তিন মেঘ, এক আকাশ
(আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে)
ইন্দ্রনীল ঘোষ, ১৯৮৬ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
তিয়াসার আজকাল কিচ্ছু ভাল লাগে না। কোনও কিছুতে মন বসে না। মাল্টি-টাস্কিং ক’রতে ক’রতে মনটাও কেমন উড়ু উড়ু হয়ে যায়। হোম ওয়ার্কের সময় মনে পড়ে, স্প্যানিশ গিটারটায় ধুলো জমছে। পামেলাদি যখন কত্থক নাচের স্টেপগুলো দেখায়, তখন তার মন চলে যায়, স্কুলে সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে দেখা একফালি নীল আকাশে ভেসে যাওয়া সাবানের ফেনার মত সাদা মেঘের দিকে। তখন তার আঁকতে ইচ্ছে করে।
আর রয়েছে তার বইয়ের জগত। সারা পৃথিবী জুড়ে কত কত সাহিত্য। তার সব পড়তে ইচ্ছে করে। সায়েন্স ফিকশন, হিস্টোরিক্যাল গ্যালান্ট্রি থেকে অ্যাডভেঞ্চার, এক্সপিডিশন, থ্রিলার, রোমান্স সব কিছু। জন গ্রীনের ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্স’-এ ১৬ বছরের তরুণী হ্যাজেল বা জিওন শেইবানীর ‘দ্য সিলভার চেইন’-এ অ্যাজাদের জীবন যেমন তাকে ভাবায়, তেমনই চার্লস ডিকেন্সের অলিভার ট্যুইস্ট বা ডেভিড কপারফিল্ড তাকে টানে। সত্যজিতের ফেলুদার মগজাস্ত্রের ধারে যেমন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, তেমনি আবার মাইকেল ডি বেইলের “দ্য রেড ব্লেজার গার্লস” সোফি, রেবেকা আর মার্গারেটকে তার দারুণ লাগে।
তেরো বছরের জীবনে কত কীই না সে দেখল। তবু সবাই তাকে ছোটই ভাবে। বিশেষ করে মাম্মা। মা’টা যেন কী! সারা দিনরাত গায়নোকলজি নিয়ে পড়ে আছে। হসপিটাল, চেম্বার, আর সুযোগ পেলেই পড়া নিয়ে হম্বিতম্বি। বিরক্তিকর। কিন্তু মাকে ভীষণ ভালও সে বাসে। মা ছাড়া কিছু যে ভাবাই যায় না। মাকে মনে হয় যেন কোনও বীরাঙ্গনা, কোনও দশ হাতের দুর্গা। একাই কেমন সব দিক সামলাচ্ছে।
বড় হয়ে সে মায়ের মত পুরোপুরি স্বাবলম্বী হবে। তবে আর যাই হোক ডাক্তার সে হবে না। মা যতই জোর করুক। বরং সে হবে একজন অ্যাস্ট্রোনট। কাজ করবে ‘ইসরো’ বা ‘নাসা’র হয়ে। কিন্তু তার জন্য তো ফিজিক্স আর ম্যাথসে খুব ভাল হতে হবে। তাই যত কষ্টই হোক, এই দুটো সাবজেক্ট সে খুব ভাল ভাবে বোঝার চেষ্টা করে।
শীত শেষের সন্ধ্যায় ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা। ডক্টর শাল্মলী মিত্রের চেম্বারে শেষ পেশেন্ট বিদায় নিল। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে তিনি চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন। গাড়ির সামনে যথারীতি জন দাঁড়িয়ে। শাল্মলীর ড্রাইভার জন বিশ্বাস। বাঙালি খ্রীস্টান। বয়স তিরিশের কম। খুব বাধ্য ছেলে। শাল্মলীকে আসতে দেখেই গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল।
– “জন, আজ একটু বাঁশদ্রোনী ঘুরে যাব।”
– “আচ্ছা। দিদা কেমন আছেন আজ?”
– “বলছেন তো ভালই। তাও একবার দেখে যাই।”
বাঁশদ্রোনীর পৈতৃক বাড়িতে মা-বাবা একলা থাকেন। দাদার সংসার বিদেশে। কোনওদিন এই পোড়া দেশে ফেরার আশা নেই। তবু ভিটেবাড়ি আগলে পড়ে আছেন। অনেকবার বলা সত্ত্বেও শাল্মলীর যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটে এসে থাকবেন না তাঁরা। বাবারও তো বয়স হয়েছে। মায়ের ক্রনিক ডিসপেপসিয়া। আজ তিনদিন হল একটু জ্বর। হয় তো ভাইরাল ফিভার, তবু টেস্ট করিয়ে নেওয়াই সেফ।
গাড়িতে বসে তিয়াসাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন, দিদাকে দেখে ফিরতে রাত হবে। যেন খেয়ে নেয়। জানে, তাও খাবে না। মায়ের জন্য অপেক্ষা করবে।
ঋষভ হঠাত করে চলে যাবার পর, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। বিরাট ছন্দপতন। অসীম শূন্যতা। শ্বশুরবাড়ি বলে কোনওদিন কিছু ছিল না তার। যে পিসির কাছে ঋষভ মানুষ হয়েছিল, তিনিও আর নেই। ছোট্ট তিয়াসাকে নিয়ে এই একলা জীবনে অভ্যস্ত হতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। তবে পেশাটা এমনই যে, ঘুরে দাঁড়াতে অসুবিধা হয় নি।
অবকাশ নেই বললেই চলে। তবু ক্লান্ত দিনের শেষে, ঘুমের দেশে যাবার আগে, ঘোমটা পরা ছায়ার মত জড়িয়ে ধরে সুরের মূর্ছনা। ঘরময় আবছায়ায় খেলে বেড়ায় খেয়াল, ঠুংরি, গজল। বেগম আখতার, গিরিজা দেবী, বড়ে গুলাম আলি। মায়াময় সেই স্বপ্নখেলার মাঝে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে আসে, টেরই পায় না সে।
বাইরে গাড়ি থামার চেনা আওয়াজটা কানে যেতেই অনসূয়া বুঝলেন, মেয়ে এসেছে। কতবার ক’রে বললেন যে, তার তেমন কিছুই হয় নি। তবু কে কার কথা শোনে! বাড়িতে ওইটুকু মেয়েটা সারাদিন একলা থাকে। কাজের শেষে কোথায় তার কাছে একটু তাড়াতাড়ি যাবে, তা নয়, এই রাতে নিজের মা-বাবাকে দেখতে আসা। আর আসা মানেই তো, ঝুড়ি ঝুড়ি ডাক্তারি উপদেশ। এটা চলবে না, ওটা চলবে না। এটা মানা, ওটা মানা। রাজ্যের ফিরিস্তি।
তিনি নিজেও তো সারা জীবন দাপুটে স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মজীবনে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর অকুন্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন। স্কুলে পড়ানো, তাদের নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এদিকে সংসার, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে জমজমাট কর্মব্যস্ত জীবন। এখনও অনেক পুরানো ছাত্র-ছাত্রী খোঁজ খবর নেয়।
রিটায়ারমেন্টের পর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ছেলেটা বিদেশে সেটল্ করে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয়, অত বেশি ব্রিলিয়ান্ট না হলেই বোধহয় ভাল হত। জানেন, ভাবনাটা একটু স্বার্থপরের মত। তাই তাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, ভাবেন, ভালই হয়েছে। তাঁরা তো এই রকমই চেয়েছিলেন। নিজেরা স্বার্থত্যাগ করে, শখ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে, অল্পে সন্তুষ্ট জীবন কাটিয়ে, চেয়েছিলেন ছেলে-মেয়ের মধ্যে দিয়ে নিজেদের স্বপ্ন সার্থক করতে। তাই হয়েছে।
