সাহিত্যিকা

পাঞ্চালী ও মাধবীলতা 

পাঞ্চালী ও মাধবীলতা 
রমা জোয়ারদার, 
দিদুন,
আজ আমার মন ভালো নেই। কারণটা পরে বলব। অতীতের সব কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে। পুরোন কথা মনে হলে আমার বুকের মধ্যেটা কেমন যেন টন্‌টন্‌ করে। সেটা সুখে না দুঃখে, তা আমি জানিনা। লোকে বলে ছেলেবেলার স্মৃতি বড়ই মধুর। আমার জীবনের মধুরতম স্মৃতি জমে আছে জীবনের প্রথম আট-ন’ বছরের মধ্যে – যতদিন তুমি ছিলে!
তোমাকে যখন শেষ দেখেছিলাম, তখন তোমার যে বয়স ছিল, আমি এখন তারই কাছাকাছি পৌঁছেছি ! অদ্ভূত ব্যপারটা কি জান –  তুমি শুনলে হয়তো হাসবে – আমার কিন্তু এখনও নিজেকে বুড়ো মনে হয় না। অথচ তোমাকে তখন একেবারেই থুর্‌থুরে বুড়ি মনে হত। ওই বয়সেই তোমার বেশ কয়েকটা দাঁত পড়ে গিয়েছিল। তুমি কিন্তু দাঁত বাঁধাওনি –  আর তোমার সেই ফোক্‌লা মুখের মায়াময় হাসি আমার কি যে ভালো লাগত ! তোমার গালের, গলার আর হাতের নরম তুল্‌তুলে চামড়া নিয়ে খেলা করতে আমার খুব মজা লাগতো। আচ্ছা দিদুন, তুমি একটুও নিজের যত্ন নিতে না, তাই না ?  না হলে ওই বয়সে অত বুড়ো হয় কেউ ? আমাকে দেখ – পঞ্চান্ন বছর হতে চলেছে, কিন্তু (নিজের মুখে বলতে নেই) আমাকে দেখে কেউ বুড়ো মানুষ বলবে না। তবে সেই সাথে এটাও স্বীকার করছি যে তোমার যুগে লোকেরা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সহজ ভাবে বুড়ো হতো। আর এখন যুগটা এমন পড়েছে যে আমরা শান্তিতে বুড়ো হতেও পারছিনা ! এটাও একটা লড়াই দিদুন, সময়ের সাথে লড়াই – নিজের সঙ্গে লড়াই।
তোমার সেই বুড়ো চেহারাটা এখনও আমার কাছে খুব প্রিয়। তোমার কোলের কাছে কী আরাম আর কী শান্তি ছিল ! আমি খুব বায়না করতাম তখন – দুধ খেতে বায়না, ভাত খেতে বায়না, চান করতে, জামা-কাপড় পরতে, ঘুমোতে – সব কিছুতেই শুধু বায়না ! সবাই অতিষ্ঠ হয়ে যেত। একে তো মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে সন্তান, তার উপর কালো ! দুধে আল্‌তা রঙ মায়ের কোলে আমায় দেখে মাসি-পিসিরা সবাই বলতো – ‘কি মায়ের কি মেয়ে !’ শুনে শুনে মায়েরও বোধহয় বিরক্তি এসে গিয়েছিল। একে তো একান্নবর্তী পরিবারের হাজার গন্ডা কাজ, তার উপর আমার বায়নাক্কা !
