সেইসব দিনগুলো
সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী, ১৯৫৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
Cover Photo: Our Public Health Engineering Group 1956
অনেক যুগ হয়ে গেলো। অনেক অনেক যুগ আর অর্ধ শতাব্দী পার। তবু মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭, মাত্র চারটি বছরের বিই কলেজের ছাত্রজীবন। এরপর অল্পদিনের জন্য শিক্ষকতা। এই তো মাত্র ক’টা বছর। তবু মনে হয় অস্তিত্বের ভিতরে কতটা যে স্থান অধিকার করে আছে এই ক্যাম্পাস কলেজের জীবন, তাঁর কোন পরিমাপই আমি কোনদিন করতে পারবো না। ঐ সেই ক্লক টাওয়ার, তারই পাশের নিস্তরঙ্গ দীঘি, সবুজ ওভাল মাঠ, বিকেলে বোটানিক্যাল গার্ডেনর ছায়াময় পথ। আর তারই সাথে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব, প্রতিযোগিতা, পিছনে ফেলে আসা তারুণ্যের কতই না ছেলেমানুষী। সামনে পেশাগত জীবনের হাতছানি দেওয়া দোলায়িত জীবন। সেই চার চারটি বছরের কতই না ছোট ছোট স্মৃতি আজও মনের আঙ্গিনায় ভীড় করে।
মনে পড়ে সহপাঠী বন্ধুদের কথা, আর নানান ঘটনা। তাঁদের সকলে আজ আর আমাদের মধ্যে নেইও। মহাকাল বড়ই নির্মম। শুরুটা আমরা করেছিলাম একসঙ্গে। কিন্তু শেষটা আমাদের কারোর হাতে নেই। তবু সেই ক্ষণিকের একসাথে থাকার স্মৃতি, ‘সহনা ভবতু সহনৌ ভোলস্তু’র মন থেকে কখনই মুছে যাবে না। যতদিন প্রাণ থাকবে, ততদিন সেই স্মৃতিগুলোও রয়ে যাবে।
প্রেসিডেন্সি কলেজের পর প্রথম বছরে গিয়েই যে কলেজের প্রেমে পড়েছিলাম, এমন কিন্তু নয়। হস্টেলে থাকাটা বাধ্যতামূলক, সেখান থেকে দিনরাত পড়াশোনা। আমার গন্ডীটা ছিলো উত্তর কলকাতায়। সেখানকার সব বন্ধুবান্ধব, ফুটপাতে খেলাধূলা, একসঙ্গে মিলে হৈচৈ, রকবাজি, এইসব তো ওঁদের সাথেই হতো। তাঁরা সব নিজেদের মতনই রইলো, আর আমি এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত উপুড় হয়ে ড্রয়িঙ্ এর ফালতু নক্সা টেনে যাচ্ছি, আর ক্যালকুলাস করছি। এমনটা কার যে ভালো লাগে জানি না, আমার অন্তত নয়। সপ্তাহের শেষে পাড়ায় ফেরার জন্য প্রাণটা হাঁসফাঁস করতো।
যন্ত্রণার এখানেই শেষ নয়। ওয়ার্কশপ নামের একটা শুধুই কঠিন নয়, কঠিনতম ব্যাপার ছিলো। একটা লোহার টুকরোকে ছেনি দিয়ে কেটে কি যেন একটা বানাতে হয়েছিলো। সেই অরিজিনাল লোহা যেমন আছে তেমনই থাকে, পরিবর্তে আমার হাতের ছালচামড়া উঠে রক্তারক্তি ব্যাপার। তারপর কামারশালা, একটা চোদ্দ পাউন্ডের হাতুড়ি দিয়ে গরম লোহাকে পেটানো। এমন পরিস্থিতিতে মনের অবস্থা কি করে আর প্রীতিকর থাকে? মনে হতো, ‘আমাদের এক একজন গামা পালোয়ানের ভাই বেরাদার?’
