যেমন ছিলাম আমরা – স্বপ্নউড়ান
গণেশ ঢোল, ১৯৮৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
দিল্লি এয়ারপোর্টটা দিনকে দিন আমাদের মতো যারা অবরে সবরে এয়ার ট্রাভেল করে তাদের জন্যে খুব অসুবিধেজনক হয়ে পড়ছে। সুরাট থেকে চেক ইন করে সাত সকালে দিল্লির এক নাম্বার টার্মিনালে পৌঁছও, সেখান থেকে শাটল বাসে ক’রে দু’ নম্বর টার্মিনালে এসে চেক ইন করে সিকিউরিটি চেকের হ্যাপা পুইয়ে একশো চৌত্রিশ নম্বর গেটের কাছে অপেক্ষা করো দেরাদুনের ফ্লাইটের জন্যে। আগে সুরাটে লাগেজ জমা করে সোজা দেরাদুনে কালেক্ট করে নিতাম। সিকিউরিটি চেকও তখন এত কড়া ছিল না। এখন সিআইএসএফ জুতো, ঘড়ি, বেল্ট পর্যন্ত সব খোলায়, প্যান্টটা শুধু বাকি রাখে। শাহরুখ খানকে তো তাও খুলিয়ে চেক করেছিল হিথরো এয়ারপোর্টে। আগে এরকম এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালের যাওয়ার ঝামেলা পোয়াতে হত না।
যাই হোক এবার আমার কী ভাগ্য কে জানে সীট পড়েছিল একেবারে সামনের সারির আইল সীটে। ওয়ান ডি। এই সীটে বেশ পা ছড়িয়ে বসা যায়। মধ্যের সীটটা ফাঁকা। জানলার ধারে একজন মোটামতো লোক বসেছিল। সে খালি এয়ার হোস্টেসদের ডেকে নানান ফরমাস করছিল। প্লেন ছাড়ার আগেই জল তেষ্টা পেয়ে যাচ্ছে তার, সল্টেড কাজুর সঙ্গে চা খেতে ইচ্ছে করছে, বোর্ডিং বন্ধ হয়ে গেছে, প্লেনের দরজা বন্ধ হবে হবে করছে, এমন সময় তার টয়লেট যেতে ইচ্ছে করছে। তবে তার আব্দারগুলো কেমন দুরন্ত অবুঝ শিশুর মতো, লম্পট বুড়োর মতো নয়। আমার খুব মজা লাগছিল লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে। হঠাৎ আমায় বলল, “আপনি মাঝের সীটটায় আপনার হাতের পেপারটা রাখতে পারেন, এই সীটটাও আমি বুক করে রেখেছি যাতে আমাদের মধ্যে কেউ বসে যেন বিরক্ত না করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি জানতেন আমি আসব এখানে?”
– “আপনার মতোই কোনো ভালোমানুষ আসবে জানতাম।”
– “আমি ভালোমানুষ আপনি বুঝলেন কী করে?”
– “আমি রোজ সকালে চোখ বুজলেই সারা দিনে কার কার সাথে দেখা হবে তার একটা আভাস পাই। আজ আপনারই অবয়বের কাউকে দেখেছিলাম।”
আমার বেশ উত্সাহ হয়, তাছাড়া মুফতে কেউ প্রশংসা করলে ভালো তো লাগবেই। খালি মনে হচ্ছিল ভদ্রলোককে আগেও কোথাও দেখেছি। বিশেষ করে ওঁর কথা বলার ধরন এবং হরকত খুব চেনা লাগছিল। এক অদ্ভুত দেজা ভূ। উনি জিজ্ঞেস করলেন, “কোথা থেকে আসছেন?”
-” সুরাট থেকে।”
– ” কিন্তু আপনাকে দেখে তো গুজরাতি মনে হয় না।”
– ” আমি গুজরাতি নই, বাঙালি।”
এতক্ষণ কথা হচ্ছিল হিন্দি, ইংরিজি মিশিয়ে, এবার উনি বিশুদ্ধ বাংলায় বলে উঠলেন, “তাহলে আপনি সুরাটে কী করছেন?”
– “ওই কর্মসূত্রে।”
– “আপনি এত ভালো বাংলা বলেন কী করে?”
– ” আমার মা বাঙালি, কলকাতায় হাজরা রোড জানেন? আমার মা ওই পরিবারের মেয়ে।”
– “আপনার মা যদি হাজরা পরিবারের মেয়ে, তো আপনি এত মোটা কেন?”
-” এটা কীরকম প্রশ্ন হল? আমার মোটা হওয়ার সাথে হাজরা বাড়ির কী সম্পর্ক?”
– “কোনো সম্পর্ক নেই। আপনার পেছনে লাগার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম। আপনি যেমন প্লেনে উঠেই এয়ার হোস্টেসদের বিরক্ত করছিলেন, তেমনি একটু আপনার লেগ পুলিং করলাম।”
“না, প্রশ্নটা ক’রে ভালো করেছেন। আপনার মনে যখন জেগেছে প্রশ্নটি তখন তার উত্তর দিয়ে দেওয়াই বিধেয়। আমি যে ধরনের কাজ করি তাতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। কখনও কখনও সারাদিন ধরে রিওয়াজ। একটা রাগ বা বন্দিশ যখন কাছে এসে দূরে সরে যায়, কিছুতেই ধরা দিতে চায় না, তখন তাকে ছোঁয়ার জন্য অনেক কসরত করতে হয়। একলা চুপ করে অন্ধকার ঘরে বাগদেবীর ধ্যান করতে হয়, বারবার সেতারের তার টান করে শুদ্ধ সা, কোমল নি-র পেছনে ছুটে বেড়াতে হয়। মিউজিক তো আর অঙ্ক নয় যে ফর্মুলা পুট করলাম আর মিলিয়ে দিলাম। সংগীত এক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে চলা সারাটা জীবন। কারুর ঠিক করে ‘সা’ লাগাতেই সারা জীবন কেটে যায়, কারুর কাছে তা চকিতেই ধরা দেয়। মিউজিক অঙ্ক নয়, আবার অঙ্কও। গ্রামার মেনে গাইলে বা বাজালে শ্রুতিমধুর হবে ঠিক কিন্তু প্রকৃত সৌন্দর্যের স্পর্শ পেতে গেলে ওই অঙ্কের সাথে একটা এক্স ফ্যাক্টর চাই। ওই এক্স ফ্যাক্টরকে ছুঁতে চাওয়ার চেষ্টাই সমস্ত জীবনের সাধনা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন না, “দ্য সং দ্যাট আই কেম টু সিং রিমেনস আনসাং টু দিজ ডে।” বিলায়েত খুঁজে পেয়েছিলেন সেই এক্স ফ্যাক্টর।অনেকেই তো সেতার বাজায় কিন্তু বিলায়েতখানি বাজ হল আলাদা। এই পৃথিবীতে আর কেউ কোনোদিন অমন বাজাতে পারবে না। যদিও আমার বাবা আমায় কখনও উঠতে দিতে চায়নি, আমার প্রতিভাকে স্বীকারই করতে চায়নি, তবু বলছি আমার বাবার মতো শিল্পী আর জন্মাবে না।”
আমি এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম ওঁর কথা, উনি থামতেই আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল, “আপনি সুজাত খান? আমি আপনার বাজনা, গান শুনেছি স্পিকম্যাকের অনুষ্ঠানে এসভিএনআইটির ক্যাম্পাসে। আমরা (আমি আর আমার স্ত্রী) এক শীতের সন্ধ্যায় শুনেছিলাম, দেখেছিলাম আপনাকে দুই অদীক্ষিত শ্রোতা-দর্শকের অপার মুগ্ধতায়।
উনি চোখ বন্ধ করে বললেন, “হ্যাঁ আমিই সুজাত খান।”
তারপর সারা উড়ান আর কোনো কথা বললেন না। চোখ বন্ধ করে থাকলেন। স্বল্প সময়ের উড়ানে আমি আর বিরক্ত করিনি ওঁকে। এমনিতেই মরমে মরে যাচ্ছিলাম আমার অনাবশ্যক বাচালতা, অহেতুক স্মার্টনেস দেখানোপনার আতিশয্যে।
প্লেন যখন ল্যান্ড করছে তখন বললেন, ” আপনার এই পিঙ্ক পেপারেই অটোগ্রাফ দিই তাহলে। আপনার নামটা?”
নাম বলতেই পাশে ফেলে রাখা ইকোনমিক টাইমসের সাদা জায়গায় খসখস করে লিখলেন – টু গণেশজী / সুজাত খান
আমার মুখ দিয়ে আর কোনো বাক্যি সরছিল না। নামার সময় ওঁর হ্যান্ডব্যাগটা হাত থেকে নিতে গেলাম, কিছুতেই নিতে দিলেন না। আমি ভুলেই গেছি সেলফি নেওয়ার কথা। আমার পেছনের সীটেই ছিল বন্ধু আর ডি দেশাই। সে চুপচাপ শুনছিল, দেখছিল আমার কাণ্ডকারখানা। ও বলল, “উনকে সাথ এক ফোটো তো লে লিজিয়ে।”
(যেমন ছিলাম আমরা ~ ২১৭ পর্ব থেকে)
© Gₐₙₑₛₕ Dₕₒₗₑ
Add comment