সাহিত্যিকা

ভ্যালেনটাইন দিবসঃ প্রেমের ত্রিধারা

ভ্যালেনটাইন দিবসঃ প্রেমের ত্রিধারা
ময়ূখ দত্ত, ১৯৯০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
এপিসোড ১ঃ বেলাশুরু
সচ্চিদানন্দ আর রুশার বিয়েটা যে কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো সেটা অনেকের কাছেই বিরাট রহস্যের!! স্কুল এবং কলেজের তিন তিনটে ভরাট সিরিয়াস প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে অবশেষে রুশা সম্বন্ধ করে বিয়েতে রাজী হয়েছিলো। তবে এরকম বিপরীত মেরুর মানুষের সাথে যে বেডরুম শেয়ার করতে হবে সেটা এর আগে কোনোদিন সে ভাবে নি। একে তো আজকের দিনে কারুর নাম যে সচ্চিদানন্দ হতে পারে, সেটা শুনেই অবাক লেগেছিলো, বন্ধুমহলে অনেকদিন হবু বরের নামটাই বলে নি, প্রথম দিকে বলতে বেশ লজ্জাই লাগতো। সম্বন্ধ ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে, বিয়ের আগে তিন-চারবার এদিক ওদিক দেখা করেছিলো দুজনে, তখন অবশ্য মানুষটাকে খারাপ লাগে নি। একদিন আর কৌতুহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই বসেছিলো “তোমার এই বিগত শতাব্দীর নাম টা কে রেখেছিলো?” হয়ত অল্প আলাপের মধ্যেই এই প্রশ্নটায় আরো অনেক ছোটো ছোটো মাইক্রো প্রশ্ন লুকিয়ে ছিলো, সেটা বুঝে বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে সফটওয়ার ইঞ্জিনীয়ার সচি সরল হাসিতে উত্তর দিয়েছিলো, “কেন, খুব সেকেলে তাই না?”
আরো অনেকেই অনেকরকম কথা বলেছে, তোমার আগে দুজন মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছিলো, কিন্তু সম্ভবত ওরা আমার এই আদ্দিকালের নামের কারনেই আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয় নি। তুমি চাইলে আমি কিন্তু কোর্টে এফিডেপিট করে আমার নামটা পাল্টে নেব বিয়ের পরে…
“আরে না, না, সেটা বলছি না…” একটু যেন অপ্রস্তুতই হয়ে গিয়েছিলো রুশা।
তবে সচির কথার মধ্যে রুশা কোথায় যেন ওর সেই অনেকদিন ধরে খুঁজতে থাকা ‘অকপট ভালবাসা’র একটা আভাস পেয়েছিলো। বিয়ের পরে একটু আধটু আলাপ পরিচয় হওয়ার পরে রুশা ভাবতো যে নামের সাথে সাথে বরটাও কি আগের যুগের? কি করে যে সদা পরিবর্তনশীল সফটওয়ার কোম্পানীতে চাকরী করে কে জানে… এখনো সেই বাংলা হিন্দি সিনেমা, আর গানেই বুঁদ হয়ে থাকে… দুধ চা ছাড়া সকালে পেট পরিষ্কার হয় না, কফি নাকি শুধু শীতকালে খাওয়ার জিনিষ, ব্ল্যাক কফি, ক্যাপুচিনো, কোল্ড কফি ইত্যাদি তো অনেক দূরের জিনিষ। জীবনে নাকি কোনোদিনই গার্লফ্রেন্ড ছিলো না, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে দু-একবার নাকি ব্লু ফিল্ম দেখেছিলো, কিন্তু সেটাও তার নাকি ভালো লাগে নি। বিয়ের আগে সেক্স ইত্যাদি তো অনেক দূরের কথা!! কথায় কথায় বীয়র পাবে বা বারে যায় না, রেড ওয়াইনের সাথে চীজ খেতে হয় নাকি হোয়াইট ওয়াইনের সাথে, এই সব আলোচনার থেকে বেশ দূরেই থাকে।
