সাহিত্যিকা

দুটি ছোট গল্প

দুটি ছোট গল্প
ইন্দ্রনীল ঘোষ, ১৯৮৬ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

১ ভুতোবাবুর দৈনন্দিন

ভুতোবাবুকে নিয়ে আগে এত লিখেছি যে, আপনাদের কাছে তিনি আমার চেয়েও বেশি পরিচিত। তবু প্রতিবারই নতুন পাঠকদের কথা ভেবে, একটু পরিচয় করিয়ে না দিলে, সেটা ভারি অন্যায় হয়।

ভুতোবাবুর আসল নাম ‘বিভূতিভূষণ সরখেল’। ‘ভুতো’ প্রথমদিকে তার ডাকনাম থাকলেও, কী করে জানি না, ওটাই তার পরিচিতি হয়ে গেছে।

উনার বৃশ্চিক রাশি, দেব গণ। নিজের জ্বালায় নিজেই জ্বলেন। কাউকে নিজের কষ্টের কথা বলতে পারেন না। তিনি খুব সহজে নিজের দাবি ছেড়ে দিয়ে, শান্তি বজায় রাখার পক্ষপাতী। সারা জীবন শুধু কম্প্রোমাইজ করে গেলেন। উনার মতন নিরীহ, গোবেচারা, নিপাট ভদ্রলোক দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হ’ল, তিনি কাউকে ‘না’ বলতে পারেন না। অফিসের বস থেকে শুরু করে অধস্তন কর্মচারী, বাড়িতে গিন্নী থেকে ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন, বাজারঘাটে দোকানী, মাছওলা, সবজিওলা, এমনকি বাসে ট্রেনে অপরিচিত সহযাত্রী পর্যন্ত, সবাই কী করে যেন ভুতোবাবুর এই ভালোমানুষির কথা বুঝে যায়।

এই তো গতকাল। বস ডেকে একগাদা কাজের ফিরিস্তি দিলেন। বসের কাছে ভুতোবাবু হলেন শর্ট-কাট রুট। অন্য কাউকে দায়িত্ব দিলে, তারা হাজারটা অসুবিধার কথা বলবে। কিন্তু ভুতোবাবুর সে সব বালাই নেই। ব্যস, ভুতোবাবুর কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে, নিশ্চিন্ত মনে সারাদিন শেয়ার বাজারের ওঠানামায় মনোনিবেশ করা যাবে।

ভুতোবাবু মনে মনে অবশ্য ভাবলেন যে, এত কম ম্যান-পাওয়ার নিয়ে কীভাবে তিনি এত কাজ শেষ করবেন! কিন্তু মুখে ‘ইয়েস স্যার’ ছাড়া অন্য কিছুই বলতে পারলেন না। বসের চেম্বার থেকে নিজের চেয়ারে ফিরেই, তাড়াতাড়ি তার দুই জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট জগাই-মাধাইকে ডেকে কাজ বোঝাতে বসলেন।
জগাই সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিল, তার নিরানববুই বছর এগারো মাস উনত্রিশ দিন বয়সী ঠাকুমার গতকাল রাত থেকে ‘এখন যাই – তখন যাই’ অবস্থা। সেঞ্চুরি হবে কি হবে না, সেই নেল-বাইটিং ফিনিশের টেনশনে তাদের বাড়ির সকলের বিনিদ্র রজনী কাটছে। এর বেশি বলতে হল না। ভুতোবাবু নিজেই বললেন, “আহা হা, আগে বলবে তো! সত্যি, এই অবস্থায় কি কাজে মন বসে?”

এবার মাধাইয়ের দিকে ফিরতেই, সে লাজুক মুখে সটান বলে দিল, তার স্ত্রীর সদ্য সুখবর হয়েছে। তার জন্য স্পেশাল টক আমলকি কিনতে, সে আজ গড়িয়াহাট মার্কেটে যাবে, হাফ-ডে ছুটি নিয়ে। এখানে বলে রাখা ভাল, ভুতোবাবু যে ডিপার্টমেন্টের প্রধান, সেখানে কারও ছুটি না-মঞ্জুর হয় না।

ভুতোবাবু চোখে অন্ধকার দেখলেন। দুহাতে কপালের রগ চেপে ধরে, টানা এক মিনিট সাড়ে পঞ্চান্ন সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। ততক্ষণে জগাই-মাধাই নিজেদের সিটে ফিরে গিয়ে, মোবাইলে, একজন ফেসবুক এবং আরেকজন গেম খেলা শুরু করে দিয়েছে। আর ভুতোবাবু, সব কাজ নিজেকেই করতে হবে, বুঝতে পেরে, মাথা নিচু করে কাজ শুরু করলেন। মনে মনে বুঝে গেলেন, ছটা না বাজতেই অফিস ফাঁকা হয়ে যাবে, কিন্তু ভুতোবাবু রোজকার মত আজও, শত চেষ্টা করলেও, রাত নটার আগে বেরোতে পারবেন না।