আমার দু-বছর হতেই ভাইয়া এলো। ফর্সা, সুন্দর ছেলে – কিন্তু রুগ্ন; অসুখ লেগেই থাকত ! মা আমাকে যেন ভুলেই গেল ! আমার নাওয়া-খাওয়া যা কিছু – সবই তুমি। ওই কালো মেয়েটাকে কী আদরই করতে তুমি ! আমাকে নাম দিয়েছিলে – ‘পাঞ্চালী’। বুকের কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে রাঙ্গা পিসিকে বলেছিলে – ‘কালো তো কি হয়েছে? চোখ দেখেছিস্‌ , কপাল দেখেছিস্‌? দেখেছিস্‌ কি সুন্দর এক মাথা কালো কুচ্‌কুচে কোঁক্‌ড়া চুল ! মহাভারতের দ্রৌপদীও তো কালো ছিল ! দেখবি, এ মেয়ের জন্য হাজারটা ফর্সা রাজপুত্তুর দরজায় দাঁড়িয়ে যাবে।’ তোমার কথা শুনে সবাই হাসত।
ওদের হাসি দেখে আমার তখন একটু একটু রাগ হত – বেশী রাগ করতে তো তখনও শিখিনি ! আর তোমাদের কথাগুলোই কি সব ঠিক্‌ ঠাক্‌ বুঝতাম? তবে মোটামুটি নিজের মতো করে কিছুটা বুঝতে পারতাম। যতদিনে পুরোপুরি বুঝতে শিখলাম, তখন তুমি আর নেই !
তোমার মনে আছে দিদুন, হীরাপুরের বাড়ির উঠোনের দরজার পাশে একটা মাধবীলতার ঝাড় ছিল। সেটা ফুলে ফুলে ভরে থাকত। রাতে ফুলের গন্ধে উঠোনটা ভরে যেত। আমাদের ওই উঠোনে একটা খাটিয়া পাতা থাকত, ওখানে রোজ সন্ধেবেলা তোমার কোলের কাছে শুয়ে আমি ব্যাঙ রাজপুত্র বা নীল কমল, লাল কমলের গল্প শুনতাম। সেই সময় মাথার উপর তারা ঝিক্‌মিকে আকাশ, তোমার গুন্‌গুন্‌ গল্প আর ওই মাধবীলতা ফুলের গন্ধ আমাকে কী এক নেশায় আচ্ছন্ন করে ফেলত। তোমার গায়ের সাথে লেপ্টে শুয়ে আমি ভাসতে ভাসতে স্বপ্নের দেশে চলে যেতাম।
জান দিদুন, আমার যখন নিজের একটা বাড়ি হল, তখন প্রথমেই আমি তার গেটের পাশে একটা মাধবীলতা লাগিয়েছি। জয়ন্ত বলেছিল – ‘এ মা, মাধবীলতা লাগাচ্ছ কেন?  শুঁয়োপোকা হবে।’  আমি উত্তর দিয়েছিলাম – ‘হলে হবে। মাধবীলতার গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে !’ আসলে আমার মনের মধ্যে তোমার গায়ের গন্ধ আর মাধবীলতার গন্ধ মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছিল। জান, সেই গাছটা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। কত ফুল হয় তাতে ! রাতে দোতলার ব্যাল্‌কনিতে বসে ওই থোকা থোকা সাদা ফুলগলো দেখতে দেখতে এখনো আমি স্বপ্নের দেশে ভেসে চলে যাই ! সকালে সূর্যের আলো পড়তেই ওই সাদা ফুলগুলো আস্তে আস্তে লাল হয়ে যায় ! তারপর আরও বেলা বাড়লে ফুলগুলো ক্রমশঃ শুকিয়ে যায় – আর বিকেলে নতুন করে ফুল আসে।
