আমি নারী, ও মনের কিছু কথা
বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
নারী দিবসের পোস্টগুলো পড়তে পড়তে কিছু মিছু কথা মনে এল। আমরা ইঞ্জিনয়ারিং পাস করেছি ১৯৮৬ সালে, মানে আজ থেকে ৩৬ বছর আগে। সেই অর্থে ধরতে পারি আমরা হচ্ছি প্রথম প্রজন্মের মহিলা প্রযুক্তিবিদ। এর আগে নিশ্চয় অনেক মহিলা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তবে তাঁরা শতকরা হিসাবে সংখ্যায় এতই কম যে তাঁদের ঠিক প্রজন্ম বলে ধরা যায় না, বরং ব্যতিক্রম বলে ব্যক্তিগতভাবে বাহবা দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সময় শিবপুর বি ই কলেজে সব মিলিয়ে পড়ুয়া ছিল ১২০০জন তার মধ্যে সাকুল্যে ১২০ থেকে ১৫০ জন মেয়ে – মানে মাত্র ১০%। সেই বছর আমরা সাতজন মেয়ে মেটালারজী নিয়ে ভর্তি হলাম। সেই সময় মেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে শুনলে শুভানুধ্যায়ী জনগণের প্রথম রিঅ্যাকশন হত –“ মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার! বিয়ে হবে না তো! ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।“ এদিকে কলেজে, ক্লাসের ছেলেরা উঁচু গলায় এবং স্যারেরা নিচু গলায় বলতেন – মেটালার্জীতে মেয়েদের চাকরী কোথায়? সারাজীবন বেকার থাকতে হবে ! তো আমরা কজন শুরু থেকেই এহেন অপূর্ব ভবিষৎবাণী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। তখন মেয়েরা অনেকেই শাড়ি পরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত, সালোয়ার কামিজ কলকাতা চত্বরে এলেও সকলের ওয়ার্ডোবে কায়েমি হয় নি। তার ওপর অত ছেলে পুলের মাঝখানে আমরা টিম টিম করছি কটি মেয়ে, মাঝে মাঝেই উড়ে আসত রসভরা টিপ্পুনী, অজ্ঞাতকুলশীল রসিকজনের থেকে। শাড়ি পরেই ক্ষান্ত দিয়েছিলাম বোরখা পরার বায়না ধরিনি, এই যথেষ্ট। আজ ভুলে গেছি কি ল্যাব ছিল, স্মিদি কি ফাউন্ড্রি – ললিত লবঙ্গলতা শাড়ি পরিহিতা সদ্য তরুণীদের দেখে পুলকিত হওয়ার বদলে স্যার লাগালেন আচ্ছা ধমক – “এই শাড়ি টাড়ি ল্যাবে চলবে না, কাল থেকে অন্য কিছু পরে আসবে!”
তখন অপরিচিত, অর্ধপরিচিত, সদ্যপরিচিত নিজের ইয়ারের ছেলেদের উঁচু গলায় “তুই” করে ডাকতে গিয়ে বিষম খাচ্ছি – কি করব, এটাই নাকি কলেজের নিয়ম। তবে আমার কিন্তু খুব ভাল লাগতো, জেন্ডারের বেড়াটা এখানেই প্রথম ভাঙা হল , এরপর চালাও পানসী বেলঘরিয়া – যত চাও আড্ডা মারো – সাহিত্য, রাজনীতি, সামাজিক ঘটনা, হাসি ঠাট্টা, এমন কি নিজের মনের কথা, নিজস্ব কথা – কোন ছেলের সঙ্গে মনখুলে গল্প করতে গেলে তার প্রেমে পড়তে হবে এমন বিধান আবার কোন শাস্ত্রে লেখা আছে!