কোথাও ঘুরতে গেলে বা কোথাও খেতে গেলেই ফেসবুকে সবাইকে যে জানাতে হবে আমি কত ভাল আছি, এসবে সচি বিশ্বাস করে না। তবে কেমন যেন সব কিছুতেই আছে, আবার কোনো কিছুতেই নেই, এরকম একটা ব্যাপার আছে মানুষটার মধ্যে… একদিন জিজ্ঞাসা করাতে প্রায় অন্য গ্রহ থেকে আসা একটা দার্শনিক টাইপের উত্তর ভেসে এলো “…পুরোনো, নতুন বা আধুনিক বলে কিছু হয় না, সব কিছুর মধ্যেই ভালো বা খারাপ দিক আছে, সেটা বুঝে, নিজের পছন্দের বৃত্ত তৈরী করে খুশী থাকাটাই আমার কাছে আধুনিকতা বলে মনে হয়, জানো নিশ্চই যে আজকাল ‘উত্তর আধুনিক’ বা post modern বলেও একটা টার্ম চালু হয়ে গেছে। ভেবে দেখো পরবর্তী প্রজন্ম কি টার্ম ব্যবহার করবে? উত্তর-উত্তর আধুনিক?!!”
নিজেই মস্করায় নিজেই হেসে উঠলো সচি। সম্বন্ধ করে বিয়ের প্রথম কয়েক সপ্তাহ শারীরিক জানা-চেনা হতেই কেটে গেলো। তিনমাস পরেই ভ্যালেন্টাইন দিবস, রুশা মনে মনে খুব উত্তেজিত যে নতুন বিয়ের ঠিক পরেই প্রথম বছর কিভাবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেট করবে। নিজের অনেক প্ল্যান মাথায় আছে, এদিকে সচির কোনো হেলদোল নেই, কোথায় দুজনে বসে প্ল্যান করবে যে কোথায় যাবে, আগের বছরের কেনা লাল-কালো ড্রেস টা রুশা রেখে দিয়েছিলো বিয়ের পরে প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে পরবে বলে… কোন রেস্ট্যুরেন্টে ডিনার করবে? আজকাল সব যায়গায় কত ডিসকাউন্ট ডিল দেয়। আপাত উদাসীন ভাবে নতুন স্বামীর মনের হদিস পেতে সচিকে একবার জিজ্ঞাসা করায় নিরুত্তাপ উত্তর পেল “আরে ভালবাসার আবার আলাদা দিন হয় নাকি? ঠিক আছে তুমি বলছ যখন কোথাও একটা যাব রাতে খেতে..”।
পুরো উত্তেজনাটাই কেমন যেন জলে ভেজা মুড়ির মত মিইয়ে গেল রুশার… কি করে এই আদ্দিকালের স্বামীকে বোঝাবে যে খেতে যাওয়া আর ডিনার করতে যাওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে!! বিয়ের সময়ে মা বারবার করে পাখীপড়ার মত করে কানের গোড়ায় ঢুকিয়েছিলো “এটা কিন্তু তোদের প্রেমের বিয়ে নয়, সম্বন্ধ করে বিয়ে, তোদের জানা-চেনা হতে অনেক সময় লাগবে, স্যাক্রিফাইস অনেক করতে হয় সংসারের জন্য…সবসময়ে প্রস্তুত থাকবি…”।