শুধু নিজের কথাই বলে চলেছি। তুমি ওখানে কেমন আছ দিদুন – খুবই জানতে ইচ্ছা করে ! শুনেছি ওখানে গেলে কারো আর কোন কষ্ট থাকেনা। তাই তুমিও নিশ্চই খুব ভালো আছ এখন। পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা –  কিচ্ছু নেই আর ! ঠাকুরদার সাথে তোমার দেখা হয়েছে? কেমন আছেন তিনি? আমার সাথে তো তার কোন কথাবার্তাই হলনা। আমি জন্মানোর আগেই হুড়োহুড়ি করে চলে গেলেন। যাক্‌গে বাবা, তোমাকে পেয়েছি – এই-ই অনেক। জানো তো, কিছুদিন আগে রাঙা পিসির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এক্কেবারে বুড়ি হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও ঘরের মধ্যে টুক্‌টুক্‌ করে হেঁটে বেড়ায়, আর নিজের কাজটুকু নিজেই করে নিতে পারে। আমাকে দেখে রাঙা পিসি বলল – ‘তোকে দেখলে মনে হয় যেন মাকে দেখছি – এক্কেবারে মায়ের আদল !’ রাঙা পিসির কথা শুনে আমি তো হেসেই মরি। তোমার আদল, না ছাই ! তোমাকে কত সুন্দর দেখতে ছিল ! তুমি কি আমার মতো কালো ভুষ্‌কুন্ডী ছিলে না কি? আসলে আমার মনের মধ্যে তুমি এখনও জাঁকিয়ে বসে আছ কি না, তাই চেহারাতেও তোমার ছবিটা ফুটে ওঠে। যতদিন তুমি ছিলে, কি ভালোই ছিলাম। তুমি যেন আমাকে দু-হাতে আগলে রেখেছিলে। সংসারের যা কিছু খারাপ, সেই সব কিছু থেকেই আমাকে তুমি আড়াল করে রেখেছিলে। তুমি চলে যাবার পরেই আস্তে আস্তে দুনিয়ার মন্দ ব্যাপারগুলো – খারাপ মানুষ, খারাপ কথা, খারাপ ব্যবহার – এই সব কিছু আমার সামনে আসতে লাগল। এই ভাবেই জীবনটা যেটা ছিল একটা খেলার মাঠ, সেটা একটা যুদ্ধ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াল। নিজের সাথে যুদ্ধ, অন্যের সাথে যুদ্ধ, পারিপার্শিকের সাথে যুদ্ধ, সমাজ-সংসার সব কিছুর সাথে যুদ্ধ। বল তো দিদুন, কেন আমি সারা জীবন ধরে এতো লড়াই করলাম? সে কি শুধু আমার স্বভাবটা লড়াকু বলে? মা বলতো, – ‘বড্ড তেজ তোর। মেয়েদের এত তেজ ভাল নয়। মেয়েদেরকে অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে হয়। ভালো লাগুক আর মন্দ লাগুক – অনেক কিছু মেনে নিতে হয় ! সংসারের শান্তি বজায় রাখতে নিজের মন আর বুদ্ধির দরজায় কুলুপ এঁটে চুপ্‌ করে থাকতে হয় !’
মা খুব ভালো মানুষ ছিলেন – একেবারে লক্ষ্মীমন্ত বউ। টুক্‌টুকে ফর্সা, সুন্দরী, গৃহকর্ম-নিপুণা, রান্নাবাড়া, সেলাই-ফোঁড়াই-এ সিদ্ধহস্ত – বলতে গেলে মায়ের সব কিছুই ভালো ছিল। কিন্তু মায়ের ওই ভালোমানুষ স্বভাবটা আমার ঠিক পছন্দ হত না। মাকে আমার কেমন যেন ভীষণ ভীতু মনে হত। কেউ কিছু বললে বা কোন কিছুতে কষ্ট পেলে মা শুধু আড়ালে গিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছত। চোখের সামনে অন্যায় দেখলেও মুখ ফুটে কোন প্রতিবাদ করতে পারত না !
আমি মায়ের মতো হইনি, দিদুন ! আমাকেও অনেক সময় অনেক অন্যায়, অনেক অবিচার সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু সব কিছু মায়ের মতো মুখ বুজে মেনে নিতে পারিনি। চোখের সামনে অন্যায় দেখলে এখনও আমার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে, আর আমি তখন প্রতিবাদ না করে থাকতে পারি না – যদিও জানি যে আমার বেশীরভাগ প্রতিবাদই মাঠে মারা যাবে !
আমাদের বাড়ীতে লোকজনের ভীড় লেগেই থাকত। নানান সম্পর্কের দাদু-দিদু, কাকা-জ্যাঠা, মাসী-পিসী এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা প্রায়ই আসা-যাওয়া করত।  তোমার বড় ঘরের বড় খাটে আমি, বিশু, খোকা, লতা – আরও কে কে যেন তখন শুতাম। কিন্তু তোমার বাঁ-পাশের যায়গাটা আমার জন্য পাকা ছিল। ওটা আমি কারোকেই ছাড়তাম না !
তুমি চলে যাওয়ার পর আমার দুনিয়াটাই যেন পাল্টে গেল। অনেক লোকের ভীড়ে আমি হারিয়ে গেলাম। বাড়ী ভর্তি লোক, কিন্তু আমার ভীষণ একা লাগত। তোমার জন্য খুব মন খারাপ হত। সন্ধ্যে বেলায় মা-কাকিমারা ঠাকুর ঘরে প্রদীপ জ্বালাত, শাঁখ বাজাত। ঘরে ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলত (হীরাপুরে তখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি)। আমি তখন খেলার মাঠ থেকে ফিরে, বাড়ীর প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে, দালান-উঠানের প্রতিটি কোনায় কোনায় আতি-পাতি করে তোমায় খুঁজে বেড়াতাম। জানতাম তুমি নেই – তবু খুঁজতাম। ভীষণ কষ্ট হত। অজানা একটা ভয় আমার পেটের মধ্যে কুন্ডলী পাকাত। বুকের মধ্যে কান্না জমে যেত। চুপ্‌ চাপ্‌ গিয়ে বসতাম উঠানের খাটিয়াটাতে। সেই সময়, ঝিরি ঝিরি বাতাসে ভেসে আসত মাধবীলতার গন্ধ। অদ্ভুত একটা আশ্বাস জড়িয়ে থাকত ওই গন্ধের মধ্যে – যেন তোমার অদৃশ্য উপস্থিতি!
এখনও সন্ধার পরে যখন কোন কাজ-কর্ম থাকেনা – আমি তখন চুপ্‌ চাপ্‌ বসে থাকি এ-বাড়ীর ছোট্ট ব্যাল্‌কনিটায়। সাধারণতঃ কেউ এটাতে ভাগ বসাতে আসেনা। বাড়ীর লোকেরা বুঝতেই পারেনা ওই সাজানো গোছানো ঘর-টর বাদ দিয়ে আমি কেন এই সাদা-মাটা বারান্দাটায় একটা পুরানো প্লাস্টিকের চেয়ারে একা বসে থাকি ! ভালই হয়েছে, এই নিরিবিলি একান্তটুকুই তো আমার কাম্য ! এখানে বসে ওই মাধবীলতার সঙ্গে আমি কথা বলি। কখন বা কবে জানিনা, তুমি ওই গাছটার সাথে মিলে মিশে এক হয়ে গেছ। গাছটা এখন এমন ঝাপ্‌ড়া হয়ে গেছে যে শুধু দোতালার রেলিং নয়, ওদিকেও গেট্‌ ছাড়িয়ে রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টটাকে জড়িয়ে ধরেছে। একবার খুব ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল – আমাদের লাইনের কয়েকটা বাড়ীর বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। লাইনটা ঠিক করতে এসে বিদ্যুৎ বোর্ডের লোকেরা বলল – ‘গাছটা কাটতে হবে; ওটা ল্যাম্প-পোস্টটাকে ডিস্‌টার্ব করছে।’ তখন মালীকে ডেকে গাছটা ছেঁটে দিয়েছিলাম। কিন্তু আবার সেটা বাড়তে বাড়তে ওই ল্যাম্প-পোস্টটাকে জাব্‌ড়ে ধরেছে। কী ফুল, কী ফুল ! কি সুন্দর যে লাগে দেখতে – বিশেষ করে রাতে; কিন্তু আবার সেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট। এবারে আমার ছেলে আর তার বাবা মিলে ঠিক কোরেছে – গাছটা একেবারেই কেটে দেবে। আমি বলে ছিলাম – ‘একেবারে কেটে ফেলার তো দরকার নেই – বেশ খানিকটা ছেঁটে দাও এখন, পরেও আবার দরকার মতো ছেঁটে দিলেই হবে।’  ওরা বলল – ‘জাস্ট একটা ফুলগাছের জন্য ফাল্‌তু এসব ঝামেলা করার দরকার কী? তাও আবার মাধবীলতা – ফুঃ !’ ওরা, অর্থাৎ জয়ন্ত আর দিগন্ত – ওরা এ রকমই বলল ! বাপ আর ছেলের নামে যেমন মিল, স্বভাবেও তেমনি মিল। দুজনেরই কথা-বার্তায় মিষ্টতা বড় কম, মনগুলো যেন একেবারে শুকনো খট্‌খটে। জান, কালই মাধবীলতা গাছটা কেটে ফেলা হবে। তোমাকে বলেছিলাম না – আমার মন খারাপ ! কারণটা এটাই। কালও হয়তো এসে এই ব্যাল্‌কনিতে বসব, কিন্তু তখন মাধবীলতাও থাকবে না, তুমিও থাকবে না। কার সাথে আমি আমার মনের কথা বলব?
