সাহিত্যিকা

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১, ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।
————————————————————-

১. গানের ব্যাখ্যা
রবীন্দ্রনাথের অতি কাছের মানুষ ছিলেন কালিদাস নাগ [১৮৯২- ১৯৬৬] । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর একান্তে এই আলাপচারী তুলে ধরতে খুব ইচ্ছে হল। সময়কাল: ১৩ই ফেব্রুয়ারী ১৯১৮।

কালিদাস কবির কাছ থেকে তাঁর দুটি গানের ব্যাখ্যা তাঁর মুখে শুনতে চাইলেন – (১) যদি প্রেম দিলে না প্রাণে; (২) আমার সকল কাঁটা ধন্য করে – কবি উৎসাহের সঙ্গে অল্পে অল্পে তাঁর অবর্ণনীয় ভাষায় এক অভিনব অনুভূতি ও রসের রাজ্য খুলে দিলেন। আমি অতি তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলুম। দ্বিতীয় গানটির ব্যাখ্যা করতে করতে তাঁর জীবনের একটি গভীরতম অনুভূতি প্রকাশ করলেন – ” আমি [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] জীবনে কতবার চেয়েছি এক হয়েছে আর। ছেলেবেলা থেকে কবি হবার সাধ। প্রথমেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর ভক্ত হয়ে পড়লুম – তাঁর রচনা পড়ি আর ভাবি কবে আমি তাঁর মত লিখতে পারব। কিন্তু পারতুম না তাঁর মতন লিখতে – সেই ব্যর্থতার বেদনা হঠাৎ আমার হৃদয়ের উৎস উন্মুখ করে দিলে। এক সন্ধ্যায় ছাদে বসে হঠাৎ “সন্ধ্যাসংগীত” গেয়ে উঠলুম। সে কি এক নিবিড় অনির্বচনীয় আনন্দময় অনুভূতি ! এমনি করে নিজেকে আবিষ্কার করেছি। কল্পনায় ভবিষৎ জীবনটা আদর্শ কবির মতন করে কাটাবার সংকল্প করেছি। এমন সময় পিতাঠাকুরের আদেশ – বিষয়কর্ম দেখ। সর্বনাশ ! কবির পক্ষে বিষয়কর্ম কি বিষময়, ভেবে শিউরে উঠলুম। যা হোক, মাথা পেতে নিলুম সে ভার – তার ফল পেয়েছি। আমাদের জমিদারিতে ঘুরে দীন দুঃখী প্রজাদের সামান্য সুখ দুঃখের সংস্পর্শে এসে আমি নিজে যে কত উপকৃত হয়েছি তা বলতে পারি না – আমার জাতীয় সাহিত্যকে যদি স্থায়ী কিছু দিয়ে থাকি তো এই দেশের সাধারণের কাছ থেকেই তার উপকরণ সংগ্রহ করেছি। জীবনে এই শিক্ষার সার্থকতা যে কি তা আমিই জানি।

তারপর শেষ বয়সে জগতকে একবার শেষবার দেখে বিদায় নেব মনে করে বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ২/৩ বার কত বাধা এসে সে পথ যেন বন্ধ করে দাঁড়াল – ভাবলুম আর হল না, আবার আমার দেশের ফুল, পাতা, মাটিতেই মজে গেলুম। হঠাৎ আমার আত্মীয়দের অনুরোধ – আমায় বিলেত যেতেই হবে। আমি তখন নারাজ কিন্তু জোর করে প্রায় সুরেন (ঠাকুর) আমায়তো পাঠাল, তা থেকে কি হল – এইটুকু বলে কবি একটু থামলেন। পরে আরম্ভ করলেন – তাই বলছিলাম, আমার জীবনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে মানুষের জীবনের প্রত্যেক অভিজ্ঞতার সার্থকতা আছে। সকল কাঁটার ভিতর থেকেই আমাদের প্রত্যেকের জীবন-দেবতা আমাদের হৃদয়-শতদল বিকশিত করে তুলছেন।”
তাঁর লেখা গানটি এখানে তুলে ধরতে লোভ হচ্ছে :
“আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে।
আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে ॥
আমার অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,
হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে ॥
আমার লজ্জা যাবে যখন পাব দেবার মতো ধন,
যখন রূপ ধরিয়ে বিকশিবে প্রাণের আরাধন।
আমার বন্ধু যখন রাত্রিশেষে পরশ তারে করবে এসে,
ফুরিয়ে গিয়ে দলগুলি সব চরণে তার লুটবে ॥“