ফেরার পথে বাসে, কেউ না কেউ অবধারিত তার পা মাড়িয়ে দেবে। কেউ কনুইয়ের গুঁতোয় বুকের পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে দেবে। ভুতোবাবু প্রচন্ড রেগে গিয়ে তাদের মা-মাসি তুলে গালি দেবেন। কেলিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবেন। অবশ্য সবই মনে মনে।

তারপর বাস থেকে নেমে, তড়িঘড়ি মাছবাজারে ঢুকে যাবেন। এত রাতে বাজার তখন বন্ধের মুখে। তবু ভুতোবাবু জানেন, শিবু একটু দেরিতেই বন্ধ করে। মেঘনাদ যেমন মেঘের আড়াল থেকে শক্তিশেল ছুঁড়েছিল, তেমনি করেই, ভুতোবাবুকে ঢুকতে দেখে, সিমেন্টের বাঁধানো চাতালের উপরে বিশাল বঁটির আড়াল থেকে শিবুর ডাক আসবে, “এই যে, ভুতোবাবু, এদিকে আসুন। আজ আপনার জন্য একখানা দুর্দান্ত রূপোলি মাল রেখেছি। এক্কেবারে আসলি বাংলাদেশ।” তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে হঠাৎ গলা নামিয়ে ফিসফিস ক’রে বলবে, “মাইরি বলছি, আঠারো শ’র কমে কাউকে দিই নি। শুধু আপনার জন্য স্পেশাল দাম। কেনা দাম পনেরো শ’য় ছেড়ে দেব।” ভুতোবাবু ভালই জানেন, নিশ্চয়ই এই মাছটা সন্ধে থেকে বিক্রি হয় নি। রেগে মেগে বলবেন, “বেটাচ্ছেলে, ঠকাবার আর জায়গা পাস নি? পরশু দিনও এই রকম বাতেলা ঝেড়ে, পাঁচশ গ্রাম পার্শে মাছ গছিয়েছিলি। কড়াইতে ছাড়তেই সেকী উৎকট গন্ধ। আবার বাংলাদেশ দেখাচ্ছিস?”

বলবেন ঠিকই, কিন্তু সবই মনে মনে। শেষ পর্যন্ত, গাদা পেটি মিলিয়ে, আট পিস রুই মাছ নিয়ে, নিঃশব্দে বাড়িমুখো হাঁটবেন। গিন্নী এবং ছেলে-মেয়ের পাতে মাছ না পড়লে, খাবে কী বেচারা’রা? তার না হয় সারা জীবন অফিস ক্যান্টিনের রুটি ঘুগনিতে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তারপর বাড়ি ফিরে, বাথরুমে ডাঁই করে রাখা, গিন্নীর নাইটি সহ বাকি সব জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে কেচে, খাবার গরম করে খেয়ে, মশারি টাঙ্গিয়ে, যখন শুতে যাবেন, ততক্ষণে ক্যালেন্ডারে ডেট পাল্টে গেছে।

ভুতোবাবুর ভীষণ সাংঘাতিক রকমের রাগ হবে। এটা কোনও জীবন! তিনি চিৎকার করে বলতে থাকবেন, “সব কটাকে দেখে নেব। ওই বস, জগাই-মাধাই, বাসের ওই পা মাড়িয়ে দাঁত কেলানো কালাপাহাড়, মাছওলা শিবু, সবকটার বাপের নাম খগেন ক’রে ছাড়ব।” এই সবকথাই তিনি গলা ফাটিয়ে বলবেন। অবশ্য সবই মনে মনে।

গিন্নীর নাসিকা-গর্জন তখন তুঙ্গে; দুটো স্বপ্ন দেখা কমপ্লিট করে, তিন নম্বরের ফার্স্ট সিন চলছে।

ভুতোবাবু পাশ ফিরে ঘুমোনোর আগে, মনে মনে আগামী কালের রুটিনটা ছকে নেবেন। ভোরে উঠে তৈরি হয়ে, গিন্নী এবং ছেলে-মেয়ের জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করে বেরোতে হবে। তাদের কারও আবার সকাল সকাল ওঠার অভ্যেস নেই কিনা।
১২/০৯/২০২২

২ মানব জনম

জগবন্ধু অধিকারীকে আমরা ‘জগাদা’ বলে ডাকলেও তিনি মোটেই এলেবেলে লোক নন। তিনি আমাদের অফিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। কাজের সময় বেশ রাশভারি। কিন্তু একান্তে আড্ডার সময় একেবারে দিল-দরিয়া। অফিসের কাজের প্রয়োজনে আমাদের প্রায়ই একসাথে ট্যুর করতে হত। সেবারে গিয়েছি কেরালার কোচি শহরে। ট্যুরের প্রথম দুদিন কাটল ঝড়ের গতিতে। তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় ভাগের পর থেকে একটু হাঁফ ছাড়ার সুযোগ হল। যে কাজে এসেছিলাম, সেই মিশন সাকসেসফুল।তাই আমাদের দুজনেরই মুডটাও বেশ ভালো। আমার সাথে পরামর্শ না করেই জগাদা ড্রাইভারকে হুকুম দিল, “হোটেলে ফেরার আগে, একটা ভালো বারে নিয়ে চল দেখি”। জগাদা জানত যে, আমার কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। বেয়ারা এসে দাঁড়াতেই, দুখানা চিল্ড বীয়ারের অর্ডার দিয়ে, বেশ জাঁকিয়ে বসে, জগাদা আমার দিকে মনোযোগ দিলো। আর তারপরেই কথা নেই, বার্তা নেই, দুম করে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “বল দেখি, মানুষ জন্ম আশীর্বাদ, নাকি অভিশাপ?”

এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, এটা নতুন কিছু নয়। মুড ভাল থাকলে, জগাদার মাঝে মাঝে এরকম আধ্যাত্মিকতা পায়।
আমি একশ শতাংশ ভোগী পুরুষ। তাই মাথা চুলকে বলি, “অবশ্যই আশীর্বাদ। শোনো নি, কথায় আছে, এই সাধের মানব জনম।“
জগাদা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে দেখে, একটু আমতা আমতা করে বলি, “শুধু আমি কেন, আমার বিশ্বাস, বেশিরভাগ মানুষই এই কথা বলবে”।

জগাদা মুখ খুলল, “তোর মত নরাধম, এছাড়া আর কী বলবে? এই জন্মে পরের জন্য তো কিছুই করিস নি। শুধু ‘আমার, আমার’ করেই কাটিয়ে দিলি। তাই তোর জন্য, মানব জন্ম বিরাট আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।“

একটু প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, জগাদার দৃষ্টি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এল। বলল, “আমি অস্বীকার করছি না। তবে আমার কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন আছে। প্রথমে, সেই শিশুটির কথা, যে ভূমিষ্ঠ হবার কিছু সময় পরে মারা গেল। সে কেনই বা এল, আর কেনই বা চলে গেল? তারপর ভাব, একজন সৎ, পরোপকারী ভাল মানুষ অকালে চলে গেল। তাদের জন্য তোর কোন্ লজিকটা প্রযুক্ত হল? আসলে তাদের সাজার মেয়াদ কম ছিল। অর্থাৎ কিনা, তাদের জন্য মানব জন্ম অভিশাপ ছিল। যদি আশীর্বাদ হত, তবে তাদের দীর্ঘায়ু হওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। তাই নয় কি?”
– খুব সাধারণ জিজ্ঞাসা। যে মানুষটা আজ ইহকালের মায়া কাটিয়ে চলে গেল, সে কি আসলে সাজা ভোগ করার পর, জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল? জেলের কয়েদিরা যেমন জেল থেকে ছাড়া পায়। নাকি আশীর্বাদ-ধন্য এমন সাধের মানব জনম উপভোগ করার পর, কোনও অভিশপ্ত অধ্যায় শুরু করতে গেল, কোনও ভিন্ন লোকে।
বলতে যাচ্ছিলাম, “সবই বিধির বিধান”। কিন্তু জগাদার ভাবনায় ফ্লো এসে গেছে, বুঝে চুপ করে গেলাম। জগাদা বলতে লাগল, “জানি, এর সাথে পূর্বজন্ম, পরজন্ম, আত্মার অস্তিত্ব, ইত্যাদি নানান বিষয়ের বিশ্বাস, অবিশ্বাসের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।“
– যেমন?
– শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় বর্ণিত আত্মার অবিনশ্বরতার সাহায্যে ব্যাখ্যা করলে, একটা উত্তর অবশ্য পাওয়া যায়। ইহজীবনের পাপপুণ্যের না মেলা ব্যালান্স শীট, পরলোকে বয়ে নিয়ে যাওয়া। তাহলে অন্তত এই ভেবে সান্ত্বনা পাওয়া যায় যে, ভাল লোকটা পরজন্মে সুখ শান্তিতে পরিপূর্ণ দীর্ঘ জীবন পাবে। এবং তোর মত দুষ্টু লোকদের জন্য আছে গরম তেলের কড়াই। কিন্তু, যারা এই যুক্তি মানতে নারাজ, তারা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, এই জীবন আশীর্বাদ, না অভিশাপ? জানতে ইচ্ছে করে।

মনে মনে বললাম, “এতোই যদি জানব, তবে কি আর এই মায়ার বন্ধনে পড়ে থাকি? কবে কৌপীন পরে, লোটা কম্বল সম্বল করে, পাড়ি দিতাম হিমালয়ের গুহায়”। গলা ছেড়ে এককলি গাইতেও ইচ্ছে হল, “ফুরাইয়া গেল মোর সাধেরই জনম, আপন কর্ম দোষে রে, …আর না হবে মোর মানব জনম, পাষাণে ভাঙ্গিলে মাথা রে…”।

জাস্ট চেপে গেলাম। কারণ, জগাদাকে চটায়, কার ঘাড়ে কটা মাথা?

Sahityika Admin

Add comment