সাহিত্যিকা

রানার

রানার
অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

খেলাধুলা নিয়ে একটা গল্প লেখার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। সেই চেস্টাই করলাম। জানি না, জিনিষটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আরেকটা কথা, এই কাহিনীর সব চরিত্রই কাল্পনিক। যদি কোন মিল দেখা যায়, সেটা হবে নিতান্তই কাকতালীয়।
—————————-

ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টের ফ্রেশারস ওয়েলকামে সিনিয়র ছেলেরা অঞ্জনাকে একেবারে ছেঁকে ধরেছে। এমনিতেই কলেজের ছেলেরা বলে ওদের কলেজ ক্যাম্পাস একটি মরুভূমি। এক একটা ইয়ারে যদি আড়াই’শো ছেলে পড়ে, সেখানে মেয়েদের সংখ্যা মাত্র গুটি পাঁচ ছয়েক। সহজ হিসাবে কলেজে, বা ক্যাম্পাসে আছে বারো’শ ছেলে আর তিরিশটি মেয়ে। আর এই মেয়েরা আছে শুধুমাত্র ইলেকট্রনিক্স আর আর্কিটেকচার, এই দু’টো ডিপার্টমেন্টেই। এই বছরে ইলেকট্রনিকস ডিপার্টমেন্টে একটিই মাত্র নতুন মেয়ে এসেছে। আর সেই কারনেই ওদের ডিপার্টমেন্টের ফ্রেশার’স ওয়েলকামে সিনিয়র ছেলেরা অঞ্জনার উপর যেন হামলে পড়েছে।

অঞ্জনা এমনিতে স্মার্ট। কিন্তু ১২০০ বনাম ৩০, এই অনুপাতের পরিবেশে কলেজের হাওয়া বুঝতেই ওর কয়েকদিন কেটে গেলো। এখন ওঁদের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ফ্রেশারস ওয়েলকাম হয়ে গেছে। আজ ডিপার্টমেন্টের ফ্রেশারস ওয়েলকাম। সিনিয়ররা শুরুতে যখন ফ্রেশারদের সাথে আলাপ করে ওদের কয়েকটা স্ট্যান্ডার্ড ফর্মুলা আছে। হোস্টেলে র‍্যাগিং এর সময় আলাপের পদ্ধতি একরকম, আর ডিপার্টমেন্টে একেবারেই অন্যরকম। তখন তাঁরা খুবই ভদ্র, বিনয়ী।

শুরুতে ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট সেক্রেটারি একটা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে ভাষন দিলেন। তারপর হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট, আর অন্য টিচাররা। তারপর ওনারা চলে যাওয়া মাত্রই সকলের মনের ছাইচাপা পুলক যেন জেগে উঠলো। বলাই বাহুল্য, পুলকের কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই অঞ্জনা। প্রায় গোটা পঁচিশেক সিনিয়র ছেলে ওকে ঘিরে ধরলো।

সবার আগে থার্ড ইয়ারের জয়ন্তদা। প্রথমে কি নাম, কোথায় থাকো, কোন স্কুল এইসব সাধারণ প্রশ্ন। তারপর আসল জায়গায়, “একটা গান শোনাও।” অঞ্জনা গান জানে, কিন্তু এই ভর দুপুরে বিনা কারণে কেন সে এদেরকে গান শোনাবে? সাফ বলে দিলো যে সে গান গাইতে পারে না। “তাহলে নেচে দেখাও।” অঞ্জনা নাচ শেখেনি, নাচতে জানে না, ইচ্ছেও নেই। “কেন? হিন্দি সিনেমার যে কোনো একটা গানের সাথে নাচো।” অঞ্জনা সিনেমাও দেখে না। “আচ্ছা, একটা প্রেমের ডায়লগ শোনাও।” অঞ্জনা প্রেমও করে না। এবার ছেলেদের মাথায় হাত। এ কোন ক্যাটাগরির মেয়ে? নতুন বছরে আমাদের ডিপার্টমেন্টে মোটে একটাই মাত্র মেয়ে, অথচ সে গান জানে না, নাচ জানে না, সিনেমা দেখে না, প্রেম করে না। তাহলে কি কারণে তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছো? অঞ্জনা তাজ্জব। ইঞ্জিনিয়ারিনং পড়তে হলে এগুলো যে শিখে আসতে হয়, সেটার সে আগাম খবর পায় নি। “তাহলে তুমি কি জানো? ক্রিকেট, ফুটবল খেলতে জানো?” এবার অঞ্জনার মুখে হাসি, “না না, ক্রিকেট ফুটবল নয়, এথলেটিক্স কিছুটা পারি। আমি রানার।” অঞ্জনা ধরে নিয়েছে, আর যাই হোক, এরা নিশ্চয়ই ক্লাসরুমের মধ্যে ওকে দৌড়াতে বলবে না। সিনিয়র যারা ওকে ঘিরে ধরেছিল সেই জয়ন্ত, প্রদ্যুত, তমাল, ভোলানাথ, তরুন, ক্ষমাদাস, বিপ্রাশীষ, দেবাশীষ, অরবিন্দ অনেকেই ফিউজড। অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সবাই যে এই মেয়েটাকে ঘিরে ধরেছিলো, আর সে বলে কিনা সে একজন রানার? এই রানার বস্তুটা কি?

দেবাশীষ অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা বলার সুযোগ খুঁজছে। রানার বস্তুটা ওর বোধগম্য হয়নি। রানার বলতে সে গ্রামের পোস্টম্যান বোঝে। সলিল চৌধুরীর গান আছে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন। ব্যাপারটা ভালোরকম না বুঝে দেবাশীষ মুখও খুলতে চাইছে না, নিজেই যদি খোরাক হয়ে যায়? কিন্তু অরবিন্দ বুঝেছে। “তুমি রানার? আচ্ছা, তাহলে দৌড়ে দেখাও।”
– তাহলে চলুন মাঠে যাই, আপনিও দৌড়াবেন আমার সাথে। একশ মিটার, কিন্তু বাজি ধরে। এমনি এমনি আমি দৌড়াবো না। বাজি ধরে, তবেই। আর আপনি যদি হেরে যান, তাহলে কি হবে?
অঞ্জনার প্রশ্ন শুনে এবার অরবিন্দ ফিউজড। বাকি সকলেই চুপ। উপস্থিত সিনিয়র দিদিরা স্মৃতি, ইন্দ্রাণী, বন্দনা, পম্পা, এরা কিন্তু খুশি। ছেলেগুলো সুযোগ পেলেই এদের প্রচুর বুলি করে। যাক, তাহলে এতদিনে একটা মেয়ে নতুন এসে একলাই এতগুলো ছেলেকে চুপ করিয়ে দিতে পারলো।

কিন্তু অঞ্জনা যে রানার, কয়েকদিনেই গোটা ক্যাম্পাসে এই কথাটা এবং তার সাথে নামটাও প্রচার হয়ে গেলো। কলেজের ছেলেমেয়েদের অনেকেরই কলেজের খাতার অফিসিয়াল নাম ছাড়াও একটা জনপ্রিয় নাম থাকে। ছেলেরাই দিয়ে থাকে। সেই নামেই ওদের পরিচিতি। কলেজে তখন অঞ্জনার সবে তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। সেই শুরুতেই অঞ্জনার নাম হয়ে গেলো রানার। যখন সে হোস্টেল থেকে কলেজ যায় বা ফিরে আসে, তখন ফিফথ ইয়ারের ছেলেদের হোস্টেলের জানালা থেকে গান চালু হয়ে গেলো রানার চলেছে তাই ঝুমঝুম নুপুর বাজছে পথে। রানার চলেছে ফাইলের বোঝা হাতে। রানার রানার চলেছে রানার। অঞ্জনা ভাবে কি কুক্ষণেই যে ডিপার্টমেন্টের ফ্রেশারস ওয়েলকামে ছেলেগুলোকে বলেছিল সে রানার। আবার নিজের মনে আনন্দও হয়, তাঁর মনে হয় যে এই নামকরনে একটা গৌরবও আছে। আর অন্যান্য অনেক মেয়ের যে সমস্ত নাম সে এই ক’দিনে জেনেছে, … এর থেকে রানার নামটা অনেক বেটার।

স্কুলে অঞ্জনাদের খেলার খুব ভালো ব্যাবস্থা ছিলো। সাউথ ক্যালকাটা ডিসট্রিক্ট গার্লস স্কুল, বিরাট মাঠ। ট্র্যাক আর ফিল্ড ইভেন্টের অনেক সুযোগ। অঞ্জনা স্প্রিন্ট ছাড়াও লং জাম্প, হাই জাম্পে প্রাণ ভরে প্র্যাকটিস করেছে। বাড়ি নিউ আলিপুরে, রিমন্ট রোডে। সেখানে পাড়ায় মেয়েদের খেলাধুলার বিশেষ ব্যাবস্থা ছিল না। তাই মনের আনন্দে অঞ্জনা স্কুলেই নিজের সাধ মিটিয়েছে। প্রতি বছর স্কুলের এন্যুয়াল স্পোর্টসে ৭৫ মিটার, একশ মিটার, দুশো মিটার আর চারশো মিটারে ফার্স্ট প্রাইজ নিয়ে আসতো। এ ছাড়াও লং জাম্প আর হাই জাম্পে। প্রতি বছর স্কুলের অনেকগুলো ফার্স্ট প্রাইজ ওর ছিলো বাঁধা। সেই স্পোর্টসের দৌলতেই অঞ্জনাকে স্কুলে সকলেই চিনতো।

স্কুলের শেষে কলেজে ভরতির সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অঞ্জনাদের এডমিশন আর সেশন শুরু হলো অনেক দেরীতে। জুলাইতে শুরু না হয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। তখন শীতকাল। জানুয়ারিতে কলেজের এন্যুয়াল স্পোর্টস। অঞ্জনা হোস্টেলের বারান্দা থেকে দেখতে পায় ওভাল মাঠে ছেলেরা প্র্যাকটিস করে। রানিং ট্র্যাক ছাড়াও মাঠের অন্যদিকে আছে হাইজাম্প, লংজাম্প, আর পোলভল্ট কোর্ট। ছেলেরা সব সেখানে প্র্যাকটিস করছে। ওদের হোস্টেলের একদম সামনে গ্যালারীর গায়ে লাগানো ভলিবল কোর্ট। সেখানেও খেলার উত্তেজনা। নিজের ঘরের জানালা থেকে যখনই ওভাল মাঠকে দেখে, মনে হয় মাঠ যেন তাঁকে ডাকছে। সে হস্টেলের কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে, যদি একসাথে মাঠে নেমে কিছু খেলাধুলা করা যায়। “তুই ক্ষেপেছিস? ছেলেরা এক্কেবারে তোকে খোরাক করে ছেড়ে দেবে”, হস্টেলের দিদিরা উল্টে সাবধান করে দেয়।

অঞ্জনার মনে একটা জেদও চেপেছে। রোজ ফাইন্যাল ইয়ারের হোস্টেল থেকে ওর উদ্দেশ্যে গান ভেসে আসে। সবাই ঠাট্টা করে ওকে নাম দিয়েছে রানার। সে চায়, এই কলেজে ওই ছেলেদের চোখের সামনেই সে নিজের রানার নামের সার্থকতা প্রমাণ করবে। মুশকিলটা এই যে এখানে কলেজে মেয়েদের খেলাধুলার সুবিধে প্রচুর আছে, কিন্তু মেয়েদের নিজেদেরই কোনো উৎসাহ নেই। হোস্টেলের সামনের লনেই ব্যাডমিন্টন আর ভলিবল কোর্ট আছে, একটা মেয়েও খেলতে নামে না। বছরে শুধু কয়েকজন মিলে এন্যুয়াল স্পোর্টসের দিনে মাঠে আসে। তাও শুধুমাত্র একটা পঞ্চাশ মিটার ফ্ল্যাট রেসের জন্য। “আমি না, তুই যা” এইসব করে করে কোনোরকমে চার পাঁচজন অনিচ্ছুক মেয়েকে নিজেরাই ঠেলে পাঠায়। ব্যাস ওইটুকুই। কারণ স্পোর্টস পুরো বয়কট করলে তো ছেলেদের কাছে প্যাঁক খেতে হবে।

অঞ্জনা এসব গত কয়েকদিনে শুনেছে। ওদের হোস্টেলের সামনেই কলেজের জিমন্যাসিয়াম, হেঁটে এক মিনিটও লাগে না। ওর সিনিয়র পম্পাদি লেডীস হোস্টেলের স্পোর্টস রিপ্রেসেন্টেটিভ। অঞ্জনা নতুন এসেছে, জিমে একা যেতে সাহস পায় না, পম্পাদিকে বেশ কয়েকবার বলেছে যদি সঙ্গে করে একবার নিয়ে যায়। পম্পাদিরও মহা বিপদ। ভালোই ছিল। স্পোর্টস রিপ্রেসেন্টেটিভ। কাজ বলতে বছরে দু একটা মিটিঙে উপস্থিত থাকা, বছরে এথলেটিক্স ক্লাবের একটা গ্রুপ ফটো, আর এন্যুয়াল স্পোর্টসের দিনে মেয়েদের ধরে বেঁধে মাঠে নিয়ে আসা। এই তিন নম্বর কাজটাই যা একটু কঠিন। এবছরে অন্য কেউ হতে রাজি হলো না, তাই হোস্টেলের মেয়েরা জোর করে ওকেই এবছরের জন্যও স্পোর্টস রিপ্রেসেন্টেটিভ বানিয়ে দিয়েছে।

পম্পাদি বুঝে পায়না এই নতুন মেয়েটা একলা একলা এতগুলো ছেলের মাঝে কি দৌড়াবে? অঞ্জনার রানার নামটাও এখন লেডীস হোস্টেলে সকলেই জেনে গেছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পম্পাদি অঞ্জনাকে এথলেটিক্স ক্লাবে নিয়ে গেলো। অঞ্জনার তিন বছরের সিনিয়র, মেকানিক্যালের তরুণ ব্যানারজি এখন কলেজের ফিল্ড আর ট্র্যাক ইভেন্টসের ক্যাপ্টেন। পম্পাদি তরুনদাকে আগেই অঞ্জনার কথা বলে রেখেছিলো। অঞ্জনা যখন পম্পাদির সাথে ক্লাবে পৌঁছালো, তরুণদা তার আগেই সেখানে এসে গেছে।

দেবেশ দাস কলেজের এথলেটিক্স ক্লাবের ইন্সট্রাকটর। আঠারো বছর এখানে আছেন, সবাই ওনাকে দেবেশ’দা বলেই সম্বোধন করে। এতদিনের কলেজ জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন, কিন্তু একটি মেয়ে এসে ট্র্যাক ইভেন্টে নিয়মিত প্র্যাকটিস করবে, এরকম ইচ্ছে বা দাবি আজ পর্যন্ত কেউ এসে জানায় নি। সত্যি বলতে কি, এরকম যে হতে পারে, সেটাও তিনি একবারও ভেবেও দেখেন নি। তাই আজ যখন অঞ্জনার ইচ্ছেটা জানতে পারলেন, উনার মাথায়ই এলো না, যে কিভাবে এর সমাধান হতে পারে। “তরুণ, তুমিই দেখো, কি করা যায়।” দেবেশদা তরুণদাকে দায়িত্ব ট্রান্সফার করে দিয়ে যেন মুক্তি পেলেন।

জিমের মধ্যে চারিদিকে প্রচুর ছেলেদের মাঝে তরুণদা অঞ্জনার সাথে কথা বলতে চাইলো না। এমনিতেই দু’টি মেয়ে জিমে এসেছে দেখে ছেলেরা সব উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে দিয়েছে। তার মধ্যে একটা নাকি আবার নতুন মেয়ে। সকলেরই উৎসাহ এই নতুন মেয়েটাকে একটিবার দেখতে হবে। আর অঞ্জনা যতই স্মার্ট হোক, এতগুলো অচেনা ছেলের আগ্রাসী চাহনির মাঝে ঠিক স্বস্তিও পাচ্ছে না।

তরুণদাও বুঝেছে অঞ্জনা এই জিমের মাঝে ঠিক স্বাভাবিক হতে পারবে না। তরুণদা অঞ্জনাকে ওভাল মাঠে নিয়ে এলো। প্রথম দিনে মাঠের এদিক ওদিক হট্টগোলের মাঝে অঞ্জনা নিজের মনের কথা হয়তো বলতে পারবে না। গ্যালারীতে অনেক ছেলেরা বসে আছে, ওখানেও হবে না। তরুণদা অঞ্জনাকে নিয়ে এলো ওভাল মাঠের কোনে ক্রিকেটের প্যাভিলিয়নের সামনে, এখানটায় ভিড় একটু কম। সে নিজেই ওকে অনেকটা সহজ করে দিলো “তোকে কি নামে ডাকবো? অঞ্জনা না রানার?” যদিও এই প্রশ্নের জন্য অঞ্জনা প্রস্তুত ছিল না তবু প্রশ্নটা ভালো লাগলো। একটু ভেবে জবাব দিলো “আপনি যদি আমায় রানার নামে ডাকেন, সেটাই আমার বেশী ভালো লাগবে।”
– ওয়ান্ডারফুল। ওয়ান্ডারফুল। আই থিংক, তোর মধ্যে একটা জেতার স্পিরিট আছে। পম্পাও তোর কথা বলেছে। দাঁড়া, দেখছি। তোর জন্য কিছু একটা ব্যাবস্থা করতে হবে।

ক্রিকেট প্যাভিলিয়নের সিমেন্টের বেদিতে বসে তরুণদা বললো “এবার বল, আমি আগে শুনি, তুই কি চাইছিস?” অঞ্জনা খানিকক্ষণ চুপ থেকে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে উত্তর দিলো “দাদা, আমি স্কুল থেকেই স্পোর্টসে অনেক প্রাইজ নিয়ে আসছি। ওখানে অনেকে মিলে মাঠে নামতাম। কিন্তু এখানে তো আমি একা হয়ে গেলাম। ওদিকে ঠাট্টা করে সবাই আমায় রানার নাম দিয়েছে। গান তৈরি করে আমার পায়ে নুপুর পরিয়েছে। যারা আমায় ঠাট্টা করেছে, আমি চাই তাঁরাই এবার আমায় রানার নামের সম্মান দিক। আমি ট্র্যাকেই নামতে চাই।”

তরুণদা এরকম পরিস্থিতিতে আগে পড়ে নি। ছেলেদের স্পোর্টস সামলানো তাঁর কাছে জলভাত। একটা মেয়ে একলা রোজ এই ওভালে প্র্যাকটিস করবে, কঠিন হলেও সেই ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু এই শত শত ছেলের কৌতুহলের সামনে অঞ্জনা একলা হয়ে কতটা ফ্রি হতে পারবে সেটাই প্রশ্ন। তরুণদা বুঝতে পারছে না, কি বলবে। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে অঞ্জনা সিরিয়াস, একটা চ্যালেঞ্জ সে নিতে চায়। এটাই তরুণদার কাছে এখন বড় দায়িত্ব।

তরুণদা এথলেটিক্সের ক্যাপ্টেন, তাই অঞ্জনার খেলাধুলার ব্যাবস্থা করা এখন তার উপরেই। কিন্তু বাস্তব সত্যটা অন্যরকম। অঞ্জনা এমন একটি কলেজে পড়ে যেখানে গোটা কলেজ বিল্ডিঙে একটাও লেডীস টয়লেট নেই। হ্যাঁ, আশ্চর্যের হলেও এটাই বাস্তব সত্য। সেখানে একটি মেয়ে মাঠে নেমে ট্র্যাক ইভেন্টে এতগুলি ছেলের মাঝে একা একা রোজ প্র্যাকটিস করবে?

তরুণদা জবাব দিলো “বুঝলাম রানার। মাই প্রমিস, আমি তোকে তোর প্র্যাকটিসের ব্যাবস্থা করে দেবো, তবে আমায় খানিকটা সময় দে। কিন্তু আমারও একটা দাবী আছে।”
– বলুন দাদা।
– দ্যাখ রানার। তুই যাই দৌড়াবি, সেটাই কলেজের রেকর্ড হয়ে যাবে। কারণ তোর আগে পঞ্চাশ মিটারের বেশী কোনো মেয়ে এখানে দৌড়ায় নি। আমি চাই তুই ছেলেদের বরাবর রেকর্ড করবি।
অঞ্জনা অবাক হয়ে শুনলো। ছেলেদের বরাবর রেকর্ড করতে হবে?
তরুণদা একটু থেমে আবার বললো “কিরে, পারবি তো?”
অঞ্জনা চেয়ে রইলো তরুণদার দিকে। “আপনি কি খেপেছেন? অলিম্পিকেও কি কোনো মেয়ে ছেলেদের টাইম ম্যাচ করাতে পেরেছে?”
– আমি কি তাই বলেছি রানার? আমি বলেছে, ওদের বরাবর তোকে হ’তে হবে। মানে ছেলেরা যদি দশ সেকেন্ড সময় নেয়, তুই খুব বেশী হলে বারো সেকেন্ড নিবি। চোদ্দ পনেরো সেকেন্ড নয়। আমার এই চ্যালেঞ্জটাই তোকে নিতে হবে। শোন রানার। টার্গেট না থাকলে চ্যালেঞ্জ হয় না।

অঞ্জনা শুনছে। পারবে না এই কথাটাও সে কিছুতেই বলবে না, কিন্তু তরুণদা যে চ্যালেঞ্জটা দিচ্ছে সেটাও অত সহজ নয়। তরুণদাও অঞ্জনার মনের ভাব বুঝতে পেরেছে। তবে আজকে প্রথম দিনেই ওকে বেশী প্রেসারও দিতে চায় না। নিজেই প্রসঙ্গ সহজ করে দিলো “ঠিক আছে। আজকে আর না, কালকে জিমে আয়। এখন আমায় তোর জন্য অনেক কিছুর ব্যাবস্থা করতে হবে। কাল তোর সাথে কথা আবার বলবো।”

পরের দিন বিকেলে তরুণদা আবার অঞ্জনাকে ওভাল মাঠে নিয়ে গেলো। “শোন। শুরু করার আগে একটা শপথ নেওয়া দরকার। টার্গেট ছাড়া চ্যালেঞ্জ হয়না। এখানে টার্গেট মানে টাইম। এটা তিয়াত্তরের জানুয়ারি। তিন বছর, মানে ছিয়াত্তরের জানুয়ারির মধ্যে তোকে আমার দেওয়া টাইমগুলো ম্যাচ করতে হবে। চ্যালেঞ্জ?”
আজকে অঞ্জনা অনেকটাই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে।
– ইয়েস দাদা, চ্যালেঞ্জ নিলাম। মাই প্রমিস। কিন্তু টাইমগুলো?
– বলছি, বলছি। ভালো করে শোন। ছেলেদের পঞ্চাশ মিটারের ইভেন্ট নেই, তাই রেকর্ডও নেই। একশ মিটারে আমাদের তরুণ চক্রবর্তীর রেকর্ড ১১.১ সেকেন্ড। সেই ছেষট্টি সালে করেছিলো। আর দুশো আর চারশো মিটারের রেকর্ড আছে অজয়দার। অজয় দেবনাথ। কয়েক বছর আগে করেছে। দু’শো মিটারে ২৭.২ সেকেন্ড। চার’শো মিটারে ৪ মিনিট ৩৮.৭ সেকেন্ড। এগুলো সব এখনের কলেজ রেকর্ড। এবার তোর টার্গেট তোর নিজেকে ঠিক করতে হবে।
– চ্যালেঞ্জ নিয়েছি দাদা, চেষ্টা করবো, আর যতটা পারবো, কাছাকাছি আসবো।
– নো, নো। হোয়াট ডু ইউ মীন বাই যতটা পারবো? ইজ ইট ইওর টার্গেট?

খানিক থেমে তরুণদা আবার শুরু করলো, “ড্যু ইউ নো, আমি নিজেই নিজেকে একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছি? আমার নিজেকে করা চ্যালেঞ্জ এই যে আমিও তরুণদার মত, অজয়দার মত ট্র্যাক ইভেন্টে নিজের কোন একটা রেকর্ড করবো, আর কলেজের রেকর্ড বুকে আমার নাম থাকবে।“

অঞ্জনা বুঝলো “চেষ্টা করবো” উত্তরটা তরুণদা মেনে নেয়নি। তরুণদা বলে চলেছে “টার্গেট না থাকলে স্পোর্টসে সাকসেস আসবে না রে রানার। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ট্রফি জিতবে সেই ইচ্ছেতেই মাঠে নামে। মিলখা সিং একটা টার্গেট নিয়েই মাঠে নেমেছিলো। এইজন্যই ওরা বাকীদের থেকে আলাদা। তুই কালকেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিস যে তোর রানার নামের মর্যাদা রাখবি। আর এখন বলছিস চেষ্টা করবো, যতটা পারবো। সো হুইচ ওয়ান ইজ ইওর ফাইন্যাল ওয়ার্ড?”

অঞ্জনা মাথা নিচু করে শুনছে। আরও একটু থেমে তরুণদা বললো, “শোন, আমিও একজন এথলিট, তোরই মতন। বিরাট কেউ আমি নই, কিন্তু আমিও কলেজ থেকে পাস করার আগে, একশ, দু’শ বা চার’শ এর যে কোনো একটাতে রেকর্ড করে, তবেই যাবো। মাঠে শুধু চারপাক দৌড়ানোর জন্য বা বছরে একটা মেডেল পাওয়ার আমি রোজ এখানে আসি না। আর তুইও কি রোজ দু’পাক দৌড়ানোর জন্য এই মাঠে আসছিস? ভেবে দ্যাখ।”

তরুণদা ঠিকই বলছে, ও তো নিজেই বলেছে রানার নামের মর্যাদা রাখবে। তরুণদা বললো “মুখটা তোল। ওই দ্যাখ মাঠের ওই পারে, ওই দূরে কোনে একটা বেঁটেমতন ছেলে একলা একলা পোলভল্ট প্র্যাকটিস করছে। একলা, একদম একলা লড়ে যাচ্ছে। আমারই ব্যাচের। সিভিলের সঞ্জয় চক্রবর্তী। দ্যাখ, একা একা কিরকম প্র্যাকটিস করে চলছে। রোজ আসে। ওর হাইট জানিস? পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। এই হাইট নিয়ে ও সাড়ে আট ফুট পোলভল্ট জাম্প করছে। এই হাইট নিয়ে ও কলেজ টিমের বাস্কেটবল প্লেয়ার। কি করে করছে? কারন একটাই। এটাই ওর চ্যালেঞ্জ। নইলে এই হাইট নিয়ে কেউ পোলভল্টে আসে না, বাস্কেটবলও খেলে না।”
অঞ্জনা খেয়াল করেছে। “পাশেও তো একজনকে দেখছি।“
– পাশের ছেলেটা শিশির ঘোষাল, হাইটের এডভান্টেজ আছে। পোলভল্টে আমাদের কলেজ রেকর্ড আছে ৯ ফুট ৪ ইঞ্চি। অশোকদার, অশোক মুখার্জীর। ১৯৬৯ ব্যাচের। মানে আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে, সেই ইয়ারে অশোকদা পাশ করে চলে যায়। ও ছিলো স্ট্রং ম্যান, ডিসকাস থ্রোতেও ১১৩ ফুটের কলেজ রেকর্ড আছে।

এবার আঙুল তুলে দেখাল গ্যালারীর দিকে “ওই দ্যাখ, যারা ভলিবল খেলছে, অনন্তদা, দুর্গা, তোদের ব্যাচের গোটো, এদের হাইট কত? ওখানে কতজন ছ’ফুটের ওপর লম্বা? একজনও নয়। তাহলে ওরা কি করে ভলি খেলছে? কি করে দু আড়াই ফুট স্পট জাম্প করে স্ম্যাশ করছে? কারণ এটাই হ’লো জেদ রানার, সিমপ্লি জেদ। তোকেও ওই জেদটাই আনতে হবে। ভুলে যাস না, এটা মেইনলি ছেলেদের কলেজ, জেদ না থাকলে তোর কাজ অত সহজ হবেনা রে রানার। হবে না। তাই এখনও ভেবে দ্যাখ।”

অনেক বকাঝকা করে এবার তরুণদা একটু থামলো। ডোজটা কি বেশী হয়ে গেছে? মেয়েটা আবার ভয়ে পালিয়ে না যায়। তরুণদা কিছুটা ভয় পেয়েই কথাটা এবার একটু ঘুরিয়ে দিলো। বললো “কাম অন রানার। ইউ হ্যাভ তো উইন। তুই শুধু তাড়াতাড়ি একটা ট্র্যাক স্যুট আর রানিং শ্যু কিনে নে। জিমে তোর জন্য আমি আলাদা করে ড্রেসিং রুম করে দিতে পারবো না, তবে পাশেই তো তোর হোস্টেল। ওখান থেকেই তোকে রোজ রেডি হয়ে আসতে হবে।“

অঞ্জনা মাথা নেড়ে সায় দিলো। “আর হ্যাঁ, তুই সাইক্লিং জানিস?”
অঞ্জনা সাইক্লিং অল্প অল্প জানে। “তোকে রেগুলার সাইক্লিং করতে হবে, এত পায়ের মাসল পাওয়ার বাড়ে। বেস্ট হ’তো যদি তোর জন্য লম্বা টানা স্যান্ড বেড পেতাম। শুকনো বালির ওপর দৌড়ালে সবথেকে ভালো, কিন্তু আমাদের এখানে সেই সুবিধে নেই। ওই লং জাম্প কোর্টে খানিকটা আছে, খুবই সামান্য, মাত্র পনেরো ফুট মতন, ওতে হবে না। তাই সাইক্লিং কর। পায়ের জন্য সবথেকে ভালো এক্সসারসাইজ। পায়ের জোর বাড়বে।”

অঞ্জনা সবই শুনলো। তরুণদার বেশীরভাগ কথাই ঠিক ধরতে পারছে না। তবে এটা বুঝেছে যে তরুণদা সিরিয়াসলি ওকে প্র্যাকটিস করাবে। এ ছাড়া ট্র্যাক স্যুট, রানিং শ্যু আর সাইকেলটাও বুঝেছে। এই শনিবার বাড়িতে গিয়ে বলতে হবে, জানে না কতটা আদায় করতে পারবে। অঞ্জনার বাবা সরকারী কাজ করেন, মা স্কুলে টিচার। ভাই এখনও ছোট, স্কুলে নিচু ক্লাসে পড়ে। তবে এও জানে বাবাই অঞ্জনার সব আবদার মেটান। এই শনিবার বাড়ি গিয়ে বাবাকেই সব বলতে হবে।

শনিবারের উইকএন্ডে মেয়ে হোস্টেল থেকে বাড়ি এসেছে, বাবা কি বাজার করে নিয়ে আসবেন বা মা কি রান্না করে মেয়েকে খাওয়াবেন সেটাই এখন ওনাদের প্রায়োরিটি। এই ক’দিন হস্টেলে কি খেলো, ব্রেকফাস্ট কি রকম, হস্টেলের অন্য মেয়েরা কিরকম, এসবের উত্তর দিতে দিতেই সারা সন্ধ্যাবেলাটা কেটে গেলো। তাই শনিবারের বিকেলে বাড়ি গিয়ে বলব বলব করেও অঞ্জনা ট্র্যাক স্যুট, সাইকেলের কথা বলতে পারলো না। থাক। কালকে রবিবার, কোনো একসময় বাবাকে বলবে।

রবিবারের সকালে মা রান্নাঘরে ব্যাস্ত, বাবা বাইরের ঘরে খবরের কাগজ পড়ছেন। অঞ্জনা কায়দা করে বাবার কানে কথাটা তুলে দিলো “বাবা, আমি ভাবছি এবার পুজোয় আর জামাকাপড় নেবো না।” বাবা কাগজ থেকে মুখ তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে মেয়েকে দেখলেন। বাবা মেয়েকে চেনেন, জানেন এটা ভূমিকা মাত্র। শুধু সময়ের অপেক্ষা কখন আসল কথাটা উঠবে। অঞ্জনা সময় নিলো না। বলে দিলো “না বাবা, মানে আমায় একটা ট্র্যাক স্যুট আর রানিং শ্যু কিনতে হবে। স্কুলে এসব লাগতো না, কিন্তু কলেজে লাগবে।” ওঃ, এই কথা? বাবা ভাবছিলেন না জানি কি একটা ভয়ানক ডিম্যান্ড আসবে। কিছু বললেন না, তবে মাথা নেড়ে সায় দিলেন। মিনিটখানেক পরে এবার শুনলেন আসল ডিম্যান্ড “বাবা, আমার একটা সাইকেলও দরকার।”

এবার বাবা খবরের কাগজ বন্ধ করলেন। সাইকেল কেন? হোস্টেল থেকে অঞ্জনার কলেজ তো খুব একটা দূরে নয়। সবাই হেঁটেই যায়। তাহলে? “না বাবা, আমার রানিং ইম্প্রুভ করার জন্য ট্রেনিং নেবো, তাই একটা সাইকেল দরকার।”

বাবার ভুরু কুঁচকে গেলো। মেয়ে খেলাধুলা ভালোবাসে সেটা তিনি জানেন, স্কুল থেকেই স্পোর্টসে ওর নাম আছে। কিন্তু মেয়ে তো এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে। স্প্রিন্ট কুইন হতে সে নিশ্চয় ওখানে যায়নি। স্প্রিন্ট কুইন হতে গেলে তো পাড়ার সস্তার কলেজেই পাঠানো যেত। বাবা চুপ করে ভাবতে বসলেন। এত টাকা এখন তিনি সাইকেল কিনতে খরচ করবেন? কেন? না, মেয়ে রানিং ইম্প্রুভ করবে?

বাবা হ্যাঁ বা না কিছুই উত্তর দিলেন না। অঞ্জনার ছোট ভাই জন ওর খুব বাধ্য। এককথায় দিদির চামচা। দিদি ওর ছোট ভাইকে মনের সবকথাই খুলে বলে। দিদিকে একটু খোঁচাতেই জন জানতে পারলো কেন দিদি সাইকেল কিনতে চাইছে। জনের বয়স কম, সবকিছু বোঝে না। তবুও খুব রাগ হয়েছে। দিদির কলেজের ছেলেরা দিদিকে কেন এইভাবে টিটকিরি মারবে? রান্নাঘরে গিয়ে মার কানে কথাটা তুলে দিলো। অঞ্জনার মা পেশায় শিক্ষক। মেয়ের অহংকারে আঘাত লেগেছে, সেটা বুঝেছেন। মেয়েকে ডেকে বললেন “তোর যা যা লাগে সব আমি কিনে দেবো, কিন্তু তুই তোর রানার নামের সম্মানটা আমাকে এনে দিবি, তাহলেই।”

সেদিন বিকেলেই অঞ্জনা ভাই জনকে সাথে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে ট্র্যাক স্যুট আর রানিং শ্যু কিনে নিয়ে এলো। কলেজে ফিরে সোমবার বিকেলে অঞ্জনা যখন জিমে এলো, গায়ে গাড় নীল ট্র্যাকস্যুট, আর পায়ে হালকা স্পোর্টস কেডস। জিমের সব ছেলেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো। শুধু ছেলেরা নয়, ক্লাবের ইনচার্জ দেবেশদারও ভ্রু কুঁচকে গেলো। ছেলেরা জানে রানার নামের একটি মেয়ে এবার কলেজে এসেছে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে মাঠে নেমে পড়বে এতটা ওরা কেউ ভাবেনি। তরুনদা অঞ্জনাকে দেখেই হেসে উঠলো। অঞ্জনার ভালো লাগলো না। ও এমন কিছু জোকার নয় যে সবাই আড়চোখে তাকিয়ে দেখবে, বা কেউ হেসে উঠবে। তরুনদা ওকে তাড়াতাড়ি মাঠে নিয়ে গেলো।
– তুই আমার ওপর রেগে আছিস, তাইনা? বলবো, সব বলবো। আগে একটা এক’শ মিটার স্প্রিন্ট দে।

ওরা এলো মাঠের পুবদিকে। কিছুদিন আগেই কলেজের মডেল স্কুলের স্পোর্টস হয়েছে। ট্র্যাকের সাদা দাগগুলো এখনও আছে। পাশেই ক্রিকেটের কংক্রিট প্র্যাকটিস পিচ। বেড়ার ওদিকে রাস্তা, সারি সারি দেবদারু গাছ। রাস্তার ওপারে বিরাট ঝিল। সুন্দর পরিবেশ। জানুয়ারি মাসের বিকেলের একটা আরামের হাওয়া। “নে, এই ট্র্যাক ধরে একশ মিটার একটা স্প্রিন্ট দে। নিজের বেস্ট স্পীডে, তার আগে পুরো দম নিয়ে নে। আমি স্টার্ট দেবো না, তুই নিজেই নিজের মতন করে স্টার্ট দে।”

তরুনদার হাতে টাইম ক্লক। অঞ্জনা নিজেই স্টার্ট দিয়ে একশ মিটার কভার করে এলো। ফিরে এসে অঞ্জনা মাঠে বসতে যাচ্ছে, তরুনদা মানা করলো “নো নো। চলবে না। বসা চলবে না। পাঁচ মিনিট একটু হালকা হেঁটে আয়। আস্তে আস্তে স্টেপিং। তারপর বলছি।” অঞ্জনা বুঝলো ওর ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে।

অঞ্জনা হালকা হালকা স্টেপ নিয়ে হাঁটতে গেলো। ফিরে আসতেই তরুনদা ওকে এবার ট্র্যাক ধরে একশ মিটার নরম্যাল হেঁটে আবার ওই ট্র্যাকেই ফিরে আসতে বললো। মানে হেঁটে আপ ডাউন দু’শো মিটার। তরুনদা হাতের টাইম ক্লকে সময় দেখছে। অঞ্জনা ফিরে আসতেই বললো “এবার খালি পায়ে খুব জোরে একটা একশ মিটার স্প্রিন্ট দিয়ে আয়। কিন্তু যখন থামতে বলবো, সঙ্গে সঙ্গে থেমে যাবি।”

অঞ্জনা খানিকটা, মানে দশ মিটার মতন দৌড়াতেই তরুনদা বলে উঠলো “স্টপ, স্টপ।” অঞ্জনা দাঁড়িয়ে গেলো। “ব্যাস। আজকে এই পর্যন্তই। আয় এবার তোকে কয়েকটা ইম্পরট্যান্ট কথা বলি।”

দুজনে ফাঁকায় গিয়ে বসলো ক্রিকেট প্যাভিলিয়নের বেদীতে। তরুনদা শুরু করলো “আর ইউ ওকে রানার? আই ক্যান সে সামথিং?” অঞ্জনা কিছুই বুঝল না কি হচ্ছে। না বুঝেই মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো, মানে শুনতে প্রস্তুত।
“তবে শোন। তোর এক’শ মিটারের টাইম দেখলাম ১৫.৩ সেকেন্ড। কোনো ভালো কম্পিটিশনে এই টাইম নিয়ে তুই পাত্তা পাবি না। ওটাকে কমিয়ে সাড়ে বারোতে আনতে হবে। খুব কঠিন। আবার বলছি, খুবই কঠিন। এই টাইম আনতে হলে তোকে প্রচুর খাটতে হবে। কলেজে ছেলেদের রেকর্ড আছে, তরুনদার ১১.১ সেকেন্ড, সাত বছর ধরে চলছে। ওর কাছাকাছি, সাড়ে বারো সেকেন্ড তোকে নামিয়ে আনতে হবে।”
অঞ্জনা শুনলো।
– তোর একটা ফিজিক্যাল ডিসএডভান্টেজ আছে, তোর হাইট। একজন স্প্রিন্টারের হাইট আর স্টেপিং খুব ইম্পরট্যান্ট। তোকে দৌড় করিয়েই থামতে বললাম। দশ মিটারে তোর চোদ্দটা স্টেপ পড়ছে। ওটাকে খুব বেশী হলেও বারোতে নামাতে হবে। মানে আরও লম্বা স্টেপিং ডিস্টেন্স চাই, বেটার লেগ স্ট্রেচিং। এই লেগ স্ট্রেচিং এ তোকে জোর দিতে হবে, মানে আরও লম্বা লম্বা স্টেপস চাই। তার সাথে শর্ট জাম্প। মানে প্রতিটা স্টেপিংএ জাম্পিং ডিষ্টেন্স বাড়াতে হবে। তোকে যে দুশো মিটার নরমাল হাঁটতে বললাম, আমি দেখলাম একই জিনিষ। হাঁটবার সময়ও খুবই শর্ট স্টেপস। এতে চলবে না।
অঞ্জনা হটাৎ যেন একটু উৎসাহ পেলো, মন দিয়ে শুনছে। এসব নতুন কথা এর আগে তো কেউ বলেনি, আর কথাগুলোয় যুক্তিও আছে। ইন্টারেস্টিং।
– তুই যখন রোজ চারবেলা হোস্টেল থেকে কলেজ যাবি আসবি, তোর হাঁটার মধ্যেই আরেকটু লম্বা লম্বা স্টেপিং এর চেষ্টা কর। আর সামান্য একটু স্পীডের। দেখবি হাঁটবার সময় একটু ফাস্ট স্টেপিং অভ্যেস হয়ে গেলে তোর রানিংও আগের থেকে অনেক ইজি হয়ে যাবে।

তরুনদার হটাৎ মনে হ’লো, অঞ্জনা বোধ হয় আজ ভালো মুডে নেই। বুঝতে পারছে না, প্রশ্ন করাটা ঠিক হবে কিনা। “কিরে? কি ভাবছিস? ভালো লাগছে না?”
একটু খোঁচাতেই অঞ্জনা নিজেই বলে দিলো “দাদা, আমার চেষ্টায় কমতি থাকবে না। তবে আমার মনে হয় যে আমি এখানে একদম একা। ওই দেখুন আমাদের ব্যালকনিতে এতগুলো মেয়ে দূর থেকে মজা দেখছে। একজনও কি পারলো না আমার সাথে এখানে আসতে? একজনও না? এদের থেকে এতটুকুও মর‍্যাল সাপোর্ট পেলাম না?”
ওঃ, এই ব্যাপার। তরুনদা বুঝলো অভিমান হয়েছে।
– রানার, দ্যাখ। আমার মনে হয় এতে তোর ভালোই হয়েছে। এটাই তুই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নে। তুই দেখিয়ে দে যে ওদের থেকে তোর মর‍্যাল সাপোর্টের কোনো দরকারই নেই।

পরদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে কাউকে না জানিয়ে অঞ্জনা ট্র্যাকস্যুট কেডস পড়ে যখন নীচে নেমে এলো, হোস্টেলে সবাই তখনও গভীর ঘুমে, কেউ জানতেও পারলো না। ছটা নাগাদ সবাই একে একে উঠবে। ছেলেদের হোস্টেলেও সবাই গভীর ঘুমে। এই শীতের ভোরে একটা সুবিধে আছে। পুরো মাঠ কুয়াশায় ঢাকা, একটু দূর থেকেও কিছু দেখা যায়না। নইলে এই ভোরে একটা মেয়ে মাঠে দৌড়াচ্ছে, এই দেখেই তৎক্ষণাৎ চারিদিকে ভিড় জমে যাওয়ার কথা। অঞ্জনা মাঠে এসে ট্র্যাক ধরে পুরো একটা রাউন্ড দিলো। স্প্রিন্ট নয়, কালকে তরুনদা যেমন বলেছে লং স্টেপস, সেই দিকেই নজর। লং স্টেপস চাই। আর একটা রাউন্ড মানে কত? আড়াই’শো তিনশো মিটার হবে? প্রতিটা স্টেপে অঞ্জনার মাথায় ঘুরছে “লং স্টেপস”, “লং স্টেপস।” শুরুতেই স্প্রিন্ট টেনে হাঁপিয়ে পড়তে চায়না। চাইছে অনেকগুলো রাউন্ড দিয়ে স্টেপিং প্র্যাকটিস করবে। এক একটা রাউন্ড শেষে অঞ্জনা দৌড় বন্ধ করে হালকা স্টেপস নিয়ে হেঁটে নিচ্ছে। তখনও মাথায় ঘুরছে “লং স্টেপস” “লং স্টেপস।” একটি বারের জন্যও মাঠে বসে বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করলো না। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বিনা বিশ্রামে টানা প্র্যাকটিস করে অঞ্জনা যখন হোস্টেলে ফিরে চারতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, ওর পা যেন আর চলতে চায় না। আশ্চর্য? মাঠে এত দৌড়ালাম কিছুই কষ্ট হয়নি। অথচ এই চারতলার সিঁড়ি আমি রোজ অনায়াসে কতবার ওঠানামা করছি, তবে আজকে এখন কেন পায়ে একটুও জোর পাচ্ছি না?

অঞ্জনা যখন ক্লান্ত হয়ে হোস্টেলে নিজের রুমে ফিরে এলো, তখনও সবাই ঘুমিয়ে। তাড়াতাড়ি উঠে স্নানে চলে গেলো। ওর রুমমেট ঘুম থেকে উঠে অবাক, কি ব্যাপার? আজকে অঞ্জনা ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে একদম ফ্রেশ? তাও আবার এই জানুয়ারির শীতে?

সেদিন বিকেলে অঞ্জনা মাঠে যেতেই তরুনদা রুটিন ধরিয়ে দিলো। রোজ সকালে স্টেপিং প্র্যাকটিস। আর বিকেলে অন্তত তিনটে একশ মিটারের সিরিয়াস স্প্রিন্ট। টাইম ক্লকের ওপর তরুনদা নজর রাখবে। এখন থেকে রোজ দু’বেলা রুটিন করা এই প্র্যাকটিসই চলবে।

এইভাবেই একমাস হয়ে গেলো। অঞ্জনা এখন রোজ সকালে স্টেপিং আর বিকেলে ওভালের একপাশে নিয়ম করে স্প্রিন্ট দেয়। রোজ, মানে এই একমাসে অঞ্জনা শুধু একবার বাড়ি গেছে। কারণ শনি রবিবারের প্র্যাকটিস ও মিস করতে চায় নি। বাড়িতে বলেছে পড়ার চাপ আছে। অন্যদিন ওর সকালের প্র্যাকটিসে তরুনদা থাকে না, তবে বিকেলের প্র্যাকটিসে রোজ স্প্রিন্ট টাইম দেখে। মাঝে শুধু একদিনই অঞ্জনা ১৩.৮ সেকেন্ড টাইম হয়েছিলো। স্টেপিং এখনও আগের মতনই আছে। ভালো নয়, বেটার করতে হবে। জাম্পিং ডিস্টেন্সও ইম্প্রুভ হয়নি। তরুনদা বলে দিয়েছে, সময় লাগবে। এছাড়াও সপ্তাহে দু’বার জিমে গিয়ে অঞ্জনা এখন নিজের ওজন চেক করিয়ে আসে।