রুশা আর কথা বাড়ায় নি, মনে মনে ভাবলো দেখাই যাক না, লোকটা কি ব্যাবস্থা করে। ভ্যালেনটাইন্স ডে’র সকালে রুশা রান্নাঘর থেকে দেখলো যে সচি খাবার টেবিলে বসে একের পর এক রেস্ট্যুরেন্টে ফোন করে যাচ্ছে। শেষে খুব বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরের দরজার পাশে এসে হতাশ মুখে বলল “আজকাল এই এক হুজুগ হয়েছে, কোনো একটা উপলক্ষ্য হলেই সবাই বাইরে খেতে চলে যায়, এই চত্তরের একটা কোনো ভালো রেস্ট্যুরেন্টের টেবিল খালি নেই আজ সন্ধ্যেতে… কি করি বলো তো?” রেগে গিয়েও মায়ের কথা মনে করে রুশা সামলে নিল – “আমি তো আগেই বলেছিলাম, ছাড়ো, একবছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেশান না হলেই বা আর কি আছে, কি খাবে বলো সন্ধ্যেবেলা, বানাবো তাহলে…”
সচি রুশার এই অভিমান সামলানো ব্যাপারটাই বুঝল না, বরং ব্যাপারটাকে কেমন যেন আক্ষরিক অর্থে ধরে নিয়ে একগাল হেসে বললো “ঠিক আছে, আমি আজ তাহলে তাড়াতাড়ি অফিস কেটে চলে আসব, দুজনে মিলে রান্না করব, খুব মজা করব, তারপরে আমাদের মুভি নাইট!! তোমার পছন্দের মুভি!! কি মুভি দেখবে ঠিক করে রাখো”। রুশার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এবারে সেলিব্রেশানের কোনো ছবিই সেভাবে পোস্ট করা যাবে না, বাকি বন্ধুরা প্রেমিক বা হাসব্যান্ডের সাথে কত কত পোস্ট দেবে। কত আশা সে করেছিলো আজকের সন্ধ্যার জন্য!
সচি সত্যিই সেদিন তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এলো, সাথে রুশার পছন্দের কোরিয়ান খাবারের অনেক কিছু মাল-মশলা… ” আজ বাড়িতেই আমরা কোরিয়ান গ্রিল বানানোর চেষ্টা করব, জমে যাবে বলো?”…
সন্ধ্যেটা রুশার অবশ্য খারাপ কাটলো না, দুজনে ইউটিউব দেখে দেখে কোরিয়ান গ্রিল বানালো, সাথে কিমচি … খেতে যে খুব একটা ভাল লাগলো রুশার তা নয়, তবু নতুন স্বামীকে খুশী রাখতে বললো “বাঃ ভালোই তো খেতে হয়েছে!!”
সচির মুখে বড় তৃপ্তির হাসি, রুশার বুক ফেটে যাওয়া হতাশাটা সচির নজরে পড়ল না..”কি সিনেমা দেখবো আজ আমাদের এই স্পেশাল মুভি নাইটে?”
মনে মনে রুশা বলতে চাইল ‘কিসের আবার স্পেশাল মুভি নাইট? সেই তো নাইট ড্রেস পরে সোফাতে বসে বসে ঘর আধা অন্ধকার করে কিছু একটা সিনেমা দেখা… এর মধ্যে ভ্যালেন্টাইন ডে কোথায়?’। মুখে বললো- “আমি একটা ভাল ইরানিয়ান সিনেমা র সন্ধান পেয়েছি, আগের সপ্তাহে আমার এক বন্ধু ওটা দেখে আমাকে জানিয়েছে…”
– ইরানিয়ান সিনেমা? কেন তোমার বন্ধু কি ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টের সাথে জড়িত নাকি আজকালকার আঁতেল বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠিভুক্ত?” হাসতে হাসতে বলল সচি…
– ঠিক আছে, তোমার পছন্দ না হলে অন্য কিছু দেখব..
– আরে না, না, আজ এই স্পেশাল দিনে তোমার পছন্দের সিনেমাই দেখব, আমি প্রমিস করেছিলাম তো!!
রাতে দুজনে সোফা কাম বেডে ওই সিনেমা টা দেখতে বসে। রুশা জানে যে এই ধরনের সিনেমা সচির এক্কেবারেই পছন্দের নয়, তাও মনের মধ্যে কেমন যেন একটা প্রতিশোধস্পৃহা জেগে আছে আজ…এবছরের ভ্যালেন্টাইন্স ডে টা এভাবে ‘নষ্ট’ হয়ে যাওয়ার জন্য!!
সিনেমাটা চালু করে আধঘন্টার মধ্যেই রুশা দেখল সচি ঢুলছে… বেশ হয়েছে… আরো মিনিট পনেরো  পরে রুশা বেশ বুঝতে পারল সচি ঘুমাচ্ছে, রুশা আরও বেশী করে পছন্দের সিনেমাটাতে মনোযোগ দিলো। সিনেমাটা বড্ড ভাল, মৌলবাদী শাসনের মাঝে এক আজন্ম প্রতিবাদী মেয়ের সমাজ ভাঙা প্রেমকথা। মেয়েটি প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে, দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, কিন্তু আবার উঠে বসছে, কষ্টের হাসি মুখে ফুটে উঠছে…  সিনেমা দেখতে দেখতে রুশাও নিজের মনে হাসছে, মন খারাপ করছে… মেয়েদের কি সব যায়গাতেই এরকম ভাবেই মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়? পৃথিবীর কোথাও কি কেউ থাকে না, যে কিনা সংসারে মেয়েদের সূক্ষ্য অনুভুতি গুলো বোঝার চেষ্টা করবে?
হঠাত কোথাও থেকে একটা ফোঁপানো কান্নার শব্দে সচির ঘুম ভেঙে গেলো, একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসে দেখলো যে রুশা দুগালে হাত দিয়ে এক্কেবারে একাত্ম হয়ে সিনেমাটা দেখছে এবং পর্দার নায়িকার সাথে নিজেও কাঁদছে, ওঁর গোলাপী দু’গাল দিয়ে জলের ধারা বইছে…
“আজ এই ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে আমার এই সুন্দরী বৌ কাঁদছে, আমি এটা দেখতে পারবো না…আজ আর তোমায় সিনেমা দেখতে হবে না, চলো শুতে যাই…” বলে সচি রুশাকে জড়িয়ে ধরে বেডরুমে নিয়ে চলে গেলো…রুশাও আর কথা বললো না…
পরের দিন রুশার ঘুম ভাঙলো ড্রইং রুমের টিভির শব্ধে। গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দেখে সচি আগের রাতের সেই ইরানিয়ান সিনেমাটাই আবার একাত্ম হয়ে দেখছে।
“তুমি আবার এই সিনেমাটা দেখতে বসেছ কেন? কাল তো নিশ্চই তোমার ভাল লাগছিলো না, তাই নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলে কাল রাতে..” একটু যেন শ্লেষের সাথেই বলল রুশা।
– সরি, সরি, সত্যি কথা বলতে, সত্যি আমার ভাল লাগছিলো না…
“তাহলে এখন?”
– না, না, আজ আমি সিনেমা টা দেখছি না, আমি বোঝার চেষ্টা করছি সিনেমাটার মধ্যে কি এমন আছে যে আমার এত ভালবাসার মানুষটা সেটা দেখে কেঁদে ফেলে, চোখ ভেজায়… সেটা না জানলে আমি কি করে তোমার এত ভালবাসার সম্মান জানাতে পারবো? শরীর তো কিছুবছর পরেই জানা-চেনা হয়ে যাবে, তারপর তো শুধুই অভ্যেস, কিন্তু আমরা দুজনে দুজনকে যদি ঠিকভাবে জানতেই না পারি তাহলে সারা জীবনটা একসাথে, এক ছাদের তলায় কি করে কাটাবো?
রুশার ঘুম চোখ টা আবার কেমন যেন জলে ভিজে গেলো, ক্যান্ডেললাইট ডিনার নাই বা হলো, লাল-কালো ড্রেস্টা পরে ফেসবুকে ছবি নাই বা পোস্ট হলো, জীবনের সবথেকে দামী মানুষটা আমার ভালবাসা বোঝার চেষ্টা করছে, আমাকে প্রতিটা অনুভুতি বোঝার চেষ্টা করছে, আমার মনটাকে বোঝার চেষ্টা করছে, এর থেকে ভালো ভ্যালেন্টাইন ডে গিফট বা সেলিব্রেশান আর কি হতে পারে?
রিমোটের বোতাম টিপে টিভিটা অফ করে কাঁধে মাথা রেখে একহাতে সচির পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে এলোমেলো করে দিতে দিতে রুশা বললো “পাগল!! মেয়েদের বোঝা কি এতই সহজ? সারা জীবন লেগে যাবে!!”।
এপিসোড ২ঃ মধ্যগগন
চার চারটি বছরের বিয়ে ও এক সন্তানের পরে ডিভোর্স, ব্যাপারটা মেনে নিতে প্রথম দিকে সুচেতনার বেশ ঝামেলাই হচ্ছিলো। যদিও আজকালকার “মুভ অন” সংস্কৃতির প্রথা মেনে সুচেতনা আর সুজয় – দুজনেই ঠিক করে নিয়েছিলো যে সংসারে থেকে প্রতিদিনের এই ঝগড়া ঝাঁটি করে থাকার কোনো মানেই হয় না, তার থেকে মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স নিয়ে সারাজীবনের জন্য ভালো ‘বন্ধু’ হয়ে দুজনের আলাদা পথ বেছে নেওয়াটাই ভালো!!
বলিউড আদর্শ আমীর খান – কিরন রাও আর ঋত্বিক রোশন – সুজান খানের মতই দুজনে এও ঠিক করে নিয়েছে যে একমাত্র ছেলেকে দুজনে মিলেমিশেই মানুষ করবে, যাতে বাবা-মায়ের অভাব সে কোনোদিন অনুভব করতে না পারে…সেই হিসেবেই সপ্তাহে দুটো দিনের জন্য সুজয় ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে যায়, দুজনে খুব আনন্দ করে।
মোটামুটি সবই ঠিকঠাক চলছিল এভাবে, শুধু স্কুলের চাকরীর হাড়ভাঙা কাজের শেষে বাড়ি ফিরে আজকাল একটা সঙ্গীর অভাব মাঝে মাঝেই অনুভব করে বছর তিরিশের সুচেতনা। ব্যাপারটা আরো বেশী করে উস্কে দিচ্ছিল পেপারে, রাস্তায় এত এত ভ্যালেন্টাইন্স ডে বিজ্ঞাপন দেখে, আর দু’সপ্তাহ আছে, তাই চারদিকে এত কিছু। আর এত বছর পরে এবারে সুচেতনার কোনো সঙ্গীই নেই… বাবা-মা অনেকবার বলেছে আবার বিয়ে করার জন্য, কিন্তু ছেলে সুজয়ের সাথে ডিভোর্সের পরে এখনো নিজেকে আবার একটা নতুন রিলেশানের জন্য কেমন যেন ‘অপ্রস্তুত’ মনে হয়!!
সেদিন অফিসের এক কলীগ একটা app র কথা বলল, যেটা নাকি শুধুমাত্র ডিভোর্সীদের জন্যই বানানো, পরবর্তী সঙ্গী খুঁজে নিতে সাহায্য করে। ওরা নাকি কারুর ছবি লোড করে না, শুধু ফোন নাম্বার আর প্রোফাইল সেভ করে রাখা থাকে। কে কি ভালবাসে, পছন্দ কেমন ইত্যাদি.. সাথে বিভিন্ন অনুভুতি যেমন রাগ, ভালবাসা, অভিমান ইত্যাদি কে বিভিন্ন মাত্রায় স্কেলিং করে রাখা হয় বিভিন্ন পার্সোনাল প্রশ্নের মাধ্যমে। এসব দেখে নাকি ডিভোর্সীরা বোঝে যে কার সাথে কতটা মিল পাওয়া যাবে… সুচেতনার এই সব app খুব একটা ভালো লাগে না, ছোটোবেলায় টিন্ডার এর কিছু বাজে অভিজ্ঞতা আছে ওর, তাই ওসব থেকে একটু দূরেই থাকে। তবু মনটা কেমন কেমন করছিলো, ভ্যালেন্সটাইন ডে’র দিনে পাশে কোনো সঙ্গী থাকবে না? কেউ একটা রোম্যান্টিক ডিনারে নিয়ে যাবে না? একটা নতুন লাল ড্রেস কি এবারে আর কেনা হবে না?
অনেক ভেবে, সকালে অফিসে বেরোনোর আগে app টা তে রেজিস্ট্রেশান করে প্রোফাইল দেখে তিনজন ছেলের ফোন নাম্বার একটা কাগজে নোট করে সামনের ঘরের টেবিলে পেপার ওয়েট দিয়ে রাখলো। রাতে বাড়ি ফিরে এক এক করে ফোন করে দেখা যেতেই পারে!! অফিসে বেরোনোর আগে কাজের মাসীকে বলে গেল “মাসী, আজ সুজয় আসবে, বাবানকে দুদিনের জন্য নিয়ে যেতে, ওর জামাকাপড় প্যাক করে দিও!!”
অফিস থেকে ফেরার পথে পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের গুঞ্জনে আবার মনে পড়ে গেল দুদিন বাদেই ভ্যালেনটাইন ডে… মনের ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিল… বাড়ি ফিরেই ওই তিনজনকে ফোন করে দেখতে হবে, কেউ কি ডেটে যেতে রাজী হবে?
ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে সুচেতনা দেখল বাবানকে সুজয় দু’দিনের জন্য নিয়ে গেছে। তারপরে সোফায় বসতে বসতে টেবিলের ওপরে রাখা কাগজের চিরকূটটাতে নজর পড়ল।  সকালে নিজের হাতে লিখে রাখা তিনটে ফোন নম্বরের নীচে সুজয়ের হাতের লেখা – “প্রথম নাম্বারের মানুষটা ব্যাবসায়ী, তোমার টেস্টের সাথে মিশ খাবে না, দ্বিতীয় নম্বরের মানুষটা খারাপ নয়, আমি চেক করেছি ব্যাকগ্রাউন্ড,  আমার থেকে বেশী সহনশীল হয়ে তোমাকে সামলে রাখতে পারবে কিনা জানি না, তবে চেষ্টা করতে পারো… আর তিন নম্বরের মানুষটাকে ফোন করে সময় নষ্ট করো না, কারন ওটা আমারই আরেকটা নতুন নম্বর আর নতুন নামে আমি ওই app টাতে রেজিস্ট্রেশান করেছিলাম, আমিও তোমার মতই সঙ্গীর অভাব বোধ করছি এই ভ্যালেন্টাইন ডে র সময়ে…কাউকে জোটাতে না পারলে, আমাকে মেসেজ করো, ফ্রি থাকলে দেখা হতে পারে!!”
একটা ছোট্ট হাসিতে সুচেতনার আজকের ক্লান্তি চলে গেল, হাত বাড়িয়ে ফোন টা হাতে নিলো…
এপিসোড ৩ঃ বেলাশেষে…
রমা আর সমরেশবাবুর বিয়ের পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো এই কয়েকমাস আগেই। অনেকমাস ধরে ছেলে-বৌমা-মেয়ে-জামাই,নাতি-নাতনীদের বিরাট প্ল্যানিংএর শেষে অনেক আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী দের নিয়ে একটা নামকরা রিসর্টে একটা পুরোদিন বেশ ভালই আনন্দ করে কাটিয়েছিলেন ওরা দুই বুড়ো-বুড়ি!! সবাই অনেক স্মৃতিচারণা করেছিলেন ওদের এত বছরের সুখী দাম্পত্যের রহস্য বিষয়ে।
