কষ্টকল্পিত
শ্রীমতী দুর্গারাণী বড়াল, ডক্টর শঙ্কর সেবক বড়ালের স্ত্রী
আমি দুর্গারাণী বড়াল।
আমি তোমাদের প্রিয় মাস্টারমশাই ডক্টর শঙ্কর সেবক বড়ালের স্ত্রী। আশির দশক অবধি বিই কলেজের পাশ করা ছাত্র ছাত্রীদের অনেকেই আমাকে চিনবে। আমি তোমাদের অনেকের মাসীমা।
একটা ছেলে, তোমাদের স্যারের ছাত্র, আর সেই সূত্রে আমাদের বাড়ির সকলের সাথে প্রায় পঞ্চাশ বছরের পরিচিত, সেই কবে থেকে আমাকে অনুরোধ করে যাচ্ছে, সেইসময়কার একটা লেখা দিতে হবে। লেখা দিতেই হবে, কিছুতেই সে আমায় ছাড়ে না। ছেলেটাকে বলেছি, আরে আমার লেখার দৌড় ঐ আত্মীয়স্বজনকে চিঠি লেখা, ব্যাস এই পর্যন্ত। তবে হ্যাঁ, স্কুলে নদী, বর্ষাকাল, এসব নিয়ে রচনা লিখেছি, কিন্তু তাঁর জন্য পাঠ্যবই ছিলো। তাই বলে নিজের কথা লিখবো, আর এই ৯৪ বছর বয়সে? আমার জন্ম ১৯২৭ সালের ১লা অক্টোবর দূর্গা ষষ্ঠীর দিন রাত দশটার সময় বিহারের ডালটনগঞ্জ শহরে। আজ এত দীর্ঘজীবনের অনেক কিছুই যেমন মনে আছে, তেমনি অনেক কিছুই আর মনে নেই।
ছেলেটা তবু ছাড়ে না, তাই তোমাদের জন্য একটা লিখেই দিলাম।
প্রথমে আমার মা বাবাকে নিয়ে কিছু লিখি।
আমার মা সারদামনির জন্ম হয়েছিলো বিহারে ডালটনগন্জে আমাদের মামাবাড়িতে। মায়ের বাবার নাম ভুবন মোহন বড়াল। চন্দননগরে দাদামশাইএর নিজস্ব বাড়ি ছিল। পরে সপরিবারে ডালটনগন্জে চলে আসেন। আমার দাদামশাইএর ছয় ছেলে ও চার মেয়ে। মা ছিলেন তৃতীয়া কন্যা, নাম ছিল সারদামনি। মাকে ছোটবেলায তাঁর ঠাকুমা মানুষ করেছিলেন। আমার মা আর আমার শাশুড়ি’মা ছোটবেলায দু’জনে খেলার সঙ্গী ছিলেন। সেই সূত্রে সুন্দর পারিবারিক যোগাযোগ ছিলো। আর আমার মামাবাড়ির সাথে শ্বশুরমশাইদের আত্মীয়তাও ছিলো।
ভুবন মোহন বড়াল, আমার মায়ের বাবা, উনি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ছাত্র ছিলেন, আর নানান বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। শিবপুর বিই কলেজে ছ’মাস পড়েছিলেন জমির মাপজোক (সার্ভেইং) ইত্যাদি বিষয়ে। তখন বি ই কলেজের ক্লাস প্রেসিডেন্সি কলেজে হতো।
তখনও পুরোপুরি রেল চলাচল শুরু হয় নি। ১৯০৫ সালে ডালটনগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়। তাই যেতে গেলে কিছুটা পথ রেলে, কিছুটা গরুর গাড়ি ও কিছুটা হাতে টানা গাড়িতে যাতায়াত করতে হতো।
এগারো বছর বয়সে আমার মায়ের বিবাহ হয় হুগলির কেদারনাথ দত্তের সাথে। তখন তাঁর বয়স আঠারো বছর। আমার ঠাকুরদাদা যখন বারাসতে ছিলেন তখন বাবার জন্ম হয় ঠাকুর’দার কর্মস্থলে। তিনি তখন হুগলি কলেজে আই এ পড়তেনI আমার বাবার যখন পাঁচ বছর বয়স, ছয় মাসের ব্যবধানে আমাদের ঠাকুরদা ও ঠাকুমা মারা যান। ঠাকুরদাদা তখনকার দিনের সাবজজ ছিলেন। সেসময় পূর্ববাংলা ভাগ হয় নি। আর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাও একসাথে ছিল।