পরের সপ্তাহে তরুনদা একদিন বিকেলে ওকে মাঠে প্র্যাকটিস না করিয়ে নিয়ে গেলো কলেজের মেন বিল্ডিঙে। “রানার, এবার তোর জন্য আরেকটা রুটিন। তোর ব্রিদিং স্ট্যামিনা, মানে কতখানি দম সেটা টেস্ট করবো। এই সিঁড়ি বেয়ে একদমে দৌড়ে চারতলায় উঠতে হবে। দম চেপে দৌড়ে উঠবার চেষ্টা করবি। আর কিপ ইট ইন মাইন্ড। একটাও সিঁড়ি ছাড়তে পারবি না, আর মাঝে থামতেও পারবি না। এতদিন ফ্ল্যাট ফিল্ডে দৌড়েছিস। দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙলে এবার তোর ব্রিদিং স্ট্যামিনাও বাড়বে। লেগ মাসল শক্ত হবে।”

অঞ্জনা শুনছে। এটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। ব্রিদিং স্ট্যামিনা বাড়াতে সিঁড়িতে কেন দৌড়ঝাঁপ করতে হবে। তাঁর উপর সামনেই দু’জন সিকিউরিটি গার্ড সব দেখছে। এর আগে ওরা কোনদিন এভাবে একটা মেয়েকে বিকেলে ট্র্যাকস্যুট পরে মেন বিল্ডিং এর সিঁড়িতে দৌড়তে দেখেনি। ওদেরও ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগছে। অঞ্জনার সমস্যা তরুণদা বুঝেছে। একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বললো, “দ্যাখ রানার, আমাদের তো আর অলিম্পিক ফেসিলিটি নেই, বা পাতিয়ালার মতন স্পোর্টস কমপ্লেক্সও নেই, সুতরাং যা আছে, তাই দিয়েই আমাদের চেষ্টা করতে হবে।“
অঞ্জনার জন্য এটা একরকমের নতুন প্রাকটিস, ভাবলো চেষ্টা করেই দেখা যাক। এদিকে মনের জেদ আর চ্যালেঞ্জের ইচ্ছেটাও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তরুণদা আর সময় খরচ করলো না।
– নে। গেট রেডি, নিজের মতন করে স্টার্ট দে।”
সেদিন বিকেলে অঞ্জনা মেন বিল্ডিং এর সিঁড়িতে শুধু দু’রাউন্ড দৌড়ে এলো। হাঁপিয়ে উঠেছে। “এটাই তোকে ইম্প্রুভ করতে হবে। অত সহজে হাঁপিয়ে গেলে হবে না।“
যখন ফিরে আসছে, রাস্তার পাশেই বক্সিং রিং।
– এদিকে আয়, তোকে একজনের সাথে আলাপ করিয়ে দি।

সন্ধ্যা নেমে আসছে, ফাঁকা বক্সিং রিং এ দু’জন প্রাকটিস করছে। তরুণদা একজনকে ডাকলো, “সোমনাথ, একটু আয়।“
ফর্সা মুখে অল্প অল্প দাড়ি, একটা বাচ্চামতন ছেলে এগিয়ে এলো। “রানার, এঁকে চিনিস?”
অঞ্জনার মুখ চেনা, নাম জানে না।
– হি ইজ সোমনাথ, সোমনাথ চ্যাটার্জি। ইয়োর ব্যাচমেট। বক্সিং এর ব জানতো না। ঐ ছেলেটা, অমিত, হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট সাব জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন, জোর করে একে বক্সিং রিং এ ডেকে এনেছে। এন্ড সোমনাথ ইজ নাউ এঞ্জয়িং হিজ বক্সিং।
অঞ্জনা বুঝতে পারছে না, তরুণদা হঠাৎই এই বক্সিং প্রসঙ্গ কেন নিয়ে এলো।
– রানার, এই যে তোর সামনে দেখছিস সোমনাথকে, যে কলেজে আসার আগে বক্সিং জানতোই না, সেই ছেলে ঐ অমিতের পাল্লায় পড়ে গত সপ্তাহে হাওড়া পুলিশের ডিস্ট্রিক্ট টুর্নামেন্টে দু’টো প্রাইজ জিতে নিয়ে এসেছে। হ্যাঁ, মুখ ফেটে রক্তও বেরিয়েছে, তবে দু’টো মেডেলও নিয়ে এসেছে।
অঞ্জনা নিজের ডানহাতটা এসিয়ে দিলো, “কংগ্র্যাচুলেশনস রে, সোমনাথ। ইউ হ্যাভ আ গ্রেট কারেজ।“
সোমনাথ চাপা স্বভাবের ছেলে, জবাবে শুধু বললো “থ্যাংক ইউ অঞ্জনা।“
– তুই এঁকে চিনিস, সোমনাথ?
– ইয়েস তরুণদা, অঞ্জনা আমার সেকশনেরই।

ফেরার সময় তরুণদা সোমনাথের ব্যাপারে আরেকটু যোগ করে দিলো। “এই সোমনাথ দারুণ স্প্রিন্টার। ও একদিন কলেজ চ্যাম্পিওন হবেই। আমারই পাড়ার ছেলে, দারূণ ফুটবলও খেলে। এখন বক্সিং শিখছে। তোকে বলছি, কারণ এরাই হবে কলেজের রোল মডেল। আর ইউ শ্যুড বি দ্যা রোল মডেল ফর অল দ্যা গার্লস।“
একটু থেমে আবার “কিন্তু”
– কিন্তু কি?
– সোমনাথটা বড্ড সিগারেট খায়, ওটা ছাড়ানো মুস্কিল। নইলে……

পরের দিন থেকে অঞ্জনার ট্রেনিং রুটিনের একটু বদল হয়ে গেলো। সকালে রোজ পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতন মাঠে প্র্যাকটিস। খুব বেশী হলে মাত্র তিনটে একশ মিটার স্প্রিন্ট। বাকিটুকু কম স্পীডে রান, জগিং টাইপের। নজর থাকবে স্টেপিঙের দিকে। স্টেপিং লম্বা করতে হবে। আর বিকেলে প্রতিদিন মাঠে ট্র্যাকে তিনটে একশ মিটার স্প্রিন্ট আর পরের দিন কলেজ মেন বিল্ডিঙে দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙা। এই হবে রোজকার রুটিন। শনিবার রবিবার ছুটি। কারণ ওয়ার্ক, স্টাডিজ আর ফ্যামিলি লাইফের ব্যালেন্সও দরকার।

ইতিমধ্যে প্রতি হোস্টেলে নোটিশ এসেছে, ইউনিভার্সিটি স্পোর্টসে যারা যারা নাম দিতে চায়, তারা যেন জিমে এসে নাম দিয়ে যায়। দেবেশবাবু জিমের এডমিনিস্ট্রেশন অফিসার। অঞ্জনা গিয়ে নাম দিতেই দেবেশবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। উনি এই কলেজে আঠারো বছর আছেন। এই প্রথমবার এই কলেজের একটি মেয়ে কলেজের বাইরে কম্পিটিশনে নাম দিতে চাইছে। তাও আবার ইউনিভার্সিটি স্পোর্টসে? দেবেশদা একবার ভেবেও শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা মুখে আনলেন না, যে অঞ্জনার কি কোনো ধারণা আছে ওখানে কি লেভেলের কম্পিটিশন? বিশেষ করে মেয়েদের?

তরুনদাও কিন্তু খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। “তুই জাস্ট একটা এক্সপিরিএন্সের জন্য নাম দিবি, এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তোর এখনও যা টাইমিং, তুই ধরে রাখ যে ট্রায়ালে একদম নীচের দিকে থাকবি। সেটা মনে রাখিস। এতে যেন তোর ফ্রাসট্রেশন না হয়। তবে হ্যাঁ, তোর একটা কম্পিটিটিভ এক্সপিরিএন্স হবে। সেটাই হবে সবথেকে বড় ব্যাপার। আরও একটা কথা। তুই যে এতদুরে ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ডে যাবি, তোর সাথে কি তোর হোস্টেলের কেউ যাবে? মনে হয়না। তোকে হয়তো একলা একলাই যেতে হবে। কারোর থেকে কিচ্ছু সাপোর্ট পাবি না। এসে কিন্তু আমার কাছে এসে অভিমান বা রাগারাগি করতে পারবি না। আর এটাই হবে তোর চ্যালেঞ্জ। আর সেটা তোকে পারতেই হবে।”

তরুনদার ধারনাই ঠিক। একমাত্র পম্পাদিই ওর সাথে যেতে রাজী হয়েছে। ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ডে ওরা গিয়ে দেখে প্রায় পঞ্চাশটি মেয়ে, বা বেশীও হতে পারে, সকাল দশটা থেকে নাম রেজিস্ট্রেশন চলছে। আর সবাই একশ মিটারেই নাম দিয়েছে। দুপুর বারোটা পর্যন্ত চারিদিকে চ্যাঁচামিচি। কেন কম হাইটের মেয়েদের লম্বা মেয়ের সাথে এক গ্রুপে রাখা হয়েছে? একই গ্রুপে কেন সব সাউথের কলেজের মেয়েদের রাখা হয়েছে? কেন একই কলেজের মেয়েদের একই গ্রুপে রাখা হয়েছে? নানান রকমের ঝামেলা। শেষ পর্যন্ত ছ’জন করে এক একটা গ্রুপ তৈরি হ’লো। প্রতি গ্রুপের দুজন উইনার পরের রাউন্ডে যাবে। তারপর ওদের মধ্যে নেক্সট রাউন্ড। এইভাবে ফাইন্যাল রাউন্ডে শেষ ছ’জন উঠবে।

অঞ্জনা প্রথম রাউন্ডেই বেরিয়ে গেলো। টাইম বোধহয় কলেজের প্র্যাকটিসের চেয়েও খারাপ। অঞ্জনার নিজের তো তাই মনে হ’লো। কলেজে ফিরে এসে তরুনদাকে জানাতেই তরুনদা বললো “টাইমিং বড় ব্যাপার নয়। ওই যে বাসে করে তুই দেড় ঘণ্টা, তারপর ময়দানে হেঁটে হেঁটে ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ড খুঁজে বার করা, তারপর একঘণ্টা ধরে তোদের গ্রুপ তৈরি, এতেই তোর এনার্জি নষ্ট হয়েছে। এটাও শেখার বিষয়, কিভাবে এনার্জি স্টোর করে রাখতে হবে। আর খারাপ টাইম নিয়ে চিন্তা করিস না। তোর বডির স্ট্যামিনা এখনও কম। রানের আগে তুই ওই ধকল নিতে পারিস নি। তবে এটাও একটা অভিজ্ঞতা, এইটা মনে রাখবি। ধরে নে এখান থেকেই তোর কম্পিটিশন শুরু হ’লো।”

ওই সপ্তাহের শনিবারে বাড়ি ফিরতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন “গত বুধবার সকাল দশটার সময় ময়দানে কি করছিলি? ক্লাস ছিলো না?” অঞ্জনা ভাবছে বাবা এসব খবর কোথা থেকে পেলো? “বারো নম্বর ফ্ল্যাটের পিনাকীবাবু অফিস যাওয়ার পথে তোকে দেখলেন তুই ময়দানে ঘুরছিস? উনি তো বাস থেকেই নেমে পড়লেন, না জানি কি হয়েছে। তারপর তোকে ওখানে খুঁজেই পেলেন না।”
ওঃ, এই ব্যাপার। অঞ্জনা বাবার কাছে সব গুছিয়ে রিপোর্ট দিলো।
কিন্তু এই ব্যাপারটাই বাবাকে ভাবিয়ে তুললো। তাহলে তার মেয়ে কি সত্যি সিরিয়াস? ইউনিভার্সিটি লেভেলে কম্পিটিশনে যেতে চায়?

