না বলা মোহাব্বত
অনিরুদ্ধ রায়, ১৯৮৩ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সোমাকে আজকাল আমার বেশ লাগে, দেখা হলেই মিস্টি হাসে আর সবসময় ইয়ার্কি মারে। ও যখন আমার বোনের সাথে স্কুলে যেত, বাস না এলে আমি অনেকবার ওদের বাইকে করে পৌঁছে দিয়েছি। তখন অবশ্য তেমন পাত্তা দিইনি। এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ব্যক্তিত্বটাই পাল্টে গেছে।
সেদিন অফিস ফেরত দেশপ্রিয় পার্কে নেমে পোস্ট অফিসের দিকে যাচ্ছি, দেখি সোমা একটা সুন্দর দেখতে ছেলের সাথে হেঁটে লেকের দিকে যাচ্ছে। আমায় দেখে হাতও নেড়ে দিল। আমার কেমন যেন দুঃখ দুঃখ ভাব এল, যাঃ সোমাটাও একটা ভালো ছেলে জুটিয়ে ফেলেছে!
আমার ভাগ্যটাই খারাপ। ধুউস্ আজকাল সরকারি চাকরির কোনো দাম নেই। ঝাঁ চকচকে অফিসের চাকরি আর ঝকঝকে চেহারা না হলে মেয়েরা পাত্তাই দেয় না। কেন যে মরতে কাস্টমসের চাকরিতে জয়েন করলাম? বেবিটা বিয়ে করে পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সোমার কথা ভেবেই মনটাকে শক্ত করছিলাম, সেও ফস্কে গেল!
আজ আফিসে দুপুরবেলা চানু ফোন করে বলল- মনুবৌদি মারা গেছে,জানিস?
– সেকিরে কখন মারা গেল?
– এই তো ঘন্টা খানেক আগে।
– কী হয়েছিল?
– তেমন কিছু না,কয়েকদিন ধরে জ্বর ছিল,বয়সও তো এমন কিছু না, কিন্তু হঠাৎই মারা গেল। কেউ তো নেই, তা তুই কি আসবি?
– দেখি,তুই থাকবি তো?
– নারে, আমার আজকে গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে অ্যাপো আছে, তুই চলে আয়,বাবা।
মনু বৌদির বর,দীপুদা পাড়ায় খুব পপুলার ছিল। সেও বছর দুয়েক আগে হঠাৎ মারা গেল। ওদের কোনো ছেলেপুলে নেই, আত্মীয় স্বজনরাও খোঁজ করে না। আমি অফিস কেটে পাড়ায় পৌঁছে দেখি প্রায় সবাই জমায়েত হয়েছে। বৌদি একাই থাকত, সবার সাথেই ভাব ভালোবাসা বজায় রেখে চলত। বাড়ির সামনে ছোট্টো জটলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পাড়ার মুদি, জলধর বলে- বৌদির কাছ থেকে আমি দেড় হাজার টাকা পেতাম, বাকিতে মাল কিনেছে শোধ না দিয়েই মরলো, আমার মতো ক্ষতি কারো হয়নি।
মদনদা শুনে বলে – রাখ তো তোর ঐ কটা টাকার শোক। আমাকে সেই বোশেখ মাস থেকে বলছে শরীরটা এট্টু ভালো হোলেই আমার সাথে তারাপীঠ যাবে। সে আর হলো না, আমার তো মন ভেঙ্গে গেছে। ভুলু খুড়ো চুপ করে রকে বসেছিল। সে বলে – মনুটা হবিষ্যান্ন খেয়ে বৈধব্যের জীবন কাটাতো, কত বলেছি ও সব ছেড়ে মাছ-মাংস খেয়ে শরীরটাকে ঠিক কর। আমার কথা না শুনে অকালেই চলে গেল।
আস্তে আস্তে ভীড় পাতলা হতে থাকল, শ্মশানে যাওয়ার লোক আর তেমন কেউ নেই। সোমাটাকে দেখি ঘরের মধ্যে মনুবৌদির বডি ধরে বসে আছে। সবাই চলে যেতে সে উঠে এসে আমাকে বলল – পানুদা ভেতরে এসো, কথা আছে।
ঘরের ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – কী কথা বল?
সোমা ফিসফিস করে বলল – বৌদির আলমারিতে আট হাজার টাকা পেলাম, এটা দিয়ে দাহ কার্য হবে না?
– সে তো হবেই, আর কালীঘাটে শ্রাদ্ধও হয়ে যাবে।
– বৌদি আমাকে বিয়েতে পাঁচ হাজার টাকা দেবে বলেছিল। সেটা রেখে দিই?
আমি বুঝলাম আমার কোনো প্রাপ্তি নেই, বরঞ্চ পকেট থেকে টাকা খসবে। সোমা বিয়ে অন্য কাউকে করবে আর আমার সাথে খালি ফাজলামি মারবে। আমার কেমন কাঁদতে ইচ্ছা করলো। বললাম – হ্যাঁ রেখে দে, কিছু কম পড়বে, সে না হয় আমি দিয়ে দেব। আর শোন, বৌদি আমাকে বলেছিল ওর মৃতদেহের সামনে যেন কীর্ত্তন গেয়ে প্রেমের ধারা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কীর্ত্তনটা আমার ঠিক আসে না তবে কান্নাটা আপনেই চলে আসে। আমি কি তোকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদব?
সোমা ইশারায় কী যেন একটা বলল, আমি ভাবলাম দরজাটা বন্ধ করতে বলছে। আমি দরজা বন্ধ করে যেই না সোমার দিকে ফিরেছি দেখি খাটের তলা থেকে ক্ষেন্তি পিসি কয়েকটা বাসন নিয়ে বেরোচ্ছে।
আমি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বললাম – আরে তুমি এর মধ্যে বাসন হাতরাতে লাগলে?
– তুই ছ্যামড়া যে দরজা বন্ধ করে সোমত্ত মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলি, তোর ডেড বডির সামনে এসব করার সাধ হয় কী করে? কোন বাড়ির ছেলে হয়ে তুই এসব করিস, তোর বাপ, জ্যাঠা শুনলে তো লজ্জায় মারা যাবে!
সোমা বলে উঠল- পিসি তুমি ভুল বুঝছ,পানুদা ভালো ছেলে ,ওর কান্না পাচ্ছিল তো, পুরুষ মানুষ কি সবার সামনে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে পারে ? তাই দরজাটা বন্ধ করেছিল।
– তুই আর ওর হয়ে সাক্ষী দিস না।
সোমা বলল- ঠিক আছে, তুমি না হয় সবার কাছে আমাদের প্রেমের সাক্ষী দিও।
– অ্যা! তোদের এতদূর গড়িয়েছে নাকি! আর যে ছ্যামড়া তোকে বাড়ি ছাড়তে আসে, তার কি হবে?
– আঃ পিসি তুমি খালি আবোলতাবোল ভাবো, ও তো আমার মামাতো ভাই লাল্টু , আমার সাথেই তো পড়ে।
পিসি দরজা খুলে উঁকি মেরে চারদিক দেখে নিয়ে আচলের খুঁট দিয়ে চোখ পুঁছে বাসন সমেত বেরিয়ে যেতে যেতে বলল- মনুটা কাউকে না জ্বালিয়ে সেই দুপুর থেকে মরে পড়ে আছে, ভারী ভালো মেয়ে ছিল। ওর তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করিস।
সোমা বলে দিল- পানুদা এসে গেছে, আর কোনো চিন্তা নেই, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
পিসি চলে যেতেই আমি বললাম- যাই খাটিয়া, ফাটিয়া কিনে আনি। তুই আজ আমাকে বাঁচিয়ে দিলি।
– আর আমাদের বিয়ের পাঁচ হাজার টাকাও বাঁচিয়েছি।
– অ্যা!!! তাই নাকি!! আর কেউ খাটের তলায় নেই তো? আমার তো আরও একবার দরজাটা বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে।
সোমা সায় দিয়ে বলল – বেশি কেঁদো না কিন্তু।
অনেক অনেক ভালোবাসা।