ফালক্রাম
দীপঙ্কর রায়, ১৯৮০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
বিক্কলেজের স্মৃতিমেদুরতায় ডুব দিয়ে অনেক মুক্তো শুক্তি তুলে আনা গেছে। বিক্কলেজের পাঁচ বছর যেখানে শেষ, আমার লেখা সেখানেই শুরু। তবে শুরুটা শেষের আগেই হয়েছিল। জোয়ালের চিন্তা। সেটা কি?
জোয়াল হলো কারিগরী পরিভাষায় ফালক্রাম, যেটা পাঠশালা থেকে বেরিয়ে, জীবনের পথে চলতে গেলে জুততেই হবে ঘাড়ে। অর্থাৎ কিনা, একটা জুতসই চাকরি, পরিভাষায় প্লেসমেণ্ট। তা প্লেসমেণ্ট ডিপার্টমেন্ট সে একটা ছিল, সে বিভাগের পাইপসেবী অধ্যাপকের নামের পিছনে তিন লাইনের ডিগ্রীর লাইন থাকতো। পরে জেনেছিলাম, তাঁর অধিকাংশই সোসাইটির মেম্বারশিপ। উনি খুব রাশভারী গলায় বললেন, ইঞ্জিরিতে কথা কইতে না পারলে জোয়াল জোতার ইন্টারভিউতে ভরাডুবি নিশ্চিত। আর ভালো জুতো চাই, জামা প্যান্টের সাথে টাই পড়তে হবে। এদিকে আমি কিনা নির্ভেজাল বাংলা মিডিয়ামে পড়া বোতাম আঁটা বঙ্গ, আমার স্পোকেন ইংলিশের দৌড়, গুডমর্ণিং, হাউ ডু ইউ ডু এর আগে আর এগোয়নি। জামা প্যান্ট আছে, টাই নেই। তাই মনে বড়ই শঙ্কা। আমার কি হবে?
দেবাশিস, আমার ছাত্রাবাস সখা, পড়েছিল ইংরেজি মিডিয়ার মিশনারী স্কুলে। সে বেশ ফটর ফটর ইংরিজি কইতে পারত। তোতাকেই ধরলুম শেষকালে।
– শোন, তুই আর আমি রোজ বিকেলে ফাস্ট গেট থেকে ঝাল মুড়ি কিনে ব্যাতাইতলা অবধি যাব। আমার সাথে শুধু ইংরেজীতে কথা কইবি। অব্যেস দরকার, বুঝলিনা? মুড়িটা অবিশ্যি আমিই খাওয়াব …
তো সে চলল কিছুদিন, তবে মুড়ি খাওয়া ছাড়া কথাবার্তা বিশেষ এগুলো না। বোলতি বন্ধ একেবারেই। শেষে ধুত্তেরি বলে ছেড়ে দিলাম।
যে কথা বলছিলাম, আমাদের তো প্লেসমেণ্ট বিভাগ ছিল, কিন্তু এই প্রজন্মের মত ক্যাম্পাসিং ছিল না এত।
আমাদের হাতে সাইক্লো করা (এই জমানার ছাত্ররা মনে হয় বুঝবে না। ধরে নাও এক সঙ্গে শ’খানেক ফটোকপি করা পাতা) একটা লিস্ট ধরিয়ে দিতেন। তারপর দেখতাম, সেই লিস্টের অর্ধেক কোম্পানি দিল্লী, বম্বে, ব্যাঙ্গালোরের। সেখানে আবেদনপত্র পোস্ট করতে হবে। কিছু কলকাতার। কলকাতার কোম্পানির ঠিকানা খুঁজে গিয়ে দেখতাম সেই নামের কোন কোম্পানির অস্তিত্বই নেই। আর হিল্লী দিল্লির আবেদনগুলোও ফেরত আসতো, No such company in this address. আর খুবই সীমিত যে দু’একটা কম্পানী আসত, তাতে বিশেষ কলকে পেতুম না।
তবে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন বেরুতো বড় বড় পাব্লিক সেক্টর থেকে, কর্মখালির বিজ্ঞাপন দিয়ে। নিজেদের উদ্যোগে সেখানে লিখিত পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ দিয়ে তবেই সেখানে চাকরি। তো এইরকম এক সংস্থায় অবশেষে আমার ইন্টারভিউয়ের শিকে ছিঁড়ল। স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া থেকে কল এলো। কিন্ত ইংরিজিতে কথা বলা? সে তখনো শিখিনি তো? কি জবাব দেব, সেটা মনে মনে অনুবাদ করে তবে বলি। অত সময় তো বোর্ড দেবেই না। আমার ফটফট করে ইংরেজি বলা সহপাঠীদের ওপর বড় হিংসে হলো।
সেইলের ইন্টারভিউ হয়েছিল কলকাতায়। সকাল সকাল গেলাম সেই আপিসে ফর্সা জামাকাপড় পরে। টাইপরার অত চল তখন ছিল না, আর টাই পরতে জানতুমও না। সহপাঠী অনেককে দেখা গেল সেখানে। দেখে ধড়ে প্রাণ এল। তারা যে আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী সেই চিন্তা মাথায় তখন আসেই নি। সে যাই হোক, ডাক পড়ল ঘরে। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ-এ। মে আই কাম ইন, প্লিজ সিট ডাউন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
এরপর দেখি বোর্ডের মাথা পাশের অফিসারের সাথে বিশুদ্ধ বাংলায় কি বললেন। শুনে প্রাণে বড় আরাম হল।
– মে আই স্পিক ইন বেঙ্গলী স্যর?
বোর্ডের মাথা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন অ্যাঁ?
তারপর একটু সামলে নিয়ে
– য়ু কাণ্ট স্পীক ইন ইংলিশ?
– আই ক্যান স্যার, বাট ক্যান এক্সপ্লেন বেটার ইন মাদার টাং
ভদ্রলোক পুরো এক মিনিট চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটু মুচকি হাসি, আচ্ছা বলো।
সেইলের পুরো ইন্টারভিউটা আমি বাংলায় দিয়েছিলুম। তবে কিনা, মাতৃভাষায় ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরির আশা কেউ করে না, আমিও করি নি। ওটা ছিল আমার পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা মাত্র।
এরমধ্যেই কলেজের হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে এসেছি। জোয়াল খোঁজা চলছেই। সারা সকাল ঝোলা কাঁধে বিভিন্ন কোম্পানিতে গিয়ে বায়োডাটা বিলিয়ে আসি, আর সারা বিকেল ডাকঘরের অমলের মত, রাজার থুড়ি কোম্পানির চিঠির অপেক্ষায় বসে থাকি। রাস্তার মোড়ে পিওন দেখলেই আশায় আশায় বারান্দায় এসে দাঁড়াই।
তো এই করতে করতেই একদিন এল বটে রাজার চিঠি। সেইলের খামে আমার সেই বাংলায় ইন্টারভিউ এর ফাইনাল সিলেকশন। আমাকে জয়েন করতে হবে ভিলাই নয়, রৌরকেল্লা, সালের, বোকারো কোথাও নয়। একদম বাড়ির কাছে আর্শিনগর, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায়। বন্ধুরা বলল, বাংলায় ইন্টারভিউ দিয়েছিলুম বলেই আমার এই বঙ্গীয় পোস্টিং। সেইল বোধ করি বুঝেছে, বেচারা হিন্দী ইংরিজি বলতে পারে না, একে ঘরের কাছে রাখাই ভাল।
তখন অক্টোবরের শুরু। বাতাসে শারদীয়া আগমনী। সোনা মাখা ভোরে, শিউলি ফুলের গন্ধ মেখে মনে হল, চিঠিটা নিয়ে এসেছে আমার কতজীবনের স্বপ্ন দেখার রসদ! পুজোটা কাটল শরতের পেঁজা তুলোর মত। লক্ষীপুজোর পর এক খুশিয়াল ভোরে, বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে, গুরুজনের আশীর্বাদ নিয়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে চড়ে বসলুম ….
