর রহিল সে চেয়ে —
কহিল গদ্গদস্বরে, “ কালি রাত্রি দ্বিপ্রহরে
মারা গেছে মোর ছোটো মেয়ে। ”
এত কহি ত্বরা করি গামোছাটি কাঁধে ধরি
নিত্যকাজে গেল সে একাকী।
প্রতি দিবসের মতো ঘষা মাজা মোছা কত,
কোনো কর্ম রহিল না বাকি।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‐————————————–
২. অনুরোধ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রায় সারা জীবন বহু মানুষের বহু রকমের অনুরোধ উপরোধের ঠেলা সামলাতে হয়েছিল। কুন্তলীন কেশ তেল মাখার উপকারিতা বা ডোয়ারকিন আন্ড সনস্-এর হারমোনিয়ামের প্রশংসাপত্র লেখা – সবই রবীন্দ্রনাথকে করতে হয়েছিল। এর উপর ছিল অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচতদের কাছ থেকে তাঁদের সন্তানদের নামকরণের অনুরোধ। এই অনুরোধ সারা জীবন ধরে তাঁকে পালন করে যেতে হয়েছিল। এছাড়া ছিল অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী এবং অপরিণত লেখকের লেখা সংশোধন করে দেওয়া – একই লেখা একাধিকবার। মুজতবা আলী বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথের মত একজন সৃষ্টিশীল লেখক কেন তাঁর মূল্যবান সময় এইভাবে নষ্ট করেছিলেন? এই সময়ে কতই না সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারতো। তবে প্রমথনাথ বিশীর মতে এই সব কাজই ছিল রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রচুর সাহিত্যিক শক্তির বিকাশের এক অন্যতম পন্থা। যাই হোক নামকরণ নিয়ে একটা মজার ঘটনার কথা বলেছেন রবীন্দ্রলিপিকার সুধীরচন্দ্র কর মহাশয়।
কবির শেষ বয়েসের দিকের ঘটনা, শান্তিনিকেতনের এক কর্মী এসে রবীন্দ্রনাথকে বললেন তাঁর পুত্রের একটা নাম ঠিক করে দিতে। রবীন্দ্রনাথ তখন মহাভারতের উপর একটি ভাষণ লেখার প্রস্তুতি করছিলেন। মাথা না তুলেই তিনি মুখে মুখে দুটি নাম বলে দিলেন – সুমিত এবং সুকৃত। কর্মীটি জানালেন এই নাম দুটি আশ্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ আর একটি নাম বলে দিলেন। এবারে কর্মীটির অনুরোধ রবীন্দ্রনাথ যদি তার পুত্রকে আশীর্বাদ করে একটা কার্ডে দু-চার লাইন কবিতা লিখে দেন। রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হলেন। বললেন মনের আশীর্বাদই যথেষ্ট। আরও দু একবার অনুরোধ করে কর্মীটি চলে গেলেন। এর কিছুদিন বাদে কর্মীটি কি একটা কাজে রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে একটা কার্ড দিলেন। কর্মীটি আশ্রমের কোন দরকারি কাগজ হিসাবে সেটি রেখে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ বললেন আরে তুমি দেখলে না কার্ডে কি লেখা আছে। দেখলেন তাঁরই প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কবি একটি আশির্বাদী কবিতা লিখে দিয়েছেন। এই অভাবিত সৌভাগ্যের আনন্দে কর্মীটি অভিভূত হয়ে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ কর্মীপুত্রের নাম রেখেছিলেন ‘সুপ্রভাস’। নামের অর্থ জানতে চাইলে বললেন সুপ্রভাস মানে যা আলো ছড়িয়ে সব উজ্জ্বল করে। নামটা একটু ভারী এই বলে কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেল। রবীন্দ্রনাথ ক্ষেপে উঠলেন। বকুনি দিয়ে বললেন, তোমাদের যত হালকা, দুর্বল, কাব্যিক নামের প্রতি ঝোঁক। দেখ তো মহাভারতের সব ওজনে ভারী নামগুলো। ধৃতরাষ্ট্র, যুধিষ্ঠির, জয়দ্রথ, বভ্রুবাহন, কার্তবীর্যার্জুন – এ সব নামের মধ্যেই সেকালের পুরুষ-চরিত্রের ভূমিকা প্রকাশমান। যদিও পরে তিনি সবসময়ের বলার মতো একটি নামও বলে দিয়েছিলেন কর্মীটিকে, নামটি হলো ‘সুব্রত’।
আর সেই কবিতাটি ছিল:
“সুপ্রভাস,
ভোরের কলকাকলীতে মুখর তব প্রাণ,
জাগাবে দিন সভাতলে আলোর জয়গান।”
ঘটনাটি এখানে শেষ হলেই ভালো হত। কিন্তু না, এখনই শেষ নয়। ছেলেটির মায়ের নাম কবিতাটিতে যুক্ত হবার সুযোগ ছিল। কর্মীটি ‘ভোরের’ শব্দটির পরিবর্তন করে কবিকে দিয়ে অন্য একটি শব্দ লিখিয়ে নেবার প্রার্থনা করলেন। সে প্রার্থনাও খারিজ হয় নি।
কবিতাটি শেষ অবধি হল এই রকম:
“সুপ্রভাস,
উষায় কলকাকলীতে মুখর তব প্রাণ,
জাগাবে দিন সভাতলে আলোর জয়গান।”
এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো, জমিদারির কাজ সামলেও, পদ্মার ধারে, শিলাইদহের সেই শান্ত নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে কবির কলম অবিরাম চলেছিল – এক দশক ধরে (১৮৯১ থেকে ১৯০১)। সেখানে এই অনুরোধ উপরোধের ঢেউ তখনও এসে পৌঁছয়নি বোধহয়।
তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১. ছিন্নপত্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃষ্ঠা ২৭৭, পত্র নং : ১৪৮, প্রকাশনা : বিশ্বভারতী।
২. রবিজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা – ৯৬-৯৭, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।
৩. রবীন্দ্র রচনাবলী – চৈতালী কাব্য।
8. কবিকথা: সুধীরচন্দ্র কর, পৃষ্ঠা ৬২, প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স।
৫. রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন: প্রমথনাথ বিশী, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ।
Add comment