ঘোড়া স্যারের নিউইয়ার ও ফেলুদা
অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
ডিসেম্বরের প্রায় শেষ, ক্রিসমাস চলছে। সন্ধ্যাবেলায় তেলমোহনবাবু আমাদের লেক টেরেসের বাড়িতে পাড়ার দোকানের সস্তার সন্দেশ আর সিঙারা নিয়ে এসে সোজা সোফায় বসে পড়েছেন। মুখে সেই জগৎভোলানো হাসি।
ওনার সাম্প্রতিক দুটো উপন্যাস তৈলাক্ত তেলেঙ্গানা, আর তিলজলার তেলরহস্য বাজারে খুব ভালো কাটছে। সেইজন্যই মনে হয় পনেরো কুড়ি টাকার সন্দেশ সিঙ্গারা নিয়ে এসেছেন। তবে আমি বা ফেলুদা কেউই এই কৃপনতায় খুশী না। ফেলুদা তো বলেই দিলো
– আপনার নতুন দুটো বই বাজারে তো ভালোই চলছে। তাহলে আপনি এত কৃপণ কেন? বড়দিনের সময় বাজারে এত ভালো ভালো কেক এসেছে, একটাও ভালোমন্দ কেক আনতে পারলেন না?
জানি তেলমোহনবাবু কিছুই উত্তর দেবেন না। আর মুখটাও নামিয়ে চুপ করে থাকবেন। তাই করছেন।
– তবে আপনার বইতে বেশ কিছু ভুল আছে, যেমন তেলেঙ্গানার নামের সাথে হলদিয়ার তেলের কোন সম্পর্ক থাকার কথা নয়। আর……
ফেলুদা আর কিছু বলার আগেই সদর দরজার কলিং বেলটা তিনচারবার বেজে উঠলো। “তোপসে, দ্যাখ তো, মনে হয় বয়স্ক কেউ হবেন, পরিশ্রান্ত হয়ে এসেছেন।“
ফেলুদার কথাই ঠিক, একজন রোগামতন লম্বা ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। কিছু ভূমিকামাত্র না করেই ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। ফেলুদার ইশারায় আমি ছুটে গিয়ে ঠান্ডা জল নিয়ে এলাম। ভদ্রলোক এক ঢোঁকেই সবটুকু জল খেয়ে মনে হয় একটু ধাতস্থ হলেন।
– আপনি তো অনেক দূর থেকে বাস বদল করে আসছেন। শান্ত হোন, তারপর ঠান্ডা হয়ে বলবেন।
আমরা সকলেই অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে তাকালাম। আগন্তুক বললেন, “আপনি ক্যামনে জানলেন?”
– আপনার হাতের ঘড়ির ব্যান্ডের নীচে দুটো বাসের টিকিট। উপরেরটা স্টেট বাসের, নীচেরটা প্রাইভেট বাসের। মানে আপনি দুবার বাস ধরেছেন। আর ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়িতে করে এলে এত ঘেমে নেয়ে আসতেন না।
শোনামাত্র তেলমোহনবাবু ব্যাগ থেকে লাল রঙের ডায়েরি বার করে কিছু নোট করে নিলেন। আর আগন্তুক ভদ্রলোক বললেন, “কি আশ্চয্যি, কি আশ্চয্যি।“
– বলুন, আমি বা আমরা আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে একটা ক্রিসমাস কার্ড বার করে দিলেন, “এটা আগে শুনেন।“
আমার কিরকম যেন মনে হলো। কার্ড তো লোকেরা পড়ে, ইনি শুনতে কেন বলছেন?
ফেলুদা কার্ডটা খুলতেই কিরকম একটা চিঁহি চিঁহি আওয়াজের মিউজিক বেজে উঠলো।
– এটা তো ঘোড়ার ডাক।
– হ, এক্কেরে ঠিক ধরসেন। ঘুড়ার আওয়াজ। এবার আমি অন্য কার্ডগুলি দেখাই।
একগুচ্ছ কার্ড উনি ফেলুদার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি উঠে গিয়ে ফেলুদার পাশে গিয়ে বসলাম। দেখি সব কার্ডেই ঘোড়ার ছবি। সান্তাক্লজের ঘোড়াগাড়ি, ঘোড়ার স্লেজগাড়িতে বাচ্চারা, বরফের উপর ঘোড়া দৌড়াচ্ছে, শ্যমবাজার পাঁচমাথায় ঘোড়ায় চড়া নেতাজি, ঝিন্দের বন্দী সিনেমায় ঘোড়ায় চড়ে উত্তমকুমার, শিবাজী ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করছেন, ট্রয়ের যুদ্ধের বিখ্যাত কাঠের ঘোড়াও আছে। এমনকি শোলে সিনেমার কালিয়া ঘোড়ায় চড়ে সঞ্জীবকুমারের গ্রামে গিয়ে আনাজ চাইছেন। সব কার্ডে শুধু ঘোড়া আর ঘোড়া।
ফেলুদাকেও চিন্তিত মনে হলো। এরকম কেস আগে এসেছে বলে মনে হয় না। ভদ্রলোক সামান্য উত্তেজিত। উনি বলতে শুরু করলেন, “এত্ত এত্ত কার্ড আইসে। কিন্তু টেবিলে যে সাজাইয়া রাখমু, তার উপায় নাই। এই মিউজিকের কার্ডখানা কি সুন্দর, আমার এত্ত পসন্দ হইসে, কিন্তু কার্ড খুললেই তো চিঁহি চিঁহি চিঁহি বাজনা শুরু হইয়া যায়।“ একটু থেমে আরও বললেন, “শুধু তাই? আজকাল ক্যাম্পাচের হচটেল থ্যকেও ছেলেগুলি আমারে দেকলেই চিঁহি চিঁহি ডাকে।“
“কেন, আপনার সাথে ঘোড়ার কি সম্পর্ক? মানে আপনি কি রেসের মাঠে যান? অথবা ………
ভদ্রলোক ফেলুদাকে আর কিছু বলতেই দিলেন না। “পাগল হইসেন?” ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিত। “আমি একজন ফিজিকশে’র প্রফেশর, আমি রেসের মাঠে যামু?”
– আরে না, না, আমাকে তো প্রশ্ন করে সুত্রগুলো বার করতে হবে। সেইজন্যই প্রশ্ন করেছিলাম।
ভদ্রলোক রেগে গিয়ে আর বসলেনই না। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে দ্রুত চলে গেলেন। কার্ডগুলোও ফেরত নিলেন না। শুনলাম, যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলছেন, আমি প্রফেশর। আমারে কয় রেসের মাঠে যাই……।
ফেলুদা গভীর চিন্তায় চলে গেলো। আমি ফেলুদাকে এইভাবে আগে অনেকবার দেখেছি। উপস্থিত এখন কোন কথা বলা যাবে না। আমি উঠে ভেতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এলাম।
– তোপসে, খোঁজ নে তো, সায়েন্স কলেজ থেকে এখানে আসতে কি ডাইরেক্ট বাস আছে?
