সাহিত্যিকা

একমুঠো অক্সিজেন (একুশে জানুয়ারীর মহামিলন) ৫০ বছরের স্মৃতি, ১৯৭৩ – ২০২৩

একমুঠো অক্সিজেন (একুশে জানুয়ারীর মহামিলন) ৫০ বছরের স্মৃতি, ১৯৭৩ – ২০২৩
কমল হালদার, ১৯৭৩, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সুকৃৎ বসু, ১৯৭৩ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

মনের দূরবীন এ দেখা -মহা বন্ধু মিলন সুবর্ণ জয়ন্তী- ২১.১.২০২৩-বিক্কলেজ
———————————————————————

গত ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ (Engineers’ Day) তে দুর্ভাগ্যবশত: বাড়িতে পড়ে গিয়ে আমার ডান পায়ের কোমরের হাড় ভেঙে যায়। বড় অপারেশন হয়। এখনও সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। তাই কলেজের ১৯৬৮-৭৩ এর ব্যাচমেট দের ২১/১/২০২৩ এর সুবর্ণ জয়ন্তী মহামিলনে সশরীরে যোগ দিতে না পেরে বড়ই আফশোস বোধ করেছি। মন পড়ে আমাদের প্রিয় বিক্কলেজের সব সুখস্মৃতি রোমন্থনে, যেখানে পাঁচটা বছর কাটিয়েছি কতই না আনন্দে!

কিছু বন্ধুর অসীম উৎসাহে এক বছর ধরে তিল তিল করে প্ল্যান করে অবশেষে ২১শে জানুয়ারি ২০২৩ এ হলো আমাদের অভূতপূর্ব মহামিলন – দূর দূর থেকে বন্ধুরা এসেছে। যেমন সুদূর USA থেকে প্রিয়, শ্যামা। ওরা আগে থেকেই বুকিং করে Alumni Guest Houseএ উঠেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকে আগেই এসে গেছে– যেমন পার্থ, গৌতম (বম্বে)!

সকাল থেকে শুরু হলো রেজিস্ট্রেশন, সুন্দর Breakfast, আর সোনার প্লেট লাগানো Memento দিয়ে। তারপর ইনস্টিটিউট হলে সুন্দর গান, কবিতা, আর মজার মাধ্যমে। বন্ধু তপনের সুষ্ঠু পরিচালনা মনে রাখার মতো। অমিয় নিমাই ভট্টাচার্যর কবিতা পাঠ, রাজশ্রী ভট্টাচার্য গান সবাইকে মুগ্ধ করে দিলো। এরপর কলেজের ফার্স্ট লবির সামনে বসে পুরো গ্রুপ ফটো – সে এক অন্যরকম nostalgic ছোঁয়া এনে দেয়।
দুপুরে পেলাম অসাধারণ লাঞ্চ। তারপর সস্ত্রীক কলেজ ঘুরে দেখা, 1968-73 friendship Golden Jubilee Celebration পেছনে রেখে ফটো তোলা! সব মিলিয়ে প্রোগ্রাম টা ছিল দারুন! হৈচৈ তে আনন্দে ভরা!

আগেই বলেছি, শারীরিক কারণে যেতে পারিনি। কিন্তু বন্ধুদের মারফৎ আমি running commentary পাচ্ছিলাম। পরমবন্ধু প্রদোষ বন্দোপাধ্যায় জানালো- তোর কবিতাটা ভালো হয়েছে। পড়ে শোনাবো সবাই কে? ….. পরে জানালো পড়ে শোনানো হ’লো এই মুহূর্তে!
এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে ছিল – অনুষ্ঠান ও আমার মনের দূরবীন এর!
গ্রুপের WA 73 Batch BEC 50yrs এ নানা খবর আসছিলো – শ্যামা, পার্থদেব, ডাক্তার,
শ্যামল এক গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে – এই মাত্র রওনা দিল বাড়ি থেকে কলেজ এর উদ্দেশ্য।
Breakfast এর ছবি -নেতাজী ভবনের মধ্যে।
সঞ্জয় উবাচ: এর মতই সব কিছু মনের দূরবীন এ।

আমি লিখে এক কবিতা পাঠিয়ে ছিলাম – WA এ বন্ধু দের উদ্দেশ্যে।
“বিক্কলেজ’৭৩- সুবর্ণ জয়ন্তী বন্ধু মিলন”
বিশ-তেইশের, একুশে জানুয়ারি -এলো সে মহান দিন,
বিক্কলেজ ‘৭৩ , বন্ধু -মিলনের সুবর্ণ জয়ন্তী দিন!
” হু -ও” দিয়ে স্বাগত জানাই, হুল্লোড় দিয়ে বাঁধাই,
রোমন্থনে মাতি মোরা, অটুট- বন্ধুত্ব শপথের সানাই!!
এটা পড়ে শোনানো হয়েছিল ইনস্টিটিউট হলে।

