বিক্কলেজের ভ্যালেন্টাইন ডে
অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
কৈশোর যৌবনে ভ্যালেন্টাইন ডে কথাটাই আমরা শুনি নি। যদি বিই কলেজে পড়াকালীন জানতাম যে ভ্যালেন্টাইন ডে কি বস্তু, তাহলে আমাদের কি অবস্থা হতো? আর আমাদের কলেজের টেলিফোন দাদুরই বা কি অবস্থা হতো?
গল্পের খাতিরে ধরে নিচ্ছি যে কিছুক্ষনের জন্য আমরা বিই কলেজের ৭০ এর দশকে আছি। এবং ধরে নি যে ভ্যালেন্টাইন ডে ৭০এর দশকেও ছিলো।
একটা ভূমিকা। পরবর্তী প্রজন্মের যারা টেলিফোন দাদুকে দেখো নি, তাঁদের জানাই যে সেই সময় গোটা বিই কলেজের ১,২০০ ছাত্রছাত্রীর জন্য ছিলো একটিই মাত্র পাবলিক ফোন। আর আমাদের সকলের ফোনদাদু ছিলেন এক বহুল চর্চিত বর্ণময় চরিত্র, যিনি সারাদিন নাতনীদের ফোন রিসিভ করে ছেলেদের হস্টেলে হস্টেলে মেসেজ পৌঁছে দিতেন। সেই নাতনীরা ছিলো তাঁর খুবই প্রিয়। এতই প্রিয় যে ফোন এলে আমাদের দাদু সেই ফোন ছাড়তেই চাইতেন না।
এবার সেই পটভূমিকায় একটি গল্প লেখার চেষ্টা করছি। সব চরিত্রই কাল্পনিক। দুর্ভাগ্যবশত যদি মিল দেখা যায়, সেটা নেহাতই কাকতালীয়।
*******
টেলিফোন দাদুর চিন্তার শেষ নেই। একেই মাথায় টাক, তাই মাথা চুলকেও আজকাল বুদ্ধি আর আসে না। আগে মাথায় যখন চুল ছিলো, তখন বুদ্ধির প্রয়োজন হলেই মাথা চুলকে নিতেন। সে অনেক অতীতের কথা। এখন বয়স হয়েছে। ক্যাম্পাসের কলেজের ১,২০০ অবাধ্য ছেলেমেয়েকে এই বয়সে সামলানো? এই বয়সে এত টেনশন নেওয়া যায়?
গতবারের ভ্যালেন্তিন দিবসের অভিজ্ঞতা বারবার মনে আসছে। এবার সেরকম হলে এই চাকরীটাই তিনি ছেড়ে দেবেন, সেরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন। সে না হয় চাকরী ছেড়ে দেবেন। কিন্তু সামনের সপ্তাহেই ভ্যালান্তিন দিবসে যে উৎপাতগুলো হবে, সেটা তিনি কিভাবে সামলাবেন?
অনেক ভাবনাচিন্তা করে গেলেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সেক্রেটারি ইন্দ্রনাথের কাছে। ইন্দ্রনাথ ভালো ছেলের দলে, সে এসব বোঝে না। সময়ে সময়ে নিজেকেও সে দুর্ভাগা মনে করে, কারণ ওর ডিপার্টমেন্টে একটাও মেয়ে পড়ে না। অন্যদিকে মেয়েরাও ওঁকে পাত্তা দেয় না। এক সিনিয়র মেয়ে একবার কবিতা শুনিয়ে তাঁকে র্যাগিং করেছিলো। এহেন ইন্দ্রনাথ, সকল দুঃখের কাহিনী শুনে ফোনদাদুকে নিরুপায় হয়ে জানালো যে আপনি বরং প্রিন্সিপালকে গিয়ে আপনার সমস্যার কথা বলুন।
এবার দুর্গানাম জপ করতে করতে অনেক সাহস নিয়ে বেলা এগারোটা নাগাদ ফোনদাদু গেলেন প্রিন্সিপালের অফিসে। সেক্রেটারি হারানবাবু নিয়মমতনই জানতে চাইলেন, কি ব্যাপারে দেখা করতে চান? টেলিফোন দাদু জানালেন যে ভ্যালেন্তিন দিবস নিয়ে কথা বলতে চান। হারানবাবু চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। একটা বিরাট বিষম খেলেন।
“ভ্যালেন্টাইন ডে? আপনার ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার কি করবেন?” হারানবাবু অবাক।
“সে অনেক লম্বা কথা, অনেক ঝামেলা আছে, তুমি সেসব বুঝবে না। আমি সেটা সোজা স্যারকেই বলবো।“
হারানবাবু আর কথা বাড়ালেন না। ফোনদাদু খানিক এগিয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢোকার দরজা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখলেন। না, সব চেনা লোকেরাই আছেন, নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। আবার দুর্গানাম জপ করে ঘরে ঢুকলেন।
“স্যার, একটা নিবেদন ছিলো।“
প্রিন্সিপাল বোধহয় কিছু একটা জরুরী আলোচনায় ছিলান। একবার দেখলেন ফোনদাদুকে। “হ্যাঁ, বলুন, কি বলবেন। কিন্তু ওভাবে অত হাত কচলাচ্ছেন কেন?”