তখন ভালো না লাগলেও আজ মনে হয়, এই কষ্টসহিষ্ণুতা ও শৃঙ্খলার সেই শিক্ষা বোধহয় পেশাদারিত্বের প্রথম সোপান ছিলো। কে জানে, এটাও আমাদের পূর্বসূরী সাহেব প্রিন্সিপালদের অভিপ্রেত ট্রেনিং কিনা? দেড়শো বছরের পরম্পরা, আজ কে তার উত্তর দেবেন? ওনাদের নামে নামে নতুন করা হস্টেলের বাড়ীগুলোই শুধু রয়ে গেছে। রিচার্ডসন, উলফেনডন, ম্যাকডোনাল্ড – এনারা তো আর নেই। তাঁদের নামাঙ্কিত বাড়িগুলোর সামনে দিয়েই রোজ আময়া হেঁটে যেতাম। শীতের কুয়াশার ভোরবেলার গঙ্গার সকাল সাতটা, কেমন যেন ঠাণ্ডা আর রহস্যময় মনে হতো। ভাবতাম, কোথায় না জানি ভাসবে আমার নৌকা, আর কোথায় গিয়ে ঠেকবে শেষ পর্যন্ত। যশোরের এক নাম-না-জানা নিতান্ত গন্ডগ্রামে আমার জন্ম, পাশ দিয়ে বয়ে যেত ভৈরব নদ। আর এখন এই শতাব্দী প্রাচীন কলেজের পাস দিয়ে বয়ে যায় সুদূর প্রবাহিনী গঙ্গা। ইতিহাসের নদী। গরমকালে ক্লাসের শেষে আমরা মাঝে মাঝে চলে যেতাম পিছনে ফোরশোর রোডের গঙ্গার ঘাটে। তবে যতই যাই করি, বিই কলেজের ছাত্রজীবনের যা মূলত প্রয়োজন, অর্থাৎ সময়ে যাওয়া, নিয়মিত অধ্যায়ন, এবং প্রজেক্টের কাজ – এসবই ভবিতব্যের জীবন …. হচ্ছেই। ছাত্রদের বৈদিক প্রার্থনা ‘সহনা ভবতু সহনৌ ভোলস্তু’র কথা বলেছিলাম, সেটা আমরা আন্তরিক অর্থেই সবৈর্ব প্রয়োগ করেছিলাম।
‘ওঁ শৃনাবধিতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ’…. ফলে প্রতিযোগিতাও আর শুধু প্রতিযোগিতা থাকতো না। ফলস্বরূপ সেরা প্রতিযোগীরাও পরীক্ষার সময়ে পরস্পরকে একটিবার ফিসফিস করে বলতো, ‘হ্যাঁ রে, অত নম্বরের উত্তর কি পেলি?’ আমাদের সময়ে ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটরের নামই কেউ শোনেনি। আমাদের ক্যাল্কুলেশন করতে হতো জার্মানির ফেবার ক্যাসল বা স্লাইড রুল দিয়ে। সেটা দিয়ে হিসেব করে ইঞ্জিনিয়ারিং অঙ্কের উত্তর বার করতে প্রায় যাদুকরের ভেলকি গোছের ব্যাপার ছিলো। এই স্কেল থেকে সেই স্কেল, তারপর উল্টেপাল্টে কোথাও স্লাইডার রেখে, কোথাও সরিয়ে শেষ ফলাফলে পৌছানো যেত। এটা অনেকটা সেতার, বেহালা, বা সাঁতার শেখার সমগোত্রীয় বেহাল সাধনা। এখন মনে হয়, ওই জন্যই বোধহয় সেই প্রথম আমাদের ছেনি দিয়ে লোহা কাটতে বলেছিলো …… শেখাতে। ম্যাট্রিকুলেশনে আমি অঙ্কে ফার্স্ট হলেও, ঐ স্লাইড রুলের টানাটানিতে নিজের থেকে আমার সহপাঠী বন্ধু ন্যাপার (নৃপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী) ওপর ভরষা ছিলো বেশি। হাজার হোক, লক্ষনৌ থেকে বিশাল কৃতিত্ব আর বিদ্যা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো।
একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে। সেটা সম্ভবত থার্ড ইয়ারের ফাইন্যাল পরীক্ষা। স্ট্রাকচারাল এনালিসিস এর পেপার। আমি পুরো অঙ্কটা করে তারপরে সুখেনের (সুখেন্দু চ্যাটার্জি) সঙ্গে উত্তর মেলাতে গিয়ে দেখি আমার উত্তর ওর ধারেকাছে দিয়েও যাচ্ছে না। ডিফ্লেকশনের অঙ্ক। মনে হলো, ওর উত্তরটাই ঠিক। কারণ ডিফ্লেকশনের একটা লিমিট তো আছে। এদিকে পুরোটা আবার শুরু থেকে ঠিক করে করার সময় আর নেই। তখন ফর্মূলা অব্দি যতটা এলজেব্রিক আর নিউমারাল ইনপুটগুলো দেওয়া আছে, তত অব্দি রেখে, বাকিটা কেটে দিলাম। যতটা সম্ভব ন্যাপার উত্তরটা বাগিয়ে মাঝের সব কেটেকুটে উত্তর লিখে খাতা জমা দিয়ে দিলাম। এবার পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেলো, ন্যাপার থেকে সেই বিষয়ে আমি বেশি নম্বর পেয়েছি। সুখেনের তখন বোধহয় কিছুটা রাগ হয়েছিলো, যদিও সেই রাগ বেশিদিন থাকেনি। আসল কথা এসব ছোটখাটো মান অভিমানের থেকে আমাদের বন্ধুত্বটাই অনেক উপরে ছিলো। ইঞ্জিনিয়ারিং এর অঙ্ক প্রথমেই একেবারে নির্ভুল বার করা সব সময় সম্ভব নাও হতে পারে। প্রায়শই ভুল হয়ে যায়। আর এইজন্যই অফিসে কাজ করার সময় এত চেকিং এর ব্যাবস্থা থাকে, যাতে একজনের ভুল অন্যজন ঠিক করে দিতে পারে। শুধু ছাত্র নয়, মাষ্টারমশাইদেরও ভুল হতে পারে। মনে আছে, তখন খুব সম্ভবত আমাদের সেকেন্ড ইয়ার, আমাদের থার্মোডায়নামিক্সের ক্লাসে একজন মাষ্টারমশাই যা করালেন তাতে সাইন থিটার ভ্যালুর রেঞ্জ গিয়ে দাঁড়ালো প্লাস ইনফিনিটি থেকে মাইনাস ইনফিনিটি। তারপর গোঁজামিল দিয়ে তিনি অঙ্কটা ঠিক করে দিলেন। তার পরদিন আমরা ক্লাসে ওনাকে বলতেই, উনি বললেন, আমি দেখছিলাম, তোরা কতটা মনোযোগ দিয়ে আমার ক্লাস করিস। তারপর উনি ভুলটা ঠিক করে দিলেন। আসলে ভুল হলে সেটা মেনে নিয়ে আবার সেই ভুল সংশোধন করাটাও একটা শিক্ষা। এইভাবেই তো আমরা ম্যানেজ করে ম্যানেজার হই। একথা শোনার পর আমার দুই মেয়ে বলেছিলো, যে তাঁরা কোনদিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে না, কারণ এভাবে তাঁরা ম্যানেজ করতে পারবে না। এমনকি আমার কাছে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্কও শিখবে না, কারণ আমি নাকি সবকিছু ম্যানেজই করতে থাকবো।