বাবা ও কাকাবাবুরা ছিলেন দুই ভাই, আর চার বোন। বাবার যখন পাঁচ বছর বয়স, আর কাকাবাবুর চার বছর, তখনই তাঁরা মা বাবাকে হারান। তখন তাঁদের এক পিসিই তাঁদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেন, ও একে একে সেই চার বোনের বিয়ে দেন। আমার বাবা প্রথমে হুগলির মল্লিকবাড়ির স্কুলে পড়াশোনা করে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর তিনি হুগলি মহসিন কলেজ থেকে আই এ, আর তারপরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিলজফি অনার্স নিয়ে বিএ ও তারপর আইন পাশ করেন। আইন পড়ার সময় তাঁর সহপাঠি ছিলেন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, যিনি পরবর্তী সময়ে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। তাঁরা উত্তর বিহারের অধিবাসী ছিলেন। সেইসময়ের কিছু চিঠিতে আরো জানতে পারি যে অনেক বিখ্যাত লেখকও তাঁদের সঙ্গে পড়তেন। আমার বাবার যাঁরা সহপাঠী ছিলেন তাঁরা সবাই বছরে একটিবার সকলে মিলে সহপাঠী সম্মেলন করতেন, তোমরা যাকে রিইউনিয়ন বলো।
আই এ পাশ করার পর, আঠার বছর বয়সে বাবার বিবাহ,হয়। এরপর ল পাশ করার পর এক বছর হুগলির কোর্টে প্রাকটিস করেন। এরপর কলকাতার হাইকোর্টে এসে প্রাকটিস করেন। ১৯০৫ সালে প্রথম ট্রেন চালু হলে তিনি ডালটনগঞ্জ আসেন। তাঁর বড়মামা স্বর্গীয় আশুতোষ বড়াল ওকালতি করার জন্যই তাঁকে কলকাতা থেকে ডালটনগঞ্জ নিয়ে আসেন। সে সময় এ কাজে ভালোই পসার ছিল।
সেই সময়ের ডালটনগঞ্জ ছিলো জঙ্গল ও পাহাড় ঘেরা এক ছোট্ট শহর, যার তিনদিক ঘিরে ছিল কোয়েল নদী। গ্রীষ্মকালে নদীতে জল থাকত খুব কম, হেঁটেই নদী পার হওয়া যেত। কিন্ত বর্ষার সময় দেখা যেতো তার রুদ্ররূপ। নদীতে বান এলে, বিশাল উঁচু উঁচু ঢেউ এসে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেতো। স্রোতের টানে ভেসে আসতো ডালপালা শুদ্ধ বড় বড় গাছ। আর লোকেরা সেই কাঠ সারা বছরের জন্য সংগ্রহ করে রাখত। তখন সেই অঞ্চলে কাঠের আগুনেই রান্না হতো। তাই কাঠ সংগ্রহ করে রাখাটাই চল ছিলো।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন মোটরগাড়ি খুবই কম ছিল। ওকালতি কাজের সুবিধার জন্য ডালটনগঞ্জ এসে কিছুদিন তিনি আমার মামার বাড়িতে ছিলেন। তারপর ভাড়া বাড়িতে চলে যান। এরপর এক বাঙালি ব্রাহ্মণ, নাম কেদারনাথ মুখার্জ্জি, উনার থেকে বসতবাড়ির জন্য ১২ কাঠা জমি কেনেন। তখনকার দিনে প্রচলিত ধারনা ছিলো যে তীর্থস্থানে মৃত্যু হলে পুনর্জন্ম হয় না। সেই বিশ্বাসে বৃদ্ধবয়সে কেদারনাথবাবু বেনারস চলে যান।