জান দিদুন, তোমার মতন বন্ধু আমার আর একটাও হল না। হীরাপুর থেকে যখন চলে এলাম, তখন ছোটবেলার বন্ধুরা সব ছিট্‌কে ছাট্‌কে কোথায় চলে গেল ! কলেজে পড়ার সময় নীতা আর কাকলি আমার খুব ভালো বন্ধু হয়েছিল। কিন্তু তাই বা টিকলো কই? আমি যখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে, তখন তিন দিনের জ্বরে মা মারা গেল। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা কাকারা তাড়াহুড়ো করে আমার বিয়ে দিয়ে দিল। কালো মেয়ে – পরে যদি পাত্র না পাওয়া যায় ! তার উপর মা নেই – কে নজরদারী করবে? অতএব আমার বি-এ পাশ করা পর্যন্ত কেউ অপেক্ষা করল না। আমি প্রতিবাদ করে ছিলাম – তীব্র প্রতিবাদ ! অনশনও করেছিলাম। কিন্তু কিছুই হল না – আমার বিয়ে হয়ে গেল। ভাগ্যিস আমার শ্বশুর মশাই ছিলেন। তিনি আমার পড়া বন্ধ হতে দিলেন না। তাঁর জন্যই আমি বি-এ-টা পাশ করতে পারলাম। আমার শাশুড়ী আর বরের মোটেই ইচ্ছা ছিল না যে বিয়ের পরেও আমি পড়াশোনা করি। আই-এস্‌-সি পাশ ছেলের বি-এ পাশ বউ – এ আবার কেমন ধারা ! আমার বাবা জামাই-এর পড়াশোনার ব্যাপার নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে চাননি। বলেছিলেন – ‘ডিগ্রী দিয়ে কি হবে? কারখানার চাকরী – কাজ শিখলেই প্রোমোশন্‌’। আমি বি-এ পাশ করার পর এম্‌-এ পড়তে চেয়েছিলাম। ইচ্ছাটা প্রকাশ করতেই জয়ন্ত একেবারে খিঁচিয়ে উঠল – ‘অনেক হয়েছে। আর পড়াশোনায় কাজ নেই। অতই যদি পড়াশনার ইচ্ছা ছিল, সেটা বাপের বাড়ী থেকে পুরণ করে এলেই তো পারতে। আমাদের উপর দিয়ে চালাচ্ছ কেন? আমি তোমার পড়ার খরচ যোগাব, আর আমার বুড়ো মা রেঁধে-বেড়ে তোমাকে কলেজে পাঠাবে – এতটা আশা কোর না !’
