ভ্যালেন্টাইন ডে, কিছু কথা
প্রদীপ কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন এখন যেন জীবনের রোম্যান্সের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে, তবে এই ছুটির দিনটির উৎসের সঙ্গে জড়িত কাহিনী একটুও রোমান্টিক নয়।
ভ্যালেন্টাইন ডের ইতিহাস খুব পূরোনো এবং জটিল। আজকের দিনে ভ্যালেন্টাইনস ডে চুম্বন, উপহার এবং ক্যান্ড্ল লাইট ডিনারের জন্য পরিচিত, কিন্তু এই উৎসবের আমেজে ভরা দিনটির পিছনে শুধু দুঃখের ইতিহাসই লুকিয়ে আছে। আসুন দেখা যাক ভ্যালেন্টাইন ডে সম্পর্কিত কিছু তথ্য।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে কবে উদযাপন করা হয়?
পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে, পোপ গেলাসিয়াস ১৪ই ফেব্রুয়ারি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময় এই দিনটির সঙ্গে শুধু ধর্মেরই সম্পর্ক ছিল। সময় এগুনোর সাথে সাথে এর সঙ্গে নানা উপকথা জুড়ে গেছে, যা এর পরের অংশে পর্যায়ক্রমে দেওয়া হয়েছে।
ভ্যালেন্টাইনস ডে কীভাবে শুরু হয়েছিল?
ভ্যালেন্টাইন্স ডে হলো ক্যালেন্ডারে একটি নির্দিষ্ট দিন যা লুপারক্যালিয়া নামক প্রাচীন রোমান ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ছুটির তালিকায় ঢুকে পড়ে। কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে ভ্যালেন্টাইনস ডে কে ভালোবাসার সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। লুপারক্যালিয়া উর্বরতা উদযাপন করতো। মনে করা হয়, এই সময়ে এক অদ্ভুত আচার পালন করার প্রচলন ছিল। এই আচার অনুযায়ী একটি বয়াম থেকে বিভিন্ন নারী ও পুরুষের নাম লেখা কাগজ তুলে নিয়ে জুটি বাঁধা হতো। প্রাচীন গ্রিসে, লোকেরা দেবতা জিউস এবং দেবী হেরার বিবাহ উদযাপনের জন্য একটি শীতকালীন উৎসব পালন করতো। তবে এই সব রীতি রেওয়াজের সঙ্গে ভ্যালেন্টাইন ডে র প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নিশ্চিত ভাবে জানা যায় না।
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কে ছিলেন? (এবং চকোলেট হার্টের সাথে তার কী সম্পর্ক?)
বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিল না বলেই অনুমান করা হয়। সময়ের সাথে সাথে এই দুটি ব্যাপার, অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন ডে এবং প্রণয়, এক হয়ে গেছে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে ছিল ক্যাথলিক ধর্মের একটি উৎসবের দিন, যা ৫০০ খ্রিস্টাব্দের লিটারজিকাল ক্যালেন্ডারে জায়গা করে নেয়। দিনটিতে শুধুই শহীদ সন্তদের স্মরণ করা হ’তো। শহীদ হওয়া সব সাধুদের একটাই নামে ডাকা হ’তো। নাম অনুমান করা খুব কঠিন কাজ নয় – হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন – ভ্যালেন্টাইন। প্রচলিত বিভিন্ন কিংবদন্তিতে ভ্যালেন্টাইন বা ভ্যালেন্টিনাস নামে তিনজন সন্তের উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে তাঁদের সম্পর্কে খুব কমই তথ্য জানা যায়। তা ছাড়া সেন্ট ভ্যালেন্টাইন সম্পর্কে প্রচলিত তৎকালীন গল্পগুলো ছিলো পরস্পরবিরোধী। তাই ১৯৬৯ সালে খ্রিস্টান লিটারজিকাল ক্যালেন্ডার থেকে দিনটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তবে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও, যার উপর ভিত্তি করে ছুটির দিন, সেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের উপর বেশ কিছু কিংবদন্তির প্রচলন আজও রয়েছে। একটি কিংবদন্তি বলে যে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন পৌত্তলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করেছিলেন এবং সেই জন্য রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তাঁকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন। তবে মৃত্যুর আগে, তিনি তার জেলারের কন্যাকে অলৌকিকভাবে সুস্থ করেছিলেন। সেই জেলার পরে সপরিবারে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। আরেকটি কিংবদন্তি বলে যে বিশপ নামক আর এক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন অফ টারনি ছিলেন আসল সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। এনাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
অন্য আর এক দলের মতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন রোমান ধর্মযাজক যিনি বিয়ে করতে নিষেধ করা সৈন্যদের বিয়ে দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে জানা যায়, এক রোমান সম্রাটের আদেশের কারণে রোমান সৈন্যদের বিয়ে করার অধিকার ও অনুমতি ছিল না, কারণ সম্রাট ভাবতেন বিবাহিত সৈন্যরা ভাল যোদ্ধা হ’তে পারে না। এই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন একটি কিউপিডের সাথে একটি আংটি পরতেন – এটি প্রেমের প্রতীক, যা সৈন্যদের তাঁকে চিনতে সাহায্য করেছিল। তিনি আপামর খ্রিস্টানদের, ঈশ্বরের প্রতি তাদের ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য হৃদয়ের প্রতীক হিসাবে ‘কাগজের হৃদয়’ বিতরণ করতেন – যা সম্ভবতঃ আজকের দিনে গ্রীটি্ংস কার্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। এট আজকের দিনের অনুমান। এই কিংবদন্তির কারণে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন পরবর্তীকালে প্রেমের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে পরিচিত হন। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রার্থনা সকল প্রেমীদের একে অপরের সাথে সংযুক্ত করতে বলে, যাতে দু’টি হৃদয় এক হয় এবং নবদম্পতি ঈশ্বরের প্রতি তাদের ভক্তি মনে রাখে।
যদিও সেন্ট ভ্যালেন্টাইন গল্পটি রোমান্টিক প্রেমের জন্য ছুটির দিন হিসাবে প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যেটি সত্যই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এবং প্রেমের মধ্যে সংযোগকে দৃঢ় করেছিল তা ছিল ১৩৮১ সালে মধ্যযুগীয় লেখক জিওফ্রে চসারের একটি কবিতা। ঐতিহাসিকরা এটিকে “আধুনিক ভ্যালেন্টাইন্স ডের উৎস বলে মনে করেন। এই দিনটিতেই আমরা এখন মনের মানুষটির সঙ্গে স্থায়ী প্রেমের অঙ্গীকার গ্রহন করি।
আমরা কেন ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন করি?