আমার দাদা, মানে মায়ের বড় ছেলে এই শহরে প্রথম গাড়ি কেনেন। উনি প্রথম সেই গাড়িতে দিদিমা ও নিজের মা’কে নিয়ে এলাহাবাদ কুম্ভ মেলায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন বাড়ি তৈরি করতে গেলে আগে ইঁট তৈরি করে তারপর বাড়ি করতে হতো। ইঁট বানাতে নদী থেকে মাটি আনতে হতো, ভারীরা জল এনে দিত। তারপর সেই ইঁট আগুনে পুড়িয়ে, সেইভাবে বানিয়ে তাই বাড়ি তৈরির জন্য ব্যবহার করা হতো। ১৯১৪ সালে বাবা প্রথমে একতলা বাড়ি করেন। পরবর্তীকালে আমার দাদা দোতলা ও তিনতলা বানান। একশ আট বছরের সেই পুরানো বাড়ি আজও অটুট আছে। বরাবরই ডালটনগঞ্জে গ্রীষ্মকালে জলের সমস্যা থাকে। তাই সেইসময় কুয়ো বানিয়ে রাখা হয়। আজও সেই কুয়োর জল ব্যবহার করা হচ্ছে।
যখন বাড়ি কেনা হয়, একতলায় ছিলো মায়ের ঘর, মেজদার ঘর, আর ছিলো এক ছোট বারান্দা। পরে সেগুলোই মেরামত করে ঠিক করা হয়। মা নিজে খুব পরিশ্রমী ছিলেন। আর কোনরকম অপচয় পছন্দ করতেন না। আমার দাদা ছিলেন মায়ের ডান হাত। বাড়ির যতো কাজ, মায়ের যা যা প্রয়োজন সব দাদাই দেখতেন। আর বাবা ব্যাস্ত থাকতেন বাইরের কাজে। আমার মা ছেলে আর মেয়েদের কখনই আলাদা চোখে দেখতেন না। বাড়ির বৌমারাও তাঁর নিজের মেয়ের মতোই ছিলেন। মেয়ে, বৌ এই দুইএর তফাত কখনো তিনি করেন নি। লক্ষ্মীপূজো, দুর্গাপুজোর দিনে মেয়ে, বৌ সবার জন্য একই রকমের শাড়ি হতো। খালি রংটাই আলাদা। তাই পড়ে সবাই একসাথে মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যেতেন। পুজোর সেই ক’দিন মা অনেকরকম ও অনেকের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করতেন। অষ্টমীর পূজো হতো আমাদের বাড়িতে। মা পুজোর পর বারোজন ব্রাহ্মণকে খাওয়াতেন, দক্ষিণা দিতেন। বাড়ির অঞ্জলির পর দূর্গাবাড়িতে পূজার অঞ্জলি দিতে যাওয়া হতো। এই দিনের পূজোর সকল উপাচার, নৈবিদ্য বড় বারকোষে সাজিয়ে কাজের লোকের হাতে মা দূর্গাবাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।
সেই ডাল্টনগঞ্জের ছোটবেলাটা আমাদের খুব আনন্দের সাথেই কেটেছে। পাঁচ দাদা, চার বৌদি, পাঁচ দিদি, ভাইপো, ভাইঝি সবাই মিলে একসাথে আমরা খুব আনন্দের সাথে কাটিয়েছি। আজ শুধু আমরা দুই বোন আছি। আমি ও আমার দিদি।
————–
মা, বাবাকে নিয়ে আমার স্মৃতিকথা লিখে রাখলাম।
এবার নিজের কিছু কথা বলি।
আগেই বলেছি, আমার জন্ম ১৯২৭ সালের ১লা অক্টোবর দূর্গা ষষ্ঠীর দিন বিহারের ডালটনগঞ্জ শহরে।
আমি যে স্কুলে ভর্তি হই, তার নাম ছিলো “বাংলা স্কুল”, আর এই স্কুলে আমার দিদিমাও পড়েছেন। বাংলা স্কুল একটাই ছিল। আর পাঁচ ছটা হিন্দী স্কুল ছিল। আমার দাদু সেই সব স্কুলের চেয়ারম্যান ছিলেন।
