বোকারো ট্যুর
দীপক চক্রবর্তী, ১৯৭৬ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
ননীগোপাল যে এইরকম একটা বিপদের সম্মুখীন হবে, সেটা সে তাঁর দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে বেড়িয়ে বেশ একটা চাকরী বাগিয়েছিল ঘাঁটি বিদ্যুৎ নিগমের সদর ঘাঁটি কলকাতায়। আনন্দের সাথে বেশ শুয়ে বসেই দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছিল; হঠাৎই তাঁকে তাঁর সুপারিনটেণ্ডিং ইঞ্জিনীয়ার সাহেব বোকারো যেতে বলায় তাঁর মাথায় রীতিমতনই বাজ পড়ল। সে বেশ বুঝতে পারছে যে এটা তাঁকে বিপদে ফেলার জন্য, তার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনীয়ারের পরামর্শ মতনই করা হয়েছে। কিন্তু অফিসের কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং যেতেই হবে।
সেই কোন ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিল, তারপর আর একটু বড় হয়ে দার্জিলিং, তাও সেই স্কুলে পড়ার সময়েই। তারপরে স্কুল পাশ করে কলেজ জীবনে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে কলকাতায় যাদবপুরে। সেই তখন থেকেই সে রানাঘাট থেকে শিয়ালদা, তারপর শিয়ালদা থেকে দক্ষিণ শহরতলীর ট্রেন ধরে যাদবপুর। আর চাকরী জীবনে শিয়ালদা থেকে বেলভেডিয়ার। এই ছিলো তাঁর পৃথিবী। বলতে গেলে কলকাতা শহরটাকেও সে ভাল করে চেনে না। বেলভেডিয়ার থেকে তাঁর কলেজ যাদবপুরে যেতে গেলেও তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়ে তবেই যেতে হয়। তাঁর চেনার বৃত্তে শুধুই রানাঘাট আর শান্তিপুর। আর তাঁকেই কিনা এখন যেতে হবে বোকারো।
ননীগোপালকে মুখ শুকনো করে বসে থাকতে দেখে তাঁর পাশের টেবিল থেকে অসীম জিজ্ঞাসা করল, “কি রে! শরীর খারাপ নাকি?”
অসীম তাঁর সহপাঠী, যাদবপুরে মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার সময় থেকেই মুখ চেনা। এখন চাকরী জীবনে একটু ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে। ওকে একটু ভরসা করা যায় মনে করে বলেই ফেলল, “আর বলিস না, সেনগুপ্ত সাহেব আমাকে আগামী সোমবার বোকারো যেতে বলছেন।“
“তাতে মুখ শুখিয়ে বসে থাকার কি আছে, চলে যাবি।“ অসীম বলে উঠল।
“আরে! বললেই কি যাওয়া যায় নাকি? কিভাবে যাব, কোথায় থাকব, কিছুই জানা নেই। অথচ বলে দিল যেতে হবে। কি না, স্টোরের মাল চেক্ করতে হবে। হিসাবে নাকি মিলছে না। তা ওখানকার কাউকে দিয়ে করিয়ে নিলেই তো পারে! খামোখা আমাকে পাঠানোর দরকার কি?”
অসীম ননীগোপালের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটার কিছুটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারল। একটু হেসে বলল, “তা ঠিক। তবে তোর দৌড়ও তো মসজিদ পর্যন্ত। সেই রানাঘাট আর শিয়ালদা ছাড়া তো পৃথিবীর কিছুই দেখলিনা। তা যা দু’দিনের জন্য একটু ঘুরে আয় বোকারো থেকে।“
আরও একটু ভেবে নিয়ে অসীম বলল, “তুই বরঞ্চ একটা কাজ কর। সিভিলের ছেলেরা হরবখত্ বোকারো যাচ্ছে। তুই বরঞ্চ ওদের থেকে জেনে নে ওঁরা কিভাবে যায় আর কোথায় থাকে।“
পরামর্শটা ননীগোপালের বেশ ভালোই লাগলো। ননীগোপাল লাঞ্চের পরে সিভিল ডিপার্টমেন্টে গিয়ে অলোককে দেখতে পেলো। চেয়ারে বসে সে একমনে কি একটা কাজ করছিলো। অলোককে ননীগোপাল একটু ভয়ই পায়, কিন্তু হলে আর কেউ না থাকায় অলোকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “এই শোনো, বোকারো গেলে কিভাবে যেতে হবে?”