*******
আমি জানি, এই পর্যন্ত পড়েই অনেকেই চোখ কোঁচকাচ্ছ। আরে ব্যাটাকে তো বরাবর তেলবেচা তেলী দেখে এলুম, পেট্রোল ডিজেল আর রান্নার গ্যাস বেচছে। এর মধ্যে আবার স্টীল এল কোদ্দিয়ে?
আসলে গল্পটাতো এখনো শুরুই হয়নি! না, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় আমি জোয়াল জুততে পারিনি শেষমেশ। পারবো কি করে? ডাক্তারী পরীক্ষায় বাতিল হয়ে গেলুম তো? ডাক্তার বললেন যে আমার দূরদৃষ্টি সেইলে কাজের উপযুক্ত নয়। এ ব্যাপারে আমার একটা খটকা ছিল অবিশ্যি। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল বটে, চশমার পাওয়ার চারের বেশী হওয়া চলবে না। তাই চোখ পরীক্ষার আগে ঘরে ঢুকেই, বোর্ডটা মুখস্থ করে নিয়েছিলাম, যাতে কম পাওয়ারেও পড়তে পারি। তো ডাক্তারবাবু পড়তে টড়তে বললেন না। স্রেফ চশমাটি নিয়ে পাওয়ার মিলিয়ে বললেন..এঃহে, হবে না তো। তোমার তো দেখি সাড়ে চার। অ্যাপ্লাই করার সময় দেখনি, লিমিট কি ছিলো? চার, সেটা খেয়াল করো নি?
অতএব, দূরদৃষ্টির অভাবে আমি বাতিল। বাক্সবিছানা নিয়ে ফেরার ট্রেনের অপেক্ষায় দুর্গাপুর স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে গাছতলার বেঞ্চে বসে আছি। পুজোর রেশ তখনও যায়নি। স্টেশনের বাইরে প্যান্ডেল খোলা হচ্ছে, আর সরে যাচ্ছে এক বাইশ বছরের তরুণের মনের রঙিন ক্যানভাসগুলো। কোজাগরীর পরে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। সেই আলোয় গা ভিজিয়ে মনে মনে বললাম, এই শহরে আর কোনদিন নয়। ডাউন ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস ঢুকছে স্টেশনে।
********
গল্পটা কিন্তু এখনেও শেষ নয়। মানে শুরুই হয় নি। বছর ছয়েক পরের কথা। তখন আমি বিহারের নেপাল সীমান্তের একটি গঞ্জ শহর রক্সৌলে পেট্রোলিয়াম মজুতের ডিপো নির্মাণে আছি। কলকাতা থেকে তখন আসতে হত মুজফ্ফরপুরে ট্রেন বদল করে, সরাসরি ব্রডগেজ যোগাযোগ ছিল না। মোবাইলের যুগ বহুদূর। বাড়িতে কথা বলতে হয় ট্রাঙ্কল বুক করে। কলকাতার কাগজ পৌঁছয় পরের দিন সন্ধ্যায়, চিঠিপত্র সপ্তাহে একদিন। সেইদিন সকাল থেকেই বসে থাকতাম বাড়ির চিঠির জন্য। তো এইরকম একদিন,বাবার চিঠি এল খামে করে
“তোমার বিবাহের জন্য পাত্রী দেখা চলিতেছে বলিয়াছিলাম। একটি সম্বন্ধ আমাদের পরিবারগত ভাবে পছন্দ হইয়াছে। কন্যার পিতা দুর্গাপুরে সেইল হাসপাতালের চিকিৎসক, কন্যা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর স্তরেপাঠরতা” …ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেদিন বুঝলাম, জীবনের দুটো ফালক্রাম। একটা জীবিকার আর অন্যটি জীবনের। দুর্গাপুরের জীবিকার ফালক্রামে বাতিল হয়ে আবার ফিরে আসতে হল জীবনের ফালক্রামে। সেই বন্ধন, যা কিনা অবিচ্ছেদ্য। এরপর তো কতবারই যাওয়া আসা দুর্গাপুরে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সেই গাছতলার বেঞ্চিটা মিটিমিটি হাসত ..কি? বলেছিলে যে, আর আসবে না এই শহরে?
না এসে কি পারি? আমার দ্বিতীয় হোমটাউন যে?
দারুণ লাগল।