আমার বিয়ে হয় ১৯৪৮ সালের ২৮শে মে। তখন আমার বয়স উনিশ, আর তোমাদের মাস্টারমশাইয়ের বয়স ২৯ (জন্ম ১৯১৯ সালের ১৫ই অক্টোবর)। তার আগে আমার স্বামী স্বর্গীয শঙ্কর সেবক বড়াল ১৯৩৯ সালে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএসসি (ফিজিক্স অনার্স) করে তারপর ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে এমএসসি করেন। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডক্টর মেঘনাদ সাহা ও ডক্টর হৃষিকেষ রক্ষিতের ডাকে উনি কলকাতার রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে জয়েন করেন। আয়নোস্ফিয়ার (ionosphere using radio pulse echo technique) এর উপর উনি রিসার্চ করতেন। কাজের চাপে সবদিন চন্দননগর ফিরতেও পারতেন না। অনেক সময়ই রাত জেগে কলেজের ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে হতো। তখন বাড়িতে না এসে সায়েন্স কলেজের ল্যাবরেটরিতেই রাত্রে থেকে যেতেন, আর নিজেই রান্না করে খেতেন। সেই সময় রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান পপুলার সায়েন্স এর উপর অনেক বক্তব্য রেখেছেন। লেকচার দেবার আগে সেটা লিখে নিতেন, আর তারপর সবসময়ই আমাকে পড়ে মতামত দিতে বলতেন। আমি আমার মতামত দিলে বলতেন “দাঁড়াও আগে ঘসে মেজে শেষ করি। তারপর দ্যাখো”। সত্যিই শেষ হলে দেখা যেতো যে লেখাটা খুবই মনোগ্রাহী হয়েছে।
উনি ১৯৫৫-৫৬ সালে বি ই কলেজে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান হয়ে যোগদান করেন। তখন থেকেই বিই কলেজের সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ। বিই কলেজ জয়েন করার পর সায়েন্স কলেজ উনি ছেড়ে দেন। তবে যখনই সায়েন্স কলেজ থেকে লেকচার, রিসার্চ বা কোন দরকারে ডাক এসেছে, তখনই চলে গেছেন। বিই কলেজে এসে উনিই আধুনিক ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রতিষ্ঠা করেন। আমার প্রিয় এই বিই কলেজ ক্যাম্পাসে আসার পর থেকেই চারিদিকের সবুজের মাঝে শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে এত সুন্দর এক আশ্রমিক পরিবেশে আমাদের দিনগুলো সত্যি খুবই ভালো কেটেছিল। সেই দিনগুলির কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।
আমি বিহারের ডাল্টনগঞ্জে বড় হয়েছি, বাংলার অনেক কিছুই জানতাম না, কিন্ত উনি কখনো আমাকে অবজ্ঞা করেন নি, বুঝিয়েই বলতেন। টাকাপয়সা যা রোজগার করতেন আমাকে দিয়ে আলমারিতে তুলে রাখতে বলতেন। নিজে একবারও খুলতেন না। দরকার হলে আমাকেই আলমারি খুলে বের করে দিতে হতো। উনি রান্না জনতেন। তাই আমি অসুস্থ হলে, বা ছুটির দিনে রান্না করে ছেলেমেয়েদের খাওয়াতেন। তাঁদের জন্মদিনে বই, পেন উপহার দিতেন। নিজে পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলেন, অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তোমাদের স্যার নিজের পড়াশোনার সাথেসাথে ছেলেমেয়েদেরও খেয়াল রাখতেন। সংসারের ভালোমন্দ সবকিছুর সাথে মানিয়ে চলতেন। ফলস্বরূপ আজ আমাদের ছেলেমেয়েরা যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত।
