রাজায় রাজায় (ধারাবাহিক ১)
মনোজ কর, ১৯৮০ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
নবদ্বীপে অশীতিপর বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনকে অতর্কিত আক্রমণে শহর’ছাড়া করে বখতিয়ার খলজি আঠারো’জন অশ্বারোহীর ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে চলেছে গৌড়ের দিকে। সেই দুরন্ত গতির তীব্রতার সঙ্গে কেউই পাল্লা দিতে পারছিল না। প্রভু মহম্মদ ঘুরির কঠোর আদেশ – মাত্র একমাসের মধ্যে বঙ্গদেশ জয় করে যোগ দিতে হবে প্রভু মহম্মদ ঘুরির সঙ্গে যিনি এখন যুদ্ধে ব্যস্ত উত্তর ভারতে।
সমস্ত রাত্রি ঘোড়া ছুটিয়ে বখতিয়ার থামলো ঠিক সূর্যোদয়ের সময়। পথের দক্ষিণদিকে দিগন্তব্যাপী প্রান্তর। যতদূর দৃষ্টি যায়, সোনালী ধানে ঝকঝক করছে। কিন্তু আশেপাশে জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। হেমন্তকাল হবে মনে হয়। পথের পাশেই টলটল করছে একটা দীঘি। দীঘির ধারে অজস্র ফুলের গাছ। ফুটে আছে মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন, রাজঅশোক, ছাতিম, বকফুল ও গন্ধরাজ। পথের বামদিকে মাটি ঈষৎ লালচে ও রুক্ষ। একটু দূরেই একটা ছোট পাহাড়। পাহাড়ের ওপারপথের এইস্থান থেকে দৃশ্যগোচর হয়না। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের ওপার থেকে দিগন্তস্পর্শী নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে উদীয়মান সূর্যের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বখতিয়ার। আফগানিস্তান থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েক সহস্রাধিক ক্রোশ অশ্বপৃষ্ঠে ভ্রমণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমন অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য তার চোখে পড়েনি কোনওদিন। মুগ্ধ বিস্ময়ে সূর্যোদয়ের এই মনোহর দৃশ্য অবলোকন করে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে দীঘির নির্মল জল আকন্ঠ পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করল বখতিয়ার।
দীঘির জলে চোখ-মুখ ধুতেই দীর্ঘ অশ্বারোহণ ও বিনিদ্র রাত্রিযাপনের ক্লান্তি আর অবসাদ এক মুহূর্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মস্তিষ্কের সমস্ত কোষ যেন জাগ্রত হয়ে উঠলো বখতিয়ারের। হঠাৎ মনে হলো গুপ্তচরদের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে এই জায়গাটা। তবে কি বঙ্গদেশের অভ্যন্তরস্থ এই ভূখন্ডের নামই স্বর্ণভূমি? মাথার মধ্যে দুন্দুভি বেজে উঠলