জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি।। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।
—————————————————————————————————————-
১. বাংলা ভাষা
ক্ষিতিমোহন সেন বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা কিছু প্রবর্তন করতে গেছেন তার প্রায় সব কিছুতেই চারিদিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। তাঁর গান, তাঁর প্রবর্তিত নৃত্যকলা, কথ্য ভাষায় তাঁর রচনা, এমনকি সভাসমিতির কাজ বাংলায় চালানোর ক্ষেত্রেও আপত্তি উঠেছিল। পরে অবশ্য এই সব প্রতিবাদ আদপেই ধোপে টেঁকেনি। একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে ১৮৩৫ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে (এর কিছুদিন পরেই অবশ্য রানী ভিক্টোরিয়া ঘোষণা করেন যে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে), Lord Macaulay [১৮০০-১৮৫৯ ] ভারতবাসীর জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। সফল হন নি তিনি। অন্যদিকে কিন্তু স্পেন ও পর্তুগাল তাদের ভাষা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে বা ব্রিটিশরা ইংরেজি ভাষা ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে চালাতে সক্ষম হয়েছিল। এর কারণ, ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষাগুলো তথা বাংলা ভাষা তখন যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এর জন্য অবশ্য দেশে ছাপাখানার একটি বড় ভূমিকা ছিল। পরবর্তী কালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (যাঁর প্রচেষ্টায় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার প্রকাশ-১৮৪৩), বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাংলা ভাষাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন। কিন্তু এসব তো ইতিহাসের কথা। ফিরে আসি রবীন্দ্রনাথের মন্দ কপালের কথায়।
১৮৯৭-এ বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন: “ন্যাশনাল কংগ্রেসের অধিবেশনে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার হয় তার মানে আছে, কিন্তু প্রাদেশিক সম্মিলনেও ইংরেজিতে বক্তৃতা হবে বাবার [রবীন্দ্রনাথ] তাতে খুব আপত্তি ছিল। কনফারেন্সের সভাপতি মেজজ্যাঠামহাশয়েরও [সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর] তাই মত দেখে বাবা বলেলন বাংলাভাষা ব্যবহার হোক এই মর্মে সভার প্রারম্ভেই তিনি এক প্রস্তাব তুলবেন। স্থির হল [নাটোরের] মহারাজা প্রস্তাবের সমর্থন করবেন। প্রস্তাব উপস্থিত হতেই অধিকাংশ সভ্যেরা উৎসাহের সঙ্গে তাঁদের সম্মতি জানালেন। প্রস্তাব গৃহীত হল। কিন্তু কংগ্রেসের যাঁরা প্রকৃত পান্ডা তাঁরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন দেখে বাবা তাঁদের শান্ত করলেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে, তাঁদের ইংরেজি বক্তৃতা তিনি নিজে সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় তর্জমা করে দেবেন। তাঁরা তখনকার মত আশ্বস্ত হলেন বটে, কিন্তু তাঁদের মনে রাগ রয়ে গেল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ প্রমুখ কংগ্রেসের মহারথীরা বরাবর ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়েছেন, তাঁদের ইংরেজি ভাষায় যেমন দখল, বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতাও তেমনি আশ্চর্য। তাঁরা বাংলায় কি করে বক্তৃতা দেবেন ? তাঁরা কয়েকজন ইংরেজিতেই বললেন, বাবা সেগুলি বাংলায় তর্জমা করে দিলেন। অধিবেশন ভাঙার সময় উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (W. C. Bonnerjee) ঠাট্টা করে বাবাকে শোনালেন – “Rabi Babu, your Bengali was wonderful, but do you think your chasas and bhusas understood your mellifluous Bengali better than our English?”
রবীন্দ্রনাথ নিজেও দুঃখ করে লিখেছিলেন : “রাজসাহী-সন্মিলনীতে নাটোরের পরলোকগত মহারাজা জগদিন্দ্রনাথের সঙ্গে চক্রান্ত করে সভায় বাংলাভাষা প্রবর্তন করবার প্রথম চেষ্টা যখন করি, তখন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় প্রভৃতি তৎসাময়িক রাষ্ট্রনেতারা আমার প্রতি একান্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কঠোর বিদ্রূপ করেছিলেন। …পর বৎসরে রুগ্নশরীর নিয়ে ঢাকা-কনফারেন্সেও আমাকে এই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হতে হয়েছিল। আমার এই সৃষ্টিছাড়া উৎসাহ উপলক্ষ্যে তখন এমনতরো একটা কানাকানি উঠেছিল যে, ইংরেজি ভাষায় আমার দখল নেই বলেই রাষ্ট্রসভার মতো অজায়গায় আমি বাংলা চালাবার উদযোগ করেছি। বাঙালির ছেলের পক্ষে যে গালি সবচেয়ে লজ্জার সেইটেই সেদিন আমার প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছিল, অর্থাৎ ইংরেজি আমি জানি নে।”
এই কনফারেন্স নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন : ” … প্যান্ডেলে গেলুম, এখন যে’ই বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়ায় আমরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠি বাংলা বাংলা। কাউকে আর মুখ খুলতে দিই না। ইংরেজিতে মুখ খুলেই ‘বাংলা’ ‘বাংলা’ বলে চেঁচাই। শেষটায় চাঁইদের মধ্যে অনেকেই বাগ মানলেন। লালমোহন ঘোষ এমন ঘোরতর সাহেব, তিনি ইংরেজি ছাড়া কখনো বলতেন না বাংলাতে, বাংলা কইবেন এ কেউ বিশ্বাস করতে পারত না – তিনিও শেষে বাংলাতেই বক্তৃতা করলেন। কী সুন্দর বাংলায় বক্তৃতা করলেন তিনি, যেমন ইংরেজিতে চমৎকার বলতে পারতেন বাংলা ভাষায় তেমনি। অমন আর শুনি নি কখনো। যাক্ আমাদের তো জয়জয়কার । বাংলা প্রচলন হল কনফারেন্সে।“
**********
২. লালু
ভাল করে ভোর না হতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাত-মুখ ধুয়ে উপাসনায় বসতেন। উপাসনার পর শুরু হতো তাঁর লেখাপড়ার কাজ। এ তাঁর বহুকালের অভ্যাস। বনমালী (তাঁর জীবনের শেষ কুড়ি বছরের একান্ত সেবক) উনুন ধরিয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্য চা করে আনত। গুরুদেব তখন মৃন্ময়ীর চাতালে বসে চা খেতেন। এই নিয়ে রানী চন্দ (১৯১২-১৯৯৭) একটি মজার গল্প বলেছিলেন। লালু বলে একটি ষন্ডামার্কা দেশী কুকুর এসে হাজির হত ঠিক এই সময়। গুরুদেবের পায়ের সামনে এসে দুপায়ে ভর দিয়ে রোজ বসত। কিন্তু মুখে কোন আওয়াজ নেই। যেন পাথরে খোদাই করা একটি মূর্তি। গুরুদেব চেয়ে দেখতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। লালু তখন একটু গঁ-গঁ আওয়াজ করত। গুরুদেব একটা পাঁউরুটিতে পুরু করে মাখন লাগিয়ে লালুকে দিতেন। লালু নিঃশব্দে খেত। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, এর কি ডিগনিটি দেখেছিস।