চসার ছিলেন মধ্যযুগের প্রথিতযশা মহাকবি, যে যুগে সোচ্চার প্রেমের সাথে কবিতা, গান, শিল্পকলা সমার্থক ছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে, “ভ্যালেন্টাইন” শব্দটি দিনের কবিতা এবং গানে প্রেমিককে বর্ণনা করার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয় এবং অষ্টাদশ শতকে, ইংল্যান্ডে দ্য ইয়াং ম্যানস ভ্যালেন্টাইন রাইটার নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ, কাগজের ভ্যালেন্টাইন কার্ডের গণ- উৎপাদন তৈরি করা শুরু হয় এবং আজকের ভ্যালেন্টাইন্স ডে তারই ফলশ্রুতি।
আধুনিক কালের ভ্যালেন্টাইন্স ডে র সাথেও কিছু দূঃখজনক ঘটনাও জড়িয়ে পড়েছে। ১৯২৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী শিকাগোতে আল ক্যাপোন গোষ্ঠী দ্বারা সংগঠিত একটি গ্যাং সাতজন মানুষকে ভ্যালেন্টাইন দিবস পালন করার অপরাধে হত্যা করেছিল। ভ্যালেন্টাইনস ডে’র এই গণহত্যা অনিয়ন্ত্রিত নিষেধাজ্ঞার ইতিহাসে একটি বহুচর্চিত ঘটনা হয়ে উঠেছে।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে মানে কি?
বেশ কিছু শতাব্দী যাবৎ ভ্যালেন্টাইন্স ডে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, একটি প্রাচীন আচার পালনের দিন এবং সর্বোপরি একটি ছুটির দিন। সে যাই হো’ক, আপনি আপনার নিজের দিনটি কিভাবে পালন করবেন সেটা আপনি নিজের মর্জি মতোই ঠিক করবেন। আপনি ফুল, চকোলেট বা অন্যান্য উপহার দিয়ে পরিবার, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, সহকর্মীদের আপ্যায়ন করতে পারেন বা দিনটি সম্বন্ধে উদাসীনও থাকতে পারেন। কিছু মানুষ যেমন এই দিনটি ভালোবাসেন, কিছু মানুষ দিনটিকে অপছন্দও করেন। ভালোবাসলে প্রিয় জনের বা প্রিয় জনেদের সঙ্গে সিনেমা দেখে, ডিনার করে, নয়তো পার্টির আয়োজন করে দিনটি স্মরনীয় করে তুলতে পারেন।
রোমের লুপারকেলিয়ার প্রাচীন আচার পালনের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে লটারির মাধ্যমে নারী ও পুরুষের জুড়ি তৈরি করা হতো প্রজননের কারনে। পরে অবশ্য প্রথাটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিলুপ্ত হয়। কেউ কেউ মনে করেন বিলুপ্ত প্রথাটি আজকের দিনের ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসাবে বিবর্তিত হয়েছে। তবে এটাও সত্য যে চতুর্দশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত ফেব্রুয়ারি মাসের এই দিনটির সাথে রোমান্সের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
মোদ্দা ব্যাপারটা যা দাঁড়াচ্ছে, তার হ’লো তিনজন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের যে কোনো একজনের নামে দিনটি ভালোবাসার দিন হিসাবে পালিত হয়। প্রথম জন সম্রাট ক্লডিয়াসের দ্বারা মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। অন্য একজন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন অফ টার্নি নামে পরিচিত এবং পরবর্তী কালে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত বিশপ এই তালিকায় দ্বিতীয় সন্ত। তৃতীয় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমান সম্রাটের বিরুদ্ধে গিয়ে সৈন্যদের বিয়ে দিয়ে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত হন। হয়তো এই তিনজন একই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন, কিন্তু সেটা নিছকই অনুমান।
আমেরিকায় ভ্যালেন্টাইন ডে মেসেজ প্রচলিত হয় উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। রোমান প্রেমের দেবতা কিউপিড, হৃদয়ের প্রতীক এবং পাখির ছবি সম্বলিত এই প্রেমের বার্তার সঙ্গে লাল ফুল, বিশেষ করে লাল গোলাপ ও চকোলেট ভ্যালেন্টাইন ডে উপহারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আজকে ভ্যালেন্টাইন ডে সারা দুনিয়ায় উদযাপিত হয়, সারা দুনিয়ার একটি জনপ্রিয় দিন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, এমনকি স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরাও এই দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে।
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার – উইকিপিডিয়া
Add comment