তবে এত এত লোকজনের মাঝে সমরেশবাবু খুব একটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না। রমা খুব ভাল করেই জানে সমরেশবাবু খুব কাটখোট্টা মানুষ, সারা জীবন কন্সট্র‍্যাকশানের কাজ করতে করতে প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি ওনার কাছে ঠিক তথাকথিত রোম্যান্টিক ভাবে ধরা দেয় না, তবে তার মানে এই নয় যে সমররেশবাবু রমাকে ভালবাসেন না। কিন্তু মুস্কিল এই যে উনি কিছুতেই যেন ভালবাসাটা প্রকাশ করতে পারেন না। এসব নিয়ে বিয়ের প্রথম দিকে বেশ মন কষাকষি হতো, কত কত বন্ধুরা বরের বা প্রেমিকের হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াত, বন্ধুরা বলতো তাদের বরেরা কত ভালো – গোলাপ ফুল কিনে নিয়ে এসে খোঁপায় গুঁজে দেয়, ইত্যাদি.. সমরেশবাবু এসব কিছুই করেন নি কোনোদিন, মানে ‘ওসব ঠিক আমার আসে না’ টাইপের…
আসলে প্রেমের এই ধরনের বাহ্যিক প্রকাশটা কিছুতেই যেন শিখে উঠতে পারেন নি আদ্যোপান্ত ভালোমানুষ, মফঃস্বলের বয়েজ স্কুলে পড়ে বড় হয়ে ওঠা সমরেশ বাবু…আস্তে আস্তে সময়ে সাথে সাথে রমাও বুঝে গেছে মানুষটা কিরকম, তাই সবার সামনে বরের নিন্দা করে যখন বলে যে “ছাড় তো, ও আর ভালবাসা? ও সেসবের মানেই জানে না…”,
ভেতরে ভেতরে কিন্তু রমা জানে যে সমরেশবাবু সত্যি ওকে খুবই ভালবাসে। তাই বৌমা, মেয়ে আর নাতি-নাতনীরা যখন চেপে ধরে বলল যে তোমাদের জীবনে একবার অন্তত ভ্যালেন্টাইন্স দিবস পালন করা উচিত, সেটা শুনে রমার খুব মজা লাগলেও সমরেশবাবুর খুব টেনশান চালু হয়ে গিয়েছিলো! এই বিদঘুটে দিনটার কথা প্রথম শুনেছিলেন ছেলে কলেজে পড়ার সময়ে, যখন সে বাবার থেকে ৩০০ টাকা চেয়েছিলো গিফট কিনবে বলে…বড় নাতনী আবার সেদিন বললো যে এখন নাকি সাত দিন ধরে গিফট দিতে হয়!! শুনে সমরেশবাবুর তো চক্ষু চড়কগাছ!!
আজ নাতি-নাতনীরা প্রায় জোর করেই সারা বাড়ি লাল হার্ট শেপের বেলুনে ভরিয়ে দিয়েছে, ব্রেকফাস্টে লাল রঙের ইডলি দেখে প্রথমে চমকে গেলেও বেশ নতুন লাগল খেতে, পরে শুনলেন ওটা নাকি বীট দিয়ে বানানো ইডলি!! বৌমা আবার কোথা থেকে বেকিং শিখে এসে একটা লাল চেরি কেক বানিয়েছে, তাতে আবার রমা খুব উৎসাহে সাহায্য করেছে সকাল থেকে… ভালই লাগছিলো বাড়ির নতুন পরিবেশটা।
ব্রেকফাস্টের পরে এক নাতি জিজ্ঞাসা করল, “দাদু, তুমি কি ঠাম্মাকে হ্যাপি ভ্যালেন্সটাইন ডে বলেছ?
“না, কেন ওসব বললে কি ওই বুড়ির ভালবাসা বেড়ে যাবে?” নাতিদের সাথে মজা করেই বললেন…
–  আচ্ছা দাদু, ঠাম্মা বলছিল তুমি নাকি কোনোদিন ঠাম্মা কে আই লাভ ইউ বলো নি…খুব বাজে!! আজ তোমাকে কিছু একটা বলতেই হবে…
পাশ দিয়ে যেতে যেতে রমার খুব মজা লাগল…. বেশ জব্দ নাতি-নাতনীদের কাছে!!
