সাহিত্যিকা

চন্দননগর – একদিনের ছুটিতে

চন্দননগর – একদিনের ছুটিতে
বিজিত কুমার রায়, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

অল্প শীতের সুন্দর একদিনের আউটিং এ চলুন চন্দননগর । কলকাতা থেকে মাত্র দেড় দুই ঘণ্টার রাস্তা ।
শীতকালে সকলেরই মন চায় কোথাও একদিন ঘুরে আসা যাক। শীতল দিনে ঘরের বাইরের উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে। সকাল এ বেরিয়ে রাতে/সন্ধেবেলা ফেরা ।
তাহলে কলকাতা থেকে কাছাকাছির মধ্যে চলেই আসতে পারেন চন্দননগর ।
না, এ জগদ্ধাত্রী পূজার জাঁকজমক ভীড় ঠেলে চলা চন্দননগর নয়। এ আমাদের কলকাতার দম আটকা বীভৎস ক্কাধাক্কির আনন্দের থেকে দূরে আধা শহরের নদীর পাড়ের মনোরম আনন্দ আর ফরাসি ইতিহাসের ছোঁয়ায় মাখা চন্দননগর।

কলকাতা থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরে হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে হুগলি জেলার একটা মহকুমা শহর এই চন্দননগর। খলিসানি, বোরো ও গোন্দলপাড়া নামক তিনটি প্রাচীন মৌজা এবং গৌরহাটির ছিটমহল সমেত নয় বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এর গঠন। হাওড়া-ব্যান্ডেল রেলপথের উপর মানকুন্ডু ও চন্দননগর রেল স্টেশন, এই দুটি জনগণের যাতায়াতের কাজে লাগে। আর গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এই শহরের মধ্য দিয়েই গেছে। বিদেশিদের আগমনের পূর্বেও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির জন্য চন্দননগরের সুখ্যাতি ছিল, যা অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে ছিল না।

আজ সকালে হঠাৎই লম্বা বেড়ানোর ইচ্ছে হলো। সকাল আটটায় স্নান সেরে চা বিস্কুট খেয়ে নিউটাউনের বাড়ি থেকে স্ত্রী কন্যা ও নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের গা ঘেঁষে নিবেদিতা ব্রিজ হয়ে তারপর সোজা ওল্ড দিল্লী রোড।

প্রথমে গেলাম রামকৃষ্ণ মিশনের হুগলি নদীর ধারে ছোট ছিমছাম মন্দিরে। তবে রাস্তা খুব সরু, তাই গাড়ি স্ট্র্যান্ডে রেখে টোটো নিয়ে যাওয়াই ভালো।

সাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতা এবং ঐতিহাসিক-গবেষক ড. সুকুমার সেন মনে করেন যে, একসময় এই জনপদে চণ্ডীর মন্দির ছিল। তাই এই অঞ্চলকে বলা হতো চণ্ডীরনগর। এই চণ্ডীরনগর নাম থেকেই নাকি চন্দননগর নামের উৎপত্তি ঘটেছে। তবে এ নিয়ে দ্বিমতও রয়েছে।

মনসামঙ্গল ও কবিকঙ্কণ চন্ডীর লেখাতেও এ শহরের উল্লেখ আছে। লাক্ষা, মোম, সোরা, বেত, কাঠ, চন্দন কাঠ, বস্ত্র শিল্প, রেশম ও মশলার রপ্তানি ও ব্যবসা চন্দননগরে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। শহরটির নামকরণ হয়েছিল এখানকার চন্দন গাছ থেকে, কিংবা এর অধিষ্ঠাত্রী দেবী বোরাইচন্ডী বা মঙ্গলচন্ডী থেকে। এ ‘ফরাসি-ভূমি’ বা ‘ফরাসডাঙ্গা’ তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। অনেক আগে বিভিন্ন বর্ণের হিন্দু, মুসলমান, ইউরোপীয় ও আর্মেনীয়গণ এখানে বসবাস করত।

ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্যোগী ফরাসি নাগরিক ডুপ্লে ১৬৭৩ সালে এখানে প্রথম পদার্পণ করেন। একটি গুদামঘর তৈরি করে তিনি এখানে ১৬৭৬ সাল পর্যন্ত থাকলেও অঞ্চলের কোনো উন্নতি করতে পারেন নি। বাঁশবেড়িয়া-শেওড়াফুলি জমিদার অধিকৃত হুগলি চাকলার মুহম্মদ-আমিনপুরের অন্তর্গত ছিল এই চন্দননগর। ১৬৮৮ সালের এক ফরমানের বলে ফরাসিরা গৌরহাটিতে একটি কুঠি নির্মাণ করে। ১৬৯৭ সালে ডেসল্যান্ড বর্তমান লালদিঘির কাছে ‘ডি-অঁরলিয়ে’ দুর্গ নির্মাণ করেন, যা ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ১৭৩৬ সালে পন্ডিচেরির গভর্নর দিসা স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা প্রকাশের জন্য নওয়াবের কাছ থেকে ফরমান সংগ্রহ করেন।

ডুপ্লে অনেকগুলি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু বেশির ভাগ যুদ্ধেই পরাজিত হন। যাহোক, ইউরোপে শান্তি ফিরে আসার পর ফরাসিরা শহরটি ফেরৎ পায়। পরিখা, নদী সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং স্থায়ী শাসন-ব্যবস্থা থাকায় এটি মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে সুরক্ষিত ছিল। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ও নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে বহু ইউরোপীয় ও ভারতীয় তখন এই শহরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

১৭৩১ সালে নতুন গভর্নর, জোসেফ ফ্রান্সিস ডুপ্লে জমিদারদের কাছ থেকে জমি নিয়ে উত্তরে তালডাঙ্গা থেকে দক্ষিণে গৌরহাটি পর্যন্ত শহরটিকে প্রসারিত করেন। একজন গভর্নর ডাইরেক্টর, ও ৫ জন সদস্যের দ্বারা গঠিত কাউন্সিলের মাধ্যমে এ শহরের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো। পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে ১৭৫৭ সালে মীরজাফর যুদ্ধক্ষেত্রে সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে কিনা তা নিশ্চিত করতে রবার্ট ক্লাইভ এখানে থেমেছিলেন। পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লবের চেতনা এ শহরটিকে প্রভাবান্বিত করে এবং ১৭৯২ সালের একটি স্থানীয় বিপ্লবে গভর্নর কিছুদিনের জন্য গৌরহাটিতে বিতাড়িত হন।

ইউরোপীয় অঞ্চলে একটি সুন্দর মঠ, দুর্গ, নদীবন্দর, গভর্নরের বাসভবন, থিসল হোটেল, ১৭২৬ সালে নির্মিত সেন্ট লুই চার্চ, গৌরহাটিতে এক মনোরম প্রাসাদ এবং নদী তীরবর্তী বাঁধানো প্রশস্ত ভ্রমণ পথ ছিল। এছাড়াও বস্ত্রশিল্প, রেশম, শোলা, ঝিনুক প্রভৃতির সুপ্রতিষ্ঠিত কুটির শিল্প গড়ে উঠেছিল চন্দননগরে। ফরাসিরা নদী তীরে একটি পাটকলও শুরু করেন। সেন্ট লুইস চার্চ ও তিববতি মিশন চার্চ ছাড়াও প্রাচীনতম বোরাই চন্ডী মন্দির ও প্রায় একশটি শিব মন্দির ছিল।