আমাদের সবথেকে কঠিন বছর ছিলো বোধহয় সেকেন্ড ইয়ার। এখনও সেইরকমই আছে বলে শুনেছি। আমাদের সময় চারটে পেপার খুব কঠিন ছিলো – থার্মোডায়নামিক্স, ড্রয়িং, ইলেক্ট্রোটেকনলজি আর অঙ্ক। এর মধ্যে থার্মোডায়নামিক্স থিয়োরি আর অঙ্কতে আমি খুব কনফিডেন্ট ছিলাম। ড্রয়িংটা আমার হতোই না, আমাকে নিয়ে সবসময় ঠাট্টা করলেও গৌরাঙ্গ (গাংগুলি) এত ভালো ড্রয়িং করতো, বা বোঝাতে পারতো যে ওর সঙ্গে এক হস্টেল থেকে, দূর থেকে দেখে দেখেই শিখে গেলাম, বা শিখলামই না – ড্রয়িং বস্তুটাই যে কি! গোলমাল বেঁধেছিল থার্মোডায়নামিক্সে ল্যাবের খাতা নিয়ে। বিই কলেজের মাষ্টারমশাইরা এমনিতেই নম্বর দিতেন খুবই কৃপণের মতন। কয়েকজন ছিলেন খুব কড়া মানুষ। তা ছাড়াও কয়েকজন খেয়াল রাখতেন কে কে সারাটা বছর এদিক ওদিক গল্প করে কাটিয়েছি। আর সেকেন্ড হাফের ল্যাবের সময়টা ছিলো আমাদের আড্ডা আর তাসাপার্টি। একদিন সেই ল্যাবের নম্বর রিপোর্টখাতা দেখে সত্যরঞ্জন (দাস) ছুটতে ছুটতে এসে বললো, ‘আমরা অনেকেই আশি থেকে নব্বই পারসেন্ট পেয়েছি, কিন্তু তোরটা দেখিনি, বলতে পারছি না।‘ এই “সত্য”কে বিশ্বাস না করে উপায় নেই। দৌড়ে গিয়ে স্যারকে ধরলাম,‘স্যার, আমি কত পেয়েছি?’ স্যার ল্যাবের সব খাতার লটের মধ্যে থেকে আমার খাতাটা বার করে ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘পাবে আর কি? কিছুই পাওয়ার যোগ্য নও। তবু আমি বিয়াল্লিশ পার্সেন্ট দিয়েছি।‘ আমি শুনে বললাম, ‘সে কি স্যার? আমার সব বন্ধুরা আশি নব্বই পার্সেন্ট পেয়েছে, আর শুধু আমিই বেয়াল্লিশ পার্সেন্ট! আমি তো স্যার থার্মোডায়নামিক্স থিয়োরিতে ভালো নম্বর পেয়েছি, প্লিজ দেখুন না রেকর্ড মিলিয়ে।‘ উনি জবাবে বললেন, ‘সে তুমি থিয়োরি পরিক্ষায় কি করেছো, কার থেকে টুকেছো, না নিজে লিখেছো, সেটা কে দেখতে গেছে? এখানে তোমার ল্যাব খাতা ভালো নয়, স্কেচটেচ কিস্যুই ঠিক করে করোনি, টেস্ট রেজাল্ট সব টুকেছো, নম্বর দেবো কি করে? তবে হ্যাঁ, একটা জিনিষ করতে পারো, খাতাটা নিয়ে যাও, সারা বছরের সব এক্সপেরিমেন্ট আবার নতুন করে করো। ভালো করে স্কেচ দিয়ে আবার সুন্দর করে সব লিখে জমা দাও, পুরনো খাতার সঙ্গে। তাহলে আমি আরেকবার দেখতে পারি কি করা যায়!’ বুঝলাম, পুরনো খাতাটা নিতেই হবে কারণ সেখানে স্যারের সব ক্লাসের টেস্ট রেজাল্ট সই করা আছে।
সেই বিভীষিকাময় সেকেন্ড ইয়ারের আর মাত্র তখন চার মাস বাকি। সেই সময় এই যন্ত্রণা। সারা বছরের সব এক্সপেরিমেন্ট আবার করতে হবে, তবু নিরুপায় হয়ে করতেই হলো। নম্বরের এই একটু এদিক ওদিক হলেই আমার স্কলারশিপ আটকে যাবে। তাহলে তো আর পড়তেই পারবো না। সুতরাং নতুন করে সব কিছু নতুন উপায়ে বার করে, তাসখেলা, দিবানিদ্রা সব চুকিয়ে অমিতাভ, অরুণ সবার খাতা টুকে আবার নতুন করে জমা দিলাম। তফাত যে হয়েছিল তা নয়, এবার বিয়াল্লিশের জায়গায় পেলাম চল্লিশ, মহানুভব শিক্ষক, পাশ তো করিয়ে দিলেন।