আমরা এই প্রশ্নের কারণ বুঝলাম না। অবশ্য জানি ফেলুদা সময় হলে নিজেই বলবে।
– তোপসে, অল্প সময় হলেও মনে হলো যে ভদ্রলোক খারাপ নয়। অনেকে মিলে উত্যক্ত করছে। উনি মাত্র চারটে সূত্র রেখে গেছেন। এক ঘোড়া, দুই ফিজিক্সের প্রফেসর, তিন ক্যাম্পাস, আর চার রেসের মাঠ একেবারেই পছন্দ করেন না। আরেকটা আছে, … দু’বারে বাস পাল্টে এসেছিলেন। তবে সবথেকে বড় সুত্রটাই মিসিং। কার্ডের এনভেলাপগুলো উনি সঙ্গে নিয়ে আসেন নি। তাহলে ব্যাপারটা অনেকটাই সহজ জয়ে যেতো।
ফেলুদা একটু থামলো। আমি জানি সময় হলে আরও কিছু বলবে।
– তবে এই ঘোড়ার ডাকের কার্ডটা ইউনিক। মিউজিক্যাল কার্ড আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু তাতে ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি আওয়াজটা নতুন আমদানি। এখানে…… মানে ভারতবর্ষে মনে হয় না পাওয়া যায়। সম্ভবত বিদেশ থেকে কেউ পাঠিয়েছে।
তেলমোহনবাবু আবার লাল ডায়েরি বার করে কি সব নোট করতে শুরু করলেন।
– তেলমোহনবাবু, নোট করছেন ভালো কথা। কিন্তু আপনার রহস্য উপন্যাসের বাংলা নববর্ষ, বা বিজয়ার শুভেচ্ছার মিউজ্যিকাল কার্ডে যেন এই চিঁহি চিঁহি না থাকে।
– ওহ তাই?
এই বলে খাতাটা বার করে তেলমোহনবাবু আবার কিছু নোট করে নিলেন।
“তোপসে, ক্যাম্পাসে ফিজিক্সের প্রফেসর। তাহলে হয় সায়েন্স কলেজ, বা শিবপুর বিই কলেজ হবে।“
আমি বুঝে গেছি ফেলুদার মাথায় এই কেসটা ইতিমধ্যেই গেঁথে গেছে। ধীরে ধীরে সব বলবে। আমি জানতে চাইলাম, “কেন? দুর্গাপুর, বা খড়গপুর বা জলপাইগুড়ি নয় কেন?”
– কারণ, উনি না জানিয়ে এসেছেন, চান্স নিয়েছেন যদি আমার সাথে দেখা হয়ে যায়। দেখা হবে কিনা জানি না, সে অবস্থায় ফোন না করে কেউ অত দূর থেকে ট্রেন ঠেঙ্গিয়ে আসবে না।“
চা এসে গেছে, তেলমোহনবাবুর কিছু সিঙাড়া তখনও ছিলো, সেগুলোই খেলাম।
– বুঝলি তোপসে? সিধু জ্যাঠার সাথে একবার কথা বলতে হবে। আর ফোনদাদুকেও খবর দে, অমিত যেন আমাকে ফোন করে।
– বিই কলেজের অমিত, মানে খোকার বাপ?
– ইয়েস তোপসে।
– কিন্তু ফেলুদা, ঘোড়ার মিউজিকের ব্যাপারটা কিরকম যেন নতুন।
– চিঁহি চিঁহি টা নতুন। জানিস তো, হিন্দী সিনেমার অনেক গানে একটা বিশেষ মিউজিক্যাল তাল আছে, বলে হর্স রিদম। আমাদের ও পি নায়ার এই হর্স রিদম অনেক গানে ব্যাবহার করেছেন।
তেলমোহনবাবু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেলেন। “হ্যাঁ, হ্যাঁ, কি যেন একটা গান আছে, জোড়া হল্লে হল্লে চল্লো মোরে সাজনা।“
– ওটা জোড়া হল্লে হল্লে নয়। জরা হল্লে হল্লে। সাওন কি ঘটা সিনেমার গান।
তেলমোহনবাবু বিস্মিত। “আপনি এত এত খবর ঐ ছোট মাথায় কি করে রাখেন মশাই?”
প্রসঙ্গ পাল্টে এবার তেলমোহনবাবু এক চোখ বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলেন, “এই খোকার বাপ কে”?
– বিই কলেজের একজন ছাত্র।
– ছাত্র? অথচ ছেলের বাবা? আশ্চর্য! বয়স কত হবে?
– হবে সতেরো, আঠারো মতন। কেন? আপনার আবার কি হলো?
– আই বাপ। মাইরি হেব্বি ইন্টারেস্টিং কেস।
তেলমোহনবাবু আবার ডায়েরি বার করে কিছু নোট করে নিলেন।
সিধু জ্যাঠুর কাছে দুনিয়ার খবর থাকে। ফোন করতেই জানা গেলো, ফেলুদার ধারণাই ঠিক। শিবপুরের প্রফেসর চ্যাটার্জীকে অনন্তকাল ধরে ছাত্ররা ঘোড়া আখ্যা দিয়ে রেখেছে। আর হস্টেল থেকে আওয়াজ দিয়ে খ্যাত হয়েছে ওখানকারই এক ছাত্র হারাধন বসাক। ইতিমধ্যে অমিতও ফোনদাদুর থেকে খবর পেয়ে ফোন করেছিলো, সেও একই কথা বললো।
“চলুন তেলমোহনবাবু, কাল সকালে শিবপুর ঘুরে আসি, আর প্রফেসর চ্যাটার্জীকেও এই কার্ডগুলো তো ফেরত দিতে হবে।“
বুঝলাম, ফেলুদা কেসটাতে নিজেকে পুরোপুরি ইনভলভ করে নিয়েছে।
আর তেলমোহনবাবু ফেলুদার সাথে সিধু জ্যাঠার ফোনে কথা চলাকালীন যেরকম একটা আশ্চর্য রকমের মুখ করে রেখেছিলেন, সেটা এক্কেবারে বাধিয়ে রাখার মতন।
ফোন শেষ হতেই বেশ পুলকিত হয়েই বললেন, “আমরা শিবপুর যাবো?”
পরদিন সকালে শিবপুরে ফিজিক্স ডিপার্ট্মেন্টে যখন গেলাম তখন স্যার ক্লাসে। ফেলুদা সবার আগে অফিসের স্টাফদের সাথে ভাব জমালো। এটা ফেলুদার নিজস্ব কায়দা। নিজের কার্ড দেখাতেই ওনারা কিভাবে খাতির করবেন ভেবেই পায় না। এরই মধ্যে তেলমোহনবাবু ব্যাগ থেকে ওনার লেখা নিশীথ রাতের তেল বইটায় নিজের নাম সই করে ওঁদের উপহার দিলেন। “ওঃ, আপনিই তেলমোহনবাবু?” ডিপারমেন্টের অফিস স্টাফেরা সকলেই বিস্ময়ে আর আনন্দে আপ্লূত।
“আসলে স্যারের কাছে প্রতিবারই ছাত্ররা ক্রিসমাস নিউ ইয়ারের কার্ড পাঠায়। কিন্তু এবার কি হয়েছে, প্রচুর ছবিতে ঘোড়ার ছবি থাকায় স্যার খুব রেগে আছেন। ঘোড়ার ছবির কার্ড আগেও এসেছে, তবে এবার বড্ড বেশি। উনার টেবিল এখন ঘোড়ার ছবিতে ছয়লাপ। এতেই স্যার রেগে গেছেন। এখন পর্যন্ত শুধু একটা ছেলেকেই ধরতে পেরেছেন, ল্যুজ রায়। বম্বে থেকে পাঠিয়েছে কলকাতার রেসের ময়দানের কার্ড, ঘোড়াগুলি দৌড়াচ্ছে। তাও ঠিক ছিলো, কিন্তু আজকে সকালে এসে দেখেন কে এক পুরনো ছাত্র শৈবাল সরকার সিডনী অস্ট্রেলিয়া থেকে হ্যাপি নিউ ইয়ার মিউজিক্যাল কার্ড পাঠিয়েছে। ব্যাস। এবার কার্ড খুলতেই মিউজিক বাজছে চিঁহি চিঁহি চিঁহি। আর এতেই স্যারের মেজাজ বিগড়ে গেছে।“
তখনই আরেকজন খবর দিলো, স্যার এসে গেছেন, একলা বসে নিজের মনেই হাঁসছেন, এখন যাওয়া যাবে না।
– কেন? এখন নয় কেন?
– কারণ স্যার এখন একলা নিজের মনে হাঁসছেন, মানে রেগে আছেন। কয়েকজন ছাত্র একটু আগেই এসেছিলো, এসে এই দেখে সব ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেছে।
“কি দারুণ ইন্টারেস্টিং। কেউ হাসছে মানে রেগে আছে?” তেলমোহনবাবু নিজের ডায়েরি বার করে নোট করে নিলেন।
“তবে কামদাবাবুও ওখানে আছেন, উনার সাথে স্যারের খুব ভাব। মনের দুঃখের সব কথা শেয়ার করেন। তাই এখন আপনাদের সামনে হয়তো রাগারাগি করবেন না। এখনই একবার গিয়ে চান্স নিতে পারেন।“
আমরা স্যারের কেবিনে ঢুকলাম, অনুমতি ছাড়াই। স্যার তখন বলছেন, “দ্যাখেন কামদা, এত সুন্দর কার্ড আইসে, অস্ট্রেলিয়া থেইক্যা। কিন্তু মিউজিকটা একবার শুনেন।” স্যার ঘরের দরজা বন্ধ করে চিঁহি চিঁহি মিউজিক শোনালেন। কামদাবাবু শুনলেন।
– আমারে চিঁহি চিঁহি শুনায়? এত সাহস?
– আরে? এতে আপনি রাগেন কেন? রাগের কি হইলো? আমাদের বাঙলা ভাষায় কত গান আছে, যেমন পিয়া পিয়া পিয়া কে ডাকে আমায়। অথবা ধরেন সন্ধ্যা মুখারজির বকম বকম পায়রা, বা নজরুলের গান কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া। সেইরকম ওই সাহেবদের দেশে এই চিঁহি চিঁহি ডাক হয়তো এক উৎসবের গান। আমি আপনি সেকথা জানিনা। কার্ড কোম্পানি তো আপনারে রাগানোর জন্য কার্ড বানায় না।
স্যার একটু ভাবলেন। কামদাবাবুর কথাটাই হয়তো সত্যি। চিঁহি চিঁহি হয়তো ওই অস্ট্রেলিয়ায় উৎসবের বাজনাই হবে, কে জানে? তবু স্যারের ধারনা, এই যে এতসব ঘোড়া মার্কা কার্ড এসেছে, এটা নিশ্চয়ই একটা অরগানাইজড আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। “ফেলুবাবু, বুঝেন তো, এইজন্যি কাল আমি আপনার কাছে গেসলাম।“
– আমি সরি স্যার, আপনাকে গতকাল ঐ প্রশ্নটা করার জন্য। আমি কালকের কার্ডগুলো দেখেছি, খুবই সুন্দর। মিউজিক্যাল কার্ডখানাও বেশ নতুন ধরনের। কিন্তু আমার প্রশ্ন সবাই আপনাকে ঘোড়ার ছবি দেওয়া কার্ড পাঠাবে কেন? আপনার নিজের কি মনে হয়?”
– নিচচই আমায় রাগাইবার জন্যি।
– মানে আপনি বলতে চান, ঘোড়ার ছবি দেখালে আপনি রেগে যাবেন? সেটা ছেলেরা জানে?
– জানে, অবিশ্যি জানে। সক্কলে জানে। আর সব ইদের বদমাইশি।
– কিন্তু আপনিই বা ঘোড়া দেখলে রেগে যাবেন কেন? কারণটা কি?
– জানেন? উত্তমকুমারের হাজারো সিনেমা, খুইজ্যা খুইজ্যা ঝিন্দের বন্দী থেইক্যা বার করসে ঘুড়ার উপরে উত্তমকুমার। শয়তানি নয়? ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছবি। সামনে ঘুড়ার গাড়ি দেখানোর কি দরকার? সবই শয়তানি। ইদের পাইলে আমি দেখমু ক্যামনে পালায়?
আমরা নমস্কার করে বেরিয়ে এলাম। ফেলুদা বুঝতে পারছে স্যার খুব রেগে আছেন। ফেলুদা নিজের মনেই বলছে, “ওই অমিত ছেলেগুলো বদমায়েশ হতে পারে, অল আর পার্টনারস ইন ক্রাইম। তবে খারাপ নয়। প্রফেসর যদি রাগের মাথায় ওদের সাপ্লি দিয়ে দেয়, সেটা অন্যায় হবে।
হস্টেলে গিয়ে দেখি সকলেই বেশ খোশমেজাজে। ফেলুদা আসতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো। অমিতদা বললো, “আরে ফেলুদা? আপনি? এসেছেন খুব ভালো হয়েছে। আমরা খুব টেনশনে আছি দাদা।“
– দিব্যি আড্ডা মারছো, আর বলছো টেনশন? তোমাদের আবার কিসের টেনশন?
– না দাদা, সামনের মার্চেই ফাইন্যাল। এবার ঘোড়া স্যার যেন আমাদের সাপ্লি দেবার একটা প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন।
– ঘোড়া স্যার? বেশ ইন্টারেস্টিং নাম তো। তা এইরকম নাম তোমরা কেন দিলে?
– না ফেলুদা। শুনেছি এই নাম বছর তিরিশ আগেকার ছাত্ররা দিয়েছে। আসল নাম আমরা কেউ জানিনা। কেন এই নাম হয়েছে তাও জানিনা কিন্তু নামটা ঐ তখন থেকেই চলে আসছে।
– তা ওনাকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে?
– ফেলুদা, ভয় বলে ভয়? ঘোড়া স্যারের ভয়ে পরশু আমাদের হোস্টেলে আমরা সরস্বতী পুজো করছি। আর সরস্বতীর হাঁসের পাশে একটা ঘোড়াও থাকবে।
– ডিসেম্বরে সরস্বতী পুজো? তাও আবার সরস্বতীর সাথে ঘোড়া? আরে এও হয় নাকি? সরস্বতী পুজো হয় মাঘ মাসে। তিথি না থাকলে কি করে তোমরা সরস্বতী পুজো করবে?
– অকালবোধন ফেলুদা, সরস্বতীর অকালবোধন। সামনেই আমাদের পরীক্ষা। ঘোড়াস্যার আর ফিজিক্স যে কি ভয়ংকর কম্বিনেশন আপনাকে সে বোঝানো যাবেনা।
– কিন্তু সরস্বতীর অকালবোধন কি আমাদের শাস্ত্রে আছে?
– না থাকলেও করতে হবে। এসব হস্টেলের ব্যাপার আপনাকে বোঝানো যাবে না ফেলুদা। তবে আপনাকে জানাই, পূজো করলেও এবার আমরা সবাই ফিজিক্সের চোথাও বানিয়ে রেখেছি। নইলে এবার ফিজিক্সে কেউ পাশ করবে না। আর চোথা যে মারবো, তাতেও পাশের গ্যারান্টি নেই।
– মানে?
– দেখুন ফেলুদা। আগের পরীক্ষায় আমি পেলাম বেয়াল্লিশ, আর আমারই চোথা করে নুনু’দা পেলো পঁয়ষট্টি। আরও আছে। নুনু’দার থেকে চোথা করে সমকামী পেলো বাহাত্তর। আর সমকামীর থেকে চোথা করে নারদ পেলো আশি। এগুলো কি অন্যায় নয়? এবার আপনিই বলুন ফেলুদা।
– অদ্ভুত তো? তাহলে চোথা মেরে লাভ? আর এবারে কিভাবেই বা তোমরা চোথা করবে?
– পুরিয়া থাকবে। মাইক্রোপুরিয়া। যে বানায় সেই একমাত্র কোডিং বুঝতে পারে। অন্যরা পারবে না। আর থাকবে সেট স্কোয়ার। বাথরুমে বই থাকবে।
– কিন্তু তোমরা বলছো একজনের কোডিং অন্যজন বুঝতে পারবে না, তাহলে পরীক্ষার সময় অন্যজন কিভাবে তোমার চোথা বুঝে নেবে?
– পাসওয়ার্ড থাকে। স্যারের হাতে চোথা গেলেও উনি পাসওয়ার্ড না জানলে ধরতেই পারবেন না।
– করেছো কি? ইনোভেশন অফ টুকলিবাজি? জিনিয়াস বয়েস। ঠিক আছে, চলো অন্য ঘরের সকলের সাথেও একবার পরিচয় করি।
– আরি ব্বাস! ভাঙ্গা খাট? আর মশারীটাও এখনও খোলাই হয় নি।
– তেলমোহনবাবু, এই মশারি প্রথম যেদিন টাঙ্গানো হয়েছিলো, সেই থেকে আজ পর্যন্ত সেইভাবেই আছে। আপনি আপনার খাতায় নোট করে নিন। আপনার আগামী উপন্যাসে নৃশংস দস্যু তকেন্দ্রর বেডরুম এইভাবেই ভাঙ্গা খাট দিয়ে লিখবেন।
“ফেলুবাবু, এই যে অমিত পেলো বেয়াল্লিশ, আর তারই চোথা করে নুনুদা পেলো পঁয়ষট্টি; আর নুনুদার সেই চোথা থেকেই সমকামী পেলো বাহাত্তর, এটা কিভাবে হয়?” দেখলাম তেলমোহনবাবু টাক চুলকাচ্ছেন। মানে রহস্যটা বুঝতেই পারছেন না। ফেলুদাই জবাব দিলো, “ও আমি আপনাকে আলাদা করে বুঝিয়ে দেবো। এখন চলুন।“
একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, অনেক ঘরেই ছোট ছোট ফ্রেমে দু’জন দেবতার বাঁধানো ফটো আছে, ফটোর তলায় শুকনো ফুলও আছে, বোঝা যায় যে এই দেবতাদের নিয়মিত পূজো হয়। কিন্তু বুঝলাম না কেন? আর এনারা কোন দেবতা সেটাও বুঝতে পারছি না। একজনকে কালীঠাকুরের মতন লাগছে, কিন্তু কালীঠাকুর নয়। অন্যজন তো শিব-দুর্গা বোঝাই যায়। কিন্তু এই শিব-দুর্গা আমি আগে দেখিনি। ছবিতে শিব তো প্রায় ল্যাংটো।
যাওয়ার পথে ফেলুদার সাথে প্রতিটি ঘরে আমরা একবার ঢুঁ মারলাম। একদিকে একদল ছেলে আড্ডা মারছে, অন্যদিকে কিছু ছেলে ঘুমিয়ে আছে। “এই দুপুরবেলা ভাত খাওয়ার সময় ঘুমিয়ে আছে? তাও এক খাটে দুজনে?” তেলমোহনবাবু খাতায় নোট করে নিলেন।
ইতিমধ্যে তেলমোহনবাবু ছেলেদের একটি প্রশ্ন করেছেন, “তোমরা দেখছি সবাই কিশোর গল্প পড়, কিন্তু গোয়েন্দাকাহিনী পড় না কেন?”
আমিও দেখেছি, পুষ্পধনু শারদীয়া সংখ্যা বইটা অনেকের ঘরেই আছে। ফেলুদাই তেলমোহনবাবুকে থামিয়ে দিলো। “তেলমোহনবাবু, ওটা বয়স্ক কিশোরদের জন্য লেখা অন্যরকম বই। লিমিটেড প্রিন্ট হয়, সব দোকানে পাওয়াও যায় না। পরে আপনাকে বুঝিয়ে দেবো।“
“অন্যরকম বই?” তেলমোহনবাবু আবার নোটবুকে কিছু যেন লিখলেন।
“না, না, তেলমোহনবাবু, এই বিষয়ে কিচ্ছু নোট করবেন না।“
ফেলুদা রীতিমত ধমক দিয়ে বললো। আর তেলমোহনবাবুও ঘাবড়ে গেলেন। “নোট করবো না?”
– না, একদম করবেন না।
আমিও দেখলাম, এই প্রথমবার ফেলুদা সিরিয়াস হয়ে তেলমোহনবাবুকে কিছু নোট করতে বারণ করলেন।
ফেলুদা একবার অমিতদার ঘরটা দেখতে চাইলো। ঘরের দরজায় ডাবল তালা। ঘরের ভেতরে এসে দেখি লকার, ট্রাঙ্কেও ডাবল তালা। সব চাবি অমিতদার পায়জামার দড়িতে বাঁধা। ট্রাঙ্কের ভেতরে আরেকটা ট্রাঙ্ক, সেটাতেও তালা। জামাকাপড় বই খাতা পেন পেন্সিল, এমনকি গামছাও ট্রাঙ্কের ভেতরে তালাচাবি দিয়ে রাখা। আর দেখলাম পুষ্পধনুর মতন একগুচ্ছ বই। ফেলুদার মুখে কিরকম যেন একটা রহস্যময় হাসি। “অমিত, তুমি কি স্নান সেরে ভিজে গামছাও ট্রাঙ্কে তালা দিয়ে রাখো?
– হ্যাঁ ফেলুদা, সব জিনিষ তালা দিয়ে রাখি। নইলে এরা আমার তেল সাবান চিরুনি টুথপেস্ট চটিজুতো গামছা যা পাবে তাই ঝেড়ে দেবে।
– তোমার সবকিছুতেই দেখছি ডাবল চাবি। আর চাবিও তোমার পায়জামার দড়িতে বাঁধা। তুমি যখন ক্লাসে প্যান্ট পড়ে যাও, তখন ওই চাবি কোথায় থাকে?
– ক্লাসে যাবার সময় ওই চাবি আমার জাঙ্গিয়ার ভেতরে থাকে।
– জাঙ্গিয়ার ভেতর? এতগুলো চাবি জাঙ্গিয়ার ভেতর? অস্বস্তি হয়না?
– এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে তাড়াতাড়ি হাঁটলে জাঙ্গিয়ার ভেতর থেকে পায়ের নুপুরের মতন আওয়াজ হয়। তাই আস্তে আস্তে হাঁটি। আর ফিরে এসে চাবিগুলো গঙ্গাজলে ধুয়ে নি।
– সত্যি, তোমাদের তুলনা নেই! এবার তোমার ফিজিক্সের চোতাখানা একবার দেখাও তো।
তেলমোহনবাবু ফটাফট লাল নোটবুকে সবকিছু টুকে নিলেন।
অমিতদা বড় ট্রাঙ্ক খুলে ভেতরের ছোট ট্রাঙ্ক থেকে সিঁদুর লাগানো কিছু কাগজ বার করে দিলো। “এই পরীক্ষার চোতার প্যাকেট আমি কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, আর তারকেশ্বরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছি।”
– তুমি চোথার বান্ডিল কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে পুজো দিয়েছো?
– হ্যাঁ ফেলুদা, আগেই দিয়েছি। আর পরশু আমাদের হোস্টেলের সরস্বতী পুজোর পর সন্ধ্যের ট্রেনেই আমি ফিজিক্সের সমস্ত চোথা নিয়ে তিরুপতি, বৈষ্ণদেবী, আর অমরনাথে ভগবানের পায়ে ঠেকিয়ে, এরপর কাশীতে ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে তবেই ফিরবো।
– তুমি এত কিছু করবে? আশ্চর্য।
– না না ফেলুদা। আমি ঘোড়াস্যারের সাথে কোন রিস্ক নেব না। আর মানতও করেছি। ফিজিক্সে চল্লিশের বেশী পেলে আজমীঢ়ের দরগায় গিয়ে সিন্নি চড়িয়ে আসবো।
ইতিমধ্যে ফেলুদা টেবিলের উপর ঘাসের মতন কি একটা খুঁজে পেয়েছে। “এটা কি অমিত? ঘাস?”
– হ্যাঁ দাদা, ঘাস। আমার ঘোড়ার পুজোয় লাগে। আমি রোজ দু’বেলা ঘোড়ার পুজো করি। দুপুরের পূজোর সময় হয়ে গেছে। বসুন, আপনাকে দেখাই।
অমিতদা ট্রাঙ্ক থেকে সযত্নে রাখা একটা ফ্রেমে বাঁধানো ঘোড়ার ফটো বের করলো। ফটোর ঘোড়ার কপালে চন্দনের ফোঁটা, ঘোড়ার পায়ে ফুল। একটা পরিষ্কার কাপড় টেবিলে রেখে তার উপর ঘোড়ার ফটোটা রেখে, এবার একটা বাটিতে ছোলা আর ঘাস দিয়ে সাজিয়ে, তারপর প্রদীপ আর ধুপকাঠি জ্বালিয়ে গুনে গুনে সাতবার চিঁহি চিঁহি আওয়াজ করলো। তারপর ঘোড়ার ফটোতে নিজে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সব্বাইকে প্রসাদ দিলো “নে, তোরাও সবাই প্রণাম কর, আর প্রসাদ নে।”
ফেলুদা যেমন অবাক, আমরাও। খুব ইন্টারেস্টিং লাগলো। “আচ্ছা অমিত। তাহলে এটাই তোমার ঘোড়াপূজো? আর তুমি যে রোজ দুবেলা ঘোড়ার পুজো করছো, এর মন্ত্র কোথায় পেলে?
– শাস্ত্রে সেরকম মন্ত্র নেই ফেলুদা। এই চিঁহি চিঁহি আওয়াজটাই মন্ত্র। রোজ ভোরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে সাতবার এক নিঃশ্বাসে চিঁহি চিঁহি ডাকতে হয়। আর সন্ধ্যাবেলায় মোমবাতি জ্বালিয়ে আবার সাতবার চিঁহি চিঁহি। আর পূর্ণিমার রাতে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে একশ’আট বার সুর করে চিঁহি চিঁহি চিঁহি গাইতে হয়। ব্যাস, এটাই ঘোড়ার পুজো।
ফেলুদার মুখে কথা নেই। “অমিত, তোমার এই ঘোড়াপূজো আমি আগে শুনিনি। এই নতুন শিখলাম।”
– ফেলুদা। একটা অনুরোধ ছিলো। আপনি তো অনেক এদিক ওদিক যান। আমায় একটা বই এনে দিতে পারবেন? ঘোড়ার ব্রতকথা, বা ঘোড়ার পাঁচালি, এই ধরণের কিছু। বা ধরুন ঘোড়ামঙ্গল। বা অশ্বমঙ্গল।
– ঘোড়ামঙ্গল?
– ওই আমাদের মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল কাব্য যেমন আছে। সেইরকম ঘোড়ামঙ্গল কাব্য যদি কোথাও থাকে।
– ঠিক আছে অমিত, আমি খুঁজে দেখবো। বলা যায়না কালিদাস হয়তো লুকিয়ে ঘোড়াসম্ভব বা ঘোড়াদুত লিখেছিলেন। হয়তো শুরুতে উনি অভিজ্ঞ্যানঘোড়াতলম লিখেছিলেন, পরে ওখানে ঘোড়ার জায়গায় শকুন্তলার নামটা বসিয়ে দিয়েছেন। আমি খুঁজে দেখবো পাই কিনা।
অমিতদার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে ফেলুদা একটা প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা অমিত, একটা প্রশ্ন করি। অনেক ঘরে শিব-দুর্গার ছবি দেখলাম, তোমার ঘরেও দেখছি। এই শিব-দুর্গার ছবিটা অন্যরকম। মনে হচ্ছে তোমাদের হস্টেলের ঘরে ঘরে নিয়মিত পুজোও হয়। তোমাদের অনেকের ঘরে ঠাকুরের এই বিশেষ ফটোটা কেন?” প্রশ্ন শুনে অমিতদাকে দেখলাম কেমন যেন গুটিয়ে গেল। কিছুই উত্তর না দিয়ে আশেপাশের বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুঝলাম অমিতদা ফেলুদার প্রশ্নের উত্তর জানে, কিন্তু জবাব দেবে না।
– ঠিক আছে অমিত, আজ আসি। দেখি কি করতে পারি। সবাই ভালো থেকো।
রাস্তায় আসতে আসতে গাড়িতে তেলমোহনবাবু বললেন, “যাই বলুন, আমার কিন্তু এই ঘোড়াপূজো আর ঘোড়ামঙ্গল কাব্যের আইডয়াটা দারুণ লেগেছে, বেশ ইউনিক। আর জাঙ্গিয়ার ভেতরে চাবির গোছাটাও ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া”।
– আপনি কি পরবর্তী সিরিজের গল্পে দুর্ধষ ক্রিমিনালকে ধরার আগে ঘোড়াপূজো করবেন? তবে জাঙ্গিয়ার ভেতরে চাবির গোছা না দিলেই ভালো।
– হ্যাঁ, ঘোড়াপূজো ব্যাপারটা মন্দ হবে না, কি বলেন? তবে আমার কিন্তু কয়েকটা প্রশ্ন আছে। যেমন এই নামগুলো। বাবা মা নিজের ছেলেদের নাম রাখবে নুনুদা, সমকামী, নারদ?
– আর কিছু প্রশ্ন?
– হ্যাঁ, যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হস্টেলের ঘরে ঘরে এই কিশোর সাহিত্যর পুষ্পধনু বইটা।
– তেলমোহনবাবু, আপনাকে আগেই বলেছি। এই পুষ্পধনু বইটা পেকে যাওয়া কিশোরদের সাহিত্য, এর বেশি আপনাকে আর কিছু বলবো না। আর এই পুষ্পধনুর উল্লেখ যেন আপনার কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাসে খবরদার না থাকে। ব্যাস, এর বেশি আর কিছু জানতে চাইবেন না।
দেখলাম, তেলমোহনবাবু কেমন যেন মুখটা কাঁচুমাচু করে বসে রইলেন।
বাড়িতে এসে ফেলুদা চিন্তায় পড়ে গেছে। ফেলুদার লাইব্রেরিতে কলকাতার রেসের মাঠের একটা রেফারেন্স বই ছিলো। “দেখি তোপসে, এই রেসের মাঠের বইতে ঘোড়ার ব্যাপারে যদি কিছু সূত্র পাই।”
– রেসের মাঠের বই থেকে মগজাস্ত্র? কি যে বলো ফেলুদা? তুমি দেখলে না, রেসের কথা বলতেই স্যার কেমন রেগে গেলেন। ওখানে লোকে জুয়া খেলে, মদ খায়। স্যার সেসব হয়তো পছন্দ করে না।
পরদিন সকালে ফেলুদাকে দেখি একদম ফ্রেস মেজাজে। আমাকে দেখেই বললো, “আয় তোপসে। কালকে তোর একটিমাত্র কথায় আমি সব সূত্রগুলো জোড়া লাগাতে পেরেছি।“
– কাল? কাল আমি কি বলেছি?
– কেন? তুই যে বললি, লোকে রেসের মাঠে গিয়ে জুয়া খেলে, আর মদ খায়?
– হ্যাঁ, বলেছি, কিন্তু তাতে কি সূত্র পেলে?
– আচ্ছা বলতো, মদের দেবতা কে?
– মদের দেবতা?
– হ্যাঁ, আমিও জানতাম না। উনি হলেন ভরুনী, সমুদ্রমন্থনের পরে যিনি আবির্ভুতা হয়েছিলেন, তাঁকে ভারতীয় ওয়াইনের দেবী বলা হয়ে থাকে। কাল রাতে অনেক বই ঘেঁটে জানলাম। সুতরাং আমরা যাকে কালীঠাকুর ভেবেছি, তিনি আসলে ভরুনী দেবী। তবে হিন্দু শাস্ত্রে কালভৈরবও মদ্যপানের জন্য বিখ্যাত, অনেকেই ওনার পুজোতে মদ উৎসর্গ করেন। গতরাতে তুই ঐ মদ আর জুয়ার কথাটা না বললে আমি তো অন্ধকারেই থাকতাম। আর আরেকটা কথা বল, পুরাণে সবথেকে বড় জুয়া খেলার ঘটনা কি?
– মহাভারতের পাশা খেলা?
– ইয়েস। তবে আমাদের পুরাণে এরকম উদাহরণ আরও আছে। তাহলে এটাই দাঁড়ায় যে হস্টেলে ফ্রেমের ঐ দেবতার ছবিগুলো ছিলো ভরুনীদেবীর। ভেবে দেখ, অমিত আর তাঁর বন্ধুরা তো নিয়মিত জুয়া খেলে, মদ খায়। ঠিক কিনা?
– কিন্তু ফটো তো শিব-দুর্গার?
– রাইট, তাহলে হস্টেলের ঘরে ঘরে এই ফটো কেন? আর যদি শিব-দুর্গাই হয়, তাহলে এই ফটো আমাদের মতন সাধারণ পরিবারে নেই কেন?
আমার মাথায় কিছুই আসছে না।
– শোন তাহলে। এই ফটোটা দেখ, কাল অনেক খুঁজে খুঁজে তারপর পেয়েছি। স্কন্দপুরাণে আর পদ্মপুরাণে আছে কালীপূজোর রাতে শিব আর পার্বতী জুয়া, মানে পাশা খেলতে বসেন। লক্ষ্মী সেদিন পার্বতীর সমর্থনে ছিলেন। শিব গোহারা হেরে গেলে, শেষে নিজের বস্ত্র নিয়ে বাজি ধরেন। সেটাতেও উনি হেরে গেলে, শিব নিজের পড়নের কাপড় খুলে পার্বতীকে দিতে উদ্যত হন। সুতরাং যে ফটো আমরা দেখেছি, সেটা শিব-পার্বতীর জুয়া খেলার ফটো। মানে হস্টেলের ছেলেরা যখন কলেজের বাইরে গিয়ে সাট্টা খেলে, তার আগে এই শিব-পার্বতীকে পূজো দিয়ে খেলতে যায়। আমিও জানতাম না, কাল সব বই ঘেঁটে জানতে পারলাম। রেফারেন্সের জন্য এই ফটোটা আমি জেরক্স করে রেখে দিয়েছি।
পরদিন সকালে কলেজে ফিজিক্স ডিপার্ট্মেন্টে যেতেই অফিস থেকে বললো “যান যান, তাড়াতাড়ি যান। এখন স্যার ভালো মুডে আছেন।”
ফেলুদা “গুড মর্নিং স্যার, কেমন আছেন?” বলে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলো।
– কি ভাবছেন স্যার?
– আরে আসেন আসেন। এই দ্যাখেন। আজকে আরও কার্ড আইসে। আগে আমারে বলেন রামায়ন মহাভারতে অশ্বমেধের ঘুড়া ছাড়া আর অন্য একটাও চ্যাপ্টার নাই? দ্যাখেন, এই দ্যাখেন হলিউডের বেন হুর সিনেমায় ঘুড়ায় টানা রথ। আরও দ্যাখেন, গ্রেগরি পেক নামের এক ব্যাটা ম্যাকানাস গোল্ড সিনেমায় ঘুড়ায় উপর বসা। মাই ফেয়ার লেডী সিনেমাতেও ঘুড়ায় দৌড়াইতাসে। দুনিয়ায় ঘুড়া ছাড়া আর কি কিছুই নাই?
– ওরা স্যার হয়তো ভাবছে আপনি ঘোড়া ভালোবাসেন।
– না, অন্য কথা। ছেলিরা পড়াশুনা করবেনা, পরীক্ষায় চোথা করবে। আর যতসব বদমাইশি।
– না স্যার, ওঁরা চোথা মারে না। তবে এবার ছেলেরা কিন্তু আপনার ফিজিক্সের ভয়ে হোস্টেলে সরস্বতী পুজোর অকালবোধন করছে। আপনার ওই অমিত ছেলেটি কালীঘাট, তিরুপতি বৈষ্ণদেবীতে পুজো দিতে যাচ্ছে? আপনি কি জানেন এসব?
স্যার ফেলুদাকে ডাকলেন, “কি বলেন? চোথা মারে না? ইদিকে আসেন”। কয়েকটা বিশাল আলমারি পাশাপাশি রাখা। আলাদা আলাদা আলমারি থেকে নিজের খুশী মতন হাতের নাগালের কাছে যা পেলেন, এমন কয়েকটা ল্যাবের এক্সারসাইজ খাতা বের করে আনলেন।
– আপনি বলেন এই কলেজের ছেলেরা চোতা মারে না। এই দ্যাখেন, ল্যাবের ফাইল। গত পঞ্চাশ বছরের, হাতের সামনে যা পাইলাম তাই আপনারে দেখাই। দ্যাখেন, এই দ্যাখেন। পঞ্চাশের দশকে দেবু মিত্তির ল্যাবের রিপোর্টে যা লিখসেন, ষাটের দশকের চিরন্তন আর মৌলিক মুখুজ্জ্যে হুবহু তাই লিখসে। এক্কেবারে ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড, লাইন বাই লাইন কমা, ফুলস্টপ পর্যন্ত এক কইর্যা দিসে? এক্কেবারে একশ ভাগ একই লিখা? আবার দ্যাখেন, এখনের ছেলেরা রুদ্র, সুকান্ত, হিমাই, গাগাও একই চোতা মারসে।
– তাই নাকি?
– দ্যাখেন দ্যাখেন। পঞ্চাশ সালে কুমার ঘোষ লেন্সের ফোকাল লেংথ মাপসিলো সাত দশমিক চার নয় তিন সেন্টিমিটার। আর গতকালও সাধন, মামু, তকাদা, লেটো, অঞ্জনা এরা হক্কলে মাপসে সেই সাত দশমিক চার নয় তিন সেন্টিমিটার। সংযনী যায় ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে। ল্যাবই করেনা অথচ তার খাতা জমা পড়ে। আর তারও মাপ আইসে সাত দশমিক চার নয় তিন সেন্টিমিটার। ক্যামনে হয় ইটা? আপনি কইবেন চোথা হয়না?
– কিন্তু স্যার, আমি বলি কি, ছেলেরা আপনাকে ভালোবাসে, অনেক শ্রদ্ধা করে। আপনি আগামীকাল সকালে একবার হোস্টেলের সরস্বতী পুজোয় আসুন, আমি প্রমান করে দেবো।
– আমি কেন হস্টেল যামু? আর এখন ডিসেম্বরে ক্যমনে সরস্বতীপুজা হয়?
– হ্যাঁ, এখন। এই ডিসেম্বরেই। ছেলেরা স্যার আপনার ভয়ে অকালবোধন করছে।
এবার স্যার একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
– আমার ভয়ে? না না। এত ভয় ক্যান পাইবে?