“না না, স্যার, জানি না, কিভাবে আপনাকে বোঝাবো। বলছিলাম, সামনের সপ্তাহেই তো ভ্যালেন্তিন দিবস। তাই কিছু কথা ছিলো।“
শুধু প্রিন্সিপাল নয়, সেখানে উপস্থিত প্রফেসর তরুণ শীল, প্রফেসর সুনীল চৌধুরী, ভঞ্জ স্যার, আর অন্য যারা ছিলেন সকলেই অবাক। এই সত্তর বছর বয়সী টেলিফোন দাদু ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে অফিসিয়াল আলোচনা করতে এসেছেন? তাও আবার সোজা কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে?
“স্যার, বলছিলাম, প্রতিবার ভীষণ গোলমাল হয়। এবারেও অনেক ঝামেলা হবে। সকাল থেকেই বাইরের সারা দুনিয়ার মেয়েরা আমাকে ফোন করবে। আর এছাড়াও…”
প্রিন্সিপাল দেরী না করে ওখানেই দাদুকে থামিয়ে দিলেন।
– আরে, সে তো প্রতিদিনই আপনার অসংখ্য নাতনীরা আপনার সাথে অসংখ্যবার দাদু, দাদু করে ডেকে কত কথাই তো বলে। এ তো নতুন কিছু নয়।
– না স্যার, ঐদিন অনেক অনেক ফোন আসবে। আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার।
– ফোন এলে আসবে। রোজ দশটা ফোন আসে, সেদিন পঁচিশটা ফোন আসবে। আপনি রোজ যেভাবে আপনার নাতনীদের সাথে কথা বলেন সেভাবেই সেদিনও কথা বলবেন। এখানে সমস্যা কোথায়?
না, প্রিন্সিপাল স্যার ফোনদাদুর সমস্যা বুঝতে চাইছেন না। বয়স্ক ফোনদাদু সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন, আর উনার মিটিং মাঝপথেই আটকে আছে। সেটাও প্রিন্সিপাল স্যারের এক অস্বস্তি। উনি একটা উপদেশ দিলেন “দাদু, এখন আমরা একটা জরুরী আলোচনায় আছি। আপনার কি কি সমস্যা আছে, আর কি কি সাহায্য চাই, সেইসব লিখে একটা এপ্লিকেশন জমা দিন। তারপর আমরা দেখছি কি করা যায়।“
ফোনদাদু চলে গেলেন, ভেবে চিন্তে একটা আবেদন জমা দিতে হবে।
দাদু চলে গেলে প্রথমেই মুখ খুললেন প্রফেসর তরুণ শীল। “ওফ, গতবারের ভ্যালেন্টাইন ডে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিলো। সকালে উঠেই দেখি আমার কোয়ার্টারের বাইরের সিঁড়িতে লাল গোলাপ ফুলের পাহাড়। ঠিক যেন কবরখানা। একবার পরিস্কার করি, জঞ্জাল ফেলার জায়গায় ফুলগুলো ফেলে আসি, তো কিছুক্ষণ পরেই দেখি আবার সেই ফুলের পাহাড়। পরে শুনলাম, ঐ জঞ্জাল থেকেই ছেলেরা সেই ফুলই আবার তুলে নিয়ে এসে আমার বাড়ির সিঁড়িতে রেখে যায়। বোঝো এবার! আমার মেয়ে তো রেগে ফায়ার।”
প্রফেসর চৌধুরীর অভিজ্ঞতা অন্যরকম। “আমার তো রাস্তার উপরেই একতলায় কোয়ার্টার। গতবার সব বদমায়েসের দল সেদিন বাড়ির সামনে সক্কালবেলায় নাচতে নাচতে কীর্তন গেয়েছিলো ইয়ে জিন্দেগী উসি কি হ্যায়, প্যার কিসি সে হো গয়া।”
স্যার বিশ্বস্ত সূত্রে আগেই জেনেছেন, ছেলেরা আনারকলি সিনেমার এই গানটা ওনার বড় মেয়ে তিলুর উদ্দেশ্যেই গায়।
প্রিন্সিপাল ছিলেন সঙ্গীত রসিক। এছাড়াও তিনি রসিক লোক, অন্যরকম ভাবেন।
– আরে? এটা তো আমার বিয়ের পরে ঐসময়ের বিখ্যাত গান। আর তুমিও তো তখন কচি বয়সের ছিলে, ঝর্ণা সিনেমায় গিয়ে এই সিনেমাটা অনেকবার দেখেছিলে, সেরকমই তো জানি।
– হোক সেই সময়ের গান। তাই বলে সক্কাল সক্কাল বাড়ির সামনে কেত্তন গাইবে? তাও আবার হিন্দী কেত্তন?
ভঞ্জ স্যারেরও অভিযোগ আছে। “আরে, আপনাদের ভাগ্যে তো বছরে শুধু একদিন। আমার মেয়ে চুমি তো ম্যাক আর রিচার্ড হলের ছেলেদের থেকে নিয়মিত চিঠি পায়। সোহম নামের একটা ছেলে, সে আবার কবিতা লিখে পাঠায়। হিমাই নামের বদ ছেলেটা হস্টেলের সামনে মোটর বাইক চালায়।“
প্রিন্সিপাল স্যার এতসব জানতেন না। এনাদের সকলের কথা শুনে বুঝলেন যে, ঐদিন ছেলেদের মধ্যে উন্মাদনাটা একটু বেশিমাত্রায়ই থাকে।
পরদিনই ফোনদাদুর আবেদনপত্র জমা পড়লো। তারপর প্রিসিপাল সাহেব মিটিং ডাকলেন, অনেকেই উপস্থিত। অনেক আলোচনা হলো, কিন্তু কিছুই সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলো না। সুতরাং ফোনদাদুকেই গোটা ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হবে। একটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেদিন সিকিউরিটি বাড়ানো হবে, অচেনা মেয়েরা হস্টেলে যেতে চাইলে আগে দাদুর কাছে ফোনবুথে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। দাদু তারপর ছেলেদের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে দেবেন। ব্যাস, মিটিং এখানেই শেষ। দরকার পড়লে দাদু স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাহায্য চাইতে পারেন।
বাড়িতে ফোনদাদুর স্ত্রী খেয়াল করেছেন, যে স্বামী কেমন যেন চিন্তিত, কিছু একটা সমস্যা নিশ্চয় আছে, কিন্তু দাদু কিছুই খুলে বলছেন না। অবশেষে দিদিমার “আমার মাথা খাও” বারবার শুনতে শুনতে বলেই দিলেন নিজের সমস্যার কথা। দিদিমা এই ভ্যালেন্তি দিবস ব্যাপারটা জানতেন না। সব শুনে উল্টো দিদা দশ কথা শুনিয়ে দিলেন। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতি বছর এত বড় একটা পূণ্যতিথি আসে। ঐ দুধের শিশুর ছেলেমেয়েরাও কত নিষ্ঠাভরে সেই তিথি পালন করে অথচ দাদু জীবনে একদিনের জন্যও সেটা পালন করলেন না? দিদিমা ওয়ার্নিং দিয়ে দিলেন, এই বছর তুমি যদি ভ্যালেন্তি দিন পালন না করো, তো তোমার একদিন আর আমারও একদিন হয়ে যাবে।
নির্দিষ্ট দিনে ফোনদাদু বেশ ফুরফুরে মেজাজেই বাড়ি থেকে বেরোলেন। দিদিমা বলে দিয়েছেন, আজকে ভ্যালেন্তি দিন, মনে থাকে যেন। দাদু অন্যদিন ফোনবুথে আটটা নাগাদ চলে আসেন, আজ অনেক সকালে সাতটার আগেই পৌঁছে গিয়ে দেখেন ইতিমধ্যেই লম্বা লাইন পড়ে গেছে। দূর থেকেই বুঝলেন কি একটা যেন ঝামেলা চলছে। আজ এসব যে হবেই, সেটা তিনি আগেই আন্দাজ করেছিলেন।
ব্যাপারটা জটিল। মাঝরাতে কিছু ছেলে ইট পেতে লাইন রেখে গিয়েছিলো, সেগুলো উধাও। কিছু ছেলে লাইন দিয়েছিলো, কিন্তু ভোরবেলা বেগ আসাতে হস্টেলে গিয়েছিলো, পেট হাল্কা করতে। ইটের লাইন সামলে রাখার জন্য যাদেরকে বলে গিয়েছিলো, তাঁদেরও বেগ এসে যায়। তাঁরাও সব নিজেদের পেট হাল্কা করতে হস্টেলে চলে যায়। এরপর ছেলেরা ফিরে এসে দেখে সব গোলমাল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে লাইনে বিরাট বিশৃংখলা, আর যত ঝামেলা।
একটা ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে এই সাত সকালেই এসে গেছে। কানপুরে বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করবে। ছেলেদের লাইনে সে দাঁড়াবে না। ওঁর দাবী, সবার আগে সেই ফোন করবে। ছেলেরা শুনেই রেগে গেলো। লাইন ভেঙে সবার আগে সেটা কোন সমস্যা নয়। অভিযোগ অন্যরকম। কলেজে হাজার খানেক ছেলের মাঝে কি একজনকেও পাওয়া গেলো না, যে কানপুরের বয়ফ্রেন্ডকেই পছন্দ হলো? ছেলেরা ভোররাতে এসে যে লাইন দিয়েছে, তাঁরা মেয়েটার দাবী মানতে রাজি নয়। ওদিকে দাদু শুনতে পাচ্ছেন, বুথের মধ্যে একের পর এক ফোন বেজেই চলেছে। কি কান্ড!
বুথ খুলতেই আবার ঝনঝন করে ফোন বেজে উঠলো। দিনের প্রথম ফোনটা তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে একটা মিষ্টি গলার আওয়াজ “দাদু, আমি খেয়ালী বলছি, এতবার তোমাকে ফোন করছি, সেই সকাল থেকে।“ রোজ এত এত ফোন আসে, কে যে খেয়ালী, দাদুর মনেই থাকে না। এইসব মিষ্টি আওয়াজে দাদুর সব টেনশন দূর হয়ে যায়, দাদু এক অনাবিল রোমাঞ্চের আনন্দ অনুভব করেন।
“হ্যাঁ, মা, কেমন আছো?” দাদু তাঁর রোজকার নিজস্ব স্টাইলে আলাপ শুরু করে দিলেন।
– দাদু, আজ ভ্যালেন্টাইন ডে দাদু, আই লাভ ইউ দাদু, আই লাভ ইউ, লাভ ইউ।
দাদু রোজই অনেক অনেক ফোন রিসিভ করেন, কিন্তু আই লাভ ইউ? দাদু ঠিক শুনছেন তো? বিশ্বাস হয় না।
– দাদু, লামিকে, মানে ঐ শংখকে একটা খবর দিতে হবে, দাদু। আজ বিকেল চারটের সময় লামি যেন লাইটহাউস সিনেমার বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করে। খবরটা দিয়ে দিও প্লিজ।
দেখো কান্ড! গতকালই তো তিন তিনটে ফোন এসেছে এই লামির জন্যই। হ্যাঁ, স্পস্ট মনে আছে দাদুর। একজন বলেছে, আজ দুপুরে হস্টেলে গিফট নিয়ে আসবে, একজন বলেছে লিপিতে দুপুরের শো’তে রাম তেরি গঙ্গা মইলির টিকিট কেটে রাখবে। আরেকজন কি যে বলেছিলো ঠিক মনে আসছে না, তবে সেও সিনেমার কথাই বলছিলো। আর এখন কে এক খেয়ালীও সেই সিনেমার কথাই বলছে। যাক গে, সে লামিই বুঝবে। দাদুর কাজ মেসেজ দেওয়া, দিয়ে দেবে।
ফোনে কথা শেষ হতেই সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন বেজে উঠলো। কিন্তু ছেলেরা নিয়ম করে দিয়েছে, যে দুটো ইনকামিং পরপর চলবে না। সাথে সাথে আউটগোইং চালু রাখতে হবে। লাইনে সবার আগে সমীর, ১৫ নম্বর হস্টেলের, ছেলেরা নাম দিয়েছে রমণীরঞ্জন, ছোট করে রমণী। মাঝরাতে এসে লাইন দিয়েছে, সকালে প্রচন্ড বেগ আসা সত্ত্বেও বেগ চেপে রেখে লাইনে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আর বেশিক্ষণ হয়তো চেপে রাখতে পারবে না।
– দাদু, আমি মালদা’র ঝামাগ্রামে ফোন করবো।
– মালদা, চামাগ্রাম, ঝামাগ্রাম। হবে না। হবে না। সে তো এসটিডি করতে হবে। এখানে এসব এসটিডি ফেসটিডি হয় না। অন্য কোথাও যাও।“
দাদু বেশ বিরক্ত। এই খেয়ালী মেয়েটা বেশ ভালো মেজাজ এনে দিয়েছিলো, এই ঝামাগ্রামের ছেলেটা এসে সব বরবাদ করে দিলো।
– মালদা হবে না? তাহলে দাদু এই নম্বরটাই লাগিয়ে দিন।
– এটা কোথাকার?
– এটা এখানের, হাওড়ার, শালিমার, ঐ ফোরশোর রোডে।“
দাদু নম্বর লাগিয়ে দিলেন। শুনলেন ছেলেটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে কথা বলছে। মামুলী কথা, দাদু তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, ফোন ছাড়তে হবে। লাইনে আরও অনেক ছেলে আছে। কিন্তু রমণী নিজের মনেই মিনিট তিনেক ধরে কথা বলে গেলো।
এই ফোন শেষ হতেই রমণী আরও একটা কলকাতার নম্বর ধরিয়ে দিলো। দাদু নিরুপায়, রমণীকে ফোন ধরিয়ে দিলেন।
এই ফোন শেষ হতেই রমণী আরও একটা ফোন করতে চায়। বাইরে লাইনে দাঁড়ানো ছেলেরা হল্লা লাগিয়ে দিলো। একদল বলছে কেউ একটার বেশি ফোন করতে পারবে না। রমণী কাতর অনুরোধ জানলো, যে রাত থাকতেই সে লাইন দিয়েছিলো, এমনকি সকালে প্রচন্ড বেগ আসা সত্তেও সে লাইনে অবিচল ছিলো। দাদুকে অনুরোধ, আর একটাই, শুধু একটাই ফোন সে করতে চায়। “দাদু, প্লিজ। আমি আর থাকতে পারছি না। এই ফোন করেই আমি পায়খানা করতে ছুটবো।“ দাদু নিজের সামনেই দেখছেন, ছেলেটা বেগের চাপে ছটফট করছে, কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল।
বাইরে আবার তুমুল হট্টগোল, অধিকাংশ ছেলেরাই বলছে অন্তত তিনটে ফোন যেন সকলকে করতে দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ চারটে পাঁচটা ফোনের অধিকারও দাবী করছে। দাদু সব শুনে নিয়ম করে দিলেন, কেউ দুটোর বেশি পরপর আউটগোইং ফোন করতে পারবে না। এরপরে দুটো ইনকামিং এর জন্য স্লট রাখতে হবে। দেখা গেল যে অনেকেই আছে যারা ফোন করবে না, শুধু ইনকামিং এর অপেক্ষায় ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। দাদু তাঁদের একটা আলাদা জোনে ভাগ করে দিলেন।
সবে মিনিট পনেরো হয়েছে, দাদু বুথে এসেছেন। এইসব দেখে এরই মধ্যে দাদুর পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। খেয়ালীর সাথে কথা বলে সুন্দর শুরু হয়েছিলো দিনটা। কিন্তু এই বদ ছেলের দলের সক্কলে মিলে সেটা বিগড়ে দিলো। দাদু উঁকি মেরে বাইরের লাইন দেখলেন। আন্দাজ শ’খানেক ছেলে, এবার ধীরে ধীরে আরও নিশ্চয় আসবে। মানে সারাটা দিনই বরবাদ।
এবার একটা ইনকামিং ফোন এলো। সুন্দর মিস্টি গলা। “দাদু, আমি নুপুর, কেমন আছো?”
এই “তুমি” সম্বোধন দাদুর খুব ভালো লাগে। যেন নিজের আপন লোক। আপনি আপনি বলে ডাকলে দাদুর মেয়েগুলোকে কেমন যেন দূরের লোক মনে হয়।
“ভালো আছি দাদু, তুমি কেমন আছো?”
বাইরে প্রতিবাদ, “দাদু, সময় কম, কথা কম। কাজের কথায় আসুন। শুধু মেসেজটা নিয়ে নিন।“
দাদুর ইচ্ছে ছিলো আরও কিছুক্ষন মেয়েটির সাথে কথা বলেন। একটু আগেই বদ ছেলেগুলো মেজাজ খিঁচড়ে দিয়েছিলো। মেয়েটার সাথে দু’দন্ড কথা বলে যে আনন্দ পাবেন, সেই যো নেই।
– দাদু, আপনাদের সাত নম্বর হস্টেলে সংযমী থাকে, তবে তুমি ঐ নামে ওঁকে খুঁজে পাবেন না। শকুন আর বিরিঞ্চি নামেই ছেলেরা ওঁকে চেনে। আমাকে বলেছিলো, আজকের দিনের জন্য সুলা রাসা সিরাজ প্রেজেন্ট করতে। আমি বাজারে গিয়ে দেখি, ওটা তো রেড ওয়াইন, সেটা তো মদ। আমি বুঝতে পারছি না দাদু, ও কি আমার থেকে মদের বোতল গিফট চেয়েছে? তুমি একটু ওকে বলবে? যেন আমায় ফোন করে? প্লিজ দাদু।
এই “প্লিজ” কথাটায় এত মধু যে দাদু আর না করতে পারেন না।
– শোনো মেয়ে, কি যেন নাম বললে? যদি মদ হয়, বিনা দ্বিধায় দিয়ে যাও। এখন তো মডার্ন মেয়েরা মদ, গাঁজা, চরস এসবই প্রেজেন্ট করে।
– ঠিক আছে দাদু, আমি এক বোতল রেড ওয়াইন নিয়ে আসছি।
– না গো, এক বোতলে ওঁদের কি আর হবে? এলে কম করেও চার পাঁচ বোতল নিয়ে এসো। ওঁদের হস্টেলে আরও অনেক মদ খাওয়ার পাবলিক আছে, এক বোতলে ওঁদের হবে না।
দাদু ভাবেন, কি যে দিনকাল এলো! গতকালই একটা স্কুলে পড়া মেয়ে এই সাত নম্বর হস্টেলেই শৈবাল নামের একটা ছেলেকে একগাদা সিগারেট উপহার দিয়ে গেছে। ছেলেটা সিগারেট খায়, কিন্তু বাড়ি থেকে যে টাকা আনে, সেই বাজেটে কুলোয় না, তাই মেয়েটা ভালোবেসে নিয়মিত সিগারেট উপহার দেয়। কি যে হবে, দাদু ভেবে কুলকিনারা পান না। স্কুলে পড়া মেয়ে তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে ভ্যালেন্তি দিবসে সিগারেট, মদ উপহার দেয়?
একটি মেয়ে এসেছে, দাদু ভাবেন এঁকে তো কলেজে ছোট্টবেলা থেকেই দেখছেন। ক্যাম্পাসেরই কোন স্টাফের মেয়ে নয় তো? নিশ্চয় বাড়ি থেকে ফোন করতে অসুবিধে, তাই এখান থেকে ফোন করতে চায়। “দাদু, চিনতে পারছো? আমি তিলু।“
দাদু, দুঃখ পেলেন। নামটাই জানেন না।
আশেপাশের ছেলেদের মধ্যে খানিকটা গুঞ্জন উঠলো। এই তিলুর উপর ওদের অনেক অভিমান আছে। বিই কলেজে জন্ম, বাবা বিই কলেজের প্রফেসর, আর মেয়েটা নিজেও বিই কলেজেই পড়ে। অথচ বিই কলেজের এত ছেলে থাকতেও ও কেন যাদবপুরের ছেলের সাথে প্রেম করে? না হয় যেদো ছেলেটা চ্যাম্পিয়ন স্পোর্টসম্যান, কিন্তু বিই কলেজে কি স্পোর্টসম্যানের আকাল পড়েছে?
তিলুর বয়ফ্রেন্ড বাঙালী, খোদ কলকাতার যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। অথচ বাঙলা বলতে পারে না। তিলু হিন্দী ইংরেজিতে মিনিটখানেক প্রেমালাপ করে চলে গেলো। ছেলের দল মুখ হাঁ করে দেখলো। দাদু যাবার সময় বললেন, “আবার এসো তিলু। যখনই সময় পাবে চলে এসো।“ দাদু সুযোগ পেলেই কলেজের নাতনীদের কত আদর করে বলেন তাঁরা যখনই সময় পাবে, যেন এই ফোনদাদুর কাছে চলে আসে। কিন্তু শুদুই দরকার ছাড়া কোন মেয়েই আসে না। এখানেই দাদুর দুঃখ।
আজকে দাদু সত্যিই ব্যাস্ত। লাইন দিয়ে এরকম দাঁড়ানো প্রতি বছরই একদিন হয়। এবার যেন আরও বেশি। তার উপর এবছর সিকিউরিটির লোকেরা যত সব অচেনা মেয়েদের দাদুর কাছেই পাঠিয়ে দিচ্ছে। ওরা রকমারি সব গিফট নিয়েও আসছে। কেউ আনছে ফুলের তোড়া, অনেকেই আনছে মদের বোতল। আবার অনেকের গিফটগুলো প্যাকেটে মোড়া, বোঝাই যাচ্ছে না ভেতরে কি আছে। শুনেছেন গতবার ময়ূখ নামে এক ছেলেকে ওর পুরুলিয়া জেলা স্কুলের গার্লফ্রেন্ড নাকি গিফট প্যাকে গাঁজার সরঞ্জাম পাঠিয়েছিলো। মেয়েটি ময়ুখকে এত ভালোবাসে যে ময়ুখের কোন ইচ্ছাই সে অপূর্ণ রাখবে না। দাদু আবার ভাবেন আর অবাক হয়ে যান। আজকালের মেয়েরা ছেলেদের এতই ভালোবাসে যে মদের বোতল, গাঁজা এইসব উপহার দেওয়ার প্রথা চালু করে দিয়েছে।
ফোনের আসর চলছে। ছেলেমেয়েরা আসছে, যাচ্ছে। একটি বেশ স্মার্ট, মডার্ণ মেয়ে এগিয়ে এসে দাদুকে বললো “হোয়ার ইজ উলফেন্ডেন হল, দাদু?”
ইংরেজি শুনে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও দাদু নিজেকে সামলে নিলেন। বুঝলেন বাইরের মেয়ে। আজ কিন্তু দাদু খুশী, একের পর এক নাতনীরা আসছে। এঁদের অনেকের সাথেই আগে ফোনে অনেক কথাই হয়েছে। সামনাসামনি এই প্রথম। দাদুর মন খুব প্রফুল্ল। খুবই মিঠে গলায় প্রশ্ন করলেন “কার জন্য এসেছো? তোমার চেনাজানা কেউ আছে ওখানে?”
“ও, ইয়েস। আমি ডীমান চ্যাকরোবর্টী কে মিট করতে চাই। কিছু গিফট এনেছি ফর হিম।“
পিছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, সে এগিয়ে এলো। “এক্সকিউজ মি, তুমি ধীমানকে চেনো?”
– অফ কোর্স, আমি চিনি, শিবিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইন্যাল ইয়ার, উলফেন্ডেনে থাকে।
– ওহ। উলফেন্ডেন? আমি তো ওকে সেই ষোলো নম্বরের দিন থেকে চিনি, তারপর সে যখন সাত নম্বর হস্টেলে গেলো, আমি কতবার সেখানেও ওঁর রুমে এসেছি।
– শো হোয়াট? তুমি হস্টেলে এসেছো, আর ও পাশ করে গেলেই বলেছে আমাকে ডারজিলিন, ডীগা, সান্টীনিকেটন নিয়ে যাবে।
– দীঘা? শান্তিনিকেতন? ব্যাস? এই পর্যন্তই? ও কিন্তু আমাকে বলেছে সিমলা, গোয়া নিয়ে যাবে। থ্রি নাইটস ফোর ডেজ প্রোগ্রাম।“
আশেপাশের জনতার মাঝে একটু মৃদু গুঞ্জন উঠলো। ধীমানকে ওরা সবাই চেনে। ক্যালিবাজ ছেলে। ছবি আঁকে, কবিতা গল্প লেখে। তাই বলে এখন থেকেই থ্রি নাইটস ফোর ডেজ আউটডোর প্রোগ্রাম? সাধারণ ছেলেদের ক্যালি, লাইটহাউস, মেট্রো, অলকা, মায়াপুরী, ভিক্টোরিয়া, ব্যাস ঐ পর্যন্তই। এর উপরের গ্রেডের ছেলেদের জন্য গার্ডেন বারের মদ, গাঁজা। কিন্তু ধীমান তো এখন কলেজে থাকতেই থ্রি নাইটস ফোর ডেজ প্রোগ্রাম সেট করছে।
দাদু ভাবছেন, এই ধীমানই তো গতকালই ফোনে কাকে যেন বলছিলো মেয়েটি যেন পাসপোর্ট রেডি রাখে। ব্যাংকক নিয়ে যাবে বলছিলো। এখন অন্য দুটি মেয়ে বলছে দীঘা, সিমলা, গোয়া, ব্যাংকক। না, ফোনদাদুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
ইতিমধ্যে আরেকটা ইনকামিং ফোন, “দাদু, ভালো আছো? আমি একটূ তাড়াতাড়িতে আছি। উলফেন্ডেনের ধীমানকে একটা খবর দিতে হবে।“
– ধীমান, উলফেন্ডেন হলের? শোনো মেয়ে, তুমি কিন্তু চার নম্বরে আছো।
– চার নম্বর? মানে?