বিই কলেজের ক্যাম্পাসে থাকলেও শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। প্রায়ই সায়েন্স কলেজ যেতে হতো আর বাড়ি ফিরলে দাদার ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসাতেন। তাঁরা সকলেই তাঁদের ছোটকাকাকে খুব মানতো।
একটা ঘটনা মনে আছে। সময়টা সঠিক মনে করতে পারছি না, (বলেছি না? এই ৯৪ বছর বয়সে সব সঠিক মনে পড়ে না), মনে হয় ৭৯-৮০-৮১ সাল নাগাদ। ছেলেদের পরীক্ষার সময় হঠাত কি একটা ব্যাপারে সেই মেসের স্ট্রাইক হয়। তখন তোমাদের ইলেকট্রনিকস বিভাগের সকলে আমার বাড়িতে এসে দিনকয়েক খাওয়াদাওয়া করেছিলো। স্যার ওঁদের বারণ করে দিয়েছিলেন যেন বাইরের হোটেলের খাওয়া না খায়। আর আমি একলাই সেই রান্না করেছিলাম। আরেকটি ঘটনা, এটা মনে হয় ‘৬৫ সাল নাগাদ হবে। পরীক্ষার সময় ইলেকট্রনিকস বিভাগের একটি ছেলের শরীর খারাপ হয়ে কলেজের হসপিটালে গিয়ে ভর্তি হয়। স্যার খবর পেয়ে ওঁকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। ছেলেটি আমাদের বাড়িতে থেকেই দু’তিনটে পরীক্ষা দিয়েছিলো।
ক্যাম্পাসে যেহেতু বয়সে আমি অনেকের বড় ছিলাম, তাই অতিরিক্ত দায়িত্বও ছিলো। সেগুলো পালন করে আনন্দও পেতাম। যেমন চিত্রা (প্রফেসর অরুণ শীলের স্ত্রী) ছেলেমেয়েদের শরীরের একটু এদিক ওদিক হলেই ঘাবড়ে যেতো। সামান্য ব্যাপার, তাও ঘাবড়ে যেতো। আমি অনেকবার গিয়ে সামাল দিয়ে এসেছি। আর ছিলো শ্যমলী, প্রফেসর যাদব চক্রবর্তীর স্ত্রী। এছাড়া ছোট ছোট বাচ্চাদের ফরমায়েসি সোয়েটার বোনা তো ছিলোই। খুব আনন্দের ছিলো সেই দিনগুলো।
স্যার বিই কলেজ থেকে রিটায়ার করার পর আমরা চন্দননগরের পৈতৃক ভিটেয় ফিরে আসি। আবার আমার শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে মিলবার সুযোগ হয় আর আনন্দেই দিনগুলো কেটে যায়। তখন তোমাদের স্যারের কাছে অনেকেই পড়তে আসতো। বিনা পয়সায় উনি ভালবেসে সবাইকেই পড়াতেন। আর সবাইকেই কিছু একটা করে দেখাতে বলতেন। কারোর রেজাল্ট ভাল হলে খুব খুশি হতেন। জীবনে এগিয়ে যেতে, প্রতিষ্ঠিত হতেও অনেককে নানানভাবে সাহায্য করেছেন। এভাবেই উনি সারাজীবন সকল ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।
পড়াশুনার বিষয়ে তোমাদের স্যারের গভীর আকর্ষন ছিলো। তাই সবসময়ই নিজের নানান রকমের পড়াশোনার মধ্যে থাকতেন ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দিকেও নজর রাখতেন। খুবই নিবিষ্ট মনে লেখাপড়া করতেন। অন্য কোনদিকে তখন মন থাকতো না। শ্বাশুডিমায়ের কাছে শুনেছি একবার হারিকেন জ্বেলে পড়ার সময় হারিকেন থেকে বিছানায় আগুন ধরে যায়, কিন্ত উনি পড়ায় এতটাই মগ্ন ছিলেন যে পাশেই আগুন ধরে গেছে সেটাও বুঝতেই পারেন নি। এইরকম নিবিষ্ট মনে পড়া আমি বিই কলেজেও দেখেছি।
