হর্ণবিলের ডাকে
সুকান্ত কুমার রায়, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
হর্ণবিল বা ধনেশ পাখি একধরনের ঠোঁটওয়ালা পাখি যার ঠোঁটগুলো শিংয়ের মতো। শিং হলো horn আর ঠোঁট হলো bill – এই দুয়ে মিলে হর্ণবিল। ধনেশ পাখিদের দেখা পাওয়া যায় প্রধানত আফ্রিকা, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে। এদের বৈশিষ্ট হলো যে এরাই একমাত্র পাখি যাদের ঠোঁটের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রথম দুটো ঘাড়ের হাড় একটা আরেকটার সঙ্গে মিশে রয়েছে। শিকার করা, খাওয়া দাওয়া থেকে বাসা তৈরি করা আরও বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুএই ঠোঁটের সাহায্যেই এরা করে থাকে। এদের অনেক প্রজাতি আছে। তারমধ্যে কিছুকিছু বিলুপ্ত প্রজাতির মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমি এখানে ধনেশ পাখি নিয়ে লিখতে বসিনি। আমার আকর্ষণ Hornbill Festival (ধনেশোৎসব কি বলা যাবে বাংলায়?), কাজেই ধান ভানতে শিবের গীত না গেয়ে সোজা পাখি থেকে উৎসবে যাওয়া যাক।
এবারের উৎসব হাঁটি হাঁটি করে তেইশ বছরে পা দিতে চলেছে। নাগা উপজাতিদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই এই উৎসব, তাই এই উৎসবের মাস তিনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় এর প্রস্তুতি। হোহো উপজাতির লোকেরা কিসমাতে মোরং বা কুঁড়েঘর মেরামত ও তৈরি করে এইসময়। প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধে যেমন বীরদর্পে হাতির দাঁতের অলঙ্কারে সেজে উঠতেন রাজা ও তার সেনাবাহিনী, তেমন ভাবেই সেজে ওঠেন নাগা আদিবাসীরা, সঙ্গী সবুজ ঘেরা পাহাড় ও নীল আকাশ।
আমাদের দেশের উত্তর পূর্ব সীমান্তে নাগাল্যান্ড একটি রাজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসের পর ১৯৬৩ সালে এই রাজ্যটি স্থাপিত হয়। আদিবাসী অধ্যুষিত এই রাজ্যটির পূর্বে মায়ানমার উত্তর ও উত্তর পূর্বে আসাম, অরুনাচল, পশ্চিমে আসাম আর দক্ষিনে মনিপুর। নাগাল্যান্ডের ১৬ টি জেলায় ১৭টি প্রজাতির আদিবাসী বসবাস করে। এই বিভিন্ন প্রজাতির আদিবাসীদের সংস্কৃতি, পোষাক আশাক এমনকি ভাষার টানও আলাদা। চাষবাস এদের প্রধান জীবিকা, এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প – বেত ও বাঁশের কাজ, বিভিন্ন ডিজাইনের চাদর ও কাপড়, মুখোশ ইত্যাদিতে নাগারা পারদর্শী। চাষবাস ও হাতের কাজ ছাড়া নাগারা খুবই উৎসবপ্রিয়। বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো প্রত্যেক প্রজাতির আদিবাসীদের একেকটি একান্তই নিজস্ব উৎসব আছে আর সেই উৎসবেতে গ্রামের সবার যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলেক। এই উৎসবগুলোর একটা প্রধান অঙ্গ হল নাচ আর গান। পল্লীগীতি থেকে শুরু করে Rock music অবধি সবই সমানতালে চলে আর তার সঙ্গে চলে আদিবাসীদের নাচ। আমাদের দেশের রক ব্যান্ডগুলোর মধ্যে নাগাল্যান্ডের অনেক নামকরা রক ব্যান্ড আছে যারা সারা দেশে perform করে বেড়ায়।
এইরকমই এক উৎসবের নাম Hornbill Festival যাকে Mother of All Festivals ও বলা হয়। প্রত্যেক বছর ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে দশদিন ধরে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার কাছে কিসমা গ্রামে এই উৎসব চলে। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই উৎসবটির বৈশিষ্ট হলো যে একই জায়গায় বিভিন্ন আদিবাসী প্রজাতির নাচ, গান, খাবার, হাতের কাজ, ও আরও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া যায়। অনেকটা আমাদের পৌষমেলার মতো। কিন্তু যেহেতু আদিবাসী গোষ্ঠির সংখ্যা ১৭, এবং প্রত্যেকের সংস্কার, খাদ্যাভাস, ভাষা আলাদা, তাই এতো বৈচিত্র অন্য কোনো রাজ্যের কোন উৎসব বা মেলায় পাওয়া দুষ্কর।
কোভিডের জন্য এই উৎসব গত দু’তিন বছর বন্ধ ছিলো। কোভিডের পর এবারই প্রথম ২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসের ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত এই হর্ণবিল ফেস্টিভ্যাল চলবে। উৎসবটা শুধু আমাদের দেশে নয়, দেশের বাইরেও যারা নাগা সংস্কৃতি এবং গ্রাম্য জীবনযাপন সম্বন্ধে উৎসুক, এরকম বহুজনের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাই এই সময়ে কোথাও হোটেল বুকিং বা গাড়ি পাওয়া অনেকটাই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। উৎসবের দিনক্ষন ঘোষনা করার এক সপ্তাহের মধ্যেই সব হাউসফুল। গোদের ওপর বিষফোঁড়াসম নাগাল্যান্ডে কোথাও ঘুরতে গেলেই দরকার Inner Line Permit, সে তুমি ভারতীয়ই হও বা বিদেশি। সেটি আগের থেকে হস্তগত না করলে ডিমাপুরে (Gateway of Nagaland) নেমে ওটি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত ওখানেই মানে এয়ারপোর্ট বা স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডেই বসে থাকা। অনেকটা Visa on Arrival এর মতো। কিন্তু জেদ যখন চেপেছে তখন যাবোই।
আমার সহধর্মিনীটি আবার পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে চলাফেরায় একেবারেই অপটু। মিনিটে মিনিটে তাঁর নাড়িভুঁড়ি সব পেটের ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরোতে চায়। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা সবে খেয়ে দেয়ে এক বিশাল ঢেঁকুর তুলে অশান্তির ভয়ে নাগ্যাল্যান্ডকে সমভূমিতে পরিনত করার ছক কষছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার মেল শভিনিজম চাগাড় দিয়ে ওঠায় নিরস্ত হয়ে বললেন “তোমার ম্যাও তুমিই সামলাও বাপু, আমাকে ফাঁসিওনা।” আমি ব্রহ্মাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম “কাজটা কিন্তু ভালো করলেন না। পরে আমার দোষ দেবেননা।” এই বলে সুট করে কেটে পড়ে একাই যাবার ছক কষতে লাগলাম।
