সাহিত্যিকা

বাংলা শেখা

বাংলা শেখা
তিলক ঘোষাল, ১৯৭২ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
“ভাষা দিবস” আসছে, আর দিনকয়েক বাদেই…. আর তা’তেই আবার মনে পড়ে গেল নিজের পুরোন একটা লেখা – বাংলা শেখা নিয়ে…. অনেক হাতড়ে খুঁজে বার করা গেল সে’টা … তারপর মনে হ’ল মজার অভিজ্ঞতাটা এই উপলক্ষে কলেজিয়ানদের সংগে শেয়ার করলে মন্দ হয় না….এই সেই লেখা……
“ক’দিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। কথায় কথায় উঠে এলো গত দুই জেনারেশন ধরে বাঙ্গালী ছেলে মেয়েরা (with a few honourable exceptions, of course) ক্রমশ কেমন বাংলা ভাষার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর তা দেখতে পাই নিজেরই পরিবারে  – একমাত্র দুই ভাইঝি ছাড়া – পরের প্রজন্মের বাকি সক্কলের মধ্যেই। এটা ঠিক যে তাদের সবারই স্কুল জীবন কেটেছে বাংলার বাইরে, তবু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে সে’টা কোন রকমেই কোন অন্তরায় হতে পারে না নিজের মাতৃভাষা শেখার পথে। না, না, nostalgic হয়ে বা কোন parochial perspective থেকে আমরা মোটেই এ বিষয়ে ভাবছিলাম না। আমাদের দু’জনেরই গভীর আক্ষেপ হচ্ছিল যে এর ফলে তারা কেমন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে। কারণ হিসেবে বন্ধু বলল – “আসলে উচ্চশিক্ষা বা প্রফেশনাল জীবনে বাংলা ভাষার তো কোন প্রয়োজন নেই, তাই এই অনীহা”। আমার কথা হ’ল – জীবনে এই দু’টো ছাড়া আর একটা রসদেরও তো প্রয়োজন আছে – মনের খোরাক! তার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন নেই?…….বন্ধুর বক্তব্য – “হয়তো অন্যান্য বিষয়ে পড়ার চাপ এতই যে বাংলায় বেশী সময় দেওয়ার সময় নেই তাদের”……..আমার পালটা জবাব – ‘যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না? আমরা নিজেরাও তো আর তেমন আদ্যিকালের মানুষ নই – আমরাও তো ইংরিজি/হিন্দির সঙ্গে বাংলাও শিখেছি – কোন অসুবিধে তো হয় নি? আর শিখেছি বলেই তো যখন ইচ্ছে বিনি পয়সায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিভূতিভূষণকে দিয়ে মন ভালো করিয়ে নিতে পারি”……..তা ছাড়া, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে যদি ইচ্ছে থাকে, কারুর পক্ষেই নিজের মাতৃভাষা শেখাটা মোটেই কঠিন নয়। সেটা যেন আমাদের DNA তেই লেখা থাকে”……. আর সেই কথাতেই মনে পড়ে গেল এ বিষয়ে নিজের ব্যক্তিগত এক মজার অভিজ্ঞতার কথা !
সিমলা স্কুলে ৪ বছর ইংরিজি, হিন্দি আরে গুরুমুখী (সিমলা তখন পাঞ্জাবের অংশ) – এই তিনটে ভাষা পড়তে হয়েছিল ফার্স্ট, সেকেন্ড এবং থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে – বাংলা ধারে কাছেও ছিল না। বাংলা ভাষার সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ হ’ত, তা কেবল সিমলা কালীবাড়িতে নববর্ষ, রবীন্দ্র জয়ন্তী আর পুজোয় আবৃত্তি প্রতিযোগিতা আর নাটকে অংশ নিয়ে। এমতাবস্থায় বাবার বদলী হ’ল দেশে – অর্থাৎ, পশ্চিম বঙ্গে………..স্কুলে ভর্তির জন্য পরীক্ষা হ’ল – হেডমাস্টারমশাই বাবাকে বললেন ‘ইংরিজি আর অঙ্ক তো ঠিক আছে, বাংলার কি করবেন?’ ………বাবা খানিক ভেবে বলল – ‘ক্লাস তো গরমের ছুটির পরই আরম্ভ হ’বে। হাতে মাস দু’য়েক সময় আছে। দেখা যাক বাড়িতে টিউটর রেখে কতদূর কি করা যায়”….. ”হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করুন….বুঝতেই পারছেন, ক্লাস ৮ এর বাংলা, তার ওপর আবার ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ !
শুরু হ’ল মাতৃভাষা শিক্ষা। অল্প বয়সী মাস্টারমশাইকে বেশ পছন্দ হ’ল। এসেই বলে দিলেন “স্যর ট্যর নয়, দিলীপ’দা বলে ডাকবে আমাকে”। এও জানা গেল যে আমারই মত ক্রিকেট পাগল উনিও। সুতরাং বেশ একটা easy working relationship গড়ে উঠলো প্রথম দিন থেকেই। প্রথম দিন গপ্পো টপ্পো করেই কাটালেন – হয়ত আমাকে খানিক মেপে যুপে নিতেই ! পরের দিন থেকে আরম্ভ হল লড়াই। ছোটবেলায় বাড়িতে শোনা/শেখা common ছোট ছোট বাংলা শব্দগুলো স্মৃতিকোঠা থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করিয়ে আনলেন…. পরে সে’গুলো লেখাতে আরম্ভ করলেন। অনেক লড়াই আর একটু থমকে, থমকে হলেও, শেষমেশ লিখে ফেলা গেল, কিছুদিনের মধ্যেই….. আরো ক’দিন পর সে’ সব শব্দ দিয়ে ছোট ছোট বাক্য রচনা আর সাথে সাথে হাতের লেখাটা পরিষ্কার করানো চলল……..তারপর নীচের ক্লাসের টেক্সট বুক্ থেকে জোরে জোরে পড়তে দেওয়া……ক্রমশ আরও লম্বা, আরও একটু কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে ছোট ছোট dictation……. বহু বানান ভুল থাকলেও, লেখাটা একটু একটু করে পোক্ত হতে লাগলো…… আর এমনি করেই ধীরে ধীরে ভিতটা গড়ে তুলতে লাগলেন দিলীপ’দা…….. মাস খানেক পর, পড়া/লেখা যখন একটু পোক্ত হচ্ছে, আরম্ভ হল গ্র্যামার – ব্যাকরণ পাঠ – আর হোঁচট খাওয়া শুরু………এই প্রথম আমি একটু ঘাবড়াতে লাগলাম। কারণ ভাষার ব্যাপারে আমি পুরোটাই instinctive – তা সে যে কোন ভাষাই হোক না কেন। পড়ে, শুনে, কথাবার্তা ইত্যাদির মধ্যে দিয়েই আমি একটা ভাষাকে চিনতে পারি, বুজতে পারি। তাকে যদি ব্যাকরণের কাঠামোর ওপর নির্ভর করে শিখতে হত, কোনদিনই কোন ভাষাই আমি একটুও শিখতে পারতাম না। যাই হোক, দিলীপ’দার একটা মস্ত ক্রেডিট হ’ল যে উনি আমার এই স্বভাবজাত প্রবণতাটাকে ধরে ফেলে, সে’টার পথে কোন অন্তরায় না হয়ে, ব্যাকরণকে একটা necessary evil হিসেবে আমার কাছে তুলে ধরে লোভ দেখালেন যে এটা দিয়ে অল্প চেষ্টতেই অনেক নম্বর তোলা যায়!! আর ভবীও মোহিত হয়ে লেগে ব্যাকরণকে নম্বর তোলার strategy ধরে! দিলীপদার আর একটা বড় কোয়ালিটি ছিল যে ভুলভাল বুঝলে বা করলেও একটুও বিরক্ত না হয়ে, দ্বিগুণ উদ্দমে লেগে যেতেন বোঝাতে – লড়াইটা যেন ওনার – জিততে ওনাকে হবেই !…..টানা দু’মাস চলল যুদ্ধ – আমার থেকে ওনার বেশি। শেষমেশ নিয়ে এলেন একটা মোটামুটি পর্যায়ে – ক্লাসে ৮ এর স্ট্যান্ডার্ডের মোটেই নয় – তবে একেবারে ছ্যা ছ্যা করার মতনও না । মা বললেন ‘বাবা দিলীপ, স্কুল খোলার পরও কিন্তু তোমাকে চালিয়ে যেতে হবে’। উনিও রাজি হলেন আমার বাংলা আরো পালিশ করে তুলতে….
