সাহিত্যিকা

সাধারণ ঘরে অসাধারণ নারী, আমার চোখে

সাধারণ ঘরে অসাধারণ নারী, আমার চোখে
নারায়ণ প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

অতীতের স্মৃতি পথ দিয়ে হাঁটলে অনেক মানুষের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কতো স্মৃতিই যে মনকে উদাস করে দেয়। আমার কর্মজীবনের প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিলো শাল শিমুল আর লাল মাটির শহর দুর্গাপুর। শহরের এক প্রান্তে সবুজে ঘেরা আমাদের আবাসস্থল ছিলো CMERI কলোনী, যেখানে এক সময়ে আমরা সহকর্মীরা একসঙ্গে থাকতাম, সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতাম। শোকে দুঃখে আমরা পরস্পরের পাশে দাঁড়াতাম। সেই মানুষের ভিড়ে আজও অম্লান কয়েকজন ব্যতিক্রমী নারীর মুখ।

বয়স পঁচাত্তর আমি অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি, আশির দিকে চলেছি। অনেক কিছু ভুলে গেলেও আমি এখনও কয়েকজনকে ভুলতে পারিনি। কয়েকজনের কথা আমি এখানে উল্লেখ করবো, যারা সাধারণ লোকের কাছে অপরিচিতা। নিজের চোখের সামনে দেখা তাদের কীর্তি এবং জীবনের কিছু ঘটনা নিয়েই আমার এই লেখা। ৮ই মার্চ আমাদের নারীদিবস। ভাবলাম তাঁদের কয়েকজনকে স্মরণ করি। আজ চারজনকে বেছে নিলাম, বিভিন্ন ভূমিকায় তাঁরা আমার কাছে হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ।

ঝর্না মজুমদার
১৯৭০ সাল। সেই প্রথম আমি ঝর্ণাকে দেখি। আমি একটা ইন্টারভিউ দিতে আমি CMERI এসেছিলাম। সব ক্যানডিডেটদের মধ্যে চোখে পড়লো একটি মেয়েকে। ছিপছিপে শ্যামবর্ণ গড়ন, মিষ্টি সপ্রতিভ চেহারা। সেদিন আমার মনে হয়েছিলো যদি আজ একজনেরও চাকরি হয় তবে এই মেয়েটিরই হবে। শেষ পর্যন্ত আমার অনুমানই সত্যি হলো। IIT Kharagpur থেকে Computer Science এ B. Tech ও M. Tech ডিগ্রি নিয়ে CMERI তে তাঁর কর্মজীবনের শুরু হলো। এর কয়েক বছর বাদে আমি আবার ইন্টারভিউ দিয়ে CMERI জয়েন করি। তখন অফিসে ঝর্ণার বেশ নাম ডাক। দারুণ ব্রিলিয়ান্ট এবং এফিসিএন্ট ।

১৯৮২ সালে আমি আর ঝর্ণা একসঙ্গে একটা প্রজেক্টের কাজ করি। এরপর আমরা যুগ্মভাবে ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে তিনটে পেপার পাবলিশ করি। তার মধ্যে দুটো পেপার বেস্ট পেপার হিসেবে পুরস্কৃতও হয়েছিলো। আমি মনে করি, ঝর্ণার জ্ঞান ও পারদর্শীতাতেই এই পেপারগুলোর গুণগত মান অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলো ।

ঝর্ণা বিয়ে করেছিলো শেখর মজুমদারকে। শেখর মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। বি ই কলেজে আমার থেকে এক বছর জুনিয়র। ওদের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রেম চলছিলো। ঝর্ণা খুব একটা সুন্দরী না হলেও ছিলো প্রচণ্ড স্মার্ট। আর শেখর সুদর্শন এবং ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতে পারতো। তবে শেখর দীর্ঘদেহি, লম্বা ছয় ফুটের কাছাকাছি। আর ঝর্ণা সে তুলনায় উচ্চতায় একটু খাটো। ওদের একমাত্র সন্তান মিমি, একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে। ১৯৮৪ তে PhD করতে ওরা দুজনে চলে গেলো জার্মানী Karlsruhe ইউনিভার্সিটি তে। Robotics এবং Artificial Intelligence এই সাবজেক্ট এ প্রচুর কাজ করে ঝর্ণা ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে অনেকগুলো পেপার পাবলিস করলো। ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে এসে DRDO র ব্যাঙ্গালোরে Gas Turbine Research Establishment Laboratory তে জয়েন করলো ডেপুটি ডিরেক্টর পোস্ট এ।