২. জমিদার

রবীন্দ্রনাথ বলতেন তাঁর পেশা জমিদারী আর নেশা আশমানদারি। প্রমথনাথ বিশী বলেছেন যে এই উক্তি সর্বৈব সত্য। বাস্তব ও কল্পনার দুই নৌকায় পা রেখে রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন চলেছেন। একটি কবিতার খাতায় দেখা যায় এক পৃষ্ঠায় দুই পাখী কবিতাটি, অন্য পৃষ্ঠায় বিরাহিমপুর পরগনার (শিলাইদহে – এখন বাংলাদেশে অবস্থিত ) সদর খাজনার হিসাব। বাস্তব ও কল্পনার এই সমাবেশ পাতায় পাতায়।

রবীন্দ্রনাথ চিরকাল গ্রামোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়েই গেছেন – প্রজাদের ঝগড়া বিবাদ মেটানোর ব্যবস্থা (মন্ডলীপ্রথা), চাষের উন্নতি করা, ঘরে ঘরে ছোট খাটো শিল্প প্রতিষ্ঠা করা, অবৈতনিক পাঠশালা, চিকিৎসালয় স্থাপন, কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন ইত্যাদি অনেক কর্মকান্ডের উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ, বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র ও জামাতা নগেন্দ্রনাথকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় নগেন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন : “তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্নগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ – ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলেই ক্ষতিপূরণ হলে মনে সান্ত্বনা পাব। মনে রেখো জমিদারের টাকা চাষির টাকা এবং চাষিরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যায়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে। এদের এই ঋণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল – নিজেদের সাংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটেই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।” তিনি মনে করতেন গ্রামের লোক নিজেরাই নিজেদের উপকার করবে। প্রজাদেরকে স্বাবলম্বী করাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। তাঁর এই সব অভিজ্ঞতা সর্বদাই যে খুব সুখকর ছিল তা কিন্তু বলা যায় না।

জীবনের বিশাল জমিদারী-অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর লেখায় (ঘরে বাইরে, গোরা, মুক্তধারা, কালের যাত্রা ইত্যাদি আরও অনেক রচনা)। সাজাদপুরের পোস্টমাস্টারটি কি তাঁর ‘পোস্টমাস্টার’ ছোটোগল্পটি লেখার উৎস? জমিদার, দেওয়ান সেরেস্তার কর্মচারীদের অত্যাচারের অভিজ্ঞতা থেকেই কি তিনি (১৬ই জুন, ১৮৯৫), শিলাইদহে বসে ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি লিখলেন? শিলাইদহ-নিবাসী শচীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেছিলেন যে ‘বাবু’ ও ‘উপেন’ হচ্ছে শিলাইদহ গ্রামের গুরুচরণ অধিকারী ও যদু দত্ত। ‘পুরাতন ভৃত্য’ ও ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যের ‘কাহিনী’ অংশের ‘গানভঙ্গ’ কি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল?

১৯০৮-০৯ সালে, রবীন্দ্রনাথের তাঁর জমিদারিতে (শিলাইদহ, কুষ্টিয়া, পতিসর – এখন সবই বাংলাদেশে) যে কয়েকটি তাঁতশালা স্থাপন করেছিলেন সেখানে তিনিই সুতা সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই উদ্যোগ সফল হয় নি। রবীন্দ্রনাথ সজনীকান্ত দাসকে বলেন: “কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠিত আমার তাঁতের কারখানার ইতিহাস যদি কোন দিন জানতে পাও তো দেখতে পাবে, ওই তাঁতের সুতো ধরে আমি সর্বনাশের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতেও ইতস্তত করি নি। সুতো সরবরাহ করে যাঁরা আমাকে ঠকিয়েছিলেন, তাঁরা আমারই দেশের লোক; স্বদেশীয়ানাকে মূলধন করে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলেন তাঁরা।”

রবীন্দ্রনাথের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রতিফলনই কি আমরা তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ [১৯১৬] ও ‘চারঅধ্যায়’ [১৯৩৪] উপন্যাসে দেখি?

৩. গান “ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই গানটি : ’ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি’ আমরা সবাই বহুবার শুনেছি। কিন্তু জানতুম না যে এই গানটি কবি কখন এবং কি উপলক্ষ্যে লিখেছিলেন। নির্মলকুমারী মহলানবিশ ‘কবির সঙ্গে য়ুরোপে’ গ্রন্থে লিখেছেন : “এঁরই [ফরাসি শিল্পী আঁদ্রে কার্পেলেস (Andrée Karpelès, 1885- 1956)] বিদায় সম্বর্ধনার দিন কবির নতুন লেখা গান ‘ভরা থাক, ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি’ গাওয়া হয়েছিল। বিশেষ ক’রে এই দিনের জন্যই কবি লিখেছিলেন গানটা।” গানটি খুবই পরিচিত কিন্তু আঁদ্রে কার্পেলেস সম্বন্ধে তো প্রায় কিছুই জানি না। একটু সন্ধান করা যাক।