কথাটা পুরোটাও শেষ করতে পারলো না, অলোক মাথা না তুলেই প্রশ্ন করলো, “ক্যানোও?”
অলোকের কথার ধরণ দেখে আর কথা না বাড়িয়ে ননীগোপাল নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে বসল।
অসীম টিফিন করতে বাইরে গিয়েছিলো। সে ফিরে এলে তাঁকে ঘটনাটা বললো। অসীম মুচকি হেসে বললো, “তোকে কেন জিজ্ঞাসা করলো, আর তুই চলে এলি? ঠিক আছে, তুই আর অলোকের কাছে যাস না। তুই বরঞ্চ প্রকৃতির কাছে যা।“
প্রকৃতি মনোযোগ দিয়ে ‘কোড অফ প্র্যাক্টিশ’ পড়ছিলো। তাঁর কাছে গিয়ে ননীগোপাল সেই একই প্রশ্ন করতেই প্রকৃতি মাথা তুলে ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করলো, “থার্মাল না স্টীল?” এইবারে ননীগোপাল রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। জিজ্ঞাসা করলো, বোকারো কিভাবে যেতে হবে, আর সে বলে কিনা থার্মাল না স্টীল? কতগুলো বোকারো রয়েছে রে বাবা! ভয়ে ভয়েই সে বললো, “ঐ যে আমাদের প্ল্যান্টে।“ প্রকৃতি একটা সিগারেট ধরিয়ে জানতে চাইল, “বেড়াতে না কাজে?” এখানে আর কথা বাড়িয়ে বিশেষ সুবিধা হবে না মনে করে ননীগোপাল তাঁর সীটে ফিরে গিয়ে অসীমকে সব কথা খুলে বললো।
ননীগোপালের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে, অসীম অনেকক্ষণ ধরে হেসে নিয়ে বললো, “তুই এক কাজ কর, তুই বরং সোহমদাকে গিয়ে একবার জিজ্ঞাসা কর।“
ননীগোপাল সোহমদাকে চেনে না। কোনদিন দেখেও নি। অনেককে জিজ্ঞাসা করে, অনেক খুঁজে, সোহমদাকে গিয়ে বললো যে সে আগামী সোমবার বোকারো যাবে, তা কিভাবে যেতে হয় সেটা উনি যদি দয়া করে একটু বলে দেন। সোহমদা আগে কখনও ননীগোপালকে দেখেননি। জিজ্ঞাসা করলেন, “একা যাবে? না বৌমাকে নিয়ে?” ননীগোপাল রীতিমত হতচকিত, সে এখনও বিয়েই করলো না, আর সোহমদা জিজ্ঞাসা করছেন বৌকে নিয়ে যাবে কিনা? সে সোহমদাকে বোঝাবার চেষ্টা করলো যে সে এখনও বিয়েই করেনি, তাই বৌ নিয়ে যাবার প্রসঙ্গই নেই। সোহমদা ওঁর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন তাহলে কি ননীগোপাল ওঁর বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে যাবে! ননীগোপাল প্রচণ্ড হতাশ হয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে সোহমদাকে বোঝাবার চেষ্টা করলো যে সে অফিসেরই কাজে সোমবার বোকারো যাবে, তাই কিভাবে যাবে এবং কোথায় গিয়ে থাকবে, সেটা যদি সোহমদা একটু বলে দেন তাহলে ননীগোপালের খুবই উপকার হয়।
সোহমদা সব শুনেটুনে বললেন, “বাঃ! বেশ ভালো, তা কখন যাবে? সকালে না বিকালে?”
ননীগোপাল ভাবলো, এ আবার কি রে বাবা! কোন কথারই সোজাসুজি উত্তর হচ্ছে না। সে এবারে একটু রেগে গিয়েই জানতে চাইলো, সকালে যাওয়ার আর বিকালে যাওয়ার মধ্যে তফাত কি হচ্ছে? সোহমদা বললেন, “দেখ, রেগে যাওয়ার মত কোনও কারণ নেই। সকালে গেলে একরকমভাবে যেতে হবে আর বিকালে গেলে আর একরকমভাবে। তারপরে থাকার জন্য গেস্টহাউসেও সেইভাবেই বলে দিতে হবে। নাকি?”