নাঃ, আর আশা করিনি। ভালো গান গাইতাম বলে বিয়ের সময় বাবা একটা হারমোনিয়ম দিয়েছিল – ওটাই টেনে নিয়ে মাঝে মধ্যে গান গাইতে বসতাম ! তাতেও আপত্তি – ‘ওই শুরু হল আবার প্যাঁ-প্যাঁ, প্যাঁ-প্যাঁ। বিয়ে তো হয়ে গেছে, এখন আর গান গেয়ে কার মন ভোলাবে তুমি?’ আশ্চর্য লাগতো – বিয়ের আগে আমায় যখন দেখতে গিয়েছিল, তখন এরা আমার গান শুনে কত প্রশংসা করেছিল, সেগুলো তবে কি? যাক্‌গে, সব কিছু বাদ দিয়ে ধোকার ডাল্‌না, মোচার ঘন্টা ইত্যাদি রাঁধতে শিখলাম। ছেলে হল – বাপের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা হল ‘দিগন্ত’। ডাক্‌ নাম বাবলু। একটা মেয়ের খুব শখ ছিল, ভাবতাম একটা খুব তেজী মেয়ে বানাব যে সোজা পথে চলবে, সোজা কথা বলবে, নির্দ্বিধায় সোজা চোখের দিকে চাইবে, কোন কিছুতে ভয় পাবে না, আর পূর্ণ প্রাণশক্তি নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। কিন্তু হল না।
আগের জন্মের পুন্য ফল বোধহয় কম ছিল, তাই ভগবান এ জন্মে মেয়ে দিলেন না। তবে মেয়ে চেয়েছি বলে ছেলে চাইনি, এমন তো নয় – ছেলেও তো আমার প্রাণের ধন ! সত্যি বলছি দিদুন, ছেলেকে মানুষ করতে আমি একটুও ফাঁকি দিইনি। আমার যতটুকু ক্ষমতা ছিল, তার সবটুকু দিয়ে বাবলুকে তৈরী করেছি। সেটা করতে গিয়েও জয়ন্তের সাথে কত যে লড়াই করতে হয়েছে ! বাবলুকে সব সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতাম – আর তার জন্য প্রায়ই কথা শোনাত – ‘বাবুয়ানী শেখাচ্ছে। সাজ গোজ দিয়ে হবে কী? মানুষ তৈরী কর।’  আচ্ছা দিদুন, মানুষ কি শুধু পড়াশোনা শিখে ভাল চাকরী করলেই হয়? আর কিছু কি দরকার নেই ! আমার মনে পড়ে, ছোট বেলায় আমি কখনও নোংরা হয়ে ঘুরে বেড়ালে তুমি মাকে পিসীকে ডেকে কত বক্‌তে। বলতে – ‘রুচি, অভ্যেস এগুলো ছোট বেলাতেই তৈরী হয়। ভালো অভ্যেস সব সময়েই ভালো। আর পরিচ্ছন্নতার অভ্যেসটা ভালো অভ্যেস !’
শুধু কি জামা-কাপড়? ছেলে ফুট্‌বল খেলতে ভালোবাসে, খেলেও ভাল – অথচ বাবা কিছুতেই ফুট্‌বল ক্লাবে ভর্তি করবেনা। কত লড়াই, কত লড়াই – শেষ-মেষটা জয়ন্ত রাজী হল। আর ফল স্বরূপ, ভাল ফুট্‌বলার বলে স্কুল-কলেজে বাবলুর নামও হয়েছিল ! এ রকম ছোট বড় কত ব্যাপার নিয়েই যে লড়াই করতে হয়েছে ! তবে বাবলু পড়াশোনাতে বরাবরই ভালো ছিল। এখন সে ভালো চাকরী করে, চেহারাটাও ভাল। কিন্তু . . .।