আঁদ্রে কার্পেলেসের বিদায়ের খবর ১৩ই বৈশাখ [২৬ এপ্রিল, ১৯২৩] আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেখান থেকে এই ফরাসি শিল্পীর কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়: “কুমারী আঁন্দ্রে কাপ্পে ফরাসী দেশীয় চিত্রশিল্পী। আচার্য্য রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ শ্রীমতী প্রতিমা দেবী ইহারই সাহায্যে বাঙ্গলা দেশের নারীগণের উন্নতির জন্য একটি শিল্পাগার প্রতিষ্ঠা করেন। কুমারী কাপ্পে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া আমাদের দেশের কৃষক-সম্প্রদায়ের মধ্যে যে চারুশিল্পের প্রয়োজন রহিয়াছে, তাহা দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছেন। ইনি আশ্রমের শিল্পী শ্রীযুক্ত নন্দলাল বসু ও শ্রীমতী প্রতিমা দেবীর সহিত মিলিত হইয়া আমাদের দেশের কাঠের কারিগর, মাটির কারিগর ও গালার কারিগরদের লইয়া আধুনিক সময়োপযোগী করিয়া ভারতের পুরাতন ঐ সমস্ত নষ্ট শিল্পের পুনরুদ্ধার করিতেছেন। কাপড়ের উপর কাজ করা আমাদের দেশের একটি মূল্যবান সম্পদ – এই দিকেও শিল্পীদের লইয়া তাঁহারা অনেক উন্নতি বিধান করিয়াছেন। তিনি স্বদেশে যাত্রা করিতেছেন এবং আগামী শীতের প্রারম্ভে পুনরায় বিশ্বভারতীর কার্য্যে আসিয়া যোগদান করিবেন। [রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ, আনন্দবাজার পত্রিকা – খন্ড ১]

না, আঁদ্রে কার্পেলেস আর শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন নি। তিনি ১৯২২-এর ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন আর ১৯২৩-এপ্রিল মাসে ফ্রান্সে ফিরে যান। সেখানে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন এক স্ক্যান্ডিনিভিয়ান যুবক C A Dal Hogman বা Dal এর সঙ্গে (খুব বড়োসড়ো চেহারার জন্য রবীন্দ্রনাথ মজা করে আঁদ্রেকে বলতেন ‘your big Scandinivian’)। কিন্তু এই অল্প সময়ে শান্তিনিকেতনের জীবনে আঁদ্রে একটা বিশেষ ছাপ রেখে যান। শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ‘বিচিত্রা’ কারুসংঘ প্রতিমা দেবী ও তাঁর উদ্যোগেই স্থাপিত হয়েছিল। ‘বিচিত্রা’-য় ছাত্রছাত্রীদের উডকাট ও অয়েল পেন্টিং শেখাতেন আঁদ্রে। ‘বিচিত্রা’ নামকরণ করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আঁদ্রে জানাচ্ছেন যে তাঁদের কাজ শুধু শান্তিনিকেতনের মধ্যেই রাখলে চলবে না, আশেপাশের গ্রামগুলিকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে দীর্ঘস্থায়ী কিছু করা যাবে না। তাঁর ধারণা ছিল এই সব কাজ গুরুদেবের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে কবির সঙ্গে আঁদ্রের আলাপ কবে হয়েছিল? যোগাযোগটা ঠাকুরপরিবারের সূত্রে। একটু ফিরে দেখা যাক। আঁদ্রে ও সুজান (Suzanne) দুই বোন। তাদের পিতা জুল (Jules) কার্পেলেসের য়ুরোপে ইন্ডিগো বা নীলের ব্যবসা ছিল এবং এই ব্যবসার কাজে তাঁকে চিন, জাপান, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে আসতে হত। এভাবেই বাবার হাত ধরে দুই বোন কলকাতায় আসে। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তাঁরা দীর্ঘ সময় কলকাতাতে থেকেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিল্পীবন্ধুদের সঙ্গে তাঁদের পরিচিতি হয় চিত্রশিল্পের সূত্রে। আঁদ্রে চিত্রশিল্পী আর সুজান ছিলেন সংস্কৃত ভাষার পারদর্শিনী ও ফরাসি পন্ডিত সিলভ্যা লেভির ছাত্রী। অবনীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পী হওয়ার জন্যই আঁদ্রে কার্পেলেসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল জোড়াসাঁকোর ৫নং বৈঠকখানা বাড়িতে। এখানে দুই বোন নিয়মিত অতিথি হতেন। এই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের পরিচয়। এখানে বলে রাখা যায় যে পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নালক’ ও ‘ক্ষীরের পুতুল’ (La Poupée de Fromage = The Cheese Doll) ফরাসিতে অনুবাদ করেছিলিন আঁদ্রে কার্পেলেস। এখানে একটা মজার ব্যাপার হল ফরাসিতে Poupée বা পুপে মানে পুতুল, আবার আমরা দেখি রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর পালিতা কন্যা নন্দিনীর ডাক নাম হল ‘পুপে’ । সম্ভবত নামটা আঁদ্রেই দিয়েছিলেন।