ছক কষা মানে বেশি কিছুই নয়। ডিমাপুরের প্লেনের টিকিট কাটা, একটা গাড়ি ভাড়া করা আর কোহিমায় কোনো ভদ্রস্থ হোটেলে তিন চারদিনের জন্য একটা মাথা গোঁজার জায়গা। যাচ্ছি যখন এতোদূর তখন আমার আসল উদ্দেশ্য নাগা আদিবাসীদের গ্রাম, তাদের ঘরবাড়ি, জীবনধারা, সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি, পোশাক আশাক, এগুলো সবই খুঁটিয়ে দেখে আসার। মেলাটাতো না হয় দু একদিনেই দেখে নেওয়া যাবে। তারপর দু’তিন দিন জয়দূর্গা বলে নাগাদের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবার প্ল্যান ছকতে বসলাম। অনেকদিন ব্যাকপ্যাকারদের মতো ঘোরা হয়নি – বিভিন্ন জায়গায় পড়ে দেখেছি নাগা আদিবাসীদের গ্রামের পরিচ্ছন্নতা আমাদের অনেক শহরের থেকে ভালো তাই বিশেষ অসুবিধা হবে বলে মনে হলো না।
এইসব ভেবে ৬ই নভেম্বর দিলাম দুম করে Inner Line Permit এর online application করে। সঙ্গে ছবি ও আধার কার্ড বা অন্য স্বীকৃত identity আপলোড করে দিলাম। সাথে সাথেই গুগল সার্চ করে কোহিমার বিভিন্ন হোটেলে বুকিং এনকোয়্যারি পাঠাতে শুরু করলাম। সামান্য ব্যাপার, হাতে দিন পঁচিশেক সময় আছে, ধীরেসুস্থে একটা জব্বর প্ল্যান বানানো যাবে।
ধাক্কাটা প্রথম এলো হোটেল থেকে। গুগল দেখে কোহিমার যতগুলো হোটেলে ফোন করেছিলাম বা এনকোয়্যারি পাঠিয়েছিলাম, সবাই সটান জানিয়ে দিলো যে Hornbill Festival এর জন্য তাদের কিছুই খালি নেই। হোমস্টে গুলোতে চেষ্টা করলাম, সেখানেও সেই একই অবস্থা। ট্র্যাভেল এজেন্সিতেও কোনো গাড়ি নেই। সবাই এমন একটা ভাব করছে যেন মেলা দেখতে সারা পৃথিবীর লোকেরা ঠিক ওই দশটি দিনের জন্যই কোহিমাতে এসে জড়ো হবে।
মনমরা হয়ে বসে নাগাল্যান্ড ভুলে কোলকাতার আশেপাশেই কোথাও ঘোরার কথা ভাবছি। ইতিমধ্যে Inner Line Permit হাতে চলে এলো। আবার জেদ চাপলো, হয় Hornbill Festival, নাগাল্যান্ডের গ্রাম, নয়তো কিচ্ছু নয়, কোলকাতায় বাড়িতেই বসে থাকা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল হল আমি যদি কোহিমায় না থেকে ডিমাপুরের কোন হোটেলে থেকে আসাযাওয়া করে Hornbill Festival দেখি তাহলে কেমন হয়? ডিমাপুর থেকে কোহিমা প্রায় আড়াই তিন ঘন্টার পাহাড়ি পথ, যাতায়াতেই দিনে পাঁচ ছ’ঘন্টা নষ্ট হবে তবুও দুধের স্বাদ তো ঘোলে মিটবে? ইন্টারনেটে দেখলাম ডিমাপুরের অজস্র হোটেল খালি, থাকাটা কোন সমস্যা নয়। নিজেকে ভাস্কো ডা গামার সমগোত্রীয় ভেবে কিঞ্চিৎ আত্মশ্লাঘা অনুভব করলাম। জয়মা বলে গাড়ির সন্ধানে দিলুম সবচেয়ে বেশি রেটিং পাওয়া SAR Car Rental Service কে একটা ফোন ঠুকে।
ঠিক এইখানেই আমার জীবন আলো করে, প্রথম প্রতিশ্রুতি নিয়ে এলেন জর্জদি, মিসেস জর্জ। ওনার সুরেলা কন্ঠস্বর আরও সুমধুর মনে হলো যখন উনি জানালেন যে মেলার জন্য ওনার সব ছোট গাড়ি বুকিং হয়ে গেছে তবে বড় গাড়ি যেমন ইনোভা, মাহিন্দ্রা ইত্যাদি পাওয়া যাবে। সুতরাং আমার গাড়ি এক ইঞ্চি এগোলো। কাঁচুমাচু হয়ে মিনমিন করে বললাম, সে তো খুবই ভালো কথা কিন্তু আমার কোনো হোটেল বুকিং হচ্ছে না। ডিমাপুর থেকে মেলা দেখা যাবে? জর্জদি বললেন খুব যাবে তবে পরিশ্রম হবে আর মেলা ছাড়া তুমি যেসব গ্রামের কথা বলছো সেগুলোর কিছুই দেখতে পাবেনা। তাহলে উপায়? এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবেনা? জর্জদি বললেন “আমাকে মিনিট পাঁচেক পর ফোন করো। আমার এক বন্ধুর কিসমা গ্রাম থেকে মিনিট পনের দুরের একটা গ্রামে হোমস্টে আছে। ওকে ফোন করে দেখি যদি পাওয়া যায়।” আমি আনন্দে আর উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ফোন ছাড়লাম।
মিনিট দশেক পর জর্জদি ফোন করে নিজেই জানালো যে ওর বন্ধুর হোমস্টেতে ৩ আর ৪ ডিসেম্বর, দু’রাত জায়গা আছে। আমাকে হোয়াটসআ্যপে বন্ধুর ফোন নম্বর পাঠাচ্ছেন, আমি যেন ফোন করে সরাসরি ওনার সাথে কথা বলে নিই। আবার ফোন, এবার ফোনমঞ্চে রোমান হলিডের প্রিন্সেস আ্যনের মতো আগমন ভিখোনো ঝাসার। ম্যাডাম ভিখোনো খিলখিল করে হাসতে হাসতে জানালেন যে ওনার বান্ধবী মিসেস জর্জের সঙ্গে ওনার কথা হয়েছে। ওনার হোমস্টে পুরো ভর্তি কিন্তু উনি ওটা বাড়াচ্ছেন এবং সেই বাড়ানোর কাজটি মেলা আরম্ভের আগেই শেষ করতে হবে কারন ওখানেও বুকিং আছে। সেই বর্দ্ধিত অংশে আমারা মাথা গোঁজার ঠাঁই হতে পারে। সিনেমা শেষ, রোমান্সের চরম মুহূর্ত, আমি ভিখোনো কে টোকেন পাঠিয়ে বুকিং কনফার্ম করে জর্জদিকে আবার ফোন লাগালাম। জর্জদি বললেন যে উনি আমাকে সাহায্য করতে পেরে খুব খুশী আর ওনার গাড়ি বুক করার জন্য কোন আ্যডভান্স লাগবেনা, ওনার মুখের কথাই যথেষ্ট। আমি জোরাজুরি করাতে বললেন যে শ’পাঁচেক টাকা গুগল পে করে পাঠিয়ে দিও।
ভেবেছিলাম এ যাত্রা একা একাই ঘুরতে হবে। কপালের ফেরে বেড়াতে যাওয়ার হপ্তা দুয়েক আগে মনমতো এক ভ্রমণসঙ্গী পেয়ে বেড়ানোর আনন্দটা শুরুর আগেই দ্বিগুন হয়ে গেল। আমাদের ব্যাচের গ্লোব ট্রটার নামে বিখ্যাত (অন্য নামও আছে, সেটা লেখা যাবেনা) সর্বশ্রী তপন গৌতম শুনে বললেন উনিও হর্ণবিলের ডাকে সাড়া দিতে খুবই আগ্রহী। তাড়াতাড়ি সংক্ষেপে ওনাকে ছকটা বোঝালাম। তখনও ছক পুরো কষিনি, ওটা আমার দ্বারা কখনই হয়নি। প্ল্যান করে বেড়ানোয় আমি বিশ্বাসী নই, তপনও তাই।
গ্লোব ট্রটার (তপনের ডাক নাম) সম্পর্কে একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যতদূর জানি ট্রট কথাটা সাধারনতঃ ঘোড়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ দুলকি চালে চলা (at a speed between walking and running), তাহলে মানুষের ক্ষেত্রে ট্রটার কথাটা আসবে কেন? যারা ঘোড়ার মতো দুলকি চালে পৃথিবী ভ্রমণ করেন, তাদেরকেই কি গ্লোব ট্রটার বলে? পন্ডিতরা বলতে পারেন, আমি পারবোনা। এই হল আমার মহা দোষ, যাচ্ছিলাম নাগাল্যান্ডে, চলে গেলাম ট্রটারে। শৃঙ্খলাবদ্ধ চিন্তা কোনদিনই মাথায় এলোনা, বেড়ানোর প্ল্যান হবে কি করে?
নাগাল্যান্ডের Gateway ডিমাপুর, রাজ্যটির দক্ষিন পশ্চিমে আসামের গা ঘেঁষে। রাজ্যের একমাত্র বড় রেলওয়ে স্টেশন, এয়ারপোর্ট, সব ডিমাপুর। রাজধানী কোহিমা সড়কপথে ডিমাপুর বা আসাম, অরুনাচল, মনিপুর বা অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হলেও বেশিরভাগই ডিমাপুর ছুঁয়ে যেতে হবে। নাগাল্যান্ডের যত ফ্যাক্টরি সবই ডিমাপুর বা তার আশেপাশে। তার থেকে আরও দক্ষিন পূর্বে পাহাড় দিয়ে ঘেরা রাজধানী কোহিমা, দূরত্ব প্রায় সত্তর কিলোমিটার, সড়কপথে প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগে। আর নাগাল্যান্ডের দক্ষিনে কোহিমা জেলার ধার ঘেঁষে রয়েছে মণিপুর। আরও দক্ষিনে কোহিমা জেলা ভাগ করে গাছপালা ও ফুলে ফলে ভরা জেলাটির নাম পেরেন যার ধার ঘেঁষে রয়েছে আসাম আর মণিপুর। পেরেনের আদিবাসীরা জেলাং আর কুকি উপজাতির লোক, জেলাংদের আগমন পাশের রাজ্য মণিপুর থেকে। দক্ষিন সীমান্তর পেরেন থেকে উত্তর সীমান্তের মন গ্রামটির দূরত্ব তিনশো তিরিশ কিলোমিটার আর পশ্চিম সীমান্ত ডিমাপুর থেকে পূর্ব সীমান্তের কিফায়ার মাত্র তিনশো দশ কিলোমিটার দূরে। এই নিয়েই আমাদের ছোট্ট রাজ্য নাগাল্যান্ড। আমরা অবশ্য এই অল্পদিনে পুরো নাগাল্যান্ড চষতে পারবোনা, মূলতঃ কোহিমা আর আশেপাশের জেলাগুলোতেই যেমন জুন্হেবটো, ফেক আর ডিমাপুরেই ঘুরতে পারবো।
আগেই লিখেছি যে নাগাদের একেক প্রজাতির আদিবাসীর রীতিনীতি, আচার ব্যবহার বা সামাজিক প্রথাও আলাদা। বিয়ের কথাটাই ধরা যাক। আনগামী প্রজাতির আদিবাসীরা একদারগ্রস্ত আবার লোটা, সেমাস এইসব প্রজাতির পুরুষেরা সামাজিকভাবে বহুবিবাহ করতে পারে, লোটারা তিনটে বৌ আর সেমাসরা পাঁচ থেকে সাতটা বৌ রাখতে পারে। মেয়েরা কিন্তু একটার বেশি বিয়ে করতে পারেনা। এদের বিয়ে দুরকমের – একটি হয় ঘটকের মাধ্যমে, আচার উপাচার করে, মন্ত্রতন্ত্র পড়ে আনুষ্ঠানিক বিয়ে আর অন্যটি কোনোরকম অনুষ্ঠান ছাড়াই অনাড়ম্বর ভাবে। দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে বর তার ভাবী বৌকে নিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে একদিন forbidden অবস্থায় থাকে। এটাকে ওরা ওদের ভাষায় বলে ‘কেন্না’। নাগা গ্রামগুলো কয়েকটা গোত্র বা ‘খেল’এ বিভক্ত থাকে। একই গোত্রে বিয়ে দেওয়াটাকে নাগারা খুব খারাপ নজরে দেখে। অবশ্য একমাত্র ব্যাতিক্রম ‘কোনিয়াক’ উপজাতির প্রধান, যারা নিজেদের বংশেই বিয়ে করতে পারে। বিয়ে সম্বন্ধে বিভিন্ন নাগা উপজাতির বিভিন্ন বিশ্বাস এবং বিভিন্ন উপাচার। যেমন ধরুন আঙ্গামি উপজাতির লোকেরা বিয়ের আগে উপাচার হিসেবে বিয়ের আগে একটা মুরগীকে শ্বাসরোধ করে। তেমনি আঙ্গামি উপজাতির মেয়েরা কোর্টশিপ বা বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন যদি কোন দুঃস্বপ্ন দেখে, তাহলে তারা ভাবী বরকে খারিজ করতে পারে।
নাগাদের জীবনযাত্রার মতো তাদের খাদ্যাভাসও খুবই বৈচিত্রপূর্ণ, এমনকি রোমাঞ্চকরও বলা যেতে পারে। সমতলের লোকেদের কথা ছেড়ে দিন, এদের খাবার ভারতবর্ষের পাহাড়ি লোকেদের খাবার দাবারের থেকেও অনেক বেশি aggressive – হলফ করে বলতে পারি নাগা বাজারে একবার ঢুঁ মারার আগে আ্যভোমিন জাতীয় ওষুধ খেয়ে না গেলে এবং ফিরে এসে সাবান দিয়ে স্নান না করলে বিপদ অনিবার্য। আমার এক বন্ধু নাগা বাজারে গিয়ে ঝাড়া চব্বিশ ঘন্টা উপোস করে ছিল, কিছু খেতে গেলেই বমি আসতো। তাই আমি আর সাহস করে ওদিক মাড়াইনি, তার মুখে শুনেই লিখছি। নাগাদের প্রিয় খাদ্য হল গুটিপোকা, গুগলি, ব্যাঙ ও কুকুরের মাংস। আমিশাষীরা ওখানে গেলে ডিম বা মুরগি খাওয়াই নিরাপদ। রান্না করার পর কুকুর আর ছাগলের মাংসের তফাৎ বিশেষ বোঝা যায়না।
মারামারি বা দাঙ্গায় আপনার মুন্ডুটা কাটা যেতেই পারে। কিন্তু এমন যদি হয় যে প্রতিপক্ষের মূল উদ্দেশ্যই হলো আপনার মাথাটি কেটে নিয়ে ঘরের শোভাবর্ধন করা বা স্বজাতির কোন তরুনীর হৃদয় হরণ করা, তাহলে ব্যাপারটা একটু গোলমেলে আর ভয়াবহ হয়ে যায়। এই মুন্ডু কেটে নেওয়া বা ‘হেড হান্টিং’ কোন নতুন ঘটনা নয়। আমাদের উপমহাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিনে বহু আদিবাসী এই মুন্ডু কাটার নেশায় একসময় জড়িয়ে পড়েছিল। এমনই একটি দুর্ধর্ষ জাতি নাগা। নাগারা জাত মুন্ডু শিকারি ছিল। মুন্ডু কেটে সেটা শুকিয়ে বাড়ির দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছিলো নাগা যোদ্ধাদের বীরত্বের এক নিদর্শন। আমরা যেমন বাঘ, হরিণ, বাইসন ইত্যাদি শিকার করে তার মুন্ডু ঝুলিয়ে রাখি, অনেকটা সেরকম। খালি তফাৎটা এই যে মুন্ডুটি মানুষের। আর যাই হোক বিয়ের কনের মন পেতে হলে অন্তত একটা মুন্ডু কেটে আনা ছিলো একসময়ের নাগা সমাজের দস্তুর। নাগাদের মধ্যে কোনিয়াক প্রজাতির লোকেরা দুর্ধর্ষ মুন্ডু শিকারি বলে কুখ্যাত। সারা গায়ে উল্কি আঁকা এই যোদ্ধারা পাহাড় ঘেরা দূর্গসদৃশ গ্রামে থাকতো। বৃটিশ মিশনারী আর সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নাগাদের এই মুন্ডু শিকারের প্রথা এখন প্বিলুপ্ত। তবে সারা পৃথিবী জুড়ে ‘হেড হান্টিং’ এখনও হয় এবং ‘হেড হান্টার’ রা রমরমিয়ে ব্যাবসা করেন। সে কথা আলাদা।
নাগারা বরাবরই স্বাধীন জাতি। আসামের অন্য প্রজাতিগুলোর সাথে কিঞ্চিৎ যোগাযোগ ছাড়া বহির্বিশ্বে আর কারো সাথে তাদের কোনই যোগাযোগ ছিলনা। ব্রিটিশরা ভারত দখল করলে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ১৮৩০ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বৃটিশ সেনা আর নাগা যোদ্ধাদের মধ্যে প্রকাশ্য আর গেরিলা যুদ্ধ চলে। শেষমেশ আধুনিক অস্ত্রের কাছে নাগারা হার মানে আর নাগাল্যান্ডে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনচেতা নাগারা ভারত স্বাধীন হবার ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ১৪ই অগাস্ট নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষনা করে। উদ্দেশ্য নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের অধীনে একটা স্বাধীন রাজ্য গঠন করা। ভারত সরকার এই দাবী না মেনে নিলে শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ। নাগাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা মাপু ফিজো দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ডকে ভারতের রাজ্য হিসেবে ঘোষনা করা হলেও নাগারা স্বাধীনতার দাবিতে যুদ্ধ চালাতে থাকে। পরে নানা শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়ে নাগারা এখন অনেকটাই ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক মূলস্রোতে।