– মানে, তোমার পাসপোর্ট আছে?
– হ্যাঁ, আছে তো। ধীমানই করিয়ে দিয়েছে। ও পাশ করলেই আমরা ইউরোপ বেড়াতে যাবো। সেরকমই আমাদের প্ল্যান আছে।“
না। দাদু আর নিতে পারছেন না। উনি জেনেছেন, এইসব কাজকম্মোকে আধুনিক বাঙ্লায় বলে মাল নামানো। যাই হোক, কে কোথায় কি মাল নামাচ্চে, দাদুর জানার কি দরকার? দাদুর কাজ খবর পৌঁছে দেওয়া, আজকে যে সব গিফট আসছে, সেগুলো পৌঁছে দেওয়া, তিনি শুধু তাই করবেন। আবার আজ মাঝে মাঝেই হতাশায় ভুগছেন। উনি কেন কলেজজীবনে এরকম সোভাগ্য নিয়ে জন্মান নি?
এভাবেই সারাটা দিন কেটে গেলো। কতজন যে আজ তিনটে, চারটে, পাঁচটা করে ফোন করেছে। আর কতজনের জন্য যে চারটে, পাঁচটা করে ইনকামিং ফোন এসেছে, তাঁর হিসাব করা মুস্কিল। তাঁর উপর পাহাড়প্রমাণ ফুল, আর কতরকমের যে গিফট। আরও জানলেন, ছেলেরা কিরকম সব মাল নামায়।
এবার ঘরে ফিরতে হবে। দাদু সমস্ত গিফট হস্টেলের ছেলেদের কাছে পাঠান নি, কিছু নিজের জন্য লুকিয়ে রেখে দিয়েছেন, যদিও জানেন না, প্যাকেটের ভেতর কি আছে। কাজ শেষ করে রিক্সা ডেকে ঐ লুকিয়ে রাখা গিফট নিয়ে বাড়ি চললেন।
ফুল আর গিফট প্যাক পেয়ে দিদিমা খুব খুশি। ফুলগুলো সাজিয়ে রেখে, এক এক করে প্যাক খুলছেন। বেশিরভাগই মদের বোতল, আর আছে সুগন্ধি পারফিউম, দামী পেন, এইসব। দামী পেন মনে হয় পড়াশুনায় ভালো ছেলেদের জন্য মেয়েরা পাঠিয়েছিলো।
– চলো গিন্নি, আজকের সন্ধ্যায় আমরা একসাথে ওয়াইন খাই। যাও, গেলাস নিয়ে এসো।
দিদিমা রান্নাঘর থেকে গেলাস নিয়ে এলেন।
– আরে, আরে স্টিলের গেলাস নয়। স্টিলের গেলাসে কেউ ওয়াইন খায় না। কাঁচের গেলাস নিয়ে এসো।
দুটি কাঁচের গেলাসে ওয়াইন খেতে খেতে দিদিমা দাদুর গলা জড়িয়ে সোহাগ করে বললেন “হ্যাঁ গো, এই ভ্যালেন্তি তিথিটা কি বছরে একবারই আসে? পুন্নিমে অমাবস্যার মতন প্রতি মাসে আসতে পারে না?”
Add comment