সাহিত্যিকা

অমৃতে কিছুক্ষন

অমৃতে কিছুক্ষন
উত্তম খান, ১৯৭৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

অনেককাল হয়ে গেলো, কয়েকদিনের জন্য দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারছি না। স্ত্রী শ‍্যামলীর হাঁটু ও শারীরিক সমস‍্যা, খুব একটা বেড়াতে চায় না। ঠিক করলাম, একাই যাবো। ইন্টারনেট ঘেঁটে জানলাম কুন্ডূ তীর্থ ও ভ্রমণের ‘কাশ্মীর ট‍্যুর’ প্যাকেজ! সময় নষ্ট না করে ওঁদের অফিসে গিয়ে বললাম একা যাবো, হবে কি না? টিকিটও হয়ে গেলো, আগামী ২২শে এপ্রিল শিয়ালদহ থেকে একটি দল জালিওয়ানাবাগ এক্সপ্রেসে রওয়ানা দেবো। সেই দলে আর কে কে যাবে, কিরকম জনতা যাবে, এসবের কিছুই জানি না।

শিয়ালদহ ষ্টেশনে আমার দলে আমি একাই। আশেপাশে অনেক লোকজন, অল্পবয়সী, মাঝবয়সী, প্রৌড়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অনেক রকমের লোকের ভীড়। বেশ কিছু পরিবার একত্রে যাচ্ছে। আমি একটু দূরে দূরেই। চেনা মুখ একটিও চোখে পড়ে না। তাহলে একা কি নিঃসঙ্গ হয়ে যাবো? উপায় নেই।

অনেক পরে দুজন এলেন। মা ও মেয়ে। মুখে মাস্ক, ভালো করে যে মুখখানি দেখবো, সেই সুযোগই নেই। ৬৭ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে বয়সটা মাপলাম। মেয়ের বয়স আন্দাজ ২৪-২৫ হবে, মার বলতে পারছি না, ৬৭ বছরের অভিজ্ঞতা কোন কাজেই এলো না। ওনারা মা মেয়ে একা একা যাবেন, অনভিজ্ঞতার একটু ভয় আছে। ভ্রমণ সংস্থার একজন এসব বোঝেন। “কাকিমা, আরে এত লোকজন আছে, একদম চিন্তা করবেন না।“ সামনে আমাকেই পেয়ে উনি আমাদের মধ্যে মৌখিক আলাপ করিয়ে দিলেন।

জালিয়ানওয়ালাবাগ এক্সপ্রেস ছাড়লো সকাল সাড়ে এগারোটায়। এবার দেখলাম শিয়ালদহে অত বড় গ্রুপ মনে হলেও আসলে আমাদের দলটা বেশ ছোট, আমাকে নিয়ে মাত্র তেরো জন। আমরা পরের দিন বিকেল চারটে নাগাদ অমৃতসর পৌছাবো।

ট্রেনে আমার সীট পড়েছিলো সাইডে যে দুটি বার্থ থাকে তারই একটায়। সেই মা ও মেয়ে কুন্ডূ ট্রাভেলসের ছেলেটিকে ধরে আমার পাশের সীটে চলে এলো। মেয়েটি আমার মুখোমুখি, আর মা ঠিক পাশেই। আলাপ পরিচয়ে মেয়েটি জানালো ওর নাম কাবেরী। বছর দুই আগে বেথুন কলেজ থেকে সায়েন্স অনার্স নিয়ে পাশ করে এখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের লাইব্রেরীতে চাকরী করছে। মা একশ শতাংশ হাউসওয়াইফ। কাবেরী বলেছিলো চাকরী পেয়ে মাকে তীর্থদর্শন করাবে, তাই সে চলেছে মাকে নিয়ে। মা দেখলাম চুপচাপ মানুষ।

ইতিমধ্যে কুন্ডুর ছেলেটি চা নিয়ে এসে চায়ের সাথে দু’মিনিটের একটা লেকচার দিয়ে সকলের সাথে দাদা, বৌদি, কাকা, কাকিমা, এরকম সম্পর্ক পাতিয়ে নিলো। আমি হয়ে গেলাম জেঠু। ছেলেটি আমার কাছে কৈফিয়ত চাইলো জেঠিমা সঙ্গে নেই কেন? বললাম, তিনি কেন আসেন নি। এবার আমি প্রশ্ন করলাম, আমি কাকু না হয়ে জেঠু কেন? সে আমাকে বুঝিয়ে দিলো, সত্তর বছর বয়স হলে দাদু, আর ষাট-সত্তরের মাঝখানে হলে জেঠু। সেই যে সে আমাকে জেঠু বানিয়ে দিলো, এরপর সারা ট্রিপে আমি সকলের জেঠু হয়ে গেলাম।

ছেলেটি চা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো, কাবেরী আরেকবার চা চাইলো। সুযোগ বুঝে আমিও আরেকবার নিলাম। “ভাই কিছু মনে করবে না, আমি কিন্তু ঘন ঘন চা খাই।“ ছেলেটি “আরে না দিদি, এই নিন” বলে আরেকবার চা দিয়ে চলে গেলো।