ফিরে আসি হর্ণবিলে। আগেই বলেছি ভারতীয় ধণেশ পাখির নাম অনুসারেই এই উৎসবের নাম রাখা হয়েছে হর্ণবিল উৎসব। কারন এই পাখির সংখ্যা নাগাল্যান্ডে যেমন বেশি দেখা যায়, তেমনিই নাগা জনজাতির সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যে হর্ণবিলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নাগা যোদ্ধাদের মুকুটে যে পাখির পালক থাকে সেগুলো হর্নবিলের।
দোসরা ডিসেম্বর সকাল দশটার উড়ান ধরে কোলকাতা থেকে এলাম ডিমাপুর। এয়ারপোর্টে বলার মতন তেমন কিছু ঘটেনি, লম্বা লাইন ছাড়া। লাউঞ্জে তপনের সঙ্গে দেখা করে গুটি পায়ে বিমানের পেটে ঢুকে পড়লাম। ডিমাপুর এয়ারপোর্টের বাইরে ড্যানিয়েল আমাদেরকে গাড়িতে তুলে নিলো। ড্যানিয়েল বছর তিরিশেকের এক প্রাণোচ্ছল যুবক। প্রথম দর্শনেই মনে ধরে গেল। আগামী পাঁচটা দিন ওর হাতে ভালোই কাটবে। দুগ্গা দুগ্গা বলে ডিমাপুর এয়ারপোর্ট থেকে ড্যানিয়েলের মারুতি Breezer গাড়িতে চেপে সোজা কোহিমা। তপন গাড়িতে উঠেই ড্যানিয়েলকে বলে দিল রাস্তায় একটা ভালো চায়ের দোকান দেখে যেন গাড়ি থামায়।
ডিমাপুর থেকে কোহিমার রাস্তা পুরোটাই পাহাড়ি। অনেক স্ট্রেচে যেমন খুব ভালো আবার কোথাও কোথাও খুবই খারাপ। পঁচাত্তর কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে প্রায় ঘন্টা আড়াই লাগে। মাঝ রাস্তায় চা খেতে নেমে দেখি গরম পুরি ভাজা হচ্ছে, সাথে আলু আর চানার ততোধিক স্বাদিষ্ট তরকারি। তপন লোভ সামলাতে না পেরে এক প্লেটের অর্ডার দিয়ে ফেললো। আমি দোকানিকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কোথায়। বললে রাজস্থান। বুঝলাম তরকারির স্বাদ এতো ভালো কেন।
কোহিমা পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। সূয্যিমামা ঢলে পড়েছেন। রোদের তেজ কমে আসছে আর ঠান্ডাও জাঁকিয়ে পড়ছে। ডিমাপুরে এতো ঠান্ডা পাইনি। গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে আমাদের হোমস্টে খুঁজে নিতে বিশেষ অসুবিধে হলো না। আরাধুরা হিলসে ক্যাথিড্রালের কাছেই আমাদের আজকে রাত কাটাবার হোমস্টে, নাম ইমচেন গেস্ট হাউস। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি কেউ নেই। অনেক ডাকাডাকির পরও কারো সাড়া পেলাম না। একটি মেয়ে বারান্দায় এসে বললে মালকিন বাজারে গেছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষন পর থলে হাতে এক বৃদ্ধার প্রবেশ। তিনি সব শুনে বললেন ওখানে আমাদের তো কোন বুকিং নেই। আমার Expedia দিয়ে বুকিংয়ের কাগজপত্র দেখাবার পরেও উনি বললেন যে ওনার এই হোমস্টের বুকিং কোনো অনলাইনে হয়ই না, সব ডাইরেক্ট করতে হয়। এটা মনে হয় কোন ফেক বুকিং, গত তিনদিন ধরেই এরকম হচ্ছে আর ওনারা পুলিশেও FIR করেছেন। আমাদের কোন থাকার ব্যাবস্থা উনি করতে পারছেন না। এমনকি আমাদের বুকিং রেট ওনার হোমস্টের রেটের অর্ধেক। এদিকে সন্ধ্যে আরও নেমে আসছে, আমি আর তপন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে দুজনেই ভদ্রমহিলাকে অনুরোধ, উপরোধ, জোরাজুরি করার পর অবশেষে চিঁড়ে ভিজলো। একটা ঘর সেদিনের মতো পাওয়া গেল। আমরা আর সময় নষ্ট না করে সোজা হর্ণবিলের দিকে রওয়ানা দিলাম। চারদিকে অন্ধকার, ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে বাজে।
হর্ণবিল উৎসব কোহিমা থেকে দশ বারো কিলোমিটার দূরে কিসামা বলে একটা গ্রামে হয়। পাহাড়ি রাস্তায় বারো কিলোমিটার যেতেই আধঘন্টা লেগে গেল। কিসামাতে একটা পাহাড় কেটে ধাপে ধাপে বানানো হয়েছে উৎসব প্রাঙ্গন। পাহাড়ে পিচের রাস্তা, তাই ধরে উঠলে গাড়িতে পওর কিলোমিটার মতো উঠে পার্কিং। সেখানে গাড়ি রেখে প্রায় তারপর বিভিন্ন উৎসবের এরিয়াতে যেতে প্রায় পাঁচশো মিটার খাড়াই উঠতে হয়। সেখানে ওপরে একটা স্টেজ, তার সামনে মাঠ, আর চারদিকে আ্যম্ফিথিয়েটারের মতো বসার জায়গা। সেটাই উৎসবের মূল প্রাঙ্গন। তারও ওপরে কিছু খাবার জায়গা আর বিভিন্ন ট্রাইবসদের ঘর। একেকটা ট্রাইবের ঘরের ডিজাইন একেকরকম।
টিকিট কেটে ওপরে উঠতে উঠতে দেখি একটা খাবার জায়গা। সেখানে কিছু খাবারের স্টল আছে। এদিকে দুপুরের পুরি ভাজির পর আমাদের পেটে ছত্রিশটা ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে। উৎসবের মূল প্রাঙ্গন আর একটা ওপরে “দুত্তোর, উৎসবের নিকুচি করেছে” বলে ঢুকে গেলাম প্রথম খাবার জায়গায়। সেখানে এক নাগা মাসিমা, নাম আসনা, যত্ন করে আমাদের বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি চাই? আমাদের চোখ ততক্ষনে চলে গেছে বাঁশের বড় বড় গ্লাসের দিকে। দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলাম রাইস বিয়ার।
এখানে রাইস বিয়ার সম্বন্ধ দু’কথা লিখে রাখি আমাদের মতো সুরাপায়ীদের জন্য। রাইস বিয়ার মূলতঃ দু’রকমের হয় – একটা ভাত পচিয়ে আর একটা যব পচিয়ে। ভাত (স্টিকি রাইস) বা যবসেদ্ধ পচিয়ে বা ফারমেন্ট করে সেই তরল পদার্থটি পরিস্রুত করে যা তৈরি হয় তাকে বলে রাইস বিয়ার। রাইস বিয়ার কোন ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয়না, ঘরে ঘরে তৈরি হয়। বারবার পরিস্রুত করা হয় বলে এর রঙ ভাতের ফ্যানের মতো ঘোলাটে হলেও আমাদের তাড়ি বা হাড়িয়া বা পচাইয়ের মতো অতো ঝাঁঝালো নয়। বরং অনেকটা হাল্কা তবে ভাত আর যবের বিয়ারের স্বাদের মধ্যে একটু তফাত আছে – ভাতেরটা একটু মিষ্টি মিষ্টি, যবেরটা নয়। আমরা একেক গ্লাস করে দুটোই মেরে দিলাম সাথে তপন চিলি চিকেন আর আমি চিলি পর্ক। দুটো করে গ্লাস শেষ করার পরে নজর পড়লো পাশের টেবিলে দুটো ছোট ছোট কাঁচের গ্লাসের দিকে।
আসলাকে জিজ্ঞেস করাতে বললে যে ওদুটো ভদকা শটের গ্লাস। কোলকাতায় তপন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল এখানে কোন বোতল আনবে কিনা। আমি সটান মানা করে দিয়েছিলাম কারন বইতে লেখা নাগাল্যান্ডে prohibition আছে। এখানে এসে আবার বুঝলাম বইয়ের জ্ঞান আর বাস্তবের অভিজ্ঞতার তফাৎ কতখানি। ঠিক হল আপাতত ভদকার প্রলোভন ছেড়ে ট্রাইবাল নাচ দেখে আসা যাক। পরে দেখা যাবে কি করা যায়।
