কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধ্যা
দেবাশীষ তেওয়ারী, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
সন্ধ্যে সাড়ে ছটার সময় ছাদে উঠলাম। আজ লক্ষ্মীপুজো। দুবছর আগে এই সময় আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা, না ছিল চাঁদ, না কোন তারা। আজ কিন্ত আকাশ পরিষ্কার, যদিও কিছু হাল্কা পেঁজা তুলোর মত মেঘ এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে। চাঁদ উঠেছে, কিন্ত সামনের গাছগুলোকে ছাড়িয়ে এখনও মাথা তোলেনি।
এবারে প্রদীপ পুজো করছে না, কোথায় যেন যাচ্ছে স্পেশ্যাল পুজো করতে, কিন্ত সে অন্য একজনকে দিয়েছে তার হয়ে পুজো করে দেবার জন্য। সেই ব্রাহ্মণ এলেন সাড়ে ছটার সময়। বছর পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ বয়স, স্বাস্থ্যবান চেহারা, নাম রক্ষাকর রায়। নতুন ধরণের নাম।
‘বাড়ি কোথায় পুরুত মশায়ের?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘আজ্ঞে কেতুগ্রামে’, পুরুত মশায় বললেন।
‘কেতুগ্রাম প্রপার?’
‘না, কেতুগ্রাম থেকে ঢুকতে হবে আরও কিলোমিটার পনের। দক্ষিণদি, অট্টহাস, সতীপীঠ, নাম শুনেছেন?’
‘নিরোল থেকে যেতে হয়, নিরোল অট্টহাস রোড, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় পিচ হয়েছে, তাইতো।’
পুরুত মশায় অবাক চোখে তাকালেন, ‘আপনি জানেন!’
বছর পঁয়ত্রিশ আগের কথা। উদ্ধারণপুর ঘাটের দিক থেকে ফিরছি কাজ দেখে, কেতুগ্রাম মোড়ে এসে গাড়ী দক্ষিণে না এগিয়ে ঘুরল পশ্চিমে। আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।
তরুনবাবু (নাম পাল্টানো) বললেন, ‘চলুন স্যার, আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই, বাহান্ন পীঠের এক পীঠ।’ ‘এত পীঠের নাম শুনি, বাংলাতেই না বাহান্ন পীঠ হয়ে যায়’।
‘ইনি খুব জাগ্রত দেবী স্যার, দেখলেই বুঝবেন।’
‘চলুন, দেখা যাক।’
আমাকে খুব একটা কনভিন্সড লাগল না। গাড়ী নিরোল এসে পিচ রাস্তা ছেড়ে দক্ষিণে কাঁচা রাস্তায় ঢুকল, কাঁচা মানে কাঁচাই, একদম মাটির রাস্তা, কয়েক কিলোমিটার অন্তর অন্তর গ্রাম। কদিন আগেই কালীপুজো হয়ে গেছে, বর্ষা যাই যাই করেও মাঝেমাঝে জল ঢেলে দিচ্ছে, রাস্তা অনেক জায়গাতেই নরম হয়ে আছে। এরকম একটা জায়গাতে এসে গাড়ীর চাকা গেল বসে। জিপসী ফোর হুইল ড্রাইভ, আজ পর্যন্ত কখনও বিপদে ফেলে নি। আমরা গাড়ী থেকে নেমে লোড কমালাম, সুবল আবার স্টার্ট দিল, ওঠার বদলে প্রচুর কাদা মাটি ছিটিয়ে গাড়ীর বাঁদিকের সামনের চাকা আরও গেড়ে বসল। কয়েকজন স্থানীয় ছেলে ছুটে এল। এভাবে হবে না, এভাবে হবে না, বলে তারা কয়েক আঁটি খড় নিয়ে এল। চাকার সামনের মাটি কোদাল দিয়ে সরিয়ে সেখানে কয়েক আঁটি খড় গুঁজে দিয়ে গাড়ী স্টার্ট করতে বলল। কোন লাভ হল না, আঁটি নরম কাদায় অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার কিছু খড় ঢোকানো হল, আবার একই রেজাল্ট। এভাবে তিনবার ফেল করার পর চতুর্থ বারে চাকা কিছু গ্রিপ করতে পারল এবং প্রচুর ধোঁয়া ও আওয়াজ ছেড়ে ওপরে উঠে এল। আমি ফিরে যেতে চাইছিলাম কিন্ত তরুনবাবু বললেন, ‘ঐতো, সামনেই দেখা যাচ্ছে অট্টহাস, এত কাছে এসে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না।’
ছেলেরাও বলল,’ঘুরে আসুন স্যার, আমরাতো রইলামই, কিছু হলে দেখে দেব।’
রাস্তা এসে শেষ হল এক বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মধ্যে, কেবল উত্তর পূর্ব কোন হঠাৎ উঁচু হয়ে গিয়ে এক গভীর জঙ্গল সুরু হয়েছে। অন্ততঃ পনের ফুট উঁচু। সেই উঁচু জঙ্গলের মধ্যে পায়েচলা সরু পথ, দুদিকে নাম না জানা বড়বড় গাছ চেপে বসেছে, বন এত ঘন যে এই দিনের বেলাতেও মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যে নেমেছে। প্রতি মুহূর্তে সাপের ভয়, কিন্ত কোন জন্তু বা পাখি চোখে পড়ল না। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ বোঁটকা গন্ধ নাকে লাগল।
‘স্যার, ওপর দিকে চেয়ে দেখুন’, তরুন বাবুর কথায় ওপরে চেয়ে দেখি গাছের উঁচু ডাল থেকে ঝুলছে বাদুড়, একটা দুটো নয়, অসংখ্য, শয়ে শয়ে। এরকম দৃশ্য কখনও দেখিনি, আমার অস্বস্তি হতে লাগল।
আরও কিছুটা এগিয়ে পথ পূর্ব দিকে ঘুরেছে, সেখানে একটা ছোট্ট মন্দির, একজন মাত্র কুঁজো হয়ে ঢুকতে পারেন, এখন মন্দির বন্ধ। চলুন স্যার, সামনেটা দেখে আসি, ততক্ষণে পুজারী এসে পড়বেন, খবর পাঠিয়েছি।
আমরা পুব দিকে এগিয়ে গেলাম। কিছুটা দূরে একটা শ্মশান, একটা লাল বেদী, তাতে সদ্য বিসর্জন হওয়া মা কালীর কাঠামো, হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলেন এক বছর পঁয়ত্রিশের সুন্দরী মহিলা,সারা কপালে সিঁদুর লেপা, খুব অখুশি মুখের হাবভাব, যেন আমরা আসায় বেশ বিরক্ত হয়েছেন, তারপর যেমন এসেছিলেন তেমনি জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তরুনবাবু চুপিচুপি বললেন, ‘ভৈরবী, এ জঙ্গলে অনেক আছে আনাচে কানাচে।’ দূরে একটা শেয়াল দেখা গেল,আমাদের দেখছে, পাশেই এক বিশাল পুকুর, দিঘীই বলা যায়। তাতে পদ্ম আর শালুকের বন। দেবী কি এইখানেই কোথাও আছেন! আমার কেমন মনে হল এখনই হয়তো মাতা বেরিয়ে আসবেন ঐ ভৈরবীর মত।
পুজারী এসে মন্দির খুললেন। আমরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। পুজারী দেবীকে দেখালেন,যা মনে পড়ছে এক প্রস্তর শিলা, পুজোর ফুল দিলেন। ‘রাস্তাটা ভাল হলে বাইরে থেকে অনেক ভক্ত আসতে পারে, একটু দেখবেন’, তিনি বললেন।
প্রথম সুযোগেই প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনায় রাস্তাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। শেষ হয়ে যাবার কয়েক বছর পর তরুন বাবু একদিন বললেন, ‘স্যার, অট্টহাসের দারুণ উন্নতি হয়েছে, চলুন দেখে আসি। পুজারী বলছিলেন আপনাকে নিয়ে আসতে।’ যে কাঁচা রাস্তাটুকু আগে যেতে এক ঘন্টা লেগেছিল, সেটা এবার পেরিয়ে এলাম পনের মিনিটে। দৃর থেকে দেখা যাচ্ছে এক তোরণ। গাড়ী আগের জায়গাতেই রাখলাম যদিও, সেখানে এখন হার্ডস্ট্যান্ড হয়ে গেছে আর চারপাশে আরও কয়েকটা গাড়ী দাঁড়িয়ে। একটা কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
জঙ্গল এখন অনেক পাতলা, পরিষ্কার, প্রায় পার্কই বলা যায়, আগের বাদুড়দের কোথাও দেখতে পেলাম না, সেই ছোট্ট মন্দির আর নেই, সেখানে একটা চৌকো দালান দেওয়া মন্দির হয়েছে। সবচেয়ে হতাশ হলাম দেখে যে মন্দিরের সামনেই একটা দোতলা গেস্ট হাউস। পুজারী মশাই খুব গর্বের সঙ্গে বললেন গেস্ট হাউসে এক রাত কাটিয়ে যেতে। এদিক ওদিক কিছুক্ষণ ঘুরে আমি পালিয়ে এলাম দেবহীন সেই মন্দির পার্ক থেকে।
রক্ষাকরের পুজো শেষ, লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ সুরু হয়েছে। আমি বারান্দায় এলাম। দুবছর আগে যখন লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ হচ্ছিল তখন আমি এই পাঠটা খুব মন দিয়ে শুনেছিলাম। পরে ফেসবুকে যা লিখেছিলাম তার থেকে নীচের অংশটা তুলে দিচ্ছি:
“এক রাজ্যের রাজা ঠিক করলেন হাটে ব্যাপারীদের সমস্ত অবিক্রীত পণ্যই দিনের শেষে কিনে নেবেন। ভালই চলছিল, বিক্রী নিশ্চিত হওয়ায় বাজার ফুলে ফেঁপে উঠল। কিন্তু একদিন বিপদ দেখা দিল। এক ব্যাপারী অলক্ষ্মীকে নিয়ে এল বেচার জন্যে। কিন্তু অলক্ষ্মীকে কে কিনবে? দিনের শেষে অতএব রাজাকেই কিনতে হবে অলক্ষ্মীকে।
সবাই রাজাকে বারণ করল, কিন্তু রাজা কারও কথায় কান দিল না। অবশেষে মা লক্ষ্মী স্বয়ং দেখা দিলেন। ‘বৎস,তোমায় যে ছেড়ে যেতে হচ্ছে।’
‘কেন মা, আমি কি আপনার চরণে কোন অপরাধ করেছি?’