সব সংসারেই নানারকমের সুবিধা অসুবিধা থাকে। তার মধ্যেই আমাদের দিন ভালভাবেই কেটে গেছে। ছেলেমেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে। যে যার নিজের জায়গায় ভালভাবে ঘর করছে। ছোটবেলায বাবা-মায়ের আমি অনেক আদরে বড় হয়েছি। বিয়ে হয়ে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সবার থেকে অনেক সন্মান ভালবাসা পেয়েছি। শিবপুর থেকে এসেও সবার সাথে থেকেছি।
আমার ছেলেমেয়েদেরও সবাই খুব ভালবাসতেন। আমার যেমন ছোটবয়সে বাবা চলে যান, ওনারও তেমনি মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বাবা চলে যান। ওনাকে দাদারাই মানুষ করেন। তখনকার দিনে ফরাসি আমলে সার্তিফিকা পরীক্ষায় পাশ করলে কলেজ অবধি ফ্রী তে পড়াশোনা করা যেতো। আমার স্বামী ওই পরীক্ষায় প্রথম হন। তাই কলেজে পড়ার সময় কোন খরচ লাগে নি।
চিরকালটা উনি খুব সাদামাটা জীবন যাপন করেছেন। কখনো কোন বাবুয়ানী করতে দেখিনি। ছেলেমেয়েদের আলাদা করে দেখতেন না। সবসময় তাই চাইতেন ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে কিছু একটা করে দেখাক। কখনো কোন অন্যায় দেখতে পারতেন না। প্রতিবাদ করতেন। আর অভ্যাসের মধ্যে রোজ ভোরবেলা হাঁটতে যেতেন। ভগবানে বিশ্বাস করতেন, রোজ গীতাপাঠ করে পূজো করতেন। তুবড়ি বানাতে ভালবাসতেন। কালীপূজার সময় ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সকলে মিলে তুবড়ি বানাতেন। তুবড়ির মালমশলা নিজেই কিনে আনতেন।
ছেলেমেয়েদের খুব ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন। কাজের চাপে সবসময় পড়াবার সময় না পেলেও রবিবার সকাল থেকে সন্ধে অবধি তাঁদের নিয়ে বসতেন। বিকালে তারা খেলতে যেতো কিন্ত সন্ধ্যা হবার আগে বাড়ি না ফিরলে রাগারাগি করতেন। আর মিথ্যাকথা বললে খুবই রেগে যেতেন।
তোমাদের স্যার স্কুলকলেজে অনেক প্রাইজ, বই, মেডেল পেয়েছেন। অনেক সোনার ও রুপোর মেডেল পেয়েছেন। সেই সব আমার নাতিনাতনিদের দিয়ে দিয়েছি। বলেছি যত্ন করে রাখতে। এমনিতে একদমই রাগ ছিলো না, তবে মেয়ে বাণীকে যখন ডাক্তারী পড়তে দিলাম না, তখন উনি আমার ওপর খুবই রেগে গিয়েছিলেন। পরে বাণী, আর দেবু দুজনেই তো বিনা চিকিৎসায় রামকৃষ্ণলোকে চলে গেলো। উনিও শেষ সময় বলতে গেলে কোন চিকিৎসাই পান নি।
আমার আজ ৯৪ বছর বয়স। আমার বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির অনেকেই অনন্ত ধামে চলে গেছেন। সবার আত্মার শান্তি কামনা করি।
আর তোমরাও সবাই সুস্থ সবল, নীরোগ ও আনন্দ নিয়ে থেকো। সকলের মঙ্গলকামনা করি ও আশীর্বাদ জানাই।
– তোমাদের মাসীমা দুর্গারাণী বড়াল
Add comment