স্কুলের প্রথম দিনের বাংলা পাঠ শুরু হল মাইকেলে মধুসূদন দত্তর কবিতা ‘কাশীরাম দাস’ দিয়ে……. সেই, “চন্দ্রচূঢ় জটাজালে আছিলা যেমতি জাহ্নবী…’…….বোঝ ব্যাপার ! আমার মত বাংলা পণ্ডিতের তো ভিমরি খেয়ে বেঞ্চ থেকে পড়ে যাওয়ার কথা ! কিন্তু তা হ’ল না – কারণ স্যর গপ্পো ফেঁদে বসলেন……চন্দ্রচূঢ় কে……কেন সেটা তাঁর নাম…….গঙ্গার উৎপত্তি কি করে হল……মহাদেবকে কেন গঙ্গাকে নিজের জটায় বাঁধতে হল ইত্যাদি – একেবারে জমাটি গপ্পো !! এরপর তারই রেষ ধরে টেনে আনলেন মূল মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় হওয়ার ফলে বাংলাভাষীরা তার রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত থাকায় কেমন করে সে অভাব পূর্ণ করলেন কবি কাশীরাম দাস বাংলায় ‘ভারত পাঁচালী’ রচনা করে। আর তার থেকেই উঠে এলো মাইকেল মধুসূদন দত্তর জীবনের গভীর আক্ষেপ যে তিনি বাংলা ভাষাকে প্রথমে উপেক্ষা করে ইংরিজিতে লেখায় সময় নষ্ট করেছিলেন। এই শেষ জিনিষটা আমাকে সব থেকে বেশী ভাবালো – তাঁর মত দু’ ভাষাতেই তুখোড় কবির সে’টা যদি আক্ষেপের বিষয় হয়, তাহ’লে বাংলা ভাষায় নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। “নাহ, ভালো করে শিখতেই হবে” – স্থির করে ফেললাম ক্লাসে বসেই! বাড়িতে সন্ধ্যে বেলায় সেই দাঁত ভাঙ্গা কবিতা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বার বার নিজেই পড়লাম – এমনই নেশা লেগেছিল !…….স্কুলে আর বাড়ি মিলিয়ে এইভাবেই চললো বাংলা চর্চা। কিছুদিন পর যখন পড়া অল্প স্বল্প সড়গড় হয়েছে, দিলীপদা সঞ্চয়িতাতে তিনটে কবিতা মার্ক করে নিজে নিজে পড়া/বোঝার চেষ্টা করতে বললেন – ‘পুরাতন ভৃত্য’…‘দুই বিঘা জমি’……‘দেবতার গ্রাস’! আর তা থেকে আরো এক নিবিড় আত্মীয়তা গড়ে উঠতে লাগলো ভাষাটার সঙ্গে…. পরিষ্কার মনে পড়ে, এক বিকেলে যখন আকাশ কালো করে ঝড় উঠেছে, আপনা আপনিই আওড়ে উঠে ছিলাম – ‘সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম; অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম’ ! যদিও সেটা কালবৈশাখীর ঝড় ছিল না, কিন্তু লাইন দু’টো আউড়ে রাজ্য জয় করার মত এক আনন্দময় অনুভূতি হয়েছিল!……….
দেখতে দেখতে স্কুলে তিন মাস কেটে গিয়ে কোয়ার্টারলি পরীক্ষা এলো। নিজেকে অবাক করে ঠেলেঠুলে হলেও, পাশ করে গেলাম বাংলায়!….পরীক্ষার খাতা দিলীপ’দাকে এনে দেখালাম। উৎসাহ দিয়ে বললেন “দেখছো তো এই ৫ মাসেই কতটা এগোতে পারা গেছে? যদি এমনি লেগে থাকতে পারো তো হাফ-ইয়ার্লিতে দেখবে আরও কত বেশী নম্বর পাবে……এখন proverb আর idioms এর দিকেও আমাদের একটু বেশী নজর দিতে হবে” ……….কারণ?…..পরীক্ষার খাতায় ‘ডুমুরের ফুল’ দিয়ে বাক্য রচনায় আমি লিখেছি – ‘ডুমুর ফুলের রং বেগুনী”!!
ইচ্ছে থাকলে আর সঠিক গুরু পেলে মাতৃভাষা শেখাটা কারুর পক্ষেই মোটেই কঠিন নয় – বয়স যাই হো’ক না কেন…….”

Sahityika Admin

Add comment