“হ্যা, হ্যা, তোরা জোর করে যদি একটা ভালবাসার কথা বলাতে পারিস!! সিনেমাতে শুধু দেখেই গেলো লোকজন হাঁটু মুড়ে কত ভালবাসার কথা বলে.. অথচ আমি তো সারা জীবন কিছুই শুনলাম না… যদি আজ বলে তাহলে স্বর্গে গিয়ে আমিও বলতে পারবো যে, হ্যাঁ তোদের দাদু আমাকে ভালবেসেছিল, নাহলে কেউ বিশ্বাসই করবে না, তাই না? সবাই বলবে ভড়কি দিয়েই সারা জীবন টা কাটিয়ে দিলো…”
সমরেশবাবু একটু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করলেন “আরে, হৃদয়ের অনুভবটাই আসল, তুমি এখনো সেই মুখের কথাতেই পড়ে আছো, এসব ভালবাসার ব্যাপারটা ফিল করতে হয়, তাই না? তোরাই বল!!!”
নাতি-নাতনীরা খুব একটা প্রভাবিত হলো না – “ওসব জানি না, আজ তুমি ঠাম্মাকে দুটো ভালবাসার কথা বলবেই… আমরাও শুনব, তুমি বলছ!!”
রমাও মজা নিচ্ছিল “ওসব জানি না, আজ সারাদিনে একটা হলেও ভালবাসার কথা বলতে হবে আমাকে… না হলে আমি কিন্তু ঝগড়া করব বলে দিলাম!!”
চারদিকের এই সাঁড়াশি আক্রমণে দৃশ্যত বিপর্যস্ত সমরেশবাবু কি যে করবেন বুজে উঠতে না পেরে পাড়ার বুড়োদের ক্লাবে আড্ডা মারতে চলে গেলেন, তাস খেললেন, দিদি-মোদি নিয়ে অনেক কথা শুনলেন, কিন্তু মাথায় ওই ভালবাসার কথাটাই ঘুরতে থাকল!!
দুপুরে মাংস-ভাত খেয়ে ঘুমও এলো না ঠিকমত। বিকেলে একবার ভাবলেন পাড়ার বাবলুর ফুলের দোকান থেকে একটা রক্তগোলাপ কিনে নিয়ে এসে বৌ এর সামনে বলেই দেবেন ওই তিনটে ম্যাজিক শব্দ – আমি তোমাকে ভালবাসি!! তারপরে নিজের মনেই হেসে ফেললেন – “যাঃ, এসব আবার কিভাবে বলব? খুব বোকাবোকা..” বাড়ির সবাই নিশ্চই মজা করছে, এতক্ষনে নিশ্চই সব ভুলে গেছে!!
ডিনার টেবিলে বাকি সবাই ভুলে গেলেও হঠাত বড় নাতনী বলে বসল ” দাদু, তুমি ঠাম্মাকে বলেছ? না বলে থাকলে এখনই বলতে হবে কিন্তু..” খুব বিপদ!! সবাই কেমন মজা নেওয়ার জন্য ওনার দিকেই তাক করে বসে আছে!! শেষে সমরেশবাবু হাল ছেড়ে দিয়ে রমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন – “সারাদিন ধরে আমি আমার অনেক বন্ধুর সাথে কথা বললাম, কেউ কোনো ভাল সাজেশান বা কোট দিতে পারল না, সবাই হেসেই গড়াগড়ি খেলো… শেষে আমি নিজেই ডিকশনারী থেকে ভাল ভাল শব্দ খুঁজে বেড়ালাম, হতাশ হয়ে শেষে হাল ছেড়ে দিলাম, তুমি যে আমার মনে কতখানি যায়গা জুড়ে আছো, সেটা ঠিক ভাবে বলার মত কোনো যুতসই শব্দ খুঁজে পেলাম না… এজন্মে আর হাঁটু মুড়ে বসা হলো না, হাঁটুর হাড় হয়ত খুলে বেরিয়ে আসবে, পরের জন্মে নিশ্চই তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করতে পারবো..!!”
সমরেশবাবু লুকিয়ে একটা গোলাপ ফুল এনেছিলেন, হাসিমুখে সেটাই স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন।
পিনড্রপ নিঃস্তব্ধতার মাঝে অস্ফূটস্বরে বড় বৌ এর গলা শোনা গেলো ” বাবা!! আপনি তো ছূপারুস্তম!!” আর রমার মুখে একটা লাজুক গোধুলি আভা ফুটে উঠল!!

Sahityika Admin

1 comment