সপ্তাহ দুই পরে অঞ্জনার ভাই জন যখন ট্যাক্সি করে হোস্টেলে এসে সাইকেল দিয়ে গেলো, হোস্টেলেও হইচই পড়ে গেছে। ছেলেরাই এখানে সাইকেল চড়ে না, আর অঞ্জনা ক্যাম্পাসে সাইকেল চড়বে? অঞ্জনার যা হাইট, প্রায় বাচ্চাদের সাইজের সাইকেল কিনবার মতন অবস্থা। সেই সাইকেল খুঁজতে জন আর ওর বাবাকেও কম হাঙ্গামা পোয়াতে হয়নি।

এপ্রিল মাস এসে গেছে, ধীরে ধীরে গরম পড়ছে। ক্রিকেট আর ফিল্ড এথলেটিক্স সীজন শেষ। ওভাল মাঠে এখন ছড়িয়ে ফুটবল খেলা হয়, বিকেলে দৌড়ের জন্য ফাঁকা ট্র্যাক আর পাওয়া যায় না। অঞ্জনা তাই সকালে প্র্যাকটিসের সময় বাড়িয়ে এক ঘণ্টা করে নিয়েছে। রোজ ভোর পাঁচটায় উঠে এখন কলেজ ক্যাম্পাসে একদিন কয়েক কিলোমিটার সাইকেল চালায়, পরের দিন ওভাল মাঠে দৌড়ায়। বিকেলে ছুটি। আরও একটা পরিবর্তন হয়েছে। অঞ্জনা নিজের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে স্পাইক শ্যু কিনে এখন রোজ সকালে স্প্রিন্ট প্র্যাকটিস করে। শুধু একদিনই ১৩.১ সেকেন্ড করেছিলো, নইলে প্রতিদিন ১৩.৬ সেকেন্ডের মতন সময়ে নামিয়ে এনেছে। তবে তরুনদা বলছে যা রুটিন করে দিয়েছিলো, সেই হিসেবে এখনই আরও এক সেকেন্ড কমার কথা। সাড়ে তেরো হ’লে ঠিক ছিলো।

দিনে দিনে এক বছর হয়ে গেলো। অঞ্জনার ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে। একটা রুটিনে নিজেকে সে ধরে রেখেছে। তাই তরুনদা এখন রোজ আর আসেনা। রোজ সামনে এসে দাঁড়িয়ে থেকে প্র্যাকটিস করানোর দরকারও পড়ে না। সপ্তাহে দু’দিন বা তিনদিন আসে। টাইম ক্লকে সময় দেখে, স্টেপিং দেখে। মেন বিল্ডিঙে সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে ওঠা খুব ভালো কাজ দিয়েছে। লোকজন সিঁড়িতে ট্র্যাকসুট পড়ে দৌড়াদৌড়ি দেখে ফেলবে, সেই মানসিক সমস্যা আর নেই। এর ফলে এখন অঞ্জনার দম আগের থেকে অনেক ভালো। এক’শ মিটারের শেষে হাঁপিয়ে যায় না। আরও ভালো হ’লে তরুনদা বলেছে সামনের বছর দু’শো মিটার আর চারশো মিটারেও নামতে দেবে। তবে এখন শুধুই এক’শ মিটার। তরুনদা একদিন একটা বুদ্ধি দিয়েছিলো যে পায়ের মাসল স্ত্রেংথ বাড়ানোর জন্য সাইকেলে একটি হালকা ওজনের মেয়েকে বসিয়ে ডাবল ক্যারি করতে। আইডিয়া দিয়েছিলো হোস্টেলের ভাস্বতী বা জয়ন্তীর মতন রোগা কোনো মেয়ে যদি রাজী হয়। অঞ্জনা জবাবে একটাই কথা বলেছিলো “মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? আমি রাজী হলেও তুমি ভাবছ ভাস্বতী রাজী হবে?”

এরপর মে জুন মাসের গরমের ছুটিতে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো। আর অঞ্জনার প্র্যাকটিসও বন্ধ হয়ে গেলো। ছুটির পর হোস্টেল ফিরে আজ করবো কাল করবো করতে করতে একে একে আগস্টের শেষ সপ্তাহও এসে গেলো। এতদিন পরে অঞ্জনা আবার প্র্যাকটিসে নেমেছে। যে অঞ্জনা মার্চ এপ্রিলে ১৩.৬ সেকেন্ডে এক’শ মিটার কভার করতো, এখন তার লাগছে ১৪ সেকেন্ড। এক’শ মিটারের শেষে হাঁপিয়ে যায়। আর চারতলা সিঁড়ি ভাঙতে এখন তার রীতিমত কষ্ট হয়। মানে আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। তরুনদার মুড খারাপ হয়ে গেছে। তরুনদা বলেছিলো অনেক প্র্যাকটিস হয়েছে। এবার কম্পিটিশন বুঝতে হবে। গতবারের মতন ইউনিভার্সিটি স্পোর্টসে ফার্স্ট রাউন্ডেই ছিটকে বেরিয়ে আসা চলবে না। বলেছিলো এই সামনের শীতেই অঞ্জনাকে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ছাড়াও হাওড়া ডিসট্রিক্ট আর সাউথ কোলকাতা ডিসট্রিক্ট কম্পিটিশনে পাঠাবে। আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। আগের এত পরিশ্রম কি সব নষ্ট হয়ে যাবে??

অঞ্জনারও খারাপ লেগেছে। বাবা মাও বাড়িতে ওকে ছেড়ে দেয় নি। এত বড় বড় অভিমানের কথা, সাইকেল চাই, ট্র্যাক স্যুট চাই, এসব কাণ্ডের কি দরকার ছিলো? পুজোর ছুটির পর আবার নতুন উদ্যমে অঞ্জনা মাঠে নামলো। মাঝে এতদিনের গ্যাপ, তরুনদা হেভি বকাবকি করলো। অক্টোবরের বিকেলে এখনও ফুটবল হকি চলছে, আরও কিছুদিন চলবে। বিকেলে মাঠ পাওয়া যায়না, তাই সকালে তরুনদা প্র্যাকটিসের টাইম আরও পনেরো মিনিট বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন অঞ্জনা রোজ ভোর পৌনে পাঁচ’টায় হোস্টেল থেকে বেরিয়ে মাঠে চলে আসে। তখনও রাতের অন্ধকার পুরো কাটে না। ক্যাম্পাসের রাস্তাও জনশুন্য থাকে। হোস্টেলের অন্য মেয়েরা বারন করেছিলো, কিন্তু অঞ্জনা শোনেনি। নিজের মতন করে অঞ্জনা তিনমাস সিরিয়াস প্র্যাকটিস করে গেলো। নিজের ইমপ্রুভমেন্ট, অনেকটা না হলেও খানিকটা যে হয়েছে, এখন সে নিজেই বুঝতে পারে।

জানুয়ারিতে কলেজের এন্যুয়াল স্পোর্টস। অঞ্জনার কাছে এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু জিমে অভিযোগ জমা পড়েছে যে ছেলেদের টাইম যদি রেকর্ড করা হয়, আর কলেজের রেকর্ডবুকে স্থান পায়, মেয়েদের জন্য কেন হবেনা? সুতরাং এবার মেয়েদের মধ্যে যে জিতবে, সেটাই হবে কলেজ রেকর্ড।

স্পোর্টসের ঠিক আগে কলেজের লেডীস হোস্টেলে জোর তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেলো। মেয়েরা বলে দিয়েছে পঞ্চাশ মিটারের বেশী দৌড়াবে না, আর অঞ্জনা বলছে এক’শ মিটারের কমে কোনো রেস হয় না। মেয়েরা কিছুতেই একশ মিটার দৌড়াতে পারবে না। শেষে রফা হয়েছে, পঁচাত্তর মিটার ফ্ল্যাট রেস হবে। আরেকটা শর্ত যে মেয়েরা কেউ ট্রায়ালে আসবে না, একদম সোজা স্পোর্টসের দিনে ট্র্যাকে গিয়ে দাঁড়াবে। আর হবে আর্কিটেকচার আর ইলেকট্রনিক্সের মধ্যে ৪x৫০ মিটার রীলে রেস।

কলেজ স্পোর্টসে অঞ্জনা ৭৫ মিটার ফ্ল্যাট রেস জিতলো। ৯.৮ সেকেন্ড। আর সেটাই হয়ে গেলো কলেজ রেকর্ড। কিন্তু তরুনদা এই কলেজ রেকর্ডকে কোন গুরুত্বই দিলো না। ওর ভাবনা অন্যরকম, আরেকটু প্র্যাকটিস করলেই অঞ্জনা এর থেকেও ভালো টাইম নিশ্চয়ই করতে পারতো।

আবার প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। জানুয়ারির শীতে ছেলেমেয়েরা সবাই প্রতিটি হোস্টেলে ভোর পাঁচটায় যখন লেপের নীচে শুয়ে আছে, তখন অঞ্জনা ট্র্যাক স্যুট গায়ে চাপিয়ে রোজ হয় সাইকেল নিয়ে নেমে পড়েছে নয়তো মাঠে গিয়ে দৌড়াচ্ছে। কুয়াশায় দশ মিটার সামনে দেখা যায়না। মাঠের নরম ঘাস শিশিরে ভেজা। তবু অঞ্জনা নিজের মনে একাই প্র্যাকটিস করে চলেছে। নিজের মনেই মন্ত্র পড়ছে “লং স্টেপস” “লং স্টেপস।”

কিছুদিন পর ইউনিভার্সিটি স্পোর্টসে এবার পম্পাদি আর তরুনদাও অঞ্জনার সাথে গেলো। বাস জার্নিতে অঞ্জনার যাতে পরিশ্রম না হয়, তরুনদা ট্যাক্সি করে ওদের নিয়ে গেলো। এখন অঞ্জনা অনেক পরিণত। নিজের ব্র্যান্ড নিয়েও সজাগ। মাথায় স্পোর্টস ক্যাপ, রোদের থেকে মাথা বাঁচবে। সাথে স্পোর্টস ব্যাগ আছে। সঙ্গে ভেজা তোয়ালে, চুইংগাম, জলের বোতল। এছাড়াও পায়ে স্পাইক শ্যু। সবই আছে, নেই শুধু কলেজের একটা ব্লেজার। এদিক ওদিক ছোট ছোট কলেজের অনেক মেয়েরাই গায়ে ব্লেজার চড়িয়ে এসেছে। তরুনদা বলে দিয়েছে, ওসবে মন খারাপ করিস না। তোর নিজের রানিং টাইমে কনসেনট্রেট কর। তরুনদার ধারণা সাড়ে তেরো সেকেন্ড আনতে পারলেই ও নেক্সট রাউন্ডে চলে যাবে। এগারোটা গ্রুপ হয়েছে, প্রতি গ্রুপে ছ’জন। ভয় একটাই, অঞ্জনার হাইট কম। যদি সব লম্বা লম্বা মেয়ে ওর গ্রুপে পড়ে, তাহলে অসুবিধে হতে পারে।

ফার্স্ট রাউন্ডে অঞ্জনা নিজের গ্রুপে ফিনিশ করলো ঠিক সাড়ে তেরো সেকেন্ডে, আর সেকেন্ড পজিশনে। যে ফার্স্ট হয়েছে সে ১৩.৪ সেকেন্ড, মানে অঞ্জনার থেকে ০.১ সেকেন্ড কম। ইউনিভার্সিটি অঞ্জনার টাইম মাপেনি, মেপেছে তরুনদা। দুজনেই খুশী। এবার ঘণ্টাখানেক গ্যাপ, অন্য গ্রুপগুলোর ট্রায়াল হবে। তারপর নেক্সট রাউন্ড। এই রাউন্ডেও প্রথম দুজনের মধ্যে আসলেই অঞ্জনা ফাইন্যাল রাউন্ডে পৌঁছে যাবে। অঞ্জনার তখন বিশ্রাম। নিরিবিলিতে একটা গাছের ছায়ায় পম্পাদি অঞ্জনার পায়ে হালকা ম্যাসাজ করে দিলো। ভিজে তোয়ালে দিয়ে বডি ওয়াশ করে দিলো। তরুনদা জলের বোতল এগিয়ে দিলো। অঞ্জনা নিজেই হাসতে হাসতে বললো, “আমি দেখিছি এখন ভি আই পি হয়ে গেলাম।“