একই সমস্যা ড্রয়িং পরীক্ষার সময়। একটা কম্পালসরি কোশ্চেন ছিলো, যতদূর মনে পড়ে, প্ল্যান এলিভেশন থেকে সাইড ভিউ আঁকা। সেটাতেই প্রায় অর্ধেক নম্বর। ঘন্টাখানেক ধস্তাধস্তি করে সেটাকে দাঁড় করিয়ে একবার জলটল খাওয়ার নাম করে উঠলাম। সেরেছে!!! কোনই মিল নেই। ওদিকে সুখেনের ছবি আরেক ভঙ্গিমায়। অপূর্ব (দাশগুপ্ত) এঁকেছে এক্কেবারে অন্যভাবে। আর গৌরাঙ্গের ড্রয়িঙটা কান্নি মেরে দেখলাম, আরেকটা দৃষ্টিনন্দন ছবি। মানে দৃষ্টিহীনের হস্তীদর্শন, আর কি! যে যেমন বুঝেছে, তেমনভাবে এঁকেছে। কেউ শুড়, কেউ লেজ, কেউ পা। তখন আর ঐ নিয়ে ভাবার অবসর ছিলো না। বাকিগুলো যেমন পারলাম, করলাম। তারপর ঐ পেপারে যে পাস করেছিলাম, নিশ্চয়ই মা মহামায়ার অকৃপণ আশীর্বাদ ছিলো।
সেই বছর আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনালে সব ব্রাঞ্চ মিলিয়ে দু’শ দশজন ছাত্রের মধ্যে মাত্র বত্রিশজনকে সব পেপারে পাস করিয়েছিলেন আমাদের সদাশয় কর্তৃপক্ষ। এই করেই ত’ আনন্দ, উত্তেজনা, টেনশন, বিবদমান বিশৃংখলার মধ্যেই শৃংখলার বারাবারণ তৈরি করা হতো। আজও মনে হয়, সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষার পর ছুটির সময় অপু আর আমি বসে বসে কতই না দুব্বোঘাস ছিঁড়েছিলাম। আমাদের বন্ধুবৎসলতা, সহমর্মিতা ছিলো অপরিসীম। যেমন অমিতাভ (ঘোষাল) আর আমি পরীক্ষার আগে একসাথে পড়তাম, বা পড়ার ভান করতাম। থার্ড ইয়ারের ফাইন্যালে জিয়োলজি পরীক্ষার আগের দিনের সন্ধ্যাবেলায় আমরা দুজনে মিলে ঠিক করলাম যে দুজনে একসাথে সব মুখস্ত করবো। আর একজন অন্যজনের পড়া ধরবো। অমিতাভ যথাসময়ে আমার ঘরে চলে এলো, আমি বসলাম চেয়ারে, আর অমিতাভ আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়া শুরু করলো। কিছুক্ষন বাদে ভাবলাম, ও শুয়ে শুয়ে আরাম করে পড়বে, আর আমি কষ্ট করে ‘ভার্টিকাল’ হয়ে চেয়ারে বসে কতক্ষন পড়বো? এ হয়না, আমরা জায়গা বদলাবদলি করলাম। অমিতাভকে চেয়ারে পাঠিয়ে আমি সটান বিছানায়। খানিক বাদে টুনটুন আমার রুমে এসে বালিশ টালিশ ঠিক করে আলোটা নিভিয়ে, দরজা বন্ধ করে, কোন শব্দ না করে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। যাকে বলে, নিস্বার্থ স্বভাবসুলভ বন্ধুপ্রীতি, যাতে আমার নাক ডাকার কোন অসুবিধে না হয়। …… রাত তিনটের সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে মনে হলো, আজকের পরীক্ষার একটাও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না …. একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে!