অফিস ট্যুরে ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে ঝর্ণা-শেখরদের সঙ্গে দেখা করতে একদিন ওদের বাড়ি গেলাম। সাঁইবাবার একটা বিরাট ফটো ওদের ঘরে সযত্নে রাখা আছে দেখলাম। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ওরা দুজনেই ওনার কাছে দীক্ষা নিয়েছে। প্রায় দু ঘন্টা জমিয়ে আড্ডা হলো। তারপর ডিনার খেয়ে আমি গেস্ট হাউস এ ফিরে এলাম। ঝর্ণা সেদিন নিজের হাতে নানা রকম নিরামিষ ও আমিষ রান্না করেছিলো ।

DRDO থেকে অবসর নিয়ে ঝর্ণা এখন ব্যাঙ্গালোরে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা করছে। ইতিমধ্যে ওর গবেষণার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বহু নামী দামী পুরস্কার পেয়েছে। ওঁদের একমাত্র মেয়েকে ভালোমতন মানুষ করেছে। জার্মানী তে PhD ডিগ্রি নিয়ে মিমি এখন ওখানেই অধ্যাপনা করছে।

উমা দত্ত
উত্তর কলকাতার এক সাধারণ ঘরের মেয়ে। বাবার একটি ছোট মুদির দোকান ছিলো। পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছাতেই স্কুলজীবন শেষ করে উচ্চ শিক্ষার্থে রাজাবাজার কলেজে ভর্তি হয় এবং সেখান থেকে সাফল্যের সঙ্গে M. Tech পাস করে CMERI তে JRF হয়ে কর্মজীবন শুরু করে। তারপরে নিষ্ঠা, অধ্যবসায় এবং মেধা এই সকল গুণের সমন্বয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করে। অটোমেশনের ওপর অনেকগুলি প্রজেক্ট এ কাজ করতে গিয়েই ওর নিষ্ঠার পরিচয় পেয়েছি। ওই প্রজেক্টগুলোর সাফল্যের পেছনে ওর অবদান ছিলো অসামান্য।

শুধু অফিসের কাজ নয়। পরিবারের প্রতিও সে ছিলো যথেষ্ট মনোযোগী। দুই পুত্রসন্তানকে মানুষ করেছিল অত্যন্ত সযত্নে। একজন IIT এবং অন্য জন ISI থেকে পাশ করে কর্ম ক্ষেত্রে উচ্চ পদে আসীন।
বর্তমানে বিধবা মা র দায়িত্ব একার কাঁধে নিয়ে সংসার করছে। মানুষ হিসেবে সে খুবই কোমল স্বভাবের। মানুষের দুঃখে কাতর হয়ে পড়ত। বহু গরীব ছাত্রছাত্রীর পড়ার খরচ নিজে বহন করত। অনেক দরিদ্র মেধাবী ছাত্রছাত্রী আজ ওর সাহায্য পেয়ে স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। সেবা, সৎসঙ্গ এবং সাধনায় বর্তমানে নিজেকে উৎসর্গ করেছে এই অসামান্য নারী।
একটি মধ্যবিত্ত সাধারণ ঘরের মেয়ের এই গল্প যে কোন মেয়ে কে অনুপ্রাণিত করবে।