একসময় চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ। ইংরেজশাসিত কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ফরাসিশাসিত চন্দননগর। কলকাতার মতো চন্দননগরেও আছে স্ট্র্যান্ড, বড়বাজার, বাগবাজার, বউবাজার। ফরাসি আমলে চন্দননগরের প্রভূত উন্নতি হয়। রাস্তাঘাট, নিকাশি সবেতেই ফরাসি দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধিকবার এই শহরে এসে থেকেছেন। তার স্মৃতিবিজড়িত পাতালবাড়ি স্ট্রান্ডের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত। তাঁতবস্ত্রের কেন্দ্র হিসেবেও চন্দননগরের নামডাক ছিল। চন্দননগরের আরেক নাম ফরাসডাঙা। এখানকার কাপড়ের খ্যাতি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৯৪৯ সালের এক গণভোটের মাধ্যমে চন্দননগর ভারতীয় ইউনিয়নের একটি অংশে পরিণত হয়। আজও এ শহরে অনেক অতীত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান; যেমন রোমান ক্যাথলিক চার্চ, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বেশ কিছু ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়।

স্বাধীনতা সংগ্রাম
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাসে হুগলির চন্দননগর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ব্রিটিশাধীন না হওয়ায় বিপ্লবযুগে এই শহরটি ছিল বহু ভারতীয় বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সে সঙ্গে বহু ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ও আসামীর আশ্রয়স্থল। এই ফরাসি উপনিবেশে বিপ্লবীরা এসে আশ্রয় নিতেন। আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অরবিন্দ ঘোষ, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কর্মীরা, বিপ্লবী গনেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, শহিদ জীবন ঘোষাল, কানাই লাল দত্ত ও মতিলাল রায় এখানে আত্মগোপন করে ছিলেন একসময়। শেষোক্ত ব্যক্তি এখানে ধর্মীয় ভক্তি, শিল্পের উন্নতি সাধন ও ভারতীয় স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে ‘প্রবর্তক সংঘ’ নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। তার ভিটে, নামাঙ্কিত একটি বিদ্যালয় ও ক্রীড়াঙ্গন এই শহরে রয়েছে। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পৈতৃক ভিটে এই শহরে ফটোকগোড়া এলাকায়। ফরাসি উপনিবেশ, তাই ব্রিটিশ পুলিশকে অনুমতি নিয়ে এখানে ঢুকতে হতো। আর সেই সুযোগে বিপ্লবীরা পালাতেন। কানাইলাল দত্ত ও উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ও শৈশব কেটেছে এই চন্দননগর শহরে।

ফরাসি উপনিবেশ থাকার কারণে বহু বিপ্লবী এখানে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেছেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, গণেশ ঘোষ, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, মতিলাল রায়, জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ, মণীন্দ্রনাথ নায়েক বারীন্দ্রকুমার ঘোষের স্মৃতিধন্য চন্দননগর ছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের আখড়া। ১৯১১ সালে মতিলাল রায়ের প্রবর্তক সংঘর ভেতর প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল রাসবিহারী বসুর বোমাটি। যা পরে নিক্ষেপ করা হয় বড়লাট হার্ডিঞ্জ এর ওপর। ঋষি অরবিন্দ এখানে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর পন্ডিচেরি চলে যান।

“এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর / তোর তরে কবিতা আমার…..”
বিশ্বকবি জীবনে বহুবার বিশ্বভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে নানাবিধ অবস্থার মধ্যে থাকতে হয়েছে। কিন্তু মোরান সাহেবের বাগানবাড়ির মতো এতো নিখুঁত বর্ণনা আর কোনো বাড়ি প্রসঙ্গে সেভাবে বলেননি। মোরান সাহেবের বাগানটি ছিল গঙ্গার দক্ষিণ সীমান্ত লাগোয়া ফরাসডাঙায়, যা আজকের চন্দননগর। সেই বাগানের প্রসঙ্গে কবি একবার জীবনের শেষ দিকে বলেছিলেন – “সেই অতিথি বৎসলা বিশ্বপ্রকৃতি তার অবারিত আঙিনায় সেদিন যখন বালককে বসালেন,তাকে কানে কানে বললেন, ‘তোমার বাঁশিটি বাজাও’। বালক সে দাবি মেনেছিল”। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘ছেলেবেলা’ বই দু’টির কোনোটিতেই জানাননি, প্রথম কবে তিনি এসেছিলেন। তবে বহুজনকেই বলেছেন, যখন একেবারেই তিনি বালক, তখনই এখানে এসেছিলেন। চন্দননগরে গঙ্গার ওপর হাউস বোটে চড়ে তিনি জ্যোতি দাদার সঙ্গে সময় কাটাতেন। গঙ্গাতীরে বকুলবীথিকা ঘেরা মোরান সাহেবের সুন্দর বাগানবাড়িতে থেকেছেন দীর্ঘকাল। কবি প্রতিভা জাগ্রত হবার অনুকূল শান্ত পরিবেশ গঙ্গাতীরের মোরান হাউস তাঁর হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। তবে মোরান সাহেব কে ছিলেন, তা খুব একটা জানা যায় না।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ঘরোয়া’ বইতে এখানকার স্মৃতিকথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের বর্ণিত ‘ছোটো সে দোতলা বাড়িতে’ বেড়াতে এসেছিলেন তাঁর পিতা গুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে। অবন ঠাকুর লেখেন – “জ্যোতি কাকামশাই থাকেন তখন ফরাসডাঙার বাগানে (‘ছোটো সে দোতলা বাড়ি’) বসে আছি। বাগানে খুব আম টাম খাওয়া হল…….. জ্যোতি কাকামশাই বললেন, “রবি গান গাও”। সেই গানটা হলো – ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’।…….. গান হতে হতে মেঘ উঠল। গঙ্গার ওপর কোন্নগরি মেঘ”।

এর কিছুদিন পর ছোট্ট সে দোতলা বাড়ি ছেড়ে দেওয়া হলো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ চন্দননগরে গঙ্গাতীরে সেই মোরান সাহেবের বাগান বাড়িতে উঠে আসলেন। সেটাও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নিজের অর্থে ভাড়া নেওয়া। ঠাকুর বাড়ির ক্যাশ বইতে এ বিষয়ে খরচের হিসেব নেই। তারিখও জানা যায় না। জীবনের প্রথমদিকের কথা উঠলেই রবীন্দ্রনাথ বারবার এই মোরান সাহেবের বাগানের কথা বলতেন। ‘ছেলেবেলা’র কাহিনিতে বলেছিলেন “তার কিছুদিন পরে বাসা বদল করা হল মোরান সাহেবের বাগানে। সেটা রাজবাড়ি বললেই হয়। রঙিন কাচের জানলা দেওয়া উঁচু নিচু ঘর, মার্বেল পাথরে বাঁধা মেঝে, ধাপে ধাপে গঙ্গার উপর থেকেই সিঁড়ি উঠেছে লম্বা বারান্দায়। ঐখানে রাত জাগবার ঘোর লাগত আমার মনে”। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ লেখা শুরু করেছিলেন এখানে। মোরান সাহেবের বাগানে তার কাব্যচর্চার সঙ্গে সঙ্গে গদ্য রচনাও চলছিল। তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ এখান থেকেই লেখা শুরু হয়েছিল।

মোরান হাউস আজ আর নেই। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই শুধুমাত্র জুটমিল হবার প্রয়োজনে ভেঙে ফেলা হয়েছিল এই বাড়িটিকে। শহরবাসীর প্রতিবাদের কন্ঠ শোনা গিয়েছিল কিনা জানা যায় না। লোহার দাঁত সেদিনের মোরান সাহেবের বাগান বাড়িকে কড়মড়িয়ে গিলে ফেলেছিল।