নেক্সট রাউন্ডেও অঞ্জনাকে খুব একটা কম্পিটিশনে পড়তে হ’লো না। গ্রুপে সেকেন্ড হয়ে সহজেই ফাইন্যাল রাউন্ডে উঠে গেলো। ওর সময় সেই একই, সাড়ে তেরো সেকেন্ড। ফাইন্যালে এখন আটজন। এইবার আসল মেডেলের জন্য দৌড়। এবার অঞ্জনার একটু একটু নার্ভাস লাগতে শুরু করেছে। মাঠে এখন আর বেশী মেয়ে নেই। এলিমিনেট হয়ে অনেকেই চলে গেছে। শুধু ফাইন্যালিস্ট যারা তারাই আছে। তরুনদাও অঞ্জনার মেডেল আশা করে না, এই ফাইন্যাল রাউন্ডে সবাই অঞ্জনার চেয়ে একহাত লম্বা। তরুনদা শুধু চাইছে, ওর অঞ্জনা যেন টাইম ল্যাগ না করে, সাড়ে তেরো সেকেন্ডের বেশী যেন না হয়। সেটা হলেই এবারের মতন ঠিক আছে। সামনের বছর হবে আসল পরিক্ষা।

ফাইন্যাল ল্যাপে আটজন লাইনে দাঁড়িয়ে। অঞ্জনার পাঁচ নম্বর লেন। দু পাশে দুটি সাড়ে পাঁচ ফুটের মেয়ে, মাঝখানে অঞ্জনা চার দশ হাইট নিয়ে লড়বার জন্য তৈরি। পম্পাদি তরুনদা বলে দিয়েছে, মেডেল নাই বা পেলি, লড়ে হারবি। বিনা যুদ্ধে হারবি না। ফার্স্ট-এর থেকে যেন ০.২ সেকেন্ডের বেশী পিছিয়ে না থাকিস।

ফাইন্যাল হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে কি যে হয়ে গেলো, অঞ্জনা যেন নিজেকে প্রথম কুড়ি পঁচিশ মিটার একদম উড়িয়ে নিয়ে গেলো। সবার আগে অঞ্জনা। পম্পাদি তরুনদা গলা ফাটিয়ে “কাম অন অঞ্জনা, ইয়েস কাম অন” চিয়ার করে গেলো। তাল কাটলো এরপর থেকে। অন্য মেয়েদের বিশাল বিশাল স্টেপিঙে অঞ্জনা পিছিয়ে যেতে থাকলো। এক’শ মিটারের মাথায় অঞ্জনা ফিফথ। আটজনের মধ্যে পঞ্চম স্থান। সময় একই আছে, ১৩.৪ সেকেন্ড। যে ফার্স্ট সে ১৩.১ সেকেন্ড। মানে তিন সেকেন্ডের ব্যাবধানে অঞ্জনা চারজনের পিছনে পড়ে গিয়েছে। তবে অঞ্জনা আর তরুনদার জন্য বড় খবর, অঞ্জনা তার টার্গেট সাড়ে তেরো সেকেন্ডের চেয়ে ০.১ সেকেন্ড কমে এক’শ মিটার কভার করেছে।

খবরটা চাপা রইলো না। কোলকাতা ইউনিভার্সিটির স্পোর্টসে এতগুলো কলেজের এতজনের মধ্যে ফিফথ হয়ে আসা কম কথা নয়, এই কলেজের ইতিহাসে আগে হয়নি। জিমের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ভূপাল দত্ত অঞ্জনাকে ডেকে অভিনন্দন জানালেন। জিমের অফিসার দেবেশবাবুকে বলে দিলেন অঞ্জনার জন্য কলেজ ব্লেজারের ব্যাবস্থা করে দিতে। দেবেশবাবু শুনলেন, কিছু বললেন না, পরের দিন প্রফেসর দত্তর সাথে ডিপার্টমেন্টে দেখা করে জানালেন ব্লেজার দিতে হ’লে স্পেশাল পারমিশন চাই। ব্লেজার দেওয়া হয় কেউ বাইরে গিয়ে কম্পিটিশন জিতে এলে বা কলেজ রিপ্রেজেন্ট করলে, বা কলেজের হয়ে কোনো রেকর্ড করলে। অঞ্জনা কোনোটাই করে নি। ইউনিভার্সিটি স্পোর্টসে সে গেছে নিজের উৎসাহে, কলেজ তাঁকে পাঠায় নি। একমাত্র প্রিন্সিপ্যাল সাহেব যদি অনুমোদন করেন, তবেই অঞ্জনাকে ব্লেজার দেওয়া যাবে।

একরাশ ক্ষোভ নিয়ে প্রফেসর দত্ত প্রিন্সিপালের অফিসে গেলেন। প্রিন্সিপ্যাল ওনার থেকে কলেজে এক বছরের জুনিয়র। বললেন “দুর্গা, আমি জিমের প্রেসিডেন্ট। আমাদের কলেজের একটা মেয়ে ইউনিভার্সিটি স্পোর্টসের ফাইন্যাল রাউন্ডে উঠলো। তাঁকে স্পোর্টসে এনকারেজ করার জন্য একটা ব্লেজার এপ্রুভ করার পাওয়ার আমার নেই?” প্রিন্সিপ্যাল স্যার প্রফেসর দত্তের কথা শুনলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজী হলেন না। জিমের কন্সটিটিউশন তিনি এইভাবে ভাঙতে চাইছেন না। এইরকম কেস কলেজে আগে আসেনি। দুজনে মিলে ঠিক করলেন নেক্সট মিটিঙেই এই রিজলিউশন পাস করিয়ে নেবেন। ব্লেজার তো আজকে এখনই লাগছে না, কিছুদিন পরে দিলেও তো চলবে।

এরপর তিন সপ্তাহ বাদে হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট কলেজগুলির স্পোর্টস। ইউনিভার্সিটিতে ভালো রেজাল্ট করে অঞ্জনা এখন আগের থেকেও সিরিয়াস হয়ে গেছে। নিজের উপর আস্থা এখন আগের থেকে অনেক বেশি। হাওড়া ডিসট্রিক্টের এক’শ মিটারে ফাইন্যালে অঞ্জনা একটুর জন্য ফার্স্ট হতে পারলো না, সেকেন্ড হয়েছে। সময় ১৩.৩ সেকেন্ড। মানে ইউনিভারসিটির থেকে আরও ০.১ সেকেন্ড কমিয়ে নিজেকে এগিয়ে এনেছে।

এবার ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই অঞ্জনা এখন ভীষণ সিরিয়াস। আগামী বছর এই সময়েই ইউনিভার্সিটির স্পোর্টস হবে, অঞ্জনার টার্গেট ওই সময়েই সে নিজের একশ মিটারের সেরা টাইম মিট করবে। ইউনিভার্সিটি আর হাওড়া ডিসট্রিক্টের রেজাল্ট অঞ্জনাকে বারতি রসদ জুগিয়েছে। বাড়িতে মা বলেছে কলেজের যারা ওর রানার নাম নিয়ে ঠাট্টা করেছে, তাদেরকেও জবাব দিতে হবে। এছাড়াও তরুনদা চ্যালেঞ্জ দিয়েছে, সামনের বছর এই সময় ওকে সাড়ে বারো সেকেন্ড টাইমে পৌছাতে হবে। সব বিবেচনা করেই অঞ্জনা ঠিক করেছে, পড়াশুনা সে ঠিকমতনই চালিয়ে যাবে, কিন্তু আগামী এক বছর সিরিয়াস হয়ে একশ মিটারের প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। আর তরুনদাও এখন ওর পিছনে পিছনে টাইম ক্লক নিয়ে দৌড়ায়। সবই ঠিক চলছে, শুধু হোস্টেলের মেয়েদের ভয় যে অঞ্জনা এসব করতে গিয়ে নিজের পড়াশুনায় বারোটা না বাজিয়ে দেয়।

মাস দেড়েকের মধ্যেই অঞ্জনা কলেজ থেকে ব্লেজার পেয়ে গেলো। সেও এক ঝামেলা। ওই ছোটোখাটো চেহারার ব্লেজারও পাওয়া যায়না। জিম থেকে কাপড় নিয়ে ওর স্কুলের দর্জির কাছে গিয়ে মাপ দিয়ে বানাতে হয়েছে।

ডিসেম্বর এসে গেছে। অনেক প্র্যাকটিস, অনেক সাধনার পর অঞ্জনার এক’শ মিটারের সময় এখন ১২.৯ সেকেন্ড। মানে টার্গেট থেকে এখনও ০.৪ সেকেন্ড পিছিয়ে। তরুনদা দেখেছে অঞ্জনা একটানা ইউনিফর্ম স্পীড আর রানিং স্ট্যামিনা ধরে রাখতে পারে না। শুরু থেকেই টপ গিয়ারে দৌড়ালে শেষের দিকে পিছিয়ে যায়। তাই তরুনদা এখন অন্যভাবে প্র্যাকটিস করাচ্ছে। শুধু লাস্টের চল্লিশ মিটার অঞ্জনা টপ স্পীডে দৌড়বে। যদিও একশ মিটারের নিয়ম প্রথম থেকেই টপ স্পীডে দৌড়াতে হবে, কিন্তু তরুনদা দেখছে, এইভাবে দৌড়লেই অঞ্জনার টাইম ভালো হয়। ব্যাতিক্রম, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এভাবেই অঞ্জনা ভালো করছে।

জানুয়ারিতে কলেজের এন্যুয়াল স্পোর্টসে তরুনদা ওর সিনিয়র অজয় দেবনাথের চার বছর আগের করা ২০০ মিটারের কলেজ রেকর্ড ভেঙে দিলো। এখন ২০০ মিটারে তরুনদার ২২.৩ সেকেন্ডে কলেজ রেকর্ড করেছে। শিশির ঘোষাল পোলভল্টে ১০ ফুট ২ ইঞ্চি করে ১৯৬৯ এর অশোক মুখার্জীর ৯ ফুট ৪ ইঞ্চির রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। আর অঞ্জনা ৭৫ মিটারে নিজের আগের রেকর্ড ৯.৮ সেকেন্ড ভেঙ্গে ৯.৭ সেকেন্ড করেছে।

এই সময় একদিন ডিপার্টমেন্ট হেড প্রফেসর বড়াল অঞ্জনাকে ডাকলেন। অঞ্জনার তো অবস্থা খারাপ। প্র্যাকটিসের জন্য ওনার পরপর দুটো ক্লাস মিস হয়েছে। স্যার হয়তো ভীষণ বকবেন আর অঞ্জনা সেই ভয়েই মরছে। একা কিছুতেই ওনার কাছে যাবে না। কাছাকাছি ছিলো সুকান্ত, তপু আর কাহালী। অঞ্জনা ওদের ধরেছে, “আমি হয়তো কেদেই ফেলবো রে। তোরাও প্লিজ আমার সঙ্গে চল।”