কিন্তু এই ব্যাপারটা বনমালীর খুব লাগত। একটা কুকুর কিনা রোজ রোজ এতখানি মাখন খাবে। এক-একদিন লালুকে আসতে দেখলেই বনমালী লালুর প্রাপ্য রুটিখানি মাটিতে রেখে পেয়ালা প্লেট মাখন চিনি সব-কিছু তুলে নিয়ে চলে যেত। লালু কিন্তু সেই রুটি ছুঁয়েও দেখতো না। বরং গুরুদেবের আরও কাছ ঘেঁষে এসে চুপ করে বসত। গুরুদেবের খেয়াল হলে চেয়ে দেখতেন লালুর রুটি মাটিতে পড়ে আছে। বনমালীকে বলতেন, লালু খায় নি আজ দেখছ? বনমালী বলত, তা এজ্ঞে কি করব আমি। রুটি তো হোথায় ঐ দিয়ে রেখেছি, দেখুন-না কেন? গুরুদেব বলতেন, সে তো জানি, আর এও জানি তুমি শুকনো রুটি দিয়েছ খেতে। জানো, লালু মাখন ছাড়া রুটি খায় না। নিয়ে এসো মাখনের বাটি এখানে, আমি মাখন লাগিয়ে দেব।
তবে এক এক দিন কিন্তু শেষ হাসিটা বনমালী হাসতো। গুরুদেব মুখ না তুলে একাগ্রচিত্তে অবিরাম লিখে চলেছেন। কোন দিকে তাঁর খেয়াল নেই। সেই সময় বনমালী লালুকে আঙুলের ইশারায় ডাকতো। লালু বেগতিক বুঝে আস্তে আস্তে উঠে বনমালীর কাছে চলে আসতো। বনমালী একটি শুকনো রুটি লালুকে দিতো। নীরবে সেই শুকনো রুটি খেয়ে লালু চলে যেত। কিন্তু একটিবারের জন্যও লালু রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতো না।
লালুকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি এখানে দিতে বড় লোভ হল।
আরোগ্য কাব্য (কবিতা নং – ১৪)
—–‐——————
প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে আসনের কাছে
যতক্ষণে সঙ্গ তার না করি স্বীকার
করস্পর্শ দিয়ে।
এটুকু স্বীকৃতি লাভ করি
সর্বাঙ্গে তরঙ্গি উঠে আনন্দপ্রবাহ।
বাক্যহীন প্রাণীলোক-মাঝে
এই জীব শুধু
ভালো মন্দ সব ভেদ করি
দেখেছে সম্পূর্ণ মানুষেরে ;
দেখেছে আনন্দে যারে প্রাণ দেওয়া যায়
যারে ঢেলে দেওয়া যায় অহেতুক প্রেম,
অসীম চৈতন্যলোকে
পথ দেখাইয়া দেয় যাহার চেতনা।
দেখি যবে মূক হৃদয়ের
প্রাণপণ আত্মনিবেদন
আপনার দীনতা জানায়ে,
ভাবিয়া না পাই ও যে কী মূল্য করেছে আবিষ্কার
আপন সহজ বোধে মানবস্বরূপে ;
ভাষাহীন দৃষ্টির করুণ ব্যাকুলতা
বোঝে যাহা বোঝাতে পারে না,
আমারে বুঝায়ে দেয় সৃষ্টি-মাঝে মানবের সত্য পরিচয়।
তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১. গুরুদেব – রানী চন্দ। পৃষ্ঠা-১০৪-১০৫, প্রকাশক: বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা।
২. রবীন্দ্ররচনাবলী (ডিজিটাল সংস্করণ) – পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
৩. পুরানো সেই দিনের কথা – প্রমথনাথ বিশী, প্রকাশক : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।
৪. রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন – ক্ষিতিমোহন সেন, পৃষ্ঠা ২৮৪, প্রকাশক : পুনশ্চ।
৫. রবিজীবনী চতুর্থ খন্ড – প্রশান্তকুমার পাল, পৃষ্ঠা -১৪৩, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স ।
৬. Grounds for Hope – Ramakrishna Bhattacharya. Page No: 30, Published by: Indian Academy of Social Sciences.
৭. ঘরোয়া – শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীমতী রানী চন্দ,পৃষ্ঠা – ২৫, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলিকাতা।
Add comment