মৌ নন্দী
NIT দুর্গাপুরের B. Tech এবং M. Tech মেকনিকাল ইঞ্জিনিয়ার। CMERI তেই কর্ম জীবন শুরু। Process Plant ডিজাইনে তাঁর ছিলো প্রচুর জ্ঞান ও দক্ষতা। বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। মায়ের কথা ভেবেই বিয়ে করতে আগ্রহী ছিল না। তারপর মা অনেক বুঝিয়ে জোর করে বিয়ে দিলেন। কিন্তু দাম্পত্য জীবন সুখের হলো না। কয়েক বছর পরে ডিভোর্স হয়ে গেলো। ইতি মধ্যে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। একদিকে বৃদ্ধা মা এবং কন্যা সন্তান, অন্য দিকে অফিসের দায়িত্ব। শুরু হলো জীবন যুদ্ধ। দুর্ভাগ্য কিন্তু পিছু ছাড়লো না। হঠাৎ করে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হল। সেই মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করে একটি অসহায় মেয়ের লড়াই চলতে লাগলো দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। কিছু দিন আগে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো একটি আশ্রমে। জানতে পারলাম এখন সে ক্যান্সার মুক্ত। মা বেঁচে নেই। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বর্তমানে মৌ এর দিন কাটছে গতানুগতিক ভাবে।

অনিতা সেন
ডক্টর বলাই সেনের স্ত্রী অনিতা বৌদির কথা বেশ মনে পড়ে। মনে আছে সেন’দা যেদিন জার্মানী থেকে Advanced Welding Technology র ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এলেন সেদিন সেনবৌদি আমাদের নিজের হাতে নানা রকম পদ রান্না করে খাইয়ে ছিলেন। সেন’দা বেহালা বাজালেন, সেন বৌদি গান করলেন, সেদিন সবাই খুব আনন্দ করেছিলাম । বিশ্বকর্মা পুজোর দুদিন আগে গানবাজনা রিহারসাল হচ্ছিল, সেই সময় হঠাৎই সেন’দার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা উঠলো। দেরি না করে ওনাকে স্থানীয় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সেন’দা চলে গেলেন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। তখন দেড় বছরের পুত্র সন্তান নিয়ে সেন বৌদি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলেন। Compassionate গ্রাউন্ড এ বৌদি CMERI লাইব্রেরিতে চাকরি পেলেন। সামান্য মাইনের চাকরি। সেই শুরু হলো জীবনের লড়াই। সেনবৌদির তখন একমাত্র লক্ষ্য ছেলেকে মানুষ করা। সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকে সারা জীবন নানা বাধাবিপত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন সেনবৌদি। আজকে তাঁর পুত্র ইন্দ্রনীল সেন একজন দক্ষ ফটোগ্রাফার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেনবৌদি মারা গেলেন এই কিছু দিন আগে।

মমতাজ
আমাদের অফিসে কাজ করতো সেলিম। ক্লাস ফোর স্টাফ। ইংরেজিতে নাম সই করতে পারত। বিদ্যের দূর ওই টুকুই। তাঁর পরিবার একটু বড়ই ছিলো। স্ত্রী মমতাজ, দুই ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে সংসার। সংসারটা যাতে মোটামুটি ভালো ভাবে চলে সেদিকে স্বামী স্ত্রী দুজনেরই বেশ খেয়াল ছিল। সেই সঙ্গে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে যথেষ্ট মনোযোগী ছিল। তাই অফিস এবং সংসারের কাজ কর্ম সেলিম খুবই মন দিয়ে করতো। সেলিমের ওর একটা সেলাই মেশিন ছিল। সে অফিস থেকে ঘরে ফিরেই সেলাই এর কাজ শুরু করতো। আমরা যারা অফিস কলোনিতে থাকতাম তারা সেলাই এর ছোটখাটো কাজ ওকেই দিতাম। এই কাজে খুব একটা নিপুণ না হলেও খারাপ কাজ করত না। আমাদের মেয়েদের স্কুলের সেলাই এর প্রোজেক্ট গুলোতেও ওর সাহায্য নেওয়া হতো। সেলিমের দুই ছেলে পড়ত ক্লাস থ্রি এবং টু’তে। ছোট মেয়ে পড়ত ক্লাস ওয়ানে। আর মমতাজ অন্যদিকে ঘরকন্যার কাজ সামলে সেলিমকে সেলাই এর কাজে সাহায্য করত। সেলিমের তিন সন্তানই পড়ত সেন্ট্রাল স্কুলে। পরে দুই ছেলেই বড় হয়ে গেলে তাঁদের পুরুলিয়ার সৈনিক স্কুলে ভর্তি করে দেয়।

আমি সেলিমের বাড়ি প্রায়ই যেতাম। টুকিটাকি সেলাই এর দরকারে। দেখতাম সেলিমের বৌ কত যত্ন সহকারে তার ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে খেয়াল রাখছে। আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগতো কিভাবে একটা প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে তার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া সন্তানদের অক্লেশে লেখা পড়ায় সাহায্য করছে! সেলিমকে কৌতুহল বশে একদিন জিজ্ঞেস করলাম – সেলিম তোমার বৌ কোন ক্লাস অবধি পড়েছে? ও বললো – বৌ ক্লাস টেন অবধি পড়েছে। তবে ক্লাসে সে বরাবরই ফার্স্ট হতো। শুনে আমি বেশ খুশী হলাম। খুব ভালো লাগলো। সেলিমকে জিজ্ঞেস করলাম- — স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল?
– না ঐ সময়ে টাইফয়েড হয়ে যায়। তারপরে এক বছর যেতে না যেতেই ওর বাবা মারা যায়। আরও এক বছর পরে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।
– তোমার বৌ কে একটু ডাক তো, আলাপ করবো।
ভেতর থেকে ওর বৌ কে ডেকে নিয়ে এলো। জানালো – বৌ রুটি বেলছিল আর বড় ছেলেটাকে একটু পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিল।
বৌ নমস্কার করে সামনে এসে দাঁড়াল। দেখলাম হাতে আটার গুঁড়ো লেগে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম – মমতাজ তুমি কোন স্কুলে পড়াশোনা করেছো?
– বর্ধমান জেলার সাতগেছিয়া গ্রামে। স্কুলের নাম সাতগেছিয়া বালিকা বিদ্যালয়।
– আচ্ছা তুমি তো বাংলা মিডিয়ামে পড়েছো। ইংরেজি মিডিয়ামের বইটই পড়াতে কোন অসুবিধা হয়না?
– না, অতটা নয়। স্যার আমি ইংরেজি মিডিয়ামের বিভিন্ন বিষয়ের বই নিয়ে পড়ি এবং শেখার চেষ্টা করি। কলোনির সিনিয়র ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে কিছু বই জোগাড় করেছি। তাছাড়া বিয়ের আগে এক বছর টিউশনি করি। ক্লাস এইট নাইনের ছেলেমেয়েদেরও এক বছর পড়িয়েছি।
– খুব ভালো। এখানে দাঁড়িয়ে তোমার পড়ানো মন দিয়ে শুনছিলাম। একাধারে সংসার সামলাচ্ছ আবার ছেলে মেয়েদেরও যত্ন নিয়ে পড়াচ্ছ দেখে খুব ভালো লাগলো। আমি বলে যাচ্ছি একদিন তোমার ছেলে মেয়েরা খুব ভালো মানুষ হবে।
সেলিমের বৌকে অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
কালক্রমে সেলিমের ছেলেরা আলিগড় ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে‌‌। বড় ছেলে গবেষণা করতে জার্মানি চলে যায়। জার্মানি থেকে ফিরে দিল্লি আই আই টি তে অধ্যাপনা শুরু করে। শুনেছি অন্য ছেলেটিও অধ্যাপক আলিগড় ইউনিভার্সিটতে। আর মেয়েটি যাদবপুর থেকে পাস করে ইংলিশ অনার্স নিয়ে ।

সেলিম অবশ্য তার ছেলে মেয়ের এই সাফল্য দেখে যেতে পারেনি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ সে মারা যায় রিটায়ারমেন্টের পরে পরেই। তারপরই শুরু হয় মমতাজের আর এক কঠিন লড়াই। স্বামীর অভাবে একার কাঁধেই সে তুলে নেয় সব দায়িত্ব।
সেলিমের তিন ছেলে মেয়ে জীবনে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।
প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মেয়ের এবং অসহায় মায়ের অবিরাম সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ সত্যি সার্থক হলো।

Sahityika Admin

Add comment