মেয়েটি সুন্দর কথা বলে, নানান বিষয়ে উৎসাহ আছে। “আসলে আমার লাইব্রেরিতে সায়েন্স ছাড়াও অনেক রকমের ম্যাগাজিন আসে, আমি সবগুলো পড়ি। ছোটবেলা থেকেই আমি স্কুল আর তারপর কলেজেও কুইজ চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। সেই জেনারেল নলেজের উৎসাহটা আজও ধরে রাখতে পেরেছি।“

ট্রেন চলছে। দুপুর দেড়টা নাগাদ সবাইকে হাল্কা স্ন্যাক্স দিলো। আর দিলো চা। বলাই বাহুল্য, কাবেরী এবারও দুবার চা নিলো। আমি হাসছি দেখে কপট রাগে বলে উঠলো, “ওরকম হাসবে না তো জেঠু”। বাব্বা, এক্কেবারে ধমক!! এইটুকু সময়ের মধ্যেই কাবেরী তাঁর নতুন জেঠুর সাথে “তুমি” সম্পর্কে চলে এসেছে।

চারটে নাগাদ ধানবাদ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই “জেঠু, একবার এসো, এসো” বলে প্রায় টানতে টানতে আমাকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে আনলো। কি ব্যাপার?
– আরে জেঠু, ধানবাদের চা ভারত বিখ্যাত। দু’এক ভাঁড় খেতেই হবে। রাস্তায় যদি চাই না খাই, তবে কিসের ট্রেন জার্নি জেঠু?
সামনের স্টল থেকে নিজের জন্য কিনলো, আমাকেও দিলো। আমি পয়সা দিতে গেলে হাঁ হাঁ করে উঠলো।
– জেঠু, তুমি কি এখন চাকরী করো?
– না, রিটায়ার্ড। কেন?
– তাহলে? আমি যখন চাকরী করি, তাই চায়ের পয়সা আমিই দেবো। ঠিক আছে?

আমার আর কিছুই বলার নেই। ট্রেনে উঠে মাকে বেশ মজা করেই সে বললো, জানো মা, এই রিটায়ার্ড জেঠু আমাদের চায়ের দাম দিতে গিয়েছিলো। মার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে উনি কিছুই বুঝলেন না। আমার রাগ হলো
– খুব মজা পেয়েছিস, না?
নিজের অজান্তেই আমার “তুই” সম্বোধনটা বেরিয়ে এলো।
এরপর রাত আটটা পর্যন্ত গয়ায় একবার, আরেকবার গোমো স্টেশনে নেমে সে চা খেলো। আর দু’বারই আমাকেও নামতে হলো। আমার জীবনে এরকম চা-খোর যাত্রী দ্বিতীয়টি আর দেখিনি।

তবে স্বীকার করতেই হবে, মেয়েটির জেনারেল নলেজ খুব ভালো। শোন নদী পেরোবার সময় আমাকে প্রশ্ন করে বসলো, “জেঠু, তুমি তো নিশ্চয়ই জানো, এই শোন নদীর ব্রিজ পৃথিবীর সবথেকে লম্বা রেল ব্রিজ?’
বললাম, সেটা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে।
– তাহলে জেঠু, তুমি যেমন কিস্যুই জানো না, তোমার বাচ্চা ছেলেও কিসসু জানে না।
– মানে?
কাবেরী কিছুই বললো না, চুপ করে মুচকি মুচকি হেসে মজা নিতে থাকলো।
– আচ্ছা জেঠু, ধরে নিলাম এটা বাচ্চা ছেলেরাও জানে। তুমি তো বললে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বলো তো এই রেলব্রিজটা, যার উপর দিয়ে আমরা এখন যাচ্ছি, সেটা কত লম্বা?
আমি চুপ করে আছি।
– সুতরাং, এক, তুমি ভুল জানো, আর দুই, যেটুকুই বা জানো, সেটাও আদ্ধেক জানো।
– মানে?
– মানে, এক, এই ব্রিজ তিন কিলোমিটার লম্বা। এরকম লম্বা ব্রিজ দেশে ক’টা আছে? তাই তোমার জানা উচিৎ। তাই বলছি আদ্ধেক জানো। আর দুই, যেটা ভুল জানো, সেটা এই যে সবথেকে লম্বা ব্রিজ এখন ভেম্বানন্দ রেল ব্রিজ।
কেন জানি না, মনে হলো, কোথায় যেন পড়েছিলাম, সাউথ ইন্ডিয়ায় একটা নতুন ব্রিজ হয়েছে, এখন সবথেকে লম্বা।
– কি জেঠু? এই ব্রিজটা কোথায়?
আমি হাত তুলে দিলাম। “তুইই বল।“
– এটা ভাল্লাপাড়ম থেকে এড়াপ্পল্লী। ভাল্লাপাড়ম একটা দ্বীপ। সেটা ২০১১ সালে কানেক্ট হয়েছে। ব্রিজটা সাড়ে চার কিলোমিটার লম্বা। সুতরাং শোন ব্রিজ এখন ভারতে দুই নম্বরে।
মাথা নেড়ে সায় দিলাম, সেরকমই কিছু একটা শুনেছিলাম।
আবার কাবেরী হাসতে শুরু করে দিলো।
– জেঠু, তুমি কি নিউজ পড় না?
– কেন আবার কি হলো?
– কারণ, এটাও ভুল। ২০১৮ সালের ডিব্রুগরের রেল ব্রিজ এখন সবথেকে লম্বা, পাঁচ কিলোমিটারের সামান্য কম।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলতে যে অবস্থা বোঝায়, আমি সেই অবস্থায়।
– তবে জেঠু, যদি ব্রম্মপুত্রের উপর দিয়ে অরুনাচল পর্যন্ত ব্রিজটা হয়ে যায়, তাহলে সেটা হবে আমাদের সবথেকে লম্বা ব্রিজ। প্রায় ন’ কিলোমিটার মতন হবে। কিন্তু সেটা রেল্ব্রিজ নয়, রোড ব্রিজ হবে।
আমার অবস্থা তথৈবচ। আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আর একটা হাটুর সমান সায়েন্স গ্রাজুয়েট আমাকে ব্রিজ নিয়ে জেনারেল ফান্ডা দিয়ে যাচ্ছে। আর তাঁর কথায় চ্যালেঞ্জও করতে পারছি না, কারণ আমার ফান্ডা নীল।
– আচ্ছা জেঠু, তুমি সবথেকে লম্বা কোন ব্রিজটা বানিয়েছো?
– আরে, আমি চাকরি করেছি ইন্ডিয়ান অয়েলে। তাই ব্রিজ বানাই নি।
– তুমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার? আর ব্রিজ বানাও নি?
কাবেরীর খুব মজা লাগলো।
– মা, শোনো, এই জেঠু বলছে সে নাকি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, অথচ সারাজীবনে একটাও ব্রিজ বানায় নি।
– এই শোন, যা বুঝিস না, বলবি না।
– ভালোই হয়েছে, তুমি ব্রিজ বানালে সেই ব্রিজ দু’দিনেই ধ্বসে যেতো।
কথা বাড়ালাম না, কি জানি আবার কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে বসবে। চেপে গেলাম।