কলেজের চার বছর তেমন বিরাট কোন বৈষম্যের শিকার হতে হয় নি। তবে আমরা মেয়েরাও যে ভাল একটা চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে ছেলেদের মতই উৎকণ্ঠায় আছি, আমরাও যে একটা করপোরেট কেরিয়ার গড়তে চাই , এটা শিক্ষক মহাশয়রা ঠিক বিশ্বাস করতে চাইতেন না, সিরিয়াসলি নিতেন না আমাদের। শিক্ষার অর্থকরী দিকটাতে মেয়েদের প্রবেশটা একটু অনধিকার চর্চা বলে ধরে নেওয়া হত। প্রায়ই ক্লাসের কিছু ছেলে অভিযোগ করত যে মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া মানে একটা সীট নষ্ট করা ! ওদের বক্তব্য ছিল যে মেয়েরা নিজেরাও চাকরি করবে আবার বিয়েও করবে চাকরি করা ছেলেকে। সে ক্ষেত্রে একটা ছেলে চাকরি পেলে একটা পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেয়, বেকার এক বউ সহ । ওদের কথায় মনে হত যেন আমরা ছেলেদের হকের একটা চাকরী ছিনিয়ে নিচ্ছি। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অর্থনৈতিক ভাবে ভাল জায়গায় আছে সেই সব মেয়েদের এক একটি বেকার ছেলের দায়িত্ব নেওয়া উচিত । অঙ্কের থিওরি হিসাবে ঠিকই ছিল, কিন্তু বিয়ে তো শুধু অঙ্কের হিসাবে অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা নয়, সামাজিক প্রথা ও বটে। মেয়েরা চাকরি করে নিয়মকরে বেকার ছেলে বিয়ে করলে অনেক পুরনো সামাজিক প্রথার পরিবর্তন চাইতে পারে, সেই সব নিয়ম বদলাতে ছেলেরা কি রাজি হবে ? রোল রিভার্সাল করতে চাইবে কি তারা? এখন তো প্রায় সব পরিবারে স্বামী স্ত্রী দুজনেই কাজ করে, সংসার দুজনের রোজগারেই চলে। সামাজিক অবস্থান কিন্তু মেয়েদের একই রয়ে গেছে । বিয়ের পরে মেয়েরা তার নিজস্ব রোজগারে নিজের বাবা মায়ের দেখাশোনা করলে অনেক ক্ষেত্রেই আপত্তি ওঠে, সে বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হলেও ওঠে। আর বৃদ্ধ বাবা মাকে নিজের কাছে এনে রাখা – এখনও খুবই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত , বাড়ির লোণের ভার সমান ভাবে বহন করা সত্বেও, বাবা মায়ের নিজের বাড়ি না থাকলেও, বাবা মা অসুস্থ, দেখার কেউ না থাকলেও – মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি এসে থাকলে এখনও “কথা ওঠে” । ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, আমি সাধারণত যা হয় সেই কথা বলছি। পুত্রবধূকে ভিলেন বানিয়ে বৃদ্ধাশ্রম সংক্রান্ত প্রচুর গল্প উপন্যাস পড়ি , কিন্তু মেয়েটির নিজস্ব রোজগার থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সামাজিক চাপে প্রয়োজনের সময় বাবা মার পাশে দাঁড়াতে না পারার অসহায়তা নিয়ে খুব একটা লেখালিখি চোখে পড়ে নি।
যাই হোক কলেজে সমস্যায় পড়লাম ফোর্থ ইয়ারে চাকরি খোঁজার সময়। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি প্রাইভেট ফার্মে অলিখিত নিয়ম আছে মহিলা রিক্রুট করা হবে না। এক নামকরা মাল্টিন্যশনল অ্যালুমিনিয়ম কোম্পানি জানালো , মহিলাদের নেওয়া যাবে না, ওদের ফ্যাক্টরিতে লেডিস টয়লেট নেই! আরেক জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল – মেয়েদের চাকরি দিলে মেটার্নিটি লিভে চার মাস যে ম্যান আওয়ার নষ্ট হবে, সেটা কি ভাবে পুষিয়ে দেব? আমি উত্তর দিয়েছিলাম , বাচ্চাটা তো একা মায়ের নয়, পুরো দেশেরও তো নাগরিক। যদি বড় হয়ে একটা কেউ কেটা হয় তখন তো সমস্ত দেশ তখন এগিয়ে আসবে “আমাদের ছেলে ” বলে তার কৃতিত্বে ভাগ বসাতে। তাহলে দেশ একটু না হয় ম্যান আওয়ার ইনভেস্ট করলোই বাচ্চাটির ওপর। আমার এ হেন যুক্তি তাদের পছন্দ হয় নি, আমি চাকরিটা পাই নি।
এখন তো সময় অনেক বদলেছে, আমরা যে যে অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিলাম তার অন্তত কিছুটা সমাধান করা গেছে। তবে এখনও , কর্পোরেটে মেয়েদের সংখ্যা অনেক বাড়লেও, কোম্পানির উঁচুথাকে তাদের উপস্থিতি খুবই কম। পরিবার সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি এটা নিয়েও কথা বার্তা হত, যে কোম্পানির বোর্ড রুমে মেয়েদের সংখ্যা এত কম কেন? শুধুই কি যোগ্যতার অভাব? মেয়েদের সাধারণতঃ কেন উল্লেখযোগ্য, চোখে পড়ার মত দায়িত্ব দেওয়া হয় না? যাকে বলে leading from front. যোগ্যতা নেই? কোন একটি মেয়ের ব্যর্থতাকে মহিলাজাতির ব্যর্থতা হিসাবে তুলে ধরা হয় , ছেলেদের ক্ষেত্রে তো কই তা হয় না!
আমাদের দেশে আইনত, শিক্ষিতা, কর্মরতা মেয়েদের কোন বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মুশকিলটা কি হয়, আমি বরাবর দেখে আসছি, মেয়েদের কি সে ভাল হয় সেটা মেয়েরা নিজে ছাড়া আর সবাই জানে। বেশির ভাগ সময় শুভানুধ্যায়ী ওপরওয়ালারা তাদের চারদিকে লক্ষণের গণ্ডী কেটে দেয় , তাদের হয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেয় । হয়তো ভাল ভেবেই । আগে যেমন মেয়েদের সুরক্ষার নামে অসূর্যম্পশ্যা করে রাখা হত, শোনা যায় তাদের ভালর জন্যই , কিন্তু কালক্রমে দেখা গেল এতে ভালর চেয়ে খারাপই বেশি হয়েছে। লক্ষণের গণ্ডী ক্রমে পরিণত হয় করপোরেট গ্লাস সিলিং এ। এই বিষয়ে অন্য আরেক দিন লেখা যাবে। ব্যতিক্রম কিন্তু সবজায়গায় আছে এবং থাকে, তবে নিজেদের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে মেয়েদের বড় বেশি ঘরে বাইরে যুদ্ধ করতে হয়, বেশির ভাগ সময় যুদ্ধে হার হবে জেনেও।
কিন্তু সব যুদ্ধই শেষ হয় আরেকটা যুদ্ধের সূচনা করে। পরের বার যারা আসে তারা আগের পরাজিত সৈনিকদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেয়, স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে, তাদের যুদ্ধটা অনেক সহজ হয়ে যায়। এখনকার মেয়েদের ঝকঝকে আত্মবিশ্বাসী হার না মানা মুখগুলো দেখে খুব ভাল লাগে। অফিস করছে, সংসার করছে, মা বউ মেয়ে পুত্রবধূ, দায়িত্বশীল কর্মী, কেরিয়ার সচেতন উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক্সিকিউটিভ – এতগুলো রোল প্লে করার পর নিজেকেও খুঁজে পেতে চাইছে – এদের কাছে জীবনযাপনের কোন সহজপাঠ নেই। কখনও ঠিক ঠাক এগোচ্ছে, কখনও ভুল হচ্ছে। তা হোক, থেমে না গেলেই হল।
তাই বলি , মেয়েদের দিবস টিবস লাগে না, প্রতিটি মেয়ের এক গোপন নিজস্ব যুদ্ধ আছে, যা তাকে রোজ নিয়ম করে সকলের চোখের আড়ালে লড়তে হয়। সেই যুদ্ধের সব ক্ষত সব রক্তপাত যত্নে লুকিয়ে হাসিমুখে পৃথিবীর মুখোমুখি হতে হয় রোজ। প্রতিটি মেয়ে জানে রোজ কত অপমান , অবিচার, তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে তাকে রেসের শেষ ফিতেটা আঙুলে ছুতে হয় – দৌড়টা কিন্তু তাকেই প্রাণপণে ছুটতে হয়, কেউ তার হয়ে ছুটে দেয় না।
প্রতিটি মেয়ের প্রাণ ভোমরা লুকোনো থাকে তার স্বপ্নের মধ্যে , সংসার সেই ভোমরাকে ছুঁতে পারে না। যেখানে যতটুকু ভাঙাচোরা , ছেঁড়াখোঁড়া সুখ ও আনন্দ লুকোনো আছে তাকে লড়াই করে , যুদ্ধ করে, লুট তরাজ করে মেয়েদের সুখী হওয়া , আনন্দে থাকা। সে লোকাল ট্রেনে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতে ফিরতে গল্পের বই পড়া হোক, বা দিনের শেষে এক কলি গান, একটা কবিতা, নিদেন একটা সেলফি – ফেসবুকে আপলোড করা হোক।
“I really think a champion is defined not by their wins but by how they can recover when they fall.”
Serena Williams
Add comment