এরপর ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ প্যারিসে যান এবং আলবের কানের (Albert Kahn) আমন্ত্রণে প্যারিসের শহরতলিতে নির্জন স্থানে এক প্রাসাদোপম বাড়ি অতুর দ্যু মঁদ (Autour du Monde) কিছুদিন থাকেন। এই সময় আঁদ্রে ও সুজান কার্পলেস ভগ্নীদ্বয় প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের কাছে আসতেন । শিল্পী আঁদ্রে রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি আঁকাও শুরু করেন। আর সুজান কার্পেলেস কবির ‘লিপিকা’র কবিতাগুলো (গদ্যকবিতা?) ফরাসিতে অনুবাদ করেন। কবি মুখে মুখে কবিতাগুলোর ইংরাজি অনুবাদ করে দিতেন আর সুজান সেখান থেকে ফরাসি অনুবাদ করতেন। দুই ভগ্নীই ভাল ইংরাজি জানতেন।

রবীন্দ্রনাথ যখন জানলেন যে আঁদ্রের শান্তিনিকেতনে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম তখন (২৬শে জানুয়ারী ১৯২৪ সালে) আঁদ্রেকে তিনি লিখলেন : “…I forgive your husband for wrenching you away from us with such a sudden jerk – and I hope you understand what a degree of generosity that forgiveness of mine represents …Your own cottage here still remains vacant. I have come to its neighbourhood occupying the bunglow which for sometimes belonged to Pearson……”

আবার ১৯৩০ সালে, প্যারিসে যখন রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী হয় তখন শেষবারে মতো আঁদ্রের সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আঁদ্রে কার্পেলেসও কবির এই প্রদর্শনীর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। এমনকি ছবির প্রশংসা করে ফরাসিতে তিনি একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন।

জীবনের শেষ বেলায় এসে (১৪ই মে ১৯৩৫সাল) রবীন্দ্রনাথ আঁদ্রে কার্পেলেসকে লিখছেন :
“…though I have very Great love for your big Scandinavian I cannot forgive him for snatching you away from our neighborhood. As my age advances, the longing in me grows in intensity for the near touch of those individuals whose love I can absolutely rely upon. The time has been long enough in my case for the process of elimination to have reached its finality and the few friends who remain as the best gifts of life become immensely precious.”

আজীবন আঁদ্রে কার্পেলেসের সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল কবিগুরুর। কবির তিরোধানের পরও রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর সঙ্গেও আঁদ্রের যোগসূত্র ছিন্ন হয় নি।

তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১. শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ – প্রমথনাথ বিশী, পৃষ্ঠা ৩৯, ৫৮, প্রকাশক: মিত্র ও ঘোষ।
২. পিতৃস্মৃতি – রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃষ্ঠা – ৪৩, জিজ্ঞসা, কলিকাতা।
৩. জমিদার রবীন্দ্রনাথ – অমিতাভ চৌধুরী, পৃষ্ঠা-৮২, প্রকাশক : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলিকাতা।
৪. রবিজীবনী : প্রশান্তকুমার পাল, ষষ্ঠ খন্ড,পৃষ্ঠা ১৫ ও নবম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩, ৪৫, ৪৬, প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স।
৫. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ – পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৪৭, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।
৬. বিশ্বপথিক কালিদাস নাগ। পৃষ্ঠা – ১০৪-১০৫, প্রকাশক – A Writers Workshop Publication.
৭. গীতবিতান (পূজা – ২৯৩) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৮. রবীন্দ্রনাথ ও ফ্রান্স – সৈয়দ কাওসর জামাল। প্রকাশক : আজকাল পাবলিশার্স।
৯. Andrée Karpelѐs and Santiniketan: Letters from Flora Hogman Archive. Rabindra Viksha Vol 53: 21-35. (৭ই পৌষ, ১৪৯১ বঙ্গাব্দ). Article · May 2020, by UDAYA NARAYANA SINGH, RABINDRA BHAVANA, VISVA-BHARATI

Sahityika Admin

Add comment