এই সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে বন্ধুদের মহামিলনের সফলতার পেছনে কোর কমিটি ছাড়াও অনেক উদ্যোগী
বন্ধুরা আছে – প্রদোষ, সন্দীপ চ্যাটার্জী, হিমাদ্রি, রিত্তিক, সন্দীপ মুখার্জি, চিত্ত, তপন, শ্যামল, শ্যামা, পার্থ, গৌতম(বম্বে), এস কে লাহিড়ী, নির্মাল্য, সুজিত ভকত, ইড্ডি, ডাক্তার, কমল সিমলাই-স্মৃতি, মনোজ, কল্যাণ, নিলয়, সুব্রত, কমল হালদার, চন্দ্রশেখর, অমিয়, মলয় বাগ, মৃগাঙ্ক, অমিত এরকম অনেকেই (স্মৃতি এখন আর প্রখর নয়। অনিচ্ছায় যদি নাম বাদ পড়ে, আমি ক্ষমাপ্রার্থী) সঙ্গে উৎসাহী Her highness দের অদম্য উৎসাহ দান, তিল তিল করে সাফল্য এনে দিয়েছে।

এই মহা মিলন ভোলার না। ৬৮ সালের প্রায় তিন’শ বন্ধুর বোঝাই সেই জাহাজ যাত্রায় আজ পঞ্চাশ বন্ধু আমরা হারিয়েছি। তবে এই পঞ্চাশ বছরেও আমাদের বন্ধুত্বের টান অপরিসীম -তাই উপস্থিতিতে ভাটা পড়ে নি – প্রায় সস্ত্রীক পঁচাত্তরের ওপর!

সকলের সুস্থ ও সুন্দর জীবন কাটুক এ প্রার্থনা করি।
শুভম…

আমি খুব ভাগ্যবান যে সুন্দর একটা বন্ধুদের গ্ৰুপ “50 years of BEC friends” পেয়েছি। আর সেই গ্ৰুপের CC (Core Committee) member দের বিগত এক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ততোধিক সুন্দর এই অনুষ্ঠান, যেন একমুঠো অক্সিজেন। Teen age এর সেই রঙীন দিনগুলোর কথা মনের মনিকোঠায় স্মৃতির গহ্বর থেকে বার করে নিয়ে আসার অনুভূতি। তাই আলাদা করে CC ও অন্যান্য বন্ধুদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। আমি এই গ্ৰুপে নবাগত। বছরখানেক আগে এখানে যোগদানের সোপান আমার পাড়ার বন্ধু চন্দ্রশেখর ব্যানার্জী।

সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর শিবপুর বি ই কলেজের ফার্স্ট গেট দিয়ে যখন ঢুকছি তখন হৃদয়ের দোলা মনটা নাড়িয়ে দিলো। তারপর অ্যালুমনি গেষ্টহাউস, ইনস্টিটিউট হল পেরিয়ে আমার মন্দির কলেজ বিল্ডিং দর্শনে পুলকিত হয়ে উঠলাম। একটু এগিয়ে নেতাজিভবনে নেমে দেখি ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’ পুরোনো বন্ধুর দল। সে এক অনাবিল আনন্দ। রেজিস্ট্রেশন পর্ব ও Memento নেওয়ার পর আড্ডা শুরু। এক ফাঁকে কলেজের ফার্স্ট লবিতে গেলাম। কলেজ বিল্ডিং এর লাগোয়া বাগানে নীচু হয়ে মাটি স্পর্শ করলাম। হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এল রে! কি যে আনন্দ হলো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না!! এরপর ব্রেকফাস্ট করলাম কড়াইশুটির কচুরি, আচারী আলুর দম, ছোলার ডাল, জয়নগরের মোয়া আর চা দিয়ে।

তারপর পুকুর পাড়ে ক্লক টাওয়ারের পাশে অসাধারণ সুন্দর ফ্লেক্সের সামনে Couple photo তুলে institute hall এসে বসলাম। প্রসঙ্গত এই ফ্লেক্সটার ডিজাইন ও প্লানিং বন্ধু স্বপন লাহিড়ীর, ওকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। ক্লক টাওয়ারের পাশ দিয়ে যখন আসছি সে আর এক শিহরণ, মাথা নামাতে ইচ্ছে করছিল না। যেন দেখি বারবার!!