 ওই কিন্তুটাই সারাক্ষণ মনের মধ্যে খচ্‌ খচ্‌ করে। জ্বালা দিদুন, বড্ড জ্বালা বুকের ভিতর। নিজের সন্তান – কারোকে কিছু বলতেও পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, খানিকটা কাঁদতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু কাঁদব কি করে? আমি তো মায়ের মতো হইনি।  বাবলুর বউ স্বাতী, ভালো মেয়ে – একটু বেশীই ভালো। বরের হম্বি-তম্বি, ধমক-ধামক – কিছুতেই কোন প্রতিবাদ নেই। শ্বশুরের কড়া অনুশাসন, জুলুমবাজী – তাও মেনে নেয় হাসি মুখে ! এতো ভালো মানুষী আমার সহ্য হয় না। মনে হয় খুব জোরে একটা ঝাঁকুনি দিই। ভেবোনা মেয়েটা একেবারে ফ্যাল্‌না। মিস্টি চেহারা, ইতিহাসে এম-এ পাশ করে বি-এড্‌ও কোরেছে। একটা স্কুলে পড়ায় ; কিন্তু ভিতরে আগুন নেই, শুধুই ঠান্ডা জল ! বাবলু যখন তখন মেয়েটাকে ধমকায়, ওর ছোট ছোট ভুল-ত্রুটি নিয়ে এমন করে !   একদিন বাবালুকে বলেছিলাম – ‘এত লক্ষ্মী মেয়েটা – কেন এরকম খারাপ ব্যবহার করিস? যেদিন ফুঁসে উঠবে, সেদিন বুঝবি !’ আমার কথা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে বাবলু বলল – ‘হুঁহ্‌ , ফুঁসে উঠে যাবেটা কোথায়? বাপের বাড়ী বলতে তো ওই ভাই-এর সংসার। সেখনে যাবে? তবেই হয়েছে !’
একদিন সকালবেলা স্বাতী স্কুলে যাওয়ার আগে রোজকার মতোই তাড়াতাড়ি করে ঘরের কাজ-কর্ম সারছিল। এই সময়টায় আমিও যতটা পারি হাতে হাতে ওর কাজ এগিয়ে দিই। কাজের ফাঁকে দেখলাম – মেয়েটার মুখটা শুকনো, চোখ দুটো ফোলা ফোলা। চোখে পড়ল, হাতে আর কানের পাশে কালশিটে দাগ। আমার অভিজ্ঞ চোখ বলে দিল, ওগুলো কোন আদরের চিহ্ন নয়,ওর মধ্যে যন্ত্রনার ইতিহাস আছে। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। স্বাতীকে ডেকে বললাম – ‘কি হয়েছে রে? আমি তোর মা, আমাকে তুই সব খুলে বলতে পারিস্‌ ! বাবলু যদি তোকে কোন কষ্ট দেয়, ভাবিস্‌ না, ছেলে বলে আমি ওর পক্ষ নেব। আমাকে তুই বল্‌।’  আমার সহানুভূতিতে মেয়েটার চোখ দিয়ে টপ্‌ টপ্‌ করে জল গড়িয়ে পড়ল। স্বাতীকে আমি দু-হাতে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে তারপর ওর চিবুকটা তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম – ‘তোর হাতের, গলার ওই নীল্‌চে দাগগুলো কিসের?’ মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠল। আমার মাথায় রক্ত চড়তে থাকে, বুকে আবার সেই আগুন জ্বলতে শুরু করে। আমি বলতে থাকি – ‘বল্‌ স্বাতী, তুই আমাকে বল্‌। বাবলু তোর গায়ে হাত তুলেছে? এত বড় সাহস ওর ! কি ভেবেছে কি ও? যা খুশী তাই করবে, ছেলে বলে পার পেয়ে যাবে? না, এটা হতে পারে না , আমি ওকে শায়েস্তা করে ছাড়ব। ’  স্বাতীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।  দু-হাতে চোখ মুছে ভীত স্বরে আমাকে অনুনয় করতে লাগল – ‘প্লীজ্‌ মা, প্লীজ্‌ ! ওকে কিছু বোল না। ও তাহলে আমাকে বাড়ী থেকে বের করে দেবে !’
