সাহিত্যিকা

গোধূলি বেলা

গোধূলি বেলা
বিমলেন্দু সোম, ১৯৬৭ আর্কিটেকচার ও রিজিওনাল প্লানিং

জীবনেরও গোধূলি বেলায় পৌঁছে গেছেন হৈমন্তী মজুমদার। আজ আপনজন বিহীন, একদম একা, পাহারা দিয়ে চলেছেন নিঝুম নিস্তব্ধতায় ঝিমিয়ে পড়া “গোধূলি বেলা”! অথচ একটা সময় ছিল, যখন হাসি খুশিতে ভরে থাকত পুরো বাড়িটা! ছেলে-বৌমা তো অনেক বছর আগেই রাজারহাটে কেনা তিন বেডরুম ফ্ল্যাটে চলে গেছে। আর বছর তিনেক আগে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক স্বামী মৌলিনাথকে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এই চরম ধাক্কাটা সামলে ওঠার আগে শুরু হ’ল করোনা অতিমারি। হৈমন্তী তারপর থেকেই পুরোপুরি গৃহবন্দি। … আর এখন তো জবুথবু অবস্থা, ললিতার সাহায্য নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন যে তাঁর জীবনের সমস্ত আনন্দ উল্লাস ক্রমশই ফিকে হয়ে আসছে!

বাড়ির সামনের দিকে রয়েছে রঙ বেরঙের মরসুমি ফুলের বাগান। ঢোকার মুখে, প্রবেশ পথের ধারে একটি ছাতিম গাছ। শরত শেষে ছাতিম ফুলের তীব্র সুগন্ধ চারপাশটা মাতিয়ে রাখে। সুষ্ঠু রুচিবোধ এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আজ তিরিশ বছর পরেও বাগান সহ বাড়িটি নতুনের মতই দেখায়। মজুমদার পরিবারের ‘ফুল টাইম হেল্পিং হ্যান্ড’, বিশ্বস্ত স্বামী-স্ত্রী জুটি রামকান্ত এবং ললিতা। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে দক্ষ, তিরিশ বছর থেকে ওদের ঠিকানা এই ‘গোধূলি বেলা’!

“গোধূলি বেলা” … স্যাটেলাইট টাউনশিপের পুরোনো দোতলা বাড়ির নামটি ভারি সুন্দর! গৃহপ্রবেশের দিনে সুন্দর সাজিয়েছিলেন বাড়িটিকে। ব্যালকনি জুড়ে গাঁদা ফুলের ঝালর। আর একটা কাঠের বোর্ডে নিজের হাতে নানান রঙের আবীর দিয়ে ডিজাইন বানিয়েছিলেন। অনেক লোকজন এসেছিলো, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, অফিসের কিছু সহকর্মী, আর ছেলেরও কিছু বন্ধু এসেছিলো। সাজানো বাড়ি দেখে সকলেই মৌলিনাথ আর হৈমন্তীর রুচির প্রশংসা করেছিলো। মৌলিনাথের অবসর গ্রহণের বছর কয়েক আগেই “গোধূলি বেলা”-য় জাঁকজমকের সাথে গৃহপ্রবেশ হয়ে গেলো। নতুন জায়গায়, নতুন বাড়িতে আনন্দের বন্যা বইতে দেরি হ’ল না।

শীতের তীব্রতা এখন নেই। ব্যালকনির মিঠে রোদ্দুর হাতছানি দিয়ে ডাকে হৈমন্তীকে, যা’ তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। সূর্য রশ্মির উত্তাপ শরীরের পক্ষে ভালো, তাই রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে সস্নেহে ললিতাকে ডাকেন: ‘একটিবার আসবি মা, আমাকে ব্যালকনির রোদে একটু বসিয়ে দিবি’?
ললিতা সাড়া দেয়: ‘আসছি কাকিমা’।
হৈমন্তীকে ব্যালকনির ইজি চেয়ারে বসিয়ে রান্নাঘরে ফিরে যায় ললিতা। উনি দু’চোখ ভরে বাইরের জগতটাকে দেখেন – কিছুই আর আগের মত নেই। বিধিনিষেধের কারণে সামনের পার্কটা সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে বঞ্ছিত, অবাঞ্ছিত বুনো ঘাস গজিয়ে উঠেছে সর্বত্র। ভাবুক হয়ে অতীত দিনের স্মৃতিচারণে ডুব দেন হৈমন্তী।

মৌলিনাথ ছিলেন ব্যাঙ্ক অফিসার – বদলির চাকরি, নানা জায়গায় পোস্টিং হয়েছে। সেই সুবাদে বিয়ের পর হৈমন্তীও সঙ্গ দিয়েছেন। কী সুন্দর ছিল সেই ভবঘুরে জীবন! নতুন নতুন জায়গায় সংসার পাতার খেলা! আর, এমনি করেই একদিন কোল আলো করে আগমন ঘটলো এক দেবদূতের। যথাসময়ে মা-বাবার চোখের মণি সেই নবাগত শিশুর নামকরণ হ’ল অর্পণ। ভালো নাম অর্পণ, আদরের ডাকনাম ছোট করে অপু। হৈমন্তী-মৌলিনাথের আদর, শিক্ষা, সংস্কৃতির মধ্যে থেকে অপু কখন যে বড় হয়ে গেল, বুঝতেও পারেন নি, তারপর তো একদিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিক্ষান্তে আরও এক ধাপ এগিয়ে এম বি এ। ততদিনে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে আইটি প্রতিষ্ঠানের বড় চাকরি অপুর হাতের মুঠোয়।

একদিন ফোনে ছেলের ফিসফিস করে কথাবার্তায় এবং হাবভাবে হৈমন্তী আঁচ করতে পেরেছিলেন, যে অপুর জীবনে ভালোবাসার মানুষ কেউ না কেউ এসে গেছে। স্বামীর কাছে তাঁর অনুমানের কথা গোপন করে রাখতে পারেন নি। দু’জনের আলোচনায় ঠিক হ’ল ছেলেকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে দেখলে ক্ষতি কী! হৈমন্তী সেই দায়িত্বটি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। সুযোগ বুঝে অপুকে ওঁদের মনের কথা খুলে বলেন। ছেলে তো মায়ের কাছে কিছুই গোপন করে না, সেদিনও করে নি।

রণিতার সঙ্গে অপুর পরিচয়, ভাব-ভালবাসা আই টি প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী হিসেবেই। তাই মা-বাবার ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে সে এক ছুটির দিনে রণিতাকে “গোধূলি বেলা”-য় নিয়ে আসে। তারপর তো ভিনি-ভিডি-ভিসি, এলাম-দেখলাম-জয় করলাম! রণিতাকে প্রথম দর্শনেই হৈমন্তী-মৌলিনাথের পছন্দ হয়ে যায়। হৈমন্তীর মনে হলো গৃহপ্রবেশের দিনে এই মেয়েটিও এসেছিলো। অপুকে জিজ্ঞেস করতে সে সলজ্জ চুপ থেকে নীরবেই উত্তরটা দিয়ে দিলো। সন্ধের দিকে হবু শ্বশুর-শ্বাশুড়ির আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সে বিদেয় নেয়। তারপর মাত্র মাস তিনেকের মধ্যেই পুত্রবধূ হিসেবে রণিতাকে বরণ করতে আলোয় আলোয় সেজে ওঠেছিল “গোধূলি বেলা”! দু’বছর পর হৈমন্তী-মৌলিনাথের আনন্দের সীমা থাকে না – যেদিন নার্সিং হোম থেকে ছেলের ফোন মারফত জানতে পেরেছিলেন যে ওঁরা ঠাম্মি-দাদু হয়েছেন!

অজান্তেই হৈমন্তী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
সময় যে তার নিজের মর্জিতেই এগিয়ে চলে।
সুখের দিন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় পেছনে ধাওয়া করে দুঃখ!