ননীগোপাল আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে গিয়ে অসীমকে সব জানাল।
অসীম সব শুনে নিয়ে বলল, “দ্যাখ, সিভিলে সবকটাই শালা শিবপুরের। সবকটাই শালা হারামী। তুই বরঞ্চ শঙ্করণ সাহেবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর। উনি আইআইটি খড়গপুরের ফার্স্ট ব্যাচ। শিবুদের মত ছ্যাঁচড়া হবেন না।“
আইআইটি খড়গপুরে পাঁচ বছর কাটানোর জন্য শঙ্করণ সাহেব বাংলাটা ভালই জানেন, বলেনও। এছাড়াও ওঁনার খুবই সুনাম রয়েছে সবাইকে সঠিক পরামর্শ দেবার ব্যাপারে; আর কারুর কোনও উপকার করতে পারলে উঁনি খুবই খুশী হন। যেতে যখন হবেই, তখন অসীমের এই পরামর্শটা মনে ধরাতে ননীগোপাল শঙ্করণ সাহেবের কাছে গেলো।
শঙ্করণ সাহেব তখন নিজের ল্যাপটপে বোকারো প্রজেক্টের সেকেন্ড ফেজের কস্টিং করছিলেন। উনি ননীগোপালের থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। তারপরে জিজ্ঞাসা করলেন, “তা তুমি কোথা থেকে যাবে?”
ননীগোপাল নিজের মনেই ভাবে, কি গেরোরে বাবা, গেলে তো বাড়ী থেকেই যাব! ওঁর মনের ভাবটা বোধহয় শঙ্করণ সাহেব বুঝতে পারলেন আর বুঝতে পেরেই বললেন, “না, আমার মতন অনেকেই রাতের দুন এক্সপ্রেস ধরে যায়তো, তখন আমরা অফিস থেকেই যাই, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।“
ননীগোপাল জানাল যে সে সোমবার বাড়ী থেকেই যাবে।
খুব খুশী হয়ে উনি একটা পরিষ্কার সাদা কাগজ বের করে ওঁনার বেয়ারাকে ডেকে দু’কাপ চা আনতে বললেন। তারপর কাগজটার ওপরে মাঝামাঝি জায়গায় পেন্সিল দিয়ে একটা গোল এঁকে বললেন, “হিয়ার ইউ আর। তা তোমার থাকা হয় কোথায়?”
ননীগোপালের এবার খুবই করুণ অবস্থা। মনে মনে অসীমের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে করতে জানাল যে সে রানাঘাটে থাকে এবং সেখান থেকেই সে রোজ সকালে অফিস করতে আসে এবং অফিস ছুটি হলে সন্ধ্যার সময় আবার ট্রেন ধরে বাড়ী ফিরে যায়।
শঙ্করণ সাহেব বললেন, “ও তুমি ডেলী প্যাসেঞ্জার, ঠিক আছে।“ বলে তিনি গোল জায়গাটায় একটা ক্রস আঁকলেন আর তার পাশে লিখলেন রানাঘাট। তারপর একটা সোজা লাইন টানলেন এবং সেটার মাঝে ছোট ছোট কতগুলো দাগ দিয়ে রেললাইনও এঁকে ফেললেন।
রেললাইন এঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তা কি ঠিক করলে? দুন ধরেই যাবে তো! তাহলে একেবারে ভোরবেলায় থার্মালে পৌঁছে যাবে।“ ননীগোপালের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা, জানাল যে সে দুনে করেই যাবে।
শঙ্করণ সাহেব এবারে অবাক হয়েই বললেন, “তাহলে তো তুমি অফিসে এসেই যেতে পার।“ তারপরে রেললাইনের নীচে আর একটা গোল এঁকে লিখলেন শিয়ালদা। সেখান থেকে আর একটা লাইন টেনে লিখলেন বেলভেডিয়ার। তারপর কাগজটা ননীগোপালের হাতে দিয়ে, চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে গিয়ে বোকারো যাওয়ার টিকিট আর হাওড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ীর কথা বলে দাও। আর হ্যাঁ, বোকারোতে থাকার বন্দোবস্ত আর স্টেশনে গাড়ী যেন থাকে সেটাও জানিয়ে দিও। নাও, এবারে চা খাও।“
Add comment