আমি ওকে শক্ত করে চেপে বল্‌লাম – ‘বের করে দেবে মানে , বের করে দিলেই হল? ও তোকে বের করার আগে আমিই ওকে বের করে দেব।’ কিন্তু কথাটা বলেই আমার মনে পড়ল – বাড়িটা আমার নামে নয়, জয়ন্তর নামে। আর জয়ন্ত কি আমাকে এ ব্যাপারে আদৌ সাপোর্ট করবে? আমার মনে পড়ল, ছোটবেলার একদিনের কথা। – আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল তোমার আর বাবার উত্তেজিত কথা-বার্তায়। আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তাই ঘুম ভাঙ্গলেও চোখ খুলিনি। তুমি বাবাকে বকছিলে – আর বাবাও সমানে তর্ক করে যাচ্ছিল। বুঝেছিলাম, রাগারাগির কারণটা মা, কারণ অলকা নামটা আমি ওর মধ্যে কয়েকবার শুনেছি। শেষ পর্যন্ত বাবা চুপ্‌ করল। আর তুমি বাবাকে বলেছিলে – ‘আর কোনদিন যদি দেখি অলকার সাথে তুমি এরকম ব্যবহার করছ, তাহলে তোমাকে আমি বাড়ী থেকে বের করে দেব। মনে রেখ, বাড়ী আমার নামে।’ – দিদুন, আমাদের বাড়ীটা জয়ন্তের নামে বলে আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। রাতের একান্তে জয়ন্তকে বললাম – ‘বাবলুকে একটু বোঝাও না। স্বাতীর সাথে মাঝে মাঝে এমন খারাপ ব্যবহার করে – মেয়েটা বড় কষ্ট পাচ্ছে !’  – ‘ছাড় তো – জয়ন্ত বলল – ‘যেমন আছে, ঠিক আছে। তুমি আবার তোমার ওই নারীবাদী কথাগুলো বৌকে শেখাতে যেওনা। তুমি নিশ্চই চাওনা যে তোমার ছেলের সংসারটা ভেঙ্গে যাক্‌ !’
না, আমি তা চাই না। কোনো মা কি তা চাইতে পারে? কিন্তু আর যে সহ্যও করতে পারিনা। ওই যে বলেছিলাম তোমাকে, প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বুকের মধ্যে। ঝড়কে শান্ত করার জন্য এই ছোট্ট ব্যাল্‌কনিতে এসে বসে থাকি। কালকে তুমি এখানে থাক্‌বেনা। মাধবীলতা তার শিকড়-বাকর, ডাল-পাতা-ফুল সবকিছু নিয়ে চলে যাবে। ভাবছি, এত বড় ছড়ানো গাছটা যদি হঠাৎ করে চলে যেতে পারে, তাহলে আমি-ই বা কেন পারব না !কথাটা মনে হতে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। – জান দিদু, আমাদের হীরাপুরের বাড়ীটা এখনও আছে। কাকারা বিক্রী করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবা বিক্রী করতে দেয় নি। কাকাদের বাড়ীর ভাগের টাকাটা দিয়ে পুরো বাড়ীটাই নিয়ে নিয়েছিল। রিটায়ার্‌ করার পর নিতাই কাকাকে নিয়ে শেষ ক-বছর ওখানেই ছিল। ভাইয়া তো সেই কবেই অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর এতদিন নিতাই কাকা একলাই ওই বাড়ীটাতে থাকত। কিন্তু মাস-তিনেক আগে নিতাই কাকা মারা যাওয়ার পর বাড়ীটা খালিই পড়ে আছে।
দিদুন, আমি ঠিক করেছি, আমি এবার ওই হীরাপুরের বাড়ীটায় গিয়ে থাকবো। জানি না সেই মাধবীলতা গাছটা এখনও আছে কি না ! যদি না থাকে, আবার নতুন করে লাগাব ! তারপর, তুমি আর আমি – আবার সেই পুরানো দিনের মতো নির্ভার, নির্ভয় জীবন কাটাব ! হয়তো বিরাট একটা ঝড় উঠবে ; কিন্তু আমি লড়তে প্রস্তুত। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি , জীবনের শেষ কটা বছর আমি আমার মত করে বাঁচতে পারি কি না !
ইতি –
তোমার আদরের পাঞ্চালী

Sahityika Admin

Add comment