“গোধূলি বেলা” থেকে অপুর কর্মস্থলে যাতায়াত করা অনেকটাই সময় এবং ব্যয় সাপেক্ষ। সমস্যা সমাধানের একটা উপায় অবশ্য ছিল ওর কাছে: মা-বাবাকে রাজারহাটের তিন বেডরুম ফ্ল্যাটে যাওয়া। অনেক ভেবে চিন্তে, রণিতার সঙ্গে আলোচনা করে মা হৈমন্তীর কাছে প্রস্তাবটি রাখে অপু। মা শুধু বলেছিলেন: ‘অপু আমাকে একটু সময় দে, তোর বাবার সঙ্গে আলোচনা করে জানাবো’।

হৈমন্তী-মৌলিনাথ ব্যাপারটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিজেদের শিকড় “গোধূলি বেলা” ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার প্রস্তাবটিতে মানসিক ভাবে কিছুতেই রাজি হতে পারলেন না। সবই বুঝতে পারেন, কিন্তু শিকড় ছেড়ে যেতে মন চায় না। অর্পণ-রণিতা-অয়নের চলে যাওয়ার দিন এসে যায়, রামকান্ত ওদের জিনিসপত্রগুলো গাড়িতে তুলে দেন। ভারাক্রান্ত মনে হৈমন্তী-মৌলিনাথ ওদের বিদায় জানাতে নিচে নেমে এসেছেন। নাতি অয়ন দাদু-ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে আবদার ধরে: ‘তোমরাও চল না দাদু-ঠাম্মি – নতুন ফ্ল্যাটে’। উনারা স্বান্তনা দিয়ে বলেন: ‘আগে তোমরা নতুন ফ্ল্যাটে গুছিয়ে বস দাদু, তারপর আমরা তোমাদের দেখতে যাব’। রণিতা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অয়নকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। অর্পণ এগিয়ে যায়, মা-বাবার কাছে গিয়ে বলে: ‘তোমরা সাবধানে থেকো। প্রত্যেক দিন ফোন করে খবর নেবো’। তারপর গাড়িতে উঠে বসলে রামকান্ত ইঞ্জিন স্টার্ট করে মেইন গেট পেরিয়ে টাউনশিপের পিচের রাস্তা ধরে। চোখের আড়াল হতেই হৈমন্তীর দু’চোখে নামে জলের ধারা, যা’ দেখে মৌলিনাথ নিজের বুকের শূন্যতাবোধ পাথর চাপা দিয়ে বলেন: ‘হেম, নিজেকে সামলে নাও, কষ্ট পেয়োনা, এটাই তো জীবন, এ মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই’! ললিতা ওর কাকিমাকে দোতলার সিঁড়ি ভাঙ্গতে সাহায্য করে।

দু’টি প্রজন্মের মধ্যে বাসস্থানের দূরত্ব তৈরি হয়ে যাওয়ার পরবর্তী কয়েকটি দিন একাকীত্ব বোধ ঘিরে রাখে হৈমন্তী-মৌলিনাথকে। পুরো বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, বিশেষ করে নাতিকে খুব বেশি মনে পড়ছিল ওঁদের। নাতি অয়ন দুটি বয়স্ক লোকের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলো।

এরপর শুরু হ’ল ওঁদের জীবনের নতুন অধ্যায়। হৈমন্তী-মৌলিনাথ একে অন্যকে আরও নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরলেন। শুরু হ’ল গুটি গুটি পায়ে প্রাতঃভ্রমণ। কখনো বা ‘ঝিল’-এর অত্যন্ত সুন্দর, মনোরম পরিবেশে ঘুরে আসা। আর কোন দিন হয়তো পার্কের বেঞ্চে বসে চেনা অচেনা বয়স্কদের জীবনের সুখ দুঃখের ভাগিদার হওয়া।

হৈমন্তীর আজও মনে আছে, স্বামীর মৃত্যুর পর সমস্ত পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন হয়ে গেলে ছেলে-বৌমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন: ‘তোমাদের দু’জনকে একটা কথা বলার ছিল, মতামত জানিও। একদিন তো আমিও থাকব না, আর এটাই জীবনের ধ্রুব সত্য! উনি চলে যাবার আগে চেয়েছিলেন, তোমরা যদি এখানে ফিরে না আসো, তা’হলে বরং বাড়িটি বিক্রি না করে একটা ‘বৃদ্ধাশ্রম’ বানিয়ে দিও, নাম থাকবে “গোধূলি বেলা”। রামকান্ত-ললিতাও এখন যেমন আছে তেমনি থাকবে। এই প্রস্তাব যদি তোমরা মেনে নিতে পারো, তা’হলে প্রয়োজনীয় এবং আইনানুগ সমস্ত ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব তোমাদের দু’জনকেই নিতে হবে’।