আবার এলাম ইনস্টিটিউট হলে। উদ্ধোধনী সঙ্গীত দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হলো। তারপর নাচ, গান, আবৃত্তি, কুইজ। অনুষ্ঠান এগিয়ে চলেছে। ওদিকে তখন ডাক এলো গ্ৰুপ ফটো তোলার জন্য ফার্স্ট লবিতে বন্ধুরা জড়ো হচ্ছে। তখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি। ভিতরে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর বাইরে বন্ধুদের নির্ভেজাল কলরব। কলেজ ও হোস্টেল লাইফের স্মৃতি রোমন্থন, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন। আমিও গুটি গুটি পায়ে ফার্স্ট লবির দিকে হাঁটা দিলাম। আর মিসেস রইলো হলের ভিতরে গানের অনুষ্ঠানে। কত বন্ধু ‘না ফেরার দেশে’ চলে গেছে !! কত বন্ধু বিদেশে রয়েছে। কত বন্ধু ব্যাক্তিগত, শারীরিক বা পারিবারিক কারণে আসতে পারেনি।

বাইরে এসে দেখা হলো দ্বিতীয় শ্রেনী (১৯৫৮) থেকে আমার স্কুলের সহপাঠী গৌরীবাড়ির ছেলে বন্ধু অজিত ঘোষের সঙ্গে। পৃথিবীটা গোল, তাই অজিত ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে ফার্স্ট হয়ে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে চলে যাবার পর আবার দেখা হলো বি ই কলেজে। কলেজে থাকাকালীন অজিত “মামু” নামে পরিচিত হলো। তারপর পাশ করে বেরিয়ে যাবার পর আর দেখা সাক্ষাত নেই। অবশেষে ২১ জানুয়ারি অজিত ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য মহামিলন উৎসবে আসায় আবার আমাদের দেখা হলো।

গ্ৰুপ ফটো তোলার পর আমরা নেতাজি ভবনে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দিলাম। এলাহী আয়োজন। দেরাদুন চালের ভাত, মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, স্যালাড, ফিস ফ্রাই, ধোকার ডালনা, দই কাতলা, মটন কষা, আমের চাটনি, জলভরা সন্দেশ আর পান।

এরপর গেলাম Campus visit এ। প্রথমে সাহেবপাড়ায়। স্মৃতির সরণী বেয়ে ১৫ নম্বর হস্টেলে (আমার সেকেন্ড, থার্ড আর ফোর্থ ইয়ার) আর সেনগুপ্ত হলে (আমার ফাইন্যাল ইয়ার); নকশাল আন্দোলন ও টালমাটাল শিক্ষা ব্যাবস্থার সময় আমরা যেখানে কাটিয়েছি। কখনও বাড়ি আর কখনও হোস্টেল। সেই দুঃস্বপ্নের নগরীতে (ক্যাম্পাস) কাটানোর দিনগুলোর কথা ভাবলে আজও মনে শিহরণ জাগে। কত বন্ধুকে আমরা হারিয়েছি সেই সময়। তারপর কলেজের পিছন দিক দিয়ে ওয়ার্কশপ, মডেল স্কুল, সুইমিং পুল পার হয়ে Downing হোস্টেলের সামনে এলাম। ওখানে বন্ধু চন্দ্রশেখরের ছবি তুললাম। বন্ধু যে ঘরে থাকতো সেখানে একসময় নারায়ণ সান্যাল থাকতো। বলা হতো 10 Downing; ওখান থেকে জিমনেসিয়ামের পাশ দিয়ে এলাম ১৩ নম্বর হস্টেলের সামনে। ১৯৬৮ সালে জুলাই মাসে এখানেই বাবার সঙ্গে ২০২ নম্বর ঘরে প্রবেশ। আমাদের ঘরের জানলায় ১২ নম্বর আর ডাউনিং এর মাঝখান দিয়ে জাহাজ দেখা যেতো। অনেক বড় বড় ক্রেনের আনাগোনা দেখতাম। গঙ্গার উল্টোদিকেই গার্ডেনরীচ। জাহাজে মাল লোডিং আন-লোডিং হতো। সন্ধ্যার পর যখন আলো ঝলমল করতো, ভারী সুন্দর দেখতে লাগতো। সে এক মনমুগ্ধকর নয়নাভিরাম মায়াবী দৃশ্য। প্রায়ই জাহাজের ভোঁ শোনা যেতো। সেইসব দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর ওই হোস্টেলের পুরোনো দিনের কথা – “স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে”। তারপর মুচিপাড়া ঘুরে আবার নেতাজি ভবনের সামনে এসে গাছতলায় বসলাম। আবার আড্ডা চলতে লাগলো কফি, কেক, কুকিস সহযোগে। এবার ঘরে ফেরার পালা।

ভরপুর জীবনিশক্তি আর একবুক অক্সিজেন নিয়ে বন্ধুদের বাই বাই জানালাম। কল্পনার অনুভবে বিদ্রোহী মন হাতড়ে ফেরে সোনালী অতীত। সে যে বুক ভরা অম্লজান (অক্সিজেন)। ক্লান্তি থেকে মুক্তি। বিষণ্ণতা থেকে আনন্দ। অন্ধকারের মাঝে আলো। পথ চলার পাথেয়।

কলেজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে। আবার আসিব ফিরে এই আশা নিয়ে ক্যাম্পাসের ফার্স্ট গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

Sahityika Admin

Add comment