রাতের খাবার এলো ন’টা নাগাদ। বেশিরভাগ লোকই চিকেন রাইস নিয়েছে। আর কাবেরীর জন্য না বলতেই ছেলেটি দু’কাপ চা দিয়ে গেলো। আমি হাসছি দেখে “জেঠু, খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু…” আমাকে শাসিয়ে দিলো।

পরের দিন সকালে দিল্লী। এখানে কিন্তু শ্রীমতি ট্রেন থেকে নামলেন না।
– কি রে? নামবি না, ট্রেন তো মিনিট পনেরো থামবে। চা খাবি না?
– না জেঠু, দিল্লীকে ঠিক ভরসা পাই না।

ব্রেকফাস্ট এলো ডাবল ওমলেট, ব্রেড স্লাইস, মাখন, আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ, সহজ কথায় সাহেবী কুড়কুড়ে লম্বা লম্বা করে কাটা আলুভাজা। এরপর ট্রেন চলছে, আর শ্রীমতী কুরুক্ষেত্র, আম্বালা, জলন্ধর স্টেশনে নেমে, সঙ্গে আমাকেও টেনে নামিয়ে চা খেলেন। আমি সবজায়গায় না হলেও শুধু আম্বালায় চায়ে সঙ্গ দিলাম।

বাকি রাস্তাতেও মেয়েটি অনেক কিছু বললো। কুরুক্ষেত্রে ট্রেন এলে জানালো, এখানে ভারতীয় কল্পনা চাওলার নামে মেমোরিয়াল প্ল্যানেটোরিয়াম হয়েছে। কল্পনার ব্যাপারেও বেশ কিছু তথ্য জানালো। এরপরও টুকিটাকি অনেক কথাই বললো।

বিকেল চারটের সময় অমৃতসর পৌছালাম। স্টেশনে গাড়ি তৈরি ছিলো। কুন্ডু ট্রাভেলসের ছেলেটাই সবার মালপত্তর তদারকি করে আমাদেরও বাসে তুলে দিলো। সোজা এসে হোটেলে উঠলাম। এতক্ষনের ট্রেন সফরে কিছুটা ক্লান্তিও এসেছিলো। হোটেলে আমি একটা আলাদা, মানে ডাবল বেড সিঙ্গল অকুপেন্সি রুম পেলাম। এসেই স্নান করে নিলাম, আর নিজেকে অনেকটাই চাঙ্গা মনে হলো।

ভাবছি, রুমে চায়ের অর্ডার দেবো, বেল বাজলো টুং টাং। দরজা খুলে দেখি কাবেরী।
– কিরে, কি ব্যাপার? আয় ভেতরে আয়।
– সে পরে হবে, তুমি এখন কি করছো? মানে তোমার কি প্ল্যান?
– প্ল্যান আবার কি? কাল সকালের আগে তো কিছুই নেই। ভাবছি একটু শুয়ে থাকি।
– মানে? শুয়ে থাকবে? আঠাশ ঘন্টায় সতেরো’শ কিলোমিটার ট্রেনে চেপে তুমি এখানে এসেছো শুয়ে থাকবে বলে?
কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
– চলো, চলো, গেট আপ, কুইক। স্বর্ণমন্দির যাবো, ওখানে পাল্কি বলে একটা ব্যাপার হয়, সেটা হয় রাত দশটায়, আর ভোর সাতটায়। কালকের কুন্ডুর টিমের সাথে গেলে সেটা আর দেখা হবে না।
মনে পড়লো, কামদেব বলেছিলো এই পাল্কির কথা। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম।