ফ্রেঞ্চ নগরী চন্দননগরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
নদীর তীরে ভূ-কৈলাসের রানির তৈরি পাথরে বাঁধানো স্ট্র্যান্ড লাগোয়া বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত মোরাম সাহেবের তৈরি পাতালবাড়ি আজও স্মৃতি রোমন্থন করায়। উল্টো দিকে অল্প উত্তরে সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট। লাগোয়া ফরাসিদের তৈরি ইন্সতিতিউত দে চন্দেরনগর, এক কালের দ্যুপ্লে প্যালেস, আজকের চন্দননগর মিউজিয়াম। ফরাসি রাজত্বের নানা স্মারক অতীতে নিয়ে যায়। বিশ্বাসহন্তা নরেন গোস্বামীকে হত্যার রিভলভারটিও এই মিউজিয়ামে প্রদর্শিত। আর রয়েছে ফরাসি ইনস্টিটিউট, রোমান ক্যাথলিক চার্চ, সমাধিভূমি, দ্যুপ্লে কলেজ (বর্তমানে কানাইলাল বিদ্যামন্দির), রবীন্দ্র ভবন, নন্দদুলাল, বিশালাক্ষী মন্দির। ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্ক।

আর থাকার জায়গা মিউনিসিপাল গেস্ট হাউস – চন্দননগর পৌরসভা। এ ছাড়া বেসরকারি কয়েকটি হোটেল আছে।

চন্দননগরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এখানের জগদ্ধাত্রী পুজো। চন্দননগরে সব সময়ের জনপ্রিয় উৎসব ছিল এই জগদ্ধাত্রীপূজা। ইউরোপে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব এ উপমহাদেশে, বিশেষ করে চন্দননগরেও অনুভূত হয়।

কি কি দেখবেন ?
১। চন্দননগরের স্ট্রান্ড-জোড়া ঘাট
২। চন্দননগর সেক্রেড হার্ট চার্চ
৩। ডুপ্লেক্স প্যালেস (ASI)
৪। পাতাল বাড়ি
৫। টেরাকোটার শিব মন্দির
৬। নন্দদুলাল মন্দির
৭। ওয়ান্ডার ল্যান্ড পার্ক
৮। চন্দননগর ক্লক টাওয়ার
৯। ঐতিহ্যের কানাইলাল বিদ্যামন্দির*
১০। লালদিঘী
১১। লিবার্টি গেট
১২। চন্দননগর কলেজের মূল ভবন*
১৩। রক্ষিত ভবন*
১৪। থ্রিসেল হোটেল ( বর্তমানে চন্দননগর কোট)*
১৫।ফ্রেঞ্চ সেমেট্রি (লালদিঘীর নিকটে)
১৬। বিশালক্ষী মন্দির
*প্রবেশ অনুমতি সাপেক্ষ

১) চন্দননগরের স্ট্রান্ড-জোড়া ঘাট
চন্দননগর স্ট্র্যান্ড হল চন্দন নগরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং সুন্দর ভ্রমণের পথ। সুন্দর সারির গাছ এবং আলো দ্বারা সারিবদ্ধ দর্শনীয় গঙ্গা নদী, স্ট্র্যান্ডের আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্র।

স্ট্র্যান্ডের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল এটি একটি শ্বাসরুদ্ধকর নদীর তীরবর্তী দর্শন ছাড়াও অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলি দেখতে পারবেন, কারণ কাছাকাছি অনেকগুলি স্বতন্ত্র ল্যান্ডমার্ক এবং ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী এলাকায় অসংখ্য রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সন্ধ্যার সময় পরিবেশটি শান্তিপূর্ণ থাকে, কারণ চারিদিক আলোকিত হয় এবং হালকা বাতাস বয়ে যায় যা জায়গাটিকে আরও ঐশ্বরিক করে তোলে।
চন্দননগর স্ট্র্যান্ড পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর অলঙ্কৃত নদীপথ হিসাবে স্বীকৃত।