মেয়ে ডাক্তার হল। ভাল জামাইও পেলেন। সেও ডাক্তার। কিন্তু কপালে সইল না। মেয়েটাকে একা একা এই জীবনযুদ্ধ আরও অনেকদিন চালিয়ে যেতে হবে। পরমেশ্বর যেন তাকে অসীম শক্তি আর মনোবল দেন। সেও যে আরেক নারী।
আগামীকাল নাকি আন্তর্জাতিক নারী দিবস। তাদের সময় এসব কেউ জানতো না। মেয়েরা সংসারের হাঁড়ি ঠেলে যাবে, এটাই ছিল নিয়ম। সেই নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে কলেজ ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরোতে পেরেছিলেন তিনি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে, সীতার লক্ষ্মণরেখা বেষ্টিত নারীর জীবন কেমন হয়, তা ঢের দেখেছেন তিনি। ভাবতে ভাল লাগে যে, শেষ পর্যন্ত চেতনা হয়েছে। মেয়েদেরও যে নিজস্ব জীবন থাকে, তাদের স্বার্থত্যাগেরও যে স্বীকৃতি প্রয়োজন, সেটা কেউ তো উপলব্ধি করেছে।
শাল্মলী তার বাবার সাথে বকবক করে যাচ্ছে। মায়ের ওষুধ পথ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে। তখনই ক্রিং ক্রিং করে ফোন বাজল। জাদুঘরে বা দোকানে সাজানো কিউরিও আইটেমের মত ল্যান্ডফোনটা এখনও রয়েছে। এবং অদ্ভুতভাবে সেটা এখনও জীবিত। শাল্মলীই জোর করে রাখিয়েছে। বলে, একটা স্ট্যান্ড-বাই থাকা ভাল। কখন কোনটা বিকল হয়। অনসূয়া মনে মনে হাসেন, শুধু মানুষেরই স্ট্যান্ড-বাই হয় না। যে চলে যায়, সে চলেই যায়।
– “দিদা, এখন কেমন আছো? মা এসেছে?”
– “ভাল আছি, দিদুন। মা এসেছে। তুমি একা একা কী করছো?”
– “এই তো, হোম ওয়ার্ক শেষ করে, এখন একটা বই পড়ছি। ফ্রেডরিক ব্যাকম্যানের লেখা ‘মাই গ্র্যান্ডমাদার আস্কড মী টু টেল ইউ সী ইজ স্যরি’।”
– “বাপ্ রে, এত বড় নাম?”
– “জানো, এই গল্পেও ছোট্ট মেয়ে এলসার তোমার মত একজন দিদা আছে।”
– “ওমা, তাই বুঝি?”
ফোন রেখে, বেশ এক রকম ভাল লাগায় ভরে গেল মনটা। এই নাতনি আর তাদের মাঝে, শাল্মলী হল সেতু। তিন প্রজন্ম। যেন এক আকাশের নিচে তারা তিনটি মেঘ। ভেসে চলেছে নিজের নিজের গতিপথে।
তারপর তিয়াসাও একদিন বড় হবে। শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে উঠবে। তারপর সেও মা হবে। যেমন ছিলেন তাঁর নিজের ঠাম্মা, দিদা, মা, শাশুড়ি এবং তারপর তিনি নিজে।
জীবন চক্র ঘুরে চলে, আপন ছন্দে। দেশ, কাল, সময়ের গন্ডি পেরিয়ে, এক শাশ্বত নিয়মানুবর্তিতায়। এক নারী থেকে, আরেক নারী। এমন করে কোটি কোটি নারী তাদের দান রেখে যাবে এই ধরিত্রীর বুকে। নারী যে সৃষ্টির উৎস। সেকথা ভুললে চলবে না। তবেই না আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সার্থকতা।
©️ ইন্দ্রনীল ঘোষ।
২৯/০১/২০২৩
Add comment