’৫৩ সালের সেই যে কিছু বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেগুলো বিই কলেজে ভর্তি হয়েছিলো, তাঁরা পরবর্তী সময়ে নিজের বিদ্যাশিক্ষার পীঠস্থানের উন্নতির জন্য, এবং নিজেদের পেশাগত উৎকর্ষের যে উদাহরণ বা সাক্ষর রেখেছে, তা অনেকেই অনুসরণ করবে। (প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, আমাদের সময়ে মেয়েরা বিই কলেজে ভর্তি হতে পারতো না, কি হতভাগ্য আমরা। মঞ্জুর নাম লিস্টে দেখে আমরা অনেকেই উৎসাহিত হয়ে ভেবেছিলাম, এবার বোধহয় কোএডুকেশন কলেজে পড়ার সুযোগ হবে।)
আমার দুই মেয়ে আমাকে করুণার চোখে দেখতো। কারণ তাঁরা বড় হয়ে উঠলো, কিন্তু আমার সাহচর্য পেতো শুধুই পড়াশোনা দেখাবার আর অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ানোর সময়। আর যাই হোক, তাঁরা স্কুল থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে আর যাই হোক, ইঞ্জিনিয়ার হবে না কোনোদিন। একজন যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথেই আর্কিটেকচার পড়লো, আর হয়ে গেলো এনট্রোপ্রেনার। অন্য মেয়ে পড়লো ডাক্তারি, হয়ে গেলো কর্পোরেট স্ট্রাটেজিস্ট। আমি তো পাশ করার পর থেকেই হিল্লীদিল্লী ঘুরে বেড়াচ্ছি (এই অভ্যেসটা অর্জন করেছি কলেজের ফোর্থ ইয়ারে পড়ার সময় যখন ট্রেনিং হয়েছিলো পাব্লিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং স্পেশাল পেপার নিয়ে, কি করে নিজের পয়সা খরচ না করে ঘুরে বেড়ানো যায়, ভালো ভালো হোটেলে থেকে খাওয়া-দাওয়া করা যায় …. যাক, সে হলো আলাদা কথা), কিন্তু পেশায় কেঠো ইঞ্জিনিয়ারই রয়ে গেলাম।
আমার সহধর্মী চিরশ্রীর প্রায় তেত্রিশটি বছর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ট মেয়েদের কলেজ দিল্লীর লেডী শ্রীরামে শিক্ষকতা করে ধারণা হলো যে শুধু পড়িয়েই চিন্তা-ভাবনা বা ধ্যানবিকাশ হয় না, তাই এখন এক আন্তর্জাতিক পত্রিকার (প্রতিচী) সম্পাদনা করছে, উদ্দ্যেশ্য পাঁচটি মহাদেশকে চিন্তাভাবনায় সংযুক্ত করা। আমাকে আমার সহকর্মীরা প্রায়ই বলে, তুমি ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ক’টা মহাদেশ যুক্ত করতে পেরেছো? কিন্তু “প্রতিচী” পাঁচটি মহাদেশকে যুক্ত করেছে।“ সে যাই হোক, আমি কিন্তু এখনও এই অছিলায় জোর কদমে কলেজগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর সেইসব তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রছাত্রীদের সংস্পর্শে আসি …. সেই পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় … সেই কলেজ ক্যাম্পাস, সেই প্রথম অনশণ ধর্মঘট (সবাই একসাথে নয়, ক্রমান্বয়ে ছোট ছোট দলে), আর স্টূডেন্ট ইউনিয়নের ইলেকশনের সময় পরমেশ (পরমেশ রঞ্জন ধর) আর গৌরাঙ্গের সেই মিনতি মাখা দুটো চোখ, সবার সাথে কি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা! তখন ওঁদের সাথে দুটো কথা বলতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। ওঁরা ছিলো আমাদের অত্যন্ত কাছের … আবার অনেক দূরের … ঠিক যাকে বলে হিরো হবার সম্পূর্ন উপাদান দিয়ে গড়া।