২) চন্দননগর মিউজিয়াম
পশ্চিমবঙ্গের সেরা এবং প্রাচীনতম যাদুঘরগুলির মধ্যে একটি হল চন্দননগর মিউজিয়াম। ১৯৫২ সালে, এই জাদুঘরটি আনুষ্ঠানিকভাবে ডুপ্লেক্স হাউসে খোলা হয়েছিল। এটি ফ্রান্সের সমৃদ্ধ ঔপনিবেশিক অতীতকে রক্ষা করে। জাদুঘরে একটি পুরানো উপহারের সংগ্রহ রয়েছে যা হরিহর সেট’কে (যিনি ছিলেন একজন পুরাকীর্তিবিদ এবং চন্দননগরের বিশিষ্ট ব্যক্তি) পুরস্কৃত করা হয়েছিল।

আপনি যদি এই জাদুঘরে যান তবে আপনি ফরাসি প্রাচীন জিনিসপত্র, অ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ ওয়ার ক্যানিয়ন, ১৮ শতকের শক্ত কাঠের আসবাবপত্র এবং গভর্নরের ব্যক্তিগত সংগ্রহ দেখতে পারেন। অতএব, আপনি যদি ফরাসি ঔপনিবেশিক নিয়মের ইতিহাসে আগ্রহী হন তবে এই যাদুঘরটি দেখার মতো স্থান।

এছাড়াও, যাদুঘরটি প্রবেশদ্বারে সুন্দরভাবে রক্ষিত আছে বাগান এবং মারিয়ানের একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে।

৩) পাতাল বাড়ি
পাতাল বাড়ি চন্দননগরের স্থাপত্য এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের একটি অত্যাশ্চর্য চিত্র। এই অনন্য স্থানটি প্রায় ১৫০ বছরের পুরানো এবং বাঁশবেড়িয়ার জমিদারদের মালিকানাধীনে তৈরী হয়েছিল। নাম অনুসারে, এই বাড়ির সর্বনিম্ন তলটি পবিত্র গঙ্গার নীচে নিমজ্জিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই স্থানটি পরিদর্শন করেছিলেন এবং এর অত্যাশ্চর্য কাঠামোর সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তাঁর অনেক সুপরিচিত লেখায় এই পাতালবাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। সুপরিচিত সমাজ সংস্কারক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এই বাসভবনে দীর্ঘকাল বসবাস করতেন।

এই রহস্যময় সুন্দর জায়গাটি চন্দননগরের একটি প্রাচীন মনোমুগ্ধকর স্থান যা আপনাকে অবশ্যই দেখতে হবে।

৪) চন্দননগরের সেক্রেড হার্ট চার্চ হল চন্দননগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি প্যারিশ চার্চ।
২০০ বছরের পুরানো ফ্রেঞ্চ-স্টাইলের সেক্রেড হার্ট ক্যাথলিক চার্চটি একটি শ্বাসরুদ্ধকর উপাসনার স্থান। বিখ্যাত ফরাসি স্থপতি Jacques Duchatz এই গীর্জাটি প্রতিষ্ঠা করেন। আপনি শুধুমাত্র দর্শনীয় স্থাপত্যের প্রশংসা ছাড়াও কিন্তু এই জনপ্রিয় ক্যাথলিক চার্চের অবস্থানের ইতিহাস সম্পর্কেও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে পারেন। এই গীর্জার একটি অসাধারণ চমৎকার সাদা পাথরের সম্মুখভাগ এবং চিত্তাকর্ষক অভ্যন্তর রয়েছে।

