হলুদ পাখি
সৌরীশ সরকার, ১৯৯৫ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
সেই যে হলুদ পাখি, বসে জামরুল গাছের ডালে
করতো ডাকাডাকি, আমার শৈশবের সকালে
একদিন গেলো উড়ে, জানিনা কোন সুদূরে
ফিরবে না, সে কি ফিরবে না,
ফিরবে না, আর কোনো দিন?
— ক্যাকটাস
১৯৯১ এর অগাস্ট মাসে এক রোববার বাবার সাথে তোষক ঘাড়ে করে ট্যাক্সি থেকে নেমেছিলাম সাত নম্বর হোস্টেলের সামনে। সাত কেন? আট বা দশ বা চোদ্দ বা ষোলো নয় কেন? খুব জটিল প্রশ্ন। Lorenz সাহেবের বাটারফ্লাই এফেক্টে কত কিছু বদলে যেতো তাহলে কে জানে! আমার এক ক্লাসমেট এগারোতে থাকতো – এখন সে নিউজিল্যান্ডে এক ধামাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় – সে যদি সাতে থাকতো, হয়তো ভ্যারেন্ডা ভাজতো এই আমার মতন – আর আমি জনপ্রিয় প্রফেসর হয়ে বসতাম, ছাত্র ছাত্রীরা অটোগ্রাফ নেবার জন্য লাইন দিতো?
সাতে ল্যান্ড করার আপাত সহজ কারণ ছিল ওটা আমিই সিলেক্ট করেছিলাম যেদিন হোস্টেল এসাইনমেন্ট হচ্ছিলো। হস্টেল বেছে নেওয়া কিন্তু শুনতে যেরকম সোজা, মোটেও ওরকম সোজা ছিল না! মা তো বাড়ি থেকে বলে দিলো ভালো করে দেখবি যে হোস্টেলে ভালো ছেলেরা থাকে আর সব চেয়ে বেশি পড়াশুনা করে, সেইখানে যাবি।
রেজিস্ট্রেশনের হলঘরে পৌঁছে দেখি চারিদিকে বিস্তর ভালো ভালো ছেলেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুঝলাম এনারা সিনিয়র। আর এনারাই লাইনে দঁড়িয়ে থাকা আমাদের মতন ছেলেদের মধ্যে কাউকে কাউকে ধরে বুঝিয়ে বলছে কোন হোস্টেলের নাম লিখতে হবে। আমার ভাগ্যেও ফাইনালি শিকে ছিঁড়লো – শান্ত সৌম্য দেখতে একজন এসে বললো আমার নাম চয়ন ঘোষাল – আমি ক্যাম্পাসের বেস্ট হোস্টেলে থাকি – হোস্টেল ১১। তারপর ভালো করে বুঝিয়ে বললো কেন ওটা বেস্ট। বুঝলাম যে হোস্টেল ১১ যেমনি রূপে তেমনি গুণে – পড়াশুনা খেলাধুলা নাটক ডিবেট সব দিকে চৌকস। আমিও ফর্মে ১১ লিখে বেশ ফুরফুরে মেজাজে এদিক ওদিক দেখছি, ও বাবা, সেই ফাঁকে একটা বাচ্চা ছেলে কখন যে আমার বাবাকে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছে আরে করেন কি কাকু, ওই চয়নের ভরসায় ছেলেকে রেখে যাচ্ছেন – তার চেয়ে তো ছেলের গলা কেটে ফেলা বা সিপিএম করে দেয়া অনেক ভালো!
বাবা পলিটিক্সকে ভীষণ ভয় পেতেন, মা র চেয়েও বেশি – আমায় এসে বললেন শোন সাত লেখ। আমি বললাম কিন্তু আমি যে ১১ সিলেক্ট করলাম? বাবা বললেন মেস dues কে দেবে, তুই না আমি?
পাঁউরুটির কোনদিকে মাখন মাখায় সেটা তখনো জানতাম, তাই চটপট ১১ কেটে ৭ করে দিলাম। চয়ন ঘোষাল বলেছিলো পরে আমাকে আর ঝামেলা (বাচ্চা দেখতে ছেলেটার নিকনেম) কে দেখে নেবে – সময় পায়নি হয়তো।
তা অগাস্টের সেই রোববার তোষকটাকে টেনে তো তুললাম সাতের চার তলায়। চাদ্দিকে উৎসুক জনতার চোখের চাহনি দেখে বাবাও বোধ হয় ঘাবড়ে গেছিলো – জীবনে প্রথমবার বাবাকে দেখলাম সিগারেট ধরিয়েছে। তোষক পাতার পর বললো চল একটু ঘুরে আসি। সাতের কাছেই এক প্রফেসর্স কোয়ার্টারে নিয়ে গেলো বাবা – পুরোনো ক্লাসমেট হিতেন ভড়ের বাড়ি। ডঃ ভড় বললেন তোমার হোস্টেলে কোনো ঝামেলা হলেই তুমি এখানে চলে আসবে, যত রাতই হোক, বুঝেছো?
আমিও ঘাড় কাত করলাম। বাবা আর ডক্টর ভড় চোখ চাওয়া চাওয়ি করলেন – দুজনেই বুঝলেন যে ছেলে কোনো দিন আসবে না। মিসেস ভড় কিন্তু বোঝেন নি । উনি আমাকে অনেক মিষ্টি খাইয়ে বার বার বললেন চলে আসবে যখন খুশি, কেমন?
ৱ্যাগিং পিরিয়ডের মধ্য গগনে এক দিন হঠাৎ ক্লাসে গিয়ে শুনি কলেজ বন্ধ – বদ্ধ পাগল না হলে হোস্টেলে ফেরার প্রশ্নই ওঠে না – সেদিনও ওনাদের বাড়ি না গিয়ে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে বসেছিলাম কোনো এক just be a man টাইপ কালচারে সাড়া দিয়ে।
ফোর্থ ইয়ারে ব্রিজের ক্লাস ছিল প্রফেসর ভড়ের – থার্ড ইয়ারে ১২০ লিড পেয়ে (থার্ড আর ফোর্থ ইয়ার মিলিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ঠিক হতো। থার্ড ইয়ারে বেশি পেয়ে গেলে লাস্ট ইয়ার’টা অন্যান্য pursuit of happyness এ দেওয়া যেত। তখন আমি কচ্চিৎ কদাচিৎ ক্লাস যেতাম – তবে বাবার বন্ধু, তাই ওনার জন্য নিয়মের অন্যথা করিনি। আর উনিও বাবাকে কিছু বলেননি কখনো।
বাবা মারা যাবার পর ওনাদের বাড়ি গেছিলাম বলতে।
স্যার তখন আর নেই, মিসেস ভড় বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। তবুও আমায় দেখেই চিনতে পারলেন – খুব কান্নাকাটি করলেন।
চুপচাপ পালালাম একটু বাদে।
এখন কেউ কোথাও যেতে বললেই যাই, না বললেও যাই
হলুদ পাখিটাকে আর কতদিন দেখতে পাবো জানি না যে।
Add comment