– আমিও স্যার সেটাই বলছি। ওঁদের ভয়টা ভাঙ্গানো দরকার।
– না না, আমারে কেন ভয় পাইবে? উচিৎ নয়। এক্কেবারেই উচিৎ নয়। ঠিক আসে, ঠিক আসে। আপনি কইলে আমি নিশ্চত যাইমু। তবে একটু দ্যাখবেন, চিঁহি চিঁহি আওয়াজ যেন না হয়।
আমরা স্যারকে নমস্কার করে চলে এলাম। তেলমোহনবাবু ব্যাপারটা বুঝলেন না। “আপনি যে স্যারকে হোস্টেলে আসতে বলে দিলেন, যদি আপনার প্ল্যান কেঁচে যায়?”
– কিচ্ছু কেঁচে যাবে না। এই সুযোগে প্রথমেই আমাকে ওনার নামটা জানতে হবে।
– পারবেন ওনার নাম জানতে? গত তিরিশ বছরে কেউ পারেনি যেটা?
– পারবো পারবো। আর তোপসে, তুই শুধু দেখে যা। এখন একবার হোস্টেলে গিয়ে একশন প্ল্যানগুলো আলোচনা করতে হবে।
ফেলুদা হোস্টেলে গিয়ে অমিত ও তাঁর বন্ধুদের জানিয়ে দিলো যে স্যার সরস্বতী পুজোর দিন সকালে হোস্টেলে আসবেন, তাঁকে যেন একদম রাগানো না হয়। আর সরস্বতীর পাশে শুধুই হাঁস থাকবে, ঘোড়া যেন না থাকে।
আজ সরস্বতী পুজোর অকালবোধন, সব আয়োজন প্রস্তুত। সরস্বতীর পাশে ঘোড়ার মূর্তি নেই। ফেলুদার আমন্ত্রনে স্যারও এসেছেন। এবার ফেলুদা স্যারকে গিয়ে অনুরোধ করলো, “স্যার, সব ছেলেরা চাইছে পুজোটা আপনিই করবেন, ওই পুজোর আসনে আপনাকেই বসতে হবে।”
– না না, আমি ক্যানে? আমি ক্যানে? ছ্যালেদের পূজা, ছ্যালেরা করবে, আমি ক্যানে?
চারিপাশ থেকে অনুরোধ, “না স্যার, না স্যার, আপনিই আমাদের হয়ে পুজোয় বসবেন।” ছাত্রদের প্রবল অনুরোধে স্যার পুজোয় বসলেন। পুরোহিত প্রাথমিক দুএকটা মন্ত্র পরিয়ে “এবার নিজের নাম বলুন, বাবার নাম আর গোত্র বলুন”। সবাই শুনলো স্যার বলছেন “নাম সুবোধ চট্টোপাধ্যায়, পিতা অমুক চট্টোপাধ্যায়, অমুক গোত্র।” ফেলুদার শেখানো মতন পুরোহিত কায়দা করে বেশ কয়েকবার স্যারকে দিয়ে “নাম সুবোধ চট্টোপাধ্যায়, পিতা অমুক চট্টোপাধ্যায়” বলিয়ে নিলো।
সবাই শুনলো। ফেলুদা মুচকি মুচকি হাসছে।
পুজো শেষ। ফেলুদা এগিয়ে এলো “সুবোধবাবু, এবার আপনি আপনার ছাত্রদের আশীর্বাদ করুন ওরা সবাই যেন ফিজিক্সে ভালো নম্বর পায়।”
– নিচচয় নিচচয়। তবে এবার তুমরা কেউ চোথা করবা না। ভালোভাবে চলবা, তাইলে সক্কলেই ভালো পাশ করবা। অমিত, তুমি টার্মিনালে চোথা কইর্যা বিয়াল্লিশ পাইসো, আমি সব জানি। ইবার ঠিকমতন পরীক্ষা দিবা।
– আর স্যার, ঐযে অমিত। ভাবছে, আপনি কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন দেবেন। ওই ভয়ে কালীঘাট, তিরুপতি, অমরনাথে যাচ্ছে, ওখানে গিয়ে পুজো দেবে।
– না না। এবার আমি সহজ প্রশ্ন দিমু। কালীঘাট যাও, কিন্তু পরিক্ষ্যায় কেউ চোথা করবা না।
স্যার অমিতের থেকে কাগজ কলম চেয়ে নিয়ে নিজের নাম গোত্র লিখে দিলেন। “তিরুপতি অমরনাথে যাইতেসো। আমার নামে পূজা দিবা। নাও, এই চোথা খানা নিজের কাছে সামলাইয়া রাখো।”
– স্যার, আপনিই তো নিজেই এবার চোথা বানিয়ে দিলেন।
– তুমি আমার আসল নাম জানো? চোথা ছাড়া তুমি আমার নাম মনে রাখতে পারবা?
এরপর বছর শেষ হয়ে নতুন বছর আসছে। ফেলুদার কাছে ছাত্ররা খুবই কৃতজ্ঞ। ঘোড়া স্যার, থুড়ি সুবোধবাবু কথা দিয়েছেন এবার সহজ প্রশ্ন করবেন। ফেলুদাও মনে করিয়ে দিয়েছে “তোমরাও নিউইয়ার প্রমিস করছো যে পরিক্ষ্যায় চোথা করবে না। আর এখন থেকে সুবোধ চট্টোপাধ্যায় নামটাও মনে রাখবে।”
পরের দিন হোস্টেলের ছেলেরা সুন্দর সুন্দর ফুল, গাছ, পাখী, আকাশের ছবি দেওয়া ক্রিসমাস নিউ ইয়ারের কার্ড স্যারকে উপহার দিয়ে এলো “হ্যাপি ক্রিসমাস অ্যান্ড নিউ ইয়ার টু আওয়ার ডিয়ার সুবোধ স্যার”।
ভাগ্যিস ফেলুদা ছিলো। নতুন বছরে এখন সুবোধবাবুর একদমই রাগ নেই ছেলেদের উপর। নতুন বছরে স্যারের নামটাও এখন সব ছেলেরাই জানে।
তেলমোহনবাবু একবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন যে হারাধনের সাথে দেখা করবেন, মানে অভিজ্ঞতার জন্য। জবাবে ফেলুদা বলেছিলো, “সে অভিজ্ঞতা আপনি হজম করতে পারবেন না।“
———————–
হ্যাপি নিউ ইয়ার সুবোধবাবু। ছাত্ররা আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছে। কিন্তু আপনি সারাজীবন আপনার ছাত্রদের বহু যত্ন নিয়ে পড়িয়েছেন। দুষ্টু ছাত্ররা কিন্তু আপনাকে মনে রেখেছে, এখনও অনেক সন্মান করে। যেখানেই থাকুন স্যার ভালো থাকবেন।
Add comment