শিক্ষকরা আমাদের সামনে প্রায়ই কঠিন কঠিন লক্ষ্য বেঁধে দিতেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল পরীক্ষার স্ট্রাকচারাল -II পেপারটা খুবই কঠিন ছিলো। বোধহয় এক অমিয় (বাসু)ছাড়া আর কেউই ঠিকমতন উত্তর দিতে পারে নি। আমরা সবাই তখন একসাথে আমাদের বিভাগীয় প্রধান ডঃ মুখার্জির কাছে গেলাম। উনি আমাদের সব কথাই ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন, আর আমাদের সবাইকেই অনেক বেশি নম্বর দেওয়া হয়েছিলো।
আমাদের মাষ্টারমশাইরা আমাদের যা পাথেয় গড়ে দিয়েছিলেন, দলগতভাবে কাজ (বা অকাজ) করার যে শিক্ষা আমরা পেয়েছিলাম, তার বলেই পেশাগত জীবনে আমরা এতদূর এগুতে পেরেছি। আমাদের মাষ্টারমশাইদের সেই নিষ্ঠা ও ছাত্রদের প্রতি সদাসর্বদা সজাগ দৃষ্টির কথা মনে হলে আজও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
ভিক্টর হুগোর কথায়, No one can resist the idea when time has come আমাদের সবার মধ্যেই ছিলো সেই নব নব উন্মেষশালী “আইডিয়া”। তা না হলে কলেজের শতবর্ষ উদযাপনে তারই সেক্রেটারির নতুন কায়দায় বাইরে থেকে ফেব্রিকেশন করে, আর লাল নীল আলো জ্বালিয়ে নেহরুজীকে Rapid Sand Filtration System দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে পারতাম না।
আসানসোলে সার্ভের সময় থিয়োডোলাইটটা ব্যাবহার করা হতো মণিমালা গার্লস কলেজের দিকে, আর এমনভাবে সেটা সেট করা হতো, যা অমিতাভর হাইটে দেখা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু আমাদের অমিতাভ একলা চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকবে, তা হয় না। তাই অপূর্ব আর আমাকে তাঁর পাশে থাকতে হতো, সান্ত্বনা দেবার জন্য। আমাদের টিমে ছিলো জনা সাতেক। আমাদের সোভাগ্য, অরুণ (দেব) ছিলো আমাদের টিম লীডার। ও সার্ভে, ড্রয়িং, ক্যালকুলেশন সব কিছু করে দিয়ে অদম্য উৎসাহ ও অপূরণীয় ধৈর্য নিয়ে আমাদের কাছে আসতো। আর আমরা তখন “অন্যান্য” নানান কাজে ব্যাস্ত থাকার ফলে পরমেশকে দিতাম চেক করার জন্য। ও প্রায় সাথে সাথেই সব এপ্রুভ করে দিতো, অবশ্য মাঝে মাঝেই এসে আমাদের কাছে জানতে চাইতো, ‘এখন কি সার্ভে হচ্ছে বলতো?’
পরিবর্তনশীল জগতে “পরিবর্তন” ছাড়া আর সব কিছুই পালটায়। তাই এই গোধূলিবেলায়, মনে হচ্ছে আমরা পালটেছি …. স্বভাবে, আচারে, ব্যাবহারে, পারিস্পারিক সম্পর্কে … কিন্তু সেই চারটি বছরে যে মননধারা তৈরি হয়েছিলো … কিভাবে হাসি-তামাসা, ব্যাঙ্গ-কৌতুক, পারস্পরিক ল্যাং মারামারি, … তার মধ্যেও ছিলো এক গ্রন্থনা, অনেকটা নাড়ীর টানের মতন … যেখানে কোন ভেদাভেদ নেই, প্রতিযোগিতা নেই, ছোটখাটো হিংসা-দ্বেষ, মান-অভিমানের বা কান্নি মারার ছদ্মবেশ নেই। আছে শুধু প্রানখোলা আড্ডা …. সবাইকে নিয়ে, কাউকে বাদ না দিয়ে। সেখানেই আমরা আর আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কটা প্রধান ও তুঙ্গে। আর তাই তো আমরা এতটা সফল।
Gathering of a few classmates 4- decades at Lake club: Apurba, Paramesh, Arun, Amitabha…2002
Add comment