সূর্যাস্তের সময় চার্চটিকে আরও সুন্দর দেখায়।

৫) নন্দদুলাল মন্দির
ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী দ্বারা ১৭৪০ সালে নির্মিত মন্দিরটি প্রাচীন ভারতীয় নিদর্শনগুলির একটি চমৎকার উদাহরণ। এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি অনন্য মন্দির রয়েছে যা দেবী কালী, মহাদেব এবং অন্যান্য দেবতাদের প্রতি পূজনীয় যা চমৎকার কারুকাজ এবং শৈল্পিক অনুভূতি প্রদর্শন করে। এই অঞ্চলের কয়েকটি মন্দিরের সাথে মন্দিরের ডিভাইডারগুলি খোদাই করা আছে এবং ধর্মীয় আইকন দিয়ে সুসজ্জিতও করা আছে। শহরের এই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্ময়কর ল্যান্ডমার্কটি নিঃসন্দেহে একটি অবশ্যই দেখার গন্তব্য কারণ এটি সমস্ত উল্লেখযোগ্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে পরিপূর্ণ।

৬) জলশ্রী ভাসমান রেস্তোরা
ঐতিহাসিক শহর চন্দননগর, যার প্রতিটি প্রান্তে রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। ইতিহাস প্রেমীদের কাছে চন্দননগরের গুরুত্ব বরাবরই অপরিসীম। কিন্তু এবার ভোজনরসিকদের কাছেও এই চন্দননগর সমানভাবে গুরুত্ব পেতে চলেছে। চন্দননগরের গঙ্গাবক্ষে উদ্বোধন করা হল ‘দ্যা রিভার হ্যাবিটেট’ বা ‘জলশ্রী’ নামে প্রথম ভাসমান দ্বিতল রেস্তোরাঁ।

এক তালেবর মন্ত্রী আসবেন তাই নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঢুকতে দিলো না । তাই গাড়ি কোর্টের পাশে রেখে ফেরি ঘাটের পাশের সুন্দর কাঠের বেঞ্চিতে বসে নদীর শোভা দেখতে দেখতে বাড়ি থেকে আনা ডেট আখরোট কেক, চিজ স্টিকস আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট হলো । তারপর হেঁটে হেঁটে মোটামুটি এক কিমীর মধ্যে নদীর ধারে সব দর্শনীয় বাড়ি বা চার্চ ঘোরা হলো । তারপর পাতাল বাড়ির কাছ থেকে টো টো নিয়ে ঘোরা হলো চন্দন নগরের অলি গলিতে মন্দির দর্শন করতে করতে । সুন্দর ছোট শহর তাই অলি গলি রাস্তা কম চওড়া । ঘন্টা দুয়েক লাগলো সবটা ঘুরতে । খুব ভালো লাগলো পুরনো ফরাসি শহর ঘুরতে ।

দুপুরের খাওয়া সারলাম চন্দন নগরের বিখ্যাত বাঙালি ভোজের দোকান ” ভূতের রাজা দিলো বর “। এই রেস্তোরাঁ টি সম্পূর্ণ রূপে গুপি বাঘার থিমে তৈরি । রেস্তোরাঁর সজ্জা বা নানা থালির সম্ভার আছে যেমন গুপির থালি, বাঘার থালি, আমলকীর থালি, হরীতকীর থালি, মহারাজের থালি ইত্যাদি অন্ততঃ দশ পনেরো রকম দাম ২০০ থেকে ১০০০/-। এছাড়া আ লা কার্তে নানা ডিশ আছে । এছাড়া পূজার সময়ে বিভিন্ন দিনের থালি, আইবুড়ো ভাতের থালি, আশীর্বাদের থালি, জামাই ষষ্ঠির থালি সব রকম আছে । আমাদের থাকা কালীন আইবুড়ো ভাত হলো সমস্ত নিয়ম মেনে, আশীর্বাদ হলো বরণ ডালা সাজিয়ে । হইহই আনন্দের তুফান । ও মজার ব্যাপার হলো যে কোনো থালি সার্ভ হওয়ার আগে যারা খাবে তাদের দুইজনকে হাতে হাতে তালি দিয়ে ভূতের রাজার কাছে খাবার চাইতে হবে । বেশ ভালো তৃপ্তি দায়ক রান্না । বেশ ভালো লাগলো ও কাটলো। যা ভীড় কদিন পরে দোকানটা ডবল সাইজ করতে হবে ।

কিন্তু অবশ্যই “সূর্য কুমার মোদকের” জলভরা” সন্দেশ খেতে ও নিয়ে আসতে ভুলবেন না। আমরা লাঞ্চের আগে গেলাম দুই তিন কিমি দূরে অরিজিনাল সূর্য মোদকের দোকানে যেটি বারাসত মানকুন্দুতে। হুগলি জেলার চন্দননগরে যেমন বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো, তেমনই প্রসিদ্ধ জলভরা সন্দেশ। শুরুটা হয়েছিল ভদ্রেশ্বরের তেলেনিপাড়ার মোদক সুইটস-এ। যার কর্মকর্তা ছিলেন স্বয়ং সূর্য মোদক। তৎকালীন বন্দোপাধ্যায় জমিদার বাড়ির নারীমহলের দাবিতে নতুন জামাইকে ঠকানোর জন্য এক অভিনব কায়দায় এই জলভরা সন্দেশ তৈরির পরিকল্পনা করেন তিনি। আজও সারা বছর গোলাপ জলের যোগান আসে কনৌজ থেকে। শীতকালে গোলাপ জলের জায়গায় আসে সুস্বাদু নলেন গুড়। বাইরে থেকে বোঝবার উপায় নেই কিন্তু ভিতরে যে গোলাপ জল কিংবা গুড়ের পুকুর লুকানো রয়েছে তা বোঝার সাধ্য কারোর নেই! ময়রার ভেল্কিতে জব্দ হয়েছিলেন জমিদারের জামাইটিও।

যাওয়া হলো সূর্য মোদকের দোকানে। আহারে মিষ্টির কী বাহার। দাম অবশ্যই আকাশ ছোঁয়া কিন্তু এই জলভরার স্বাদ অতুলনীয়। খাঁটি গরুর দুধের ছানা আর চিনির পাক, তারপর হাতে ডলে তাকে একেবারে নরম করে নেওয়া হয়। এরপর ছাঁচে সেই পাক করা সন্দেশের কিছুটা পরিমাণ দিয়ে হাতের সাহায্যে ছোটো একটা গর্ত করে নিয়ে তাতে ঢেলে দেওয়া হয় সুগন্ধী গোলাপ জল, আর তারপর আবার সন্দেশ ভরে ছাঁচের মুখটা সিল করে দিলেই প্রস্তুত হয়ে যায় জলভরা সন্দেশ।

এছাড়া আরো প্রায় শত খানেক মিষ্টির সম্ভার এনাদের দোকানে। প্রতিদিন অন্তত ৫০ রকম মিষ্টি তৈরি হয় জানালেন ওনারা । কিছু মিষ্টি যেমন জলভরা, সরপুলি সন্দেশ, অমৃত পাতুরি, রাজ নন্দিনী, বেকড রসমাধুরি মতিচুর সন্দেশ ইত্যাদি নিয়ে এলাম বাড়িতে খাওয়ার জন্য। স্টেশন থেকে কাছে একটি দোকান আছে তবে মূল পুরানো দোকানটি বারাসত নামক জায়গাতে মানকুন্ডুর কাছে। সম্প্রতি এই বছরে রাজ্য সরকার “জলশ্রী” নামে জলযান রেস্তোরাঁর এর শুভ সূচনা করেছে। এখানেও খেতে পারেন।

খাওয়া দাওয়ার পর ছোট্ট নাতনির অনুরোধে ফেরি বোট চেপে এপারে রাণী ঘাট থেকে হুগলীর ওপারে জগদ্দল এ গিয়ে আবার রিটার্ন ফেরিতে ফেরত এলাম। তারপর গাড়িতে লাগলো ঘণ্টা দেড়েক নিউ টাউনে ফিরতে। রোববারের রাস্তা একদম ফাঁকা

Sahityika Admin

Add comment