‘তুমি অলক্ষ্মীকে ঠাঁই দিয়েছ।’ ‘মা, আমি যে কথা দিয়েছি যা কিছু বিক্রি হবে না তাই আমি কিনে নেব। আমি ধর্ম রক্ষা করেছি মাত্র।’
‘কিন্তু লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মী একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাই অলক্ষ্মী থাকলে আমায় যেতে হবে।’
পাঠ যখন ঠিক এই রকম ইন্টারেস্টিং জায়গায়, দাদা ছাদ থেকে ডাকল, ‘একবার শুনে যা।’ আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। পরে ফিরে এসে দেখলাম পাঁচালী পাঠ শেষ হয়ে গেছে।”
শেষ পর্যন্ত রাজার কি হল তা আর আমার শোনা হয়নি। আজ দুবছর পর আমাকে তা জানতেই হবে।
পাঠ চলছে, অবশেষে সেই জায়গা এল।
রাজা ধর্মরক্ষার্থে অলক্ষ্মীকে ঠাঁই দেওয়ায় লক্ষ্মী তাঁকে ছেড়ে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যের শ্রী অন্তর্হিত হল। ব্যবসা বাণিজ্য মার খেতে লাগল, রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, মড়ক দেখা দিল, লোকে রাজ্য ছেড়ে পালাতে লাগল। নিরুপায় রাজা ধর্মকে স্মরণ করলেন।
‘প্রভু, আমার কি কোথাও ভুল হল?’
ধর্মরাজ দেখা দিলেন।
‘বৎস, তোমার কোন ভুল হয়নি। বিপদ নিশ্চিত জেনেও তুমি ধর্ম থেকে চ্যুত হওনি। লক্ষ্মী অবশ্যই তোমায় দেখবেন। কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে তুমি লক্ষ্মীর আরাধনা কর।’
সেইমত রাজা লক্ষ্মীর পুজো করলে অলক্ষ্মী দূর হল, লক্ষ্মী ফিরে এলেন, রাজ্য আবার শস্য শ্যামলা হয়ে উঠল।ব্যবসা বাণিজ্য নতুন করে সুরু হল, রাজ্যে আবার সমৃদ্ধি ফিরে এল।
আমার যা জানার ছিল জানা হয়ে গেছে, আমি ছাদে বেরিয়ে এলাম। চাঁদ এখন গাছের মাথা ছাড়িয়ে ওপরে উঠেছে, হাল্কা পেঁজা তুলোর মত মেঘের মধ্যে দিয়ে তার কিরণ ছড়াচ্ছে। আমি মোবাইলে সেই ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্ত কিছুতেই চাঁদ আসেনা ছবিতে, ফ্যাটফেটে সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে চাঁদকে মোটেই দেখা যায় না।
ডুগ্গু পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কিছুক্ষণ পরে বলল ‘দাও তো দাদা, আমি একটু দেখি।’
‘তুই পারবি? দেখ চেষ্টা করে।’
আমার ভরসা হলনা। ডুগ্গু এই সেদিনের ছেলে,ও কি করে করতে পারবে যেটা আমিই পারছি না! তবু আজকালকার বাচ্চারা টেকস্যাভি হয় ভেবে মোবাইলটা ওকে দিলাম। ডুগ্গু ফোনটা নিয়ে খুট খাট টেপাটেপি করলো, কি সব মোড চেঞ্জ করল, তারপর কয়েকটা ফটো তুলে আমায় ফোনটা ফিরিয়ে দিল। আমি হাঁ হয়ে গেলাম। এইতো বেশ চাঁদকে দেখা যাচ্ছে মেঘের ভেতর দিয়ে। একটা ফটো আমার খুব ভাল লাগল।
গাছের মাথার ওপর সবে চাঁদ উঠেছে। ওটা কি পর্বত শৃঙ্গ না মেঘ, যার মধ্যে দিয়ে চাঁদ আলো ঢেলে দিচ্ছে নীচের পৃথিবীতে? দক্ষিণে একটু ওপরে জ্বলজ্বল করছে সন্ধ্যাতারা। কি অসাধারণ ছবি আর কি কম্পোজিশন। ডুগ্গু তুলেছে এই ফটো!
Add comment