মূল উৎসব প্রাঙ্গনে গিয়ে দেখি সেদিনের শেষ আদিবাসী নাচ তখনও চলছে। সেটা শেষ হলে ঘন্টা দুয়েকের বিরতি। তারপর সাড়ে পাঁচটা থেকে হর্ণবিল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। তাতে প্রতিদিন থাকবে দুটো রকব্যান্ড। এখানে রক ছাড়া আর কোন গান নেই। আমরা দেখলাম এই সুযোগ। আদিবাসী নৃত্য শেষ হতেই আবার দৌড়োলাম মাসীমার ঠেকে। কোন ভণিতা না করে মাসীমাকে বললাম দুগ্লাস রাইস বিয়ার আর সাথে দু’শট ভদকা। তপন হাঁ হাঁ করে বললে আগে একশট নিয়ে দ্যাখ কিরকম লাগে। শুরু হল আমাদের তাড়ির সঙ্গে ভদকা পান। আরও গোটা দুয়েক গ্লাস আর গোটা তিনেক শট মেরে যখন মূল প্রাঙ্গনের মাঠে এসে বসলাম, মাথাটা মনে হল কেমন তাজ্জিম মাজ্জিম করছে। তার সাথে চারদিকে অন্ধকার, আর কনকনে ঠান্ডা।
নাগাল্যান্ড এবং সমস্ত উত্তর পূর্ব ভারতের লোকেরা গান বলতে মাত্র দু’রকমের গানই বোঝে – ফোক সং আর রক ব্যান্ড। এছাড়া অন্যকোন মিউজিক বোধহয় ওঁদের অভিধানে নেই। সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারত জুড়ে অনেক রক ব্যান্ড আছে যাদের মধ্যে নাগাল্যান্ড, মেঘালয় আর মণিপুরের কিছু ব্যান্ড বেশ নাম করেছে। এরা নিয়মিত দেশে ও বিদেশে অনুষ্ঠান করে। আমার এবং তপনের দুজনেরই রক মিউজিকের ওপর একটু দূর্বলতা আছে। বলতে গেলে, আমাদের হর্ণবিল উৎসবে আসার এটাও একটা কারণ। তাই আর দেরি না করে ওই কনকনে ঠান্ডাতেই খোলা মাঠের একটা কোনে গিয়ে বসে পড়লাম। সেদিন অনুষ্ঠান ছিলো এক স্থানীয় ব্যান্ডের। খুবই ভালো এবং মার্জিত গলা, যে কোন বিদেশি ব্যান্ডকে পাল্লা দেবার মতো। সেই সুরে মজে যখন বাড়ি ফিরলাম, রাত প্রায় সাড়ে ন’টা।
গতরাত্রে হর্ণবিল উৎসব থেকে রাইস বিয়ার (তাড়ি) ও ভদকার মিশ্রণের সাথে সারাদিনের ক্লান্তি যোগ করে ঘরে ফেরার পর খাবার আর ইচ্ছেই ছিলো না। তবু কোনরকমে কিছু গলাধঃকরন করে সেই যে লেপের ভেতরে ঢুকলাম, একঘুমে রাত কাবার। হোমস্টের ব্যাবস্থা বেশ ভালোই, আ্যটাচড বাথ আর গিজার আছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আজ তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। এখান থেকে অন্য একটা হোমস্টেতে আগামী দুদিনের জন্য। সেটা কোহিমার বাইরে, হর্ণবিলের আরও কাছে। পথে দু’চারটে জায়গা দেখে যাবার ইচ্ছে, তাই তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ব্যাগ গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসলাম।
রান্নাঘরেই খাবার টেবিল। আমাদের ফ্লোর থেকে ওপরে, সেখানে টেরাস আর রান্নাঘর ছাড়া আর কোন ঘর নেই। আমরা গিয়ে দেখলাম মা ও ছেলে আমাদের ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত। কথায় কথায় মালকিন জানতে চাইলেন আমরা কি করি। কলেজের বন্ধু শুনে কোন কলেজ জিজ্ঞাসা করলেন। চমকের পর চমক, কলেজের নাম শুনে জানালেন যে ওনার প্রয়াত স্বামী খড়গপুর আইআইটির ইঞ্জীনিয়ার ছিলেন। এক ছেলে কোহিমার সাইন্স ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করেন। সেই কলেজটি ওনার বাড়ি থেকে পনের কিলোমিটার দুরে জোতসমায় বলে একটা জায়গায় বৌ বাচ্চা নিয়ে সেখানেই থাকে। অন্য ছেলেটি কলেজে পড়ে, একসঙ্গে থাকে এবং আপাতত ব্রেকফাস্ট বানাতে ওনাকে সাহায্য করছে। ছোট ছেলে কথায় কথায় বললে যে আমরা ভারতে থেকেও ভারতীয় নই, ভারত সরকার আমাদের outsider বলেই মনে করে, সেই স্বাধীনতার সময় থেকে।
“When you go home, please tell them of us and say, for your better tomorrow, we have our today.” প্রাতঃরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কোহিমা ওয়ার cemetery দেখতে। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট কোহিমা শহরটি প্রকৃতিদেবী যেন সযত্নে গড়ে তুলেছেন। সেই শহরের মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাজার হাজার শহিদদের স্মৃতি বরণ করে রয়েছে কোহিমা war cemetery; সারি সারি পাথরের ফলকের মধ্যেই রয়েছে বিখ্যাত ‘ব্যাটল আন্ডার দ্য চেরি ট্রি’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং জাপানি সৈন্যদের মধ্যে লড়াইয়ে মিত্রশক্তির যেসব সৈন্য এখানে প্রাণ হারিয়ে ছিলেন তাঁদের স্মরন ও সম্মানেই এই ওয়ার সেমেটেরি। পাহাড়ের গায়ে থাকে থাকে তৈরি করা এই সেমেট্রিতে রয়েছে নাম লেখা শহিদদের অসংখ্য ফলক, তাদের ধর্মীয় বিচারধারা অনুযায়ী। একদম নিচের এবং মাঝের স্তরগুলোতে ক্রিশ্চান, ওপরে মুসলিম এবং সবচেয়ে ওপরে হিন্দু ও শিখ সৈন্যদের স্মরনে একটি ছোট্ট বাড়ি। যেহেতু এটি ব্রিটশদের সহযোগিতায় তৈরি তাই অক্ষশক্তির (জাপান) কোন সৈন্যদের স্মারক এখানে নেই। আমার আশ্চর্য লাগলো যে স্বাধীনতার প্রায় পঁচাত্তর বছর পরেও ভারতের ও বাঙালীর গর্ব নেতাজীর আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রামের ইতিহাসের ছিঁটেফোটা চিহ্নও কোথাও দেখলামনা। আমরা বোধহয় এখনও ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস ভুলতে পারিনি। এই আমাদের ইতিহাস। থাক, এই নিয়ে আর বিতর্কের সৃষ্টি করে কোন লাভ নেই যদিও ‘কোহিমা’ – এই ছোট্ট শব্দটিতেই লুকিয়ে আছে বাঙালীর গর্বের ইতিহাস, নেতাজীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।
ওয়ার সেমেটেরি দেখে রওয়ানা দিলাম জুকো (Dzukou) ভ্যালির দিকে। নাগাল্যান্ড ও মনিপুরের সীমান্তে অবস্থিত এই জুকো ভ্যালির উচ্চতা ২৪৩৮ মিটার। এখানেই আছে নাগাল্যান্ডের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জাপফু পিক। জুকো ভ্যালি ট্রেকিং নাগাল্যান্ডের এক অন্যতম আকর্ষন। ট্রেকিং করে ওপরে গিয়ে ফিরে আসতে প্রায় ঘন্টা ন’য়েক সময় লাগে। অনেকে ট্রেক করে ওপরে গিয়ে সারারাত ওখানে ডরমিটরিতেই থেকে পরদিন ফিরে আসে। আমাদের সময় না থাকায় আমরা ট্রেক না করে ট্রেকিং বেস থেকেই ফিরে এলাম। যাবার রাস্তা কোহিমা থেকে ইম্ফল যাবার রাস্তায় পরে। দু ধারের অপূর্ব দৃশ্য সত্যি দেখার মতো।