হোটেলের লবিতে এসে দেখলাম আরও তিন চারজন যাবে, তারাও পাল্কি দেখতে চায়। কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেলো। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। পালকি হবে রাত দশটায়, মানে রাত ন’টা নাগাদ আমাদের গিয়ে জায়গা নিতে হবে। সুতরাং মহিলারা ঠিক করলেন শপিং এ যাবেন। এই একটা রোগ। স্বর্ণমন্দির দেখতে যাওয়ার আগে শপিং। কিন্তু কিরকম শপিং হবে সেই ব্যাপারে দুই দলের মতের মিল হলো না। আমি, কাবেরী, আর ওর মা, তিনজনে মিলে অটোতে করে রওয়ানা দিলাম।

কাবেরী মনে হয় পড়াশোনা করে বেশ তৈরি হয়েই এসেছে। অটোওয়ালাকে বললো, দুর্গিয়ানা মন্দির চলো। আর আমায় খানিকটা জ্ঞানও দিয়ে দিলো, এটি ষোড়শ শতাব্দীর হিন্দু মন্দির, এর স্থাপত্য অনেকটাই স্বর্ণমন্দির ঘরানায় তৈরি, চূড়ার সোনার পাতও সেই একই ঘরানার। এর চারিপাশে পুষ্করিণীও খনন করা হয়েছে। দেবী দূর্গার নামেই এই মন্দিরটি, তবে এখানে বিষ্ণু ও লক্ষীরও পূজা হয়। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম ছিলো। এবং লোকের বিশ্বাস, রামায়ণের লব ও কুশের জন্ম হয় এই আশ্রমেই। জনশ্রুতি এই যে রামের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে ও হনুমানকে লব-কুশ এখানের দুর্গিয়ানা মন্দিরের একটি গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলো।

দুর্গিয়ানা মন্দিরে গিয়ে মনে হলো, এখানে না আসলে আর কাবেরীর ঐতিহাসিক আর পৌরাণিক তথ্যগুলো না জানলে অমৃতসর ট্রিপটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। কাবেরীকে ডেকে বললাম, থ্যাংক ইউ। সে বুঝলো না, হঠাৎ থ্যাংক ইউ? কেন?
– তুই আগে থেকে আমাকে ব্রিফ না করে দিলে এই মন্দিরের ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্টই হতো না।
– ওহ, এখন ইন্টারেস্ট হয়েছে? ঠিক আছে, তাহলে চলো আইসক্রীম খাওয়াও।
– আইসক্রীম খাবি?
– হ্যাঁ, খাবো। এপ্রিল মাসে অমৃতসরে এসে আইসক্রীম খাবো না?
– এখন?
– তুমি কি চাও জেঠু? ডিসেম্বরে আলাস্কায় গিয়ে আইসক্রীম খাবো? জেঠু ……, তুমি না, একটা ……, আর কি বলবো?
– হ্যাঁ, বল বল, থামলি কেন?
– না, এখন বললে তুমি আর আইসিক্রীম খাওয়াবে না। আগে খাওয়াও, তারপর।

আইসক্রীম পর্বের শেষে এবার স্বর্ণমন্দির যাবো। “জেঠু, তুমি ভাবছো, কেন এই রাতে তোমাকে স্বর্ণমন্দির নিয়ে যাচ্ছি,তাই তো? তাহলে শোনো, রাতের স্বর্ণমন্দির দেখে তারপর আমাকে জানিও, কেমন লাগলো?”
স্বর্ণমন্দিরে এসে মন্দিরের বাইরে অটোটা ছেড়ে দিলাম। একদম সামনেই আইসক্রীমের দোকান। “জেঠু, জেঠু, আইসক্রীম, আইসক্রীম।“
ওর মা সারাক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। এবার তিনিও ধমক দিলেন, “চুপ কর। পাগলের মতন চ্যাঁচাস কেনো?”
আইসক্রীম খেয়ে যেন সে শান্ত হলো। “জেঠু, পঞ্জাবের দুধের আইসক্রীম জানো তো? এক্কেবারে পাগলা। তবে জেঠু, আমাদের ধানবাদের ষ্টেশনের চাও কিন্তু কম যায় না।“
না, এই মেয়ের সাথে তক্কাতক্কি একদম নয়।

আমরা এগিয়ে গেলাম। সামনেই স্বর্ণমন্দির। নিজের মনে হলো, এর ইতিহাসটাও জানলে হয়তো ইন্টারেস্ট আরেকটু বাড়বে। কাবেরীকে বললাম। মোটামুটি সে যা বললো, ষোড়শ শতাব্দীতে, ১৫৭০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ মুঘল সম্রাট আকবর এই জায়গাটি দান করেন। এই মন্দিরের নাম হরমন্দির সাহিব। শিখ গুরু রামদাসের নির্দেশে অমৃত সারস পুষ্করিণী খনন করা হয়। সুতরাং এই পুষ্করিণী প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, এটিকে খনন করা হয়েছিলো। আর এই অমৃত সারস নাম থেকেই অমৃতসর নামকরন। এরপর ১৫৯০ সাল নাগাদ পুস্করিণীর কেন্দ্রে হরমন্দির সাহিব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই হরমন্দির সাহিবকেই আমরা সাধারণ লোকেরা স্বর্ণমন্দির বলি। এরপর সপ্তদশ শতাব্দীর একদম শুরুতে ১৬০০-১৬০৫ সাল নাগাদ শিখ গুরু অর্জুন গ্রন্থসাহিব রচনা করে এই হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করেন। বাবা বুদ্ধ সাহিব ছিলেন এর প্রথম গ্রন্থী।
– আর পাল্কি?
– জেঠু, এটি একটি অনুষ্ঠান, দিনে দু’বার হয়। রাত দশটা নাগাদ হরমন্দির সাহিবে দিনের শেষ হুকুমনামা পাঠ হয়ে গেলে, গুরু গ্রন্থসাহিবকে হরমন্দির সাহিব থেকে স্বর্ণখচিত পাল্কি সিংহাসনে সাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে সামনের অকাল তখত সাহিবে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পাল্কিকেই বলে পাল্কি সাহিব। সকলের আগে একজন ট্রাম্পেট বাজিয়ে আসেন। পিছনে ভক্তরা কাঁধে সেই পাল্কি বহন করেন। সকলের বিশ্বাস, অকাল তখতে গুরু গ্রন্থসাহিব ঐসময় রাত্রির বিশ্রাম নেন। অকাল তখতে সেইসময় গ্রন্থসাহিব বন্ধ রাখা হয়, উনার নির্বিঘ্নে বিশ্রামের জন্য কীর্তন বন্ধ থাকে, শুধু কিছু বিশেষ স্লোক উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে এইসময় হরমন্দির সাহিবের দৈনন্দিন পরিস্কারের কাজ চলে। ভক্তরাই এটি করেন।
তবুও সবকিছু বোঝা যাচ্ছে না। কোথায় যেন ডিসকানেক্ট হচ্ছে। কাবেরী বুঝতে পেরেছে।
– শোনো জেঠু, আমরা হিন্দুরা যেমন দেবদেবীর মূর্তিপুজা করি, শিখধর্মে ওরা গুরু গ্রন্থসাহিবকে সামনে রেখে প্রার্থনা করে। গ্রন্থসাহিব ওঁদের ধর্মগ্রন্থ। এই গুরু গ্রন্থসাহিব মূলত গুরু নানক, গুরু অঙ্গদ, গুরু অমর দাস, গুরু অর্জন, ও গুরু তেগবাহাদুর রচনা করেছিলেন। তবে একটু আগেই যে বললাম ১৬০০ সাল নাগাদ যখন হরমন্দির সাহিব প্রতিষ্ঠা হয়, তখন পঞ্চম শিখ গুরু, গুরু অঙ্গদ, আদি গ্রন্থটির রচনা সম্পন্ন করেন। তারপর সেই গ্রন্থটি হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করা হয়।

অবাক হয়ে সব শুনলাম। “তুই হিস্টোরিয়ান না হয়ে লাইব্রেরিয়ান কেন হলি?” মনে হলো প্রশ্নটা কাবেরীর পছন্দ হলো না।
– লাইব্রেরিয়ান হতে গেলে কত কিছু জানতে হয় সে খেয়াল তোমার আছে, জেঠু? ট্রেনে আসার সময় আমাদের রেল্ব্রিজ নিয়ে আমি তোমায় অনেক ফান্ডা দিলাম। ধরে নাও তুমি লাইব্রেরি গিয়ে সেই ভেম্বানন্দ রেল ব্রিজের উপরই একটা রেফারেন্স বই চাইলে। এবার লাইব্রেরিয়ান যদি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তাহলে কি হবে? সেইজন্যই লাইব্রেরিয়ানদের অনেক পড়াশোনা করতে হয়।
আমি জানতাম লাইব্রেরিয়ান মানে বইপত্তরের কেয়ার টেকার। আমার ধারণাটা সে পাল্টে দিলো।

পাল্কি অনুষ্ঠান শুরু হলো রাত প্রায় তখন দশটা। কামদেবের কথাই ঠিক, যদি এই রাতে না আসতাম, তাহলে ভাবতেও পারতাম না কি সুন্দর এই অনুষ্ঠান, আর কি ডিসিপ্লিন!! আর কাবেরীও আমাকে এই পাল্কির ইতিবৃত্ত আগেই বলে রেখেছিলো। এরপর রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মন্দিরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু তখন ভিতরে পর্দা টাঙিয়ে দিয়ছে। ঐ ভীড়ে মা ও মেয়ের অবস্থা শোচনীয়। আমি না থাকলে ওরা ফিরেই আসতো। সেই রাতেও চারিদিকে দলে দলে দশ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সের শিখ ছেলেমেয়েরা সেবা করে যাচ্ছে। স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গনের পুরোটাই মার্বেল পাথরে বাঁধানো। সেখানে একদল মন্দিরের সোনার দেওয়াল, অন‍্য দল রেলিং, আরেকটি দল পুরো মন্দির চত্বররের মেঝে মুছছে। সবই অবস্থাপন্ন ঘরের লোকজন। সেখানে ধনী গরীবের ভেদাভেদ নেই। আরেকদিকে বিরাট লঙ্গর চলছে, কাতারে কাতারে লোক। গুরুদ্বারের উল্টোদিকে একটা বড় মিউজিয়াম আছে, কিন্তু সন্ধ্যার পর বন্ধ। দেখা হলো না। ঐ রাতের ভীড়ে আমাদের কলকাতার পূজোয় মহ: আলি পার্ক, একডালিয়া এসবের কথা মনে এলো। কামদেব যে পাল্কির কথা বলেছিলো, সেটা দেখাও সার্থক হলো। শুনলাম স্বর্ণমন্দিরের ভিতর শিবের মূর্ত্তির রোজ পূজো হয়। কিন্তু দেখা হলো না।

রাতের পাল্কি শোভাযাত্রা দেখে মন্দির চত্ত্বরের বাইরে এলাম। রাস্তার উপরে বেশ কিছু খাবারের দোকান। সব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। রাস্তায় পরিস্কার চেয়ার টেবিল পাতা আছে। সেরকম একটা দোকানের বাইরের চেয়ারে কাবেরী বসে পড়লো। আমি কিছু বুঝে উঠে বলার আগেই কাবেরী বলে দিলো, আগে বসো, পরে কথা বলবে। দোকানীকে ডেকে অর্ডার দিলো, মালাই লসস্যি, পিতল কি গেলাস মে। দো বড়া, এক ছোটা।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ জেঠু কি যেন বলতে চাইছিলে?
– এখন রাত এগারোটা বাজে, তুই এখন লসসি খাবি?
– তাহলে অর্ডার বাতিল করে দি? তুমি কলকাতায় ফিরে গিয়ে ধর্মতলার অনাদি কেবিনে, বা আমহার্স্ট স্ট্রীটের পুটিরামের দোকানে গিয়ে কাঁসার গ্লাসে মালাই লসসি খেয়ে নিও।
না, তক্কো নয়, মেয়েটা ঠিকই বলছে। পঞ্জাবে এসে লসসি খাবো না? খেলাম। সেই কাঁসার গেলাসের লসসি খেয়ে শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তিও উধাও।
ফ্রেস হয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
কাল সকালে কুন্ডু টিমের সাথে আবার এখানেই আসতে হবে। কাবেরী বলে দিলো, আমরা যেন হোটেলে ব্রেকফাস্ট না করি। বললাম, “আরে, আমরা তো ব্রেকফাস্টের জন্য পয়সা দিয়ে রেখেছি।“
– ঠিক আছে, তুমি পাউরুটি, মাখন, ডিমভাজা খেয়ে নিও। আমি কিন্তু হোটেলের ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি না।
বুঝলাম মেয়েটি কিছু সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে, এখন এর বেশি কিছুই বলবে না।

ন’টা নাগাদ দলের তেরো জন ছোট্ট ১৭ সীটের এসি ট্রাভেলরস বাসে করে স্বর্ণমন্দির চত্তরে পৌছালাম। কাবেরী বলে দিয়েছে, স্বর্ণমন্দির মানে হরমন্দির সাহিব। শুরুতে সাহেব সাহেব বলছিলাম, সে ভুল সংশোধন করে দিলো, সাহিব হবে, সাহেব নয়। সাহিব কথাটির অর্থ হৃদয়ের গভীর সম্মান উৎসর্গ করা।

আমাদের দলে আছে
বাবা, মা, মেয়ে (বাবা রিটায়ার্ড, মা মেয়ে চাকরী করে, বয়স আন্দাজ ২৩-২৪)
বাবা, মা, মেয়ে (বাবা মা রিটায়ার্ড, মেয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার, সব‍্যসাচীর ফার্মে কাজ করে, বয়স আন্দাজ ২৪-২৫)
স্বামী, স্ত্রী (স্বামী SAIL এ কর্মরত)
স্বামী, স্ত্রী (ব‍্যবসায়ী পরিবার)
মা, মেয়ে (মেয়ে লাইব্রেরিয়ান, বয়স আন্দাজ ২৩-২৪)
আর, আমি একলা (কাবাব মে হাড্ডি)
আর দলে আছেন একজন ম্যানেজার, দুজন অলরাউন্ডার সহকারী।

সেদিন ছিলো রবিবার, তাই প্রচন্ড ভীড়। আমাদের পূজোয় মহম্মদ আলি পার্ক বা একডালিয়ার মতো। দু – একজন দর্শনার্থীকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম,ওরা আশে পাশের জেলা থেকে এসছে। দূরের লোক যেমন এসেছে, নিকটবর্ত্তী অঞ্চলেরও অনেক লোকই এসেছে। সবাই যখন হরমন্দিরের দিকে যাচ্ছে, কাবেরী আমাদের সেদিকে যেতেই দিলো না। যেহেতু গতকাল রাতে আমাদের দেখা হয়ে গেছে।