অর্পণ-রণিতা নিজেদের মধ্যে ইশারায় একে অন্যের মনের কথা বুঝতে পেরে একযোগে বলে ওঠে: ‘তুমি একদম চিন্তা করো না মা, বাবা যা চেয়েছেন তাই হবে’।
হৈমন্তীর দু’চোখে আনন্দাশ্রু, প্রাণভরে সেদিন তিনি আশীর্বাদ করেছিলেন ছেলে-বৌমাকে।

পরদিন সকালে হৈমন্তী ব্যলকনিতে ইজি চেয়ারে বসে চা খাওয়ার সময় রামকান্ত-ললিতা দুজনকেই ডাকলেন। শান্ত গলায় ধীরে ধীরে বললেন “শোনো, তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। তোমাদের ছোটবাবু, ঠিক করেছে তাঁদের নিজেদের ফ্ল্যাটেই থাকবে, আর আমারও এই বয়সে নিজেদের আস্তানা ছেড়ে আর অন্য কোথাও যেতে মন চাইছে না। তোমাদের দাদা অনেক পরিশ্রম করে এই বয়সে এই বাড়িটা বানিয়েছেন, তাই আমাদেরও মায়া পড়ে আছে এই বাড়ির উপর। তাই এখানেই আমি থাকবো। আর তোমরাও আমার কাছেই থাকবে।”

একটু থেমে, চায়ে এক চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন “আমি এই বাড়িটা বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে যাবো।“
“বৃদ্ধাশ্রম?” একই সাথে রামকান্ত ললিতা বলে উঠলো।
“হ্যাঁ, বৃদ্ধাশ্রম, ঠিকই শুনেছো তোমরা। তবে এই বাড়ির দুটো ঘর তোমাদের নামে থাকবে। আমার মৃত্যুর পর তোমাদের অন্য কোথাও যেতে হবে না। আর আমি তোমাদের নামে কিছু টাকাও ব্যাংকে জমা করে দেবো।“

রমাকান্ত আর ললিতা শুনছে। কি বলবে ভেবেই পাচ্ছে না। মনে মনে যে খুশী হয়েছে, সেরকম নয়। এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, সেরকমই কোন ধারনা ছিলো না।

আবার শুরু করলেন হৈমন্তী। “তোমরা ভাবছো, এ আবার কি? কিন্তু জেনে রাখো, তোমরা দুজনে আমাদের যে সেবা এতদিন করে এসেছো, এবার আমার পালা তোমাদের কিছু দেওয়ার। আমি অপুকে যে চোখে দেখি, তোমাদেরও সেরকম। অপুর অনেক আছে, আরও হবে। ওর ভবিষ্যতের জন্য চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু আমি না থাকলে এরপরে তোমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাই তোমাদের ভবিষ্যাতের জন্যই এই ব্যাবস্থা করে যাচ্ছি।“

রমাকান্ত ললিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে শুনছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। হৈমন্তী চায়ে আরেকটি চুমুক দিয়ে আবার বললেন “তোমরা এখানেই থাকবে, এটাই আমার ইচ্ছে। এই বাড়িতে তোমরা অনেক কাজ করেছো, এবং চাইছি তোমরা তোমাদের শেষ দিনিগুলোও এই বাড়ির দ্বায়িত্ব নিয়ে থাকবে। তাহলেই আমিও শান্তিতে যেতে পারবো।“

রমাকান্ত আর ললিতার চোখে জল ধরে রাখতে পারছে না।
শান্ত গলায় হৈমন্তী বললেন “কাদিস না রে, কাঁদিস না। তাহলে আমিও যে চোখের জল আর আটকাতে পারবো না”।

Sahityika Admin

Add comment