প্রফেসর বড়ালের কাছে যেতেই উনি ছেলেদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, কি ব্যাপার? হটাৎ সবাই মিলে কি জন্য এসেছো? সবাই চুপ, অঞ্জনাও। “কি ব্যাপার। কথা বলছো না তো এসেছো কেন?”
এবার অঞ্জনাই জবাব দিলো “স্যার, ওরা এমনি আমার সাথে এসেছে।”
– কেন? এরা তোমায় কি হেল্প করবে?
– না স্যার, আপনি আমায় ডেকেছেন, তাই।
অঞ্জনার মুখে উত্তর আসছে না। সত্যি তো, স্যার তো এদের কাউকেই ডাকেন নি। আর এদেরও স্যারের সাথে কোনো দরকারই নেই।
স্যার প্রশ্ন করলেন “তোমায় ডেকেছি, বুঝলাম। কিন্তু এরা কেন?”
– না স্যার। মানে বলছিলাম এমনি আমার সাথে এসেছে।
আবার অঞ্জনার অবস্থা খারাপ। স্যারের প্রশ্নের উত্তর ওর জানা নেই। স্যার অবশ্য নিজেই ম্যানেজ করে দিলেন “তোমায় তো ছেলেরা রানার নাম দিয়েছে?”
– হ্যাঁ স্যার।
– আর সামনেই তোমার ইউনিভার্সিটি স্পোর্টস।
– হ্যাঁ স্যার।
– গত দু’বছর তো তোমার এইসব বন্ধুরা তোমায় সাপোর্ট দিতে একবারও যায়নি। সত্যি তো?
– হ্যাঁ স্যার।
– এবার কেউ যাবে?
এবার সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে শুরু করেছে। স্যার একেবারে মোক্ষম জায়গায় প্রশ্নটা করেছেন। “শোন মেয়ে। কেউ যদি না যায় না যাবে। তাহলে আমিই একলা সাপোর্ট দিতে যাবো। এই কথাটা বলতেই ডেকেছিলাম। আর কিছু নয়।”
কৃতজ্ঞতায় অঞ্জনার চোখে জল এসে গেলো। কতজনের ভাগ্যে এইরকম স্যার জোটে? উফ, কি ভয়টাই না অঞ্জনা পেয়েছিলো। আর এদিকে স্যারও এই সুযোগে ছেলেদের দলকে মিষ্টি করে একহাত নিয়ে নিলেন।

ওদিন সন্ধ্যাবেলায় প্রফেসর বড়ালের মেয়ে রমু’দি হোস্টেলে অঞ্জনার সাথে দেখা করতে এলো। রমুদি অঞ্জনার থেকে এক বছরের সিনিয়র, আর্কিটেকচারের মেয়ে। ক্যাম্পাসেই থাকে। প্রায়ই হোস্টেলে গল্প করে সময় কাটাতে আসে। আজকে এসেই সে জানতে চাইছে অঞ্জনার ইউনিভার্সিটির স্পোর্টস কবে? অঞ্জনাও ভাবছে, হটাৎ কেন রমুদি ইউনিভার্সিটি স্পোর্টসের দিন জানতে চাইছে। “না রে। আমি বলছি কি লেডীস হোস্টেলের আমরা অনেকেই তোকে চিয়ার আপ করতে যাবো।” ওঃ, এবারে অঞ্জনা বুঝলো। তার মানে রমুদিও প্রোফেসর বড়ালের থেকে ডোজ পেয়েছে।

ইউনিভার্সিটি স্পোর্টসের আগের দু’সপ্তাহ অঞ্জনার একমাত্র ধ্যানজ্ঞ্যান গত বছরের থেকে ভালো টাইম, লং স্টেপস, আর রেসে প্রথম তিনে আসতেই হবে। সকালে সময় বাড়িয়ে এখন সে দুঘণ্টা প্র্যাকটিস করছে, বিকেলেও প্রায় দু ঘণ্টা। স্ট্যামিনা অনেক বেড়েছে। দমও বেড়েছে। একশ মিটার দৌড়ে এখন সে আর হাঁপায় না। আরও একটা জিনিষ, তরুনদা রোজ কুড়ি পঁচিশবার অঞ্জনাকে “রেডি স্টার্ট গো” প্র্যাকটিস করা শিখিয়েছে। জানা অজানা সিনিয়র জুনিয়র বহু ছেলে এসে অঞ্জনাকে বেস্ট উইশ জানিয়ে গেলো। এখন অঞ্জনা যখন প্র্যাকটিস করে, তখন অনেকেই মাঠে এসে চিয়ার আপ করে।

স্পোর্টসের দিনে প্রফেসর বড়াল অঞ্জনার জন্য গাড়ির ব্যাবস্থা করে দিলেন। আর ছেলেমেয়ের দল যাবে ওয়ার্কশপের বাসে, মুড়ির টিনে। কলেজ থেকেই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। বাসের ড্রাইভার পরিমল’দা এর আগে কলেজের অনেক টিমকে নিয়ে এদিক ওদিক গেছে। কিন্তু একটি মেয়ের জন্য ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ডে সাপোর্টার নিয়ে যাওয়া এই প্রথম। অন্য কলেজের থেকে আসা মেয়েরা তাকিয়ে দেখছে। অঞ্জনার সাথে প্রায় পঞ্চাশ জন সাপোর্টার।

মাঠে এসেই ছেলেদের দল ময়দানে নেমে পড়লো, কোন কলেজের কোন সুন্দরী মেয়ে এসেছে? ইশারা, চোখে চোখে কথা শুরু হয়ে গিয়েছে। শুধু তরুনদা, মেয়েরা আর কয়েকজন সিরিয়াস ছেলের দলই অঞ্জনাকে ঘিরে রয়েছে।

চারিদিকে কলেজের বন্ধুদের মাঝে অঞ্জনা আজ অনেক কনফিডেন্ট। মনে কোনো টেনশন নেই। পারফেক্ট বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। ওকে কোন গ্রুপে দিলো, সহজ গ্রুপ না কঠিন গ্রুপ এসব চিন্তাই ওর নেই। প্রথমে ওদের এলিমিনেশন রাউন্ড। নিজের গ্রুপে অঞ্জনা অনায়াসে ফার্স্ট হয়ে এলো। পরের রাউন্ডেও ফার্স্ট। দুবারই সময় নিয়েছে ১২.৮ সেকেন্ড। একটুও হাঁপায় নি, পুরো দমে দৌড়েছে। এবার ফাইন্যাল রাউন্ড। অঞ্জনাকে নিয়ে সাতজন। এইবার অঞ্জনার নিজেকে একটু নার্ভাস নার্ভাস লাগতে শুরু করেছে। বাসভরতি এতজন কলেজ থেকে এসেছে ওকে সাপোর্ট দিতে। ওদের অনেক অনেক আশা অঞ্জনা আজ ভালো রেজাল্ট করবে, আর সেটাই এখন অঞ্জনার টেনশন মনে হচ্ছে। তরুনদা দ্রুত অঞ্জনার ফেস রিডিং করে নিয়েছে। কলেজের ব্লেজারের হাতে ছুঁইয়ে ভোকাল টনিক দিলো “তোকে প্রফেসর বড়াল গাড়ির ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। আমরা এতজন তোর পাশে আছি। তোর কিসের টেনশন?” মেয়েরাও চিয়ার আপ করালো। অঞ্জনা তখন একটা ঘোরের মধ্যে। সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করলো ভোকাল টনিকে অঞ্জনাকে চাঙ্গা করে দিতে।

ফাইন্যালে অঞ্জনা এক নম্বর ট্র্যাকে। স্টার্ট হতেই অঞ্জনা লাইন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। প্রথম কুড়ি পঁচিশ মিটার অঞ্জনা সবার আগে। তবে এরপর ধীরে ধীরে অনেকেই ওকে ডিঙিয়ে এগিয়ে গেলো। প্রচুর উত্তেজনার মাঝে একটু পিছিয়ে লাস্ট চল্লিশ মিটার পর্যন্ত অঞ্জনা পাঁচ নম্বরে। ঐখানটায় ট্র্যাকের পাশেই তরুনদা দাঁড়িয়ে ছিলো। চিৎকার করে উঠলো “নে রানার, এবার টান।” এটা শুনতেই অঞ্জনা যেন হটাতই তীরের বেগে বেরিয়ে এলো। এক মুহূর্তে একজনকে ওভারটেক করে নিলো। পর মুহূর্তে আরেকজনকে। কলেজের সবাই চিয়ার আপ করছে “কাম অন অঞ্জনা, কাম অন”। অঞ্জনা ততক্ষণে নিজের খোলস ত্থেকে বেরিয়ে এসেছে। একশ মিটার পৌছানোর আগেই সামনের তিনজনকে ওভারটেক করে অঞ্জনা ফাইন্যালি সেকেন্ড। সময় নিয়েছে ১২.৬ সেকেন্ড। সুকান্ত ক্যামেরা নিয়ে ফিনিশিং লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলো। অঞ্জনা লাল ফিতে ছুঁতেই সুকান্তর ক্যামেরাও ক্লিক করে উঠলো। অঞ্জনার জীবনে এক স্মরণীয় মুহূর্ত। জীবনের প্রথম ইউনিভার্সিটি মেডেল সে পাবে। ওর কলেজের ওই প্রথম মহিলা যে কোলকাতা ইউনিভার্সিটির একটা মেডেল পাবে। অঞ্জনার চোখে জল, আর নতজানু হয়ে মাঠকে প্রণাম করছে।

রেস শেষ হতেই অঞ্জনার কলেজের সবাই হই হই করে ট্র্যাকে নেমে এলো। সুকান্ত অঞ্জনাকে একেবারে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করেছে। আরও কয়েকজন বন্ধু ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলো। সবাই তখন ফটাফট ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ফটো তুলছে।

সেই রাতে লেডীস হোস্টেলে গ্র্যান্ড ফিস্ট। ওদের নিজেদের কিচেন আছে, কিন্তু রান্না আসে বাইরে থেকে। আজ রাতে স্পেশাল ব্যাপার, নিজেদের কিচেনেই রান্না হবে। স্পেশাল মেনু, ডাবল ডিমের কারী। ছেলেরা সবসময় হাফ ডিম নিয়ে কলেজের মেয়েদের বদনাম দেয়। আজ শুধু ফুল ডিম নয়, সবার জন্য ডাবল ডিমের কারী। এছাড়াও মাছ মাংস দই মিষ্টি তো আছেই।

পরের দিনে কলেজে একে একে অনেকেই ওকে ডাকলেন, অনেক ভালো কথা বললেন। সবার আগে জিমের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর দত্ত, আর তারপরই প্রিন্সিপাল প্রফেসর ব্যানার্জি।

অঞ্জনা এখানেই থামছে না। কয়েক দিন পরেই, সামনের শনিবারে হাওড়া ডিসট্রিক্ট এন্যুয়াল স্পোর্টস। অঞ্জনার পাখীর চোখ এখন ওইদিকে। ওখানে ইউনিভার্সিটির থেকেও ভালো করতে হবে।

নির্দিষ্ট দিনে আবার সকলে মিলে অঞ্জনার সাথে হাওড়া ময়দানে গেলো। বিশেষ কিছু বলার নেই। অঞ্জনা একশ মিটারে অনায়াসে ফার্স্ট। সময় অবশ্য ইমপ্রুভ করতে পারলো না, সেই ১২.৬ সেকেন্ডই আছে। কিন্তু পুরো হাওড়া ডিসট্রিক্টের ১০০ মিটারের ফার্স্ট গার্ল এখন অঞ্জনা।

মার্চ মাসে, ফুটবল সিজন শুরুর আগে অঞ্জনাকে জিমে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। কলেজের প্রথম মেয়ে যে কলকাতা ইউনিভার্সিটি আর হাওড়া ডিসট্রিক্টের মেডেল নিয়ে এসেছে। স্যারেরা অনেক ভালো ভালো কথা বললেন। সবার শেষে অঞ্জনাকে কিছু বলতে ডাকা হ’লো। অঞ্জনা এসে অল্প কথায় জানালো “আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে ইউনিভার্সিটির স্পোর্টসে মেডেল জিতবো, এই আশা আমার ছিলো না। কিন্তু আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ, যারা ডিপার্টমেন্টের ওয়েলকামে আমায় রানার নাম দিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন। ওই হোস্টেলের ছেলেদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যারা জানালা থেকে আমায় রানার নাম দিয়ে প্যারোডি গান গেয়েছিলেন। গান বানিয়ে আমার পায়ে আপনারা নুপুর পরিয়েছিলেন। আপনারা আমায় রানার নাম না দিলে আর তরুনদার মতন গুরু না পেলে আমার আজ এই মেডেল পাওয়া হতো না। আমার ভালো লাগছে যে আমি আজ সত্যি একজন রানার। স্যারদের আমার প্রণাম জানাই। তোমাদের সবাইকেও আমার ধন্যবাদ আর নমস্কার জানাই”।

Sahityika Admin

Add comment