ভিখোনো’দির হোমস্টে (Vales Homestay) তে আমাদের পরবর্তী দু’রাত কাটানোর কথা। সেই হোমস্টেটাও এই রাস্তাতেই পড়ে বলেই একটু ডিট্যুর করে জুকো ভ্যালির দিকে যাওয়া। তাড়াতাড়ি জুকো ভ্যালি সেরে হোমস্টেতে ফিরে এসে দেখি ভিখোনো’দি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। উনি ওনার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় খিলখিল করে হেঁসে আমাদের ঘরটা দেখিয়ে যে মন্তব্য করলেন সেগুলো এখানে না লেখাই সমীচিন মনে করি। ঘরে মালপত্র জমা করে ছুটলাম হর্ণবিলের দিকে। প্রথম স্টপ আসনা মাসীর ঠেক। আজকে আমরা অনেক পরিনত, তাই ঠিক করলাম তাড়ি, ভদকা সব একবারে সেরে তারপর সন্ধ্যের রক কনসার্টে বসবো। আসনা মাসী আমাদের দেখে তো উচ্ছসিত। আদর করে সবচেয়ে ভালো সিটটা অফার করেই দুটো গ্লাস সামনে এনে রাখলেন। আমরা ইশারায় আরও দুটো ছোট গ্লাসের অর্ডার দিলাম। আবার সেই তাড়ি ও ভদকার মিশ্রণ, সঙ্গে চিলি চিকেন। এরমধ্যেই দেখলাম একটা স্টলে আলুর চপ বিক্রি হচ্ছে। সেটাও নিয়ে এলাম। খেতে অনেকটা আমাদের আলুর চপের মতো হলেও ব্যাসন দেওয়া নেই। পেটভর্তি খাবার আর মদ বোঝাই করে এবার গুটিপায়ে হাঁটা দিলাম হর্ণবিল মিউজিক ফেস্টিভালের দিকে।
মাঠে যখন পৌঁছলাম, তার একটু পরেই শুরু হল জেলিয়াং উপজাতির বাজপাখির নাচ (Falcon Dance), স্থানীয় ভাষায় “আহিওবে লিম” বলা হয়। এই জেলিয়াং উপজাতি নাগাদের অন্যতম প্রধান একটি উপজাতি। এরা থাকে প্রধানত নাগাল্যান্ড, মণিপুর আর আসামের সীমান্তে। সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে বাজপাখিরা নাগাল্যান্ডে আসে আবার ফিরেও যায়। এই নাচটার movements বাজাপাখির ওড়ার মতো।
অনেকদিন পরে আজকের সন্ধ্যায় আমার শোনা বহু রক কনসার্টের অন্যতম একটি উপভোগ্য সন্ধ্যা। না, জলীয় প্রভাবের জন্য নয়, সত্যিই একটা মনমাতানো সন্ধ্যা। তপনও বলল অনেকদিন এরকম প্রোগ্রাম শোনেনি। প্রথম শুরু করলো এক ডিমাপুরের ব্যান্ড, “The Electric Cool Kid” – এদের অনেক রেকর্ড আছে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানও করেছে। Lead singer, Imliakum Iier এর গলার depth, tightness, আর modulation শুনে আমি স্তম্ভিত। সেই মোহ কাটতে না কাটতেই মঞ্চে প্রবেশ ইজরায়েলি ব্যান্ড “Tiny Fingers” এর। রক মিউজিকের অনুরাগীদের জগতে Tiny Fingers এর নাম শোনেনি এমন লোক পাওয়া দুর্লভ। এদের গিটার ও ড্রামের synchronisation যারা শোনেনি তাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসাধ্য। আমিও live program না শুনলে বিশ্বাস করতে পারতামনা। গিটারে এতরকমের বিভিন্ন notes অবিশ্বাস্য। একসময় কনসার্টটা শেষ হলে, মনে হল এতো তাড়াতাড়ি কেন? পরিপূর্ণ ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হোমস্টেতে ফিরে এলাম।
সকালে সামনের পাহাড়টার কোল থেকে সূয্যিমামা উঁকি দিয়ে জানালেন এক নতুন দিন শুরু হয়েছে। নতুন স্বপ্ন, নতুন আশায় বুক বেঁধে জীবন শুরু। কাল যা ছিল, আজ সকালেই সব ঝরে গেছে। এই মুহূর্তগুলো প্রত্যেকের একান্তই নিজের, চাওয়া পাওয়ার কোনো হিসেব নেই এখন। প্রকৃতি কুয়াশার ঘোমটার আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। একটু পরেই সূর্য্য তার কিরণে প্রকৃতির অবগুন্ঠন নববধূর মতো উন্মোচন করবে। চারিদিক নিস্তব্ধ, কিন্তু নিস্তব্ধতারও একটা আওয়াজ আছে – “The Sound of Silence” – এখন সময় হয়েছে সেই নিস্তব্ধতা একাকী উপলব্ধি করার। চারধারে এই নির্জনতায় ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় দেখতে দেখতে নিজেকেই মুচকি হেঁসে প্রশ্ন করি “ওহে বাপু, এতগুলো বছর কাটিয়ে কি বুঝলে? জীবনটা কিরকম? পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা, টকঝালমিষ্টি চানাচুর নাকি ধোপার ভারবাহী গাধা?”
আজ আমাদের কোথাও যাবার নেই, এক হর্ণবিল উৎসব ছাড়া। তাই সকাল থেকেই যাচ্ছি, যাবো করে আলস্য কাটাচ্ছি। হর্ণবিল উৎসব হবে কোহিমা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে কিসামা নামে একটা গ্রামে । আমরা আছি এই কিসামা থেকেও পাঁচ কিলোমিটার দূরে কিগামা গ্রামে। কোহিমা শহর আমাদের নাগালের বাইরে, যদিও এইসব গ্রামগুলোই কোহিমা জেলার মধ্যে পড়ে। আজ একটু দেরি করেই শুয়ে বসে জানলা দিয়ে চারদিকের পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে সকাল দশটা নাগাদ গুটি গুটি পায়ে কিসামার দিকে রওনা দিলাম। আজ সারাদিন হর্ণবিলেই কাটাবো, ফিরবো একেবারে রাতে।
সকালবেলায় হর্ণবিলে ঢুকে সোজা চলে গেলাম মাঠে, আদিবাসীদের নাচগান শুনতে। এখানে প্রোগ্রাম প্রত্যেকদিন তিনটে ভাগে হয় – সকাল সাড়ে ন’টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত, আবার দুপুর একটা থেকে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত মাঠের মধ্যে বিভিন্ন আদিবাসীদের নাচ গান, খেলাধুলা ইত্যাদি। তারপর সন্ধ্যে সোয়া পাঁচটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত সেই মাঠেই হবে হর্ণবিল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল অর্থাৎ রক ব্যান্ড। প্রত্যেকদিন দুটো ব্যান্ডের শো থাকে একটা স্থানীয় আরেকটা বাইরের, বিদেশেরও হতে পারে। আজ “Powerfaith” নামে একটা স্থানীয় গ্রুপ আর “Ginger Feet” নামে কোলকাতার একটা ব্যান্ডের শো আছে। কিন্তু সেকথা পরে।
আজ সকালে দেখলাম ‘আও’ উপজাতির ‘Nokinketer Yar’ বা যুদ্ধের নাচ। তারপরই ছিল ‘Ben Kesi’ লোকগীতি যেটা উৎসবের সময় বা মুন্ডু শিকারের সময় গাওয়া হয়। আও উপজাতির বাস নাগাল্যান্ডের মোককচুং জেলায়, পূর্বে দিখু উপত্যকা থেকে পশ্চিমে দিসাই উপত্যকা অবধি। লোককথায় পাওয়া যায় আও উপজাতির উৎপত্তি “Longtrok” থেকে যার অর্থ ছয়টি পাথর। সেখান থেকে তারা চুংলিমতি গ্রামে গিয়ে প্রথম বসতি স্থাপন করে। আও উপজাতি ছয়টি বংশে বিভক্ত আর এরাই হল নাগাদের প্রথম উপজাতি যারা খ্রীষ্টধর্মে পরিবর্তিত হয়। এজন্য অনেকের ধারণা যে আও রা অন্যান্য নাগা উপজাতিদের থেকে অনেক বেশি ক্ষেত্রে অগ্রসর।
সকালের অনুষ্ঠান দেখে আমরা ফিরে এলাম মাসীর ঠেকে। এখানে বাকি সময়টা কাটিয়ে আবার সন্ধ্যের রক ব্যান্ডের প্রোগ্রামে ফিরে যাবো। আসলা মাসীর ঠেক আর ফুড কোর্টটা একটা যেন মিনি ভারতবর্ষ। কতরকমের লোক, কতধরনের পোষাক পরে যে চলাফেরা করছে না দেখলে বোঝা যায়না। দুপুর একটা নাগাদ ঠেকে পৌঁছে সবে তাড়িতে চুমুক মেরেছি এমন সময় চিৎকার “মল্লিকদা, ও মল্লিকদা, এখানে মাছ পাওয়া যায়না? কখন থেকে ডেসার্ট স্টলে দাঁড়িয়ে আছি, আপনারা কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেলেন?” বুঝলাম এনার হর্ণবিল উৎসবে আসার মূল উদ্দেশ্য হল মাছ খাওয়া। আমরা নিজেদের পরিচয় না দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম হৃষ্টপুষ্ট দুই বাঙ্গালী দম্পতি, মাথায় টুপি, চোখে চশমা, হাতে দুটি ঢাউস ব্যাগ, তাতে ব্যাগভর্তি কেনাকাটা। মল্লিকগিন্নি তখন উচ্চৈস্বরে বলে চলেছেন “এই তপতী, এই মালাদুটো দ্যাখ? কি কিউট? আচ্ছা পুঁতিগুলো খুলে গেলে কি হবে রে? ভাবতেই ভয় লাগে। একেকটার দাম হাজার তিনেক, তবে এক্কেবারে আসল জিনিস। আমার গোলাপী ড্রেসটার সঙ্গে যা মানাবে না।” তপতীও দমবার নন। ঘাড় দুলিয়ে বলে উঠলেন “এই জন্যই তো আমি শাল আর মাফলার কিনলাম। শালের দাম সাত হাজার টাকা, বললে নাকি হাতে বোনা। দ্যাখ দ্যাখ কি সুন্দর ডিজাইন। একেবারে অরিজিনাল ট্রাইবাল ডিজাইন।” অন্যদিকে মল্লিকদা আর তার বন্ধুটি তখন হন্যে হয়ে মাছ খুঁজে চলেছেন।
গত দুদিন ধরেই দেখছি আমাদের ঠেকের এককোনে দুই ভদ্রলোক সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি রাইস বিয়ার, এক বোতল ভদকা আর বিভিন্ন খাবারদাবার নিয়ে বসে থাকেন আর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন। মাসী ছাড়া কারোর সঙ্গে কোনো কথাও বলেননা, বাথরুম যাওয়া ছাড়া নিজেদের সিট ছেড়ে ওঠেনা না। ঠেকের টেবিলগুলো পাশাপাশি, দূরত্ব খুবই কম, এমনকি অনেক সময় এক টেবিল শেয়ারও করতে হয়। তাই নিম্নস্বরে কথাবার্তা হলেও একদিন শুনে ফেললাম যে ওনারা নাকি সাংবাদিক। নিজেদের কাগজের জন্য হর্ণবিল ফেস্টিভ্যাল কভার করতে এসেছেন!
আজ আমাদের টেবিল শেয়ার করলেন এক মালায়লী, তার শ্বশুর এবং শ্বশুরের ভাই। মালায়লী জানালেন যে বছর বিশেক আগে তিনি বম্বেতে থাকতেন। তারপর একটি গারো মহিলাকে বিবাহ করিয়া তিনি শিলং হতে কিছু দূরে গারো পাহাড়ের নিকটবর্তী মারিয়াং শহরে থাকেন। লোকটি চূড়ান্ত হামবাগ, আর তার গারো শ্বশুর ও শ্বশুরের ভাই ঠিক ততোধিকই চুপচাপ। হামবাগ মালায়লী তাঁর শ্বশুরের ফাই ফরমাশ খেটে যাচ্ছে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিবাহবশতঃ তিনি যে খুবই সুখে আছেন, এ কথা হলপ করে বলতে পারি।
সন্ধ্যেবেলা যথাসময়ে রক ব্যান্ড শুনতে মাঠে গেলাম। প্রথমে এলেন স্থানীয় ব্যান্ড Powerfaith – এনারা নিজেদের Gospel Band বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। দ্বিতীয় ব্যান্ডটি কোলকাতার ব্যান্ড Ginger Feet; সত্যি বলতে কি এতো জঘন্য প্রোগ্রাম আগে কখনও শুনিনি। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়। খালি জগঝম্প বাজনা, synchronisation, melody, tight tone – এসব বেসিক কিছুই নেই। কোথায় কালকের Tiny Fingers আর কোথায় এই যমযত্রণা। সন্ধ্যে সাতটা অবধি “এবার নিশচয়ই ভালো হবে”, এই আশায় আশায় বসে থেকে উঠেই পড়লাম।
সমুদ্রতল থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে, কোহিমা থেকে পেরেন যাবার রাস্তায় প্রায় ২০ কিলোমিটার দুরে খোনোমা নামে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট্ট গ্রাম। নাগাল্যান্ডের অসংখ্য ছোট ছোট গ্রামের মধ্যে এটাও একটা। কিন্তু এর বিশেষত্ব হলো যে এই গ্রামটি ইউনেস্কো দ্বারা স্বীকৃত এশিয়ার প্রথম সবুজ গ্রাম (Green Village)। খোনোমা জঙ্গল ও পাহাড়ে ঘেরা ট্র্যাগোপ্যান স্যাঙ্কচুয়্যারির মধ্যে আঙ্গামি উপজাতিদের গ্রাম। জঙ্গল বাঁচানোর জন্য গ্রামের লোকেরা শিকার করা বহুদিন হলো ছেড়ে দিয়েছে, এখানে শিকার নিষিদ্ধ। এই ঘন জঙ্গলে ট্র্যাগোপ্যান নামে এক বিশেষ পাখি দেখা যায়, তাই এর নাম ট্র্যাগোপ্যান সাঙ্কচুয়্যারি। নাগা আদিবাসীদের সম্বন্ধে আমাদের অনেক প্রচলিত ভুল ধারনার একটা হল শিকার এদের মূল জীবিকা। আসলে এদের প্রধান জীবিকা হল চাষবাস। শিকার এরা করে অবসর সময়ে বা চাষের off season এ। এরকম অনেক ভুল ধারনা আমাদের পাঠ্য পুস্তকের দৌলতে আছে। সেগুলো পরে লেখা যাবে।
আঙ্গামি পুরুষরা তাদের সাহস ও যুদ্ধের পারদর্শিতার জন্য বিখ্যাত। ব্রিটিশরা যখন কোহিমা দখলের লড়াই চালায়, সেই লড়াই প্রথম শুরু হয় আজ থেকে প্রায় সাতশো বছর আগে আঙ্গামিদের সঙ্গে এই খোনিমা গ্রামেই। গ্রামে ওঠার জন্য পাহাড় কেটে সরু পাথরের সিঁড়ি আর গ্রাম রক্ষার জন্য সেই সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা উঁচুতে, প্রায় পঞ্চাশ ধাপ ওপরে, অনেকটা মাঝামাঝি জায়গায়, একটা পাথরের দরজা যেটা বন্ধ করলে গ্রামে ওঠা নামার রাস্তা বন্ধ। খোনোমাতে এরকম সাতটা গেট আছে বিভিন্ন দিকে। বৃটিশদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ছ’টা গেট স্থায়ীভাবে বন্ধ রেখে একটা মাত্র গেট খোলা ছিলো।
আমরা নীচে গাড়ি রেখে, গ্রামে যাবার টিকিট কেটে আমাদের গাইড কেভির জন্য মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার ফাঁকে একবার চা খেয়ে নিলাম। নাগাদের যে কোন গ্রামকে (village) কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়, তাকে এরা বলে ‘খেল’। এই ‘খেল’ (Khel) গুলোকে আবার কয়েকটা ভাগে ভাগ করে প্রত্যেকটা ভাগকে বলা হয় clan বা বংশ। খোনোমা গ্রামে তিনটে খেল – M Khel, S Khel আর T Khel; প্রত্যেকটা খেল geographically divided with clear boundaries in different altitudes; আমরা গ্রামে ঢুকলাম M Khel দিয়ে, তারপর S Khel ঘুরে T Khel দিয়ে বেরোলাম। পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু অংশে M Khel, মাঝে S Khel আর একেবারে নীচে যেখানে গাড়ি রেখেছিলাম সেই লেভেলে T Khel. প্রত্যেকটা গ্রামে একটা ছোট দূর্গ থাকে যেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। প্রত্যেকটা Khel এ থাকে একটা করে মরঙ্গ (কাঠের বাড়ি), যেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য গ্রামের লোকদের সভা বসে। মরঙ্গে বসে গ্রামের প্রবীনরা তাঁদের প্রজাতির বীরত্বের কথা, সাহসের কথা, যুদ্ধজয়ের কথা যুবক বা শিশুদের গল্প করে শোনান। প্রত্যেকটা মরঙ্গে ছেলেদের থাকার জন্য একটা করে ডরমিটরি থাকে। তপন খুব উৎসাহ নিয়ে মেয়েদের ডরমিটরি কোথায় জিজ্ঞেস করায় কেভি অবাক চোখে তাকিয়ে বলেণ “no, no, no girls dormitory in any morong”.
ফোর্ট আর মরঙ্গ ছাড়াও প্রত্যেকটা খেল এ আছে বেশ কিছু Khwehu, উচ্চারন ফ্যাহু। এই ফ্যাহু হল একটা গোলাকার পাথরে বাঁধানো জায়গা যেগুলো তৈরি করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে, গ্রামের বিশিষ্ট লোকেদের বীরত্বের কথা স্মরণ করে। একটা ফ্যাহু অনেক লোকেদের নামে উৎসর্গিত হতে পারে। খোনোমার দূর্গের ইতিহাস রোমাঞ্চকর। দূর্গটা প্রথম তৈরি হয় ১৮২৫ সালে। ১৮৫০ সালে প্রথম আ্যঙ্গলো খোনোমা যুদ্ধ এই দূর্গ থেকেই পরিচালিত হয়। ১৮৭৯ সালে দ্বিতীয় আ্যঙ্গলো খোনোমা যুদ্ধের সময় বৃটিশরা এই দূর্গটি ধ্বংস করে। তারপর ১৮৭৯ সালে আঙ্গামিরা আবার নতুন করে এই দূর্গ তৈরি করে। ১৯০৬ সালে বৃটিশ সরকারের আভ্যন্তরীন কলহে দ্বিতীয়বার এই দূর্গ ধ্বংস হবার পর আঙ্গামিরা ১৯১৯ সালে আবার দূর্গটা তৈরি করে। ১৯৫৬ সালে তৃতীয়বার ইন্দো নাগা যুদ্ধের সময় এই দূর্গ ধ্বংস হয়ে শেষবারের মতো ১৯৯০ সালে তৈরি হয়।
খোনোমা গ্রাম পুরোটাই পাহাড়ের ওপরে। নীচে দুই পাহাড়ের উপকার মাঝে rice terrace, ধাপে ধাপে তৈরি করা ধানক্ষেত। এখানে কুড়ি রকমের ধান চাষ হয়। কথায় কথায় কেভি আমাদের উল্টোদিকের পাহাড়গুলো দেখিয়ে বলল “ওই পাহাড়েই বৃটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ হতো। আমরা ওপরে থাকতাম আর ওরা নীচ থেকে উঠতো বলে আমাদের সুবিধা বেশি ছিল। জঙ্গলে অনেক বাঁশ গাছ, সেই বাঁশে আগুন ধরিয়ে দিলে সেগুলো শব্দ করে ফাটতো আর বৃটিশরা ভাবতো আমাদের আগ্নেয়াস্ত্র আছে।”
খোনোমা শেষ করে আমরা পেরেনের পথে আরও ২০ কিলোমিটার দূরে জুলেকে (Dzuleke) গ্রামের দিকে রওনা দিলাম। কোহিমা থেকে খোনোমার রাস্তা বেশ খারাপ, কিন্তু জুলেকের রাস্তা কহতব্য নয়। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে সাসপেনশন জবাব দেবে। ড্যানিয়েল দাঁতে দাঁত চেপে চালাতে লাগলো আর আমরা কোমর ধরে বসে রইলাম। জুলেকে যাবার উদ্দেশ্য ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আরেকটা সুন্দর গ্রাম দেখতে যাওয়া। সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দেখতে পেলাম নাগাল্যান্ডের জাতীয় পশু – মিথুন। মিথুন গরু ও মোষের মিলিয়ে একটা জন্তু। নাগারা মিথুনের শিং কে সাহস ও শৌর্যের প্রতীক বলে মানে। একদল বন্য মিথুন আমাদের দিকে তাচ্ছিল্যের চাউনি দিতে দিতে জঙ্গলে ঘোরাফেরা করছিল। আমরাও মোবাইল বাগিয়ে সবেগে ভিডিও তুলতে লাগলাম। জুলেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ননীয়, খোনোমার থেকেও ভালো তবে এখানে প্রকৃতি ছাড়া খোনোমার মত ইতিহাস নেই। জুলেকে থেকে ফেরার পথে উল্টোদিকের পাহাড় থেকে একটা আওয়াজ ক্রমাগত আসাতে ড্যানিয়েলকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বললো নাচুনে হরিণের (dancing deer) এর ডাক, ওই পাহাড়গুলো ওদের ডেরা।
এই পাঁচ ছয়দিন নাগাল্যান্ডে ঘুরে নাগাদের সম্বন্ধে কিছু আবছা ধারনা এবার লিখি। নাগারা অত্যন্ত পরিস্কার, নাগাদের প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরেও যে পরিচ্ছন্নতা আমি দেখেছি, সমতলের কোনো শহরেও, এমনকি কোলকাতা বা বম্বেতেও তার ছিটেফোঁটা দেখিনি। এদের মধ্যে পিএইচডি হয়তো বেশি নেই, তবে basic education এর চল অনেক বেশি। এদের গ্রামের বাচ্চারা সমতলের গ্রামের বাচ্চাদের থেকে অনেক well groomed, well behaved. শিশুকাল থেকে এই grooming এর ফলেই হয়তো এরা সমতলের লোকেদের থেকে অনেক বেশি disciplined, সংযত ও diligent; শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, আমাদের মতো গুঁতিয়ে লাইন ভাঙতে চায়না। আস্তে কথা বলা এদের অভ্যেস, কোনো “মল্লিকদা কেস” দেখিনি। অত্যন্ত বাহুল্যবর্জিত জীবনযাপন, খাওয়ার পেছনে পয়সা খরচ না করে fashionable dress বেশি ভালোবাসে। নিজেদের সবসময় presentable রাখতে চেষ্টা করে। এখানকার ছেলেমেয়েদের dressing sense সমতলের লোকজনের থেকে কম তো নয়ই, বরং এক কাঠি বেশি। এরা খুবই সঙ্গীতপ্রিয়, বিশেষ করে লোকগীতি ও western music -সর্বোপরি এরা খুবই অতিথিপরায়ণ, client handling যে কি তা এদের সাধারন লোকেরাও আমাদের বলে বলে শেখাবে। কোহিমা শিলিগুড়ি বা কোলাপুরের থেকেও ছোট শহর কিন্তু সেখানকার ও তার আশেপাশের গ্রামের মানুষজনকে দেখলেই তফাৎটা চোখে পড়ে। ইচ্ছে রইল আগামীবার পুরো নাগাল্যান্ড চষে ফেলার।
তবে হর্ণবিল উৎসবের সময়টা বেশ বেখাপ্পা মনে হচ্ছে। শীতকালে তেনাদের আদৌ দেখা পাওয়া যায়কি? আমাদের লাস্ট ট্রিপের মহলদিরামের কাছে লাটপঞ্চর নামে একটা জায়গা হর্নবিল পাখির জন্য বিখ্যাত। সেখানে গিয়ে শুনলাম শীতকালে তাদের দেখা পাওয়া কঠিন!
তখনই গুগল ঘেঁটে দেখেছিলাম হর্নবিলের দেখার বেস্ট টাইম ফেব্রুয়ারি-মার্চ!
হর্ণবিল এখন ডিমাপুরের চিড়িয়াখানা ছাড়া এখানে কোথাও বোধহয় পাওয়া যায়না। প্রথম দিন কনসার্ট মাঠে বসে শুনেছিলাম। আমার মাথায় টুপিও ছিলনা। তাড়ি আর ভদকার কম্বিনেশন বাঁচিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় দিন গ্যালারিতে বসে ছিলাম। শেষ সময়ে মাটিতে গিয়েছিলাম তপনের নাচ দেখতে।
Add comment