আমরা বসে আছি, দেখলাম কাবেরীর ছবি তোলার খুব শখ। বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডে সে ছবি তুলবে। আমার কাজ ছবি তুলে দেওয়া। আমি বিরক্ত হলেও, জোর করে আমাকে দিয়ে ছবি তোলাচ্ছে। ম‍্যানেজার ঐ ভীড়ে পাগলের মতন দলকে খুঁজতে খুঁজতে এদিক ওদিক করছে। আবার মাঝে মাঝে আমাদের টেরিয়েও দেখছে। রসায়নটা বুঝতে পারছে না। খানিক পরে নিজেই এসে আমাদের বললো, আপনারা পাশেই জালিওয়ানাবাগটা দেখে আসুন।

এক্কেবারে শুরুতেই বাদিকে জালিয়ানওয়ালাবাগের সদর দরজা। আমরা সেদিকে গেলাম। এখন অনেক গ্যালারী বানিয়েছে, তাতে হাল্কা সাউন্ড আর আলো, আর ছবি সহ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জালিয়ানওয়ালাবাগের ইতিহাসটা তুলে ধরেছে। সেই অভিশপ্ত কূঁয়োটা দেখলাম যেখানে অনেকে প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপ দিয়েছিলো, আর পরে লাশ স্তূপাকৃত করে ফেলা হয়েছিলো। দেওয়ালে গুলির দাগগুলো সযত্নে মার্ক করে রাখা আছে। এসব দেখে যখন একটা নিদিষ্ট জায়গায় সকলে ফিরলাম, তখন বাকী দল স্বর্ণমন্দির দেখে ফিরলো। সময়ের বাধ‍্যবাধকতা থাকায়, বাকিদের আর জালিয়ানওয়ালাবাগ দেখাই হলো না। এবার দলের সকলে দূর্গিয়ানা মন্দির যাবে। আমরা জানালাম যে গতকালই দেখে এসেছি, তাই আজ আর যাবো না। আমরা তিনজনে থেকে গেলাম, বাকীরা চলে গেলো।

জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে বাইরে আসার জন্য একটা গলিপথ দিয়ে সামনের দিকে আসতে হয়। কাবেরী আমাদের সেই গলিতে ডেকে নিয়ে গেলো। “জেঠু, তোমার তো ব্রেকফাস্ট হয় নি। চলো, আজ আসল পঞ্জাবী পরোটা, সাদা মাখনে ফ্রাই করা, তোমাকে খাওয়াই, সঙ্গে পঞ্জাবী দাল মাখানি।“
মেয়েটা মন্দ বলে নি। এবার মনে হলো যে এইজন্যই হোটেলে আমাদের ব্রেকফাস্ট করতে দেয় নি?
স্টীলের থালায় পরোটা দাল মাখানি, সঙ্গে লঙ্কা আর আচারও আছে। অপূর্ব। এই পরোটা আর দাল মাখানি কলকাতার পঞ্জাবী রেস্তোরাঁতেও পাবো না। এরপর বাইরে এসে ছোট কাঁসার গ্লাসে মালাই লস্যি। তখন বাজে প্রায় বারোটা। সুতরাং আজ লাঞ্চে আর কিছুই নয়।
এবার হোটেলে ফিরবো। অতই সহজ? আবার আইসক্রীমের দোকানের সামনে কাবেরী দাঁড়িয়ে পড়লো। সেই আইসক্রীম খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। এখন ঘন্টা দুয়েকের বিশ্রাম, তারপর ওয়াগা বর্ডারের প্যারেড দেখতে যাবো।

ওয়াগা সীমান্ত অমৃতসর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। পৌঁছলাম বিকেল চারটে নাগাদ। এখানে আমাদের বিএসএফ সেনাদের প্যারেড না দেখলে অমৃতসর ট্রিপ অপূর্ণ থেকে যাবে।

চারটা নাগাদ হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে একজন কম্যান্ডিং ফৌজি অফিসার এলেন। প্রাথমিক জয় হিন্দ, ভারতমাতা কি জয়, বন্দে মাতরম ইত্যাদি বলে আসরটাকে একটু নয়, অনেকটাই চাঙ্গা করে দিলেন। সারা স্টেডিয়াম জুড়ে সাউন্ড সিস্টেম, তার সাথে আমাদের স্লোগানের আওয়াজে চারিদিক গমগম করছে। আর উনি লম্বা স্টেডিয়ামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। হাতের, বডি ল্যাঙ্গুয়েজের কায়দায় বারবার বোঝাচ্ছেন যে আওয়াজ আরও জোরে চাই। হাতের ইশারায় বারবার বোঝাচ্ছেন, আমাদের এই আওয়াজ বর্ডারের ওপারে পাকিস্তানে পৌঁছানো চাই।

চারটা দশ নাগাদ অনেক ছেলেমেয়ের একটা দল এলো, প্রায় তিরিশ চল্লিশ জনের। এরা সবাই দর্শনার্থী। অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে। বিএসেফের ফৌজিরা এঁদের ধরে এক একবারে চারজন করে স্টেডিয়ামের মাঝখানের রাস্তায় আমাদের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করালো। সারা স্টেডিয়াম তখন ওঁদের তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে। তালি বা আওয়াজ কম হলেই সেই ফৌজি কম্যান্ডার বলছেন, আওয়াজে আরও জোর চাই। এর মিনিট দশেক বাদে, মানে চারটা কুড়ি নাগাদ ফৌজি কম্যান্ডার মাইক্রোফোনে ঘোষনা করলেন, মেয়েদের মধ্যে যারা নাচতে চায়, তাঁরা নীচে নেমে আসতে পারে। এটা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যই। জনতা এমনিতেই চাঙ্গা ছিলো। এই ঘোষনা শোনামাত্রই সারা স্টেডিয়ামের কোনা কোনা থেকে মেয়েদের দল সব দৌড়ে দৌড়ে নেমে এলো।

এবার শুরু হলো নাচ। পাকিস্তান বর্ডারের সামান্য দূরত্বে পাকিস্তানকে সামনে রেখে সারা স্টেডিয়াম জুড়ে গান চলছে হামসে যো টকরায়গা, আর সেই গানের সাথে নাচছে প্রায় হাজার খানেক ভারতীয় মেয়ে। তাল মিলিয়ে সাপোর্ট দিচ্ছে পুরো স্টেডিয়াম। মেয়েরা, কেউ একজন অন্য আরেকজনকে চেনে না, তবু হাতে হাত ধরে দলবেঁধে হিউম্যান চেইন বানিয়ে স্বতঃফুর্ত হয়ে নেচে চলেছে। আর ফৌজি কম্যান্ডারের ভূমিকা তো আছেই। এই নাচ চললো প্রায় মিনিট চল্লিশেক। এর ফাঁকে ফাঁকেই ফৌজি কম্যান্ডারের সাথে তাল মিলিয়ে সারা স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে বারংবার আওয়াজ উঠছে
– হিন্দুস্তান
– জিন্দাবাদ
– ভারতমাতা কীইইইইইই
– ঝয়য়য়য়য়য় (কেন জানিনা, জয় বলতে গিয়ে আমার ঝয় বেরিয়ে আসছিলো)
– বন্দে
– মাআআআআতরম

এরপর প্যারেড করে এলো আমাদের বিএসএফ এর জওয়ানরা। বর্ডার থেকে আন্দাজ ৭০ মিটার দূরে আমাদের সীমানায় এসে দাঁড়ালো। একদম প্রথম সারিতে দু’জন বিএসএফ মেয়ে। ড্রিলের শুরুতে এই দুটি মেয়ে হাতে তরোয়াল উঁচিয়ে ধেয়ে গেলো বর্ডারের দিকে। এই ড্রিলকে সঠিক বর্ণনায় কি বলবো জানিনা। যেভাবে, মানে যে স্পীডে মেয়ে দুটি এগিয়ে গেলো সেটা ঠিক হাঁটা নয়, প্রায় দৌড়ে ধেয়ে যাওয়াই বলা চলে। মানে আমরা যদি কাউকে তাড়া করি, বা আক্রমণ করার জন্য ধেয়ে যাই, অনেকটাই সেইরকম। তারপর বর্ডারের গেটের সামনে গিয়ে এক্কেবারে কাঁধের উপর পা তুলে একটা এয়ারকিক। পাকিস্তানের তরফেও একই রকম ড্রিল দেখলাম। এই ড্রিল উভয় দেশের মধ্যে সিনক্রোনাইজড। এরপর একে একে ভারতীয় বিএসএফ জওয়ান ড্রিল করে চলেছে। একটু আগেই যা বললাম, একদম যাকে বলে ধেয়ে যাওয়া, অনেকটাই যেন “আজ তোকে শেষ করে দেবো”, এই শারীরিক ভাষায়। তারপর বর্ডারে গিয়ে এয়ারকিক, যা কাঁধ ছাড়িয়ে যায়। তারপর বুকের ছাতি দেখানো, সবই নিঃশব্দ শারীরিক ভাষায় শত্রুকে নিজের শৌর্যের প্রকাশ, অবশ্যই ফৌজি কায়দায়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে দুই দেশের বর্ডারের গেট খুলে দেওয়া হয়। আমাদের বর্ডার গেট তেরঙ্গা রঙের। আর সবার শেষে Beating Retreat. সূর্যাস্তের ঠিক আগে দুই দেশের জাতীয় পতাকা একই সাথে নামিয়ে আনা হয়। তারপর দুই দেশের জওয়ানরা হাত মেলায়। এই বিশেষ শারিরীক ও মুখচোখের ভাষার হাত মেলানোকে ইংরেজি ভাষায় বলবো brusque handshake। এর মানে quick and direct in manner or speech, and often not polite. If you describe a person as brusque, you mean that they seem to be rude এই প্যারেড এককথায় ফৌজি ভাষায় displaying the two countries’ rivalry আবার দুই দেশের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকারিভাবে বলতেই হয় an effort to display of brotherhood and cooperation between the two nations. কিন্তু যেটা পাওনা, সেটা আমাদের মতন সাধারণ দর্শনার্থীদের একটা জাতীয়তাবোধের চেতনা। এই ড্রিল দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই সেই জাতীয়তাবোধ বারংবার মনে চলে আসে। এই ওয়াঘা বর্ডারের প্যারেড এককথায় Lifetime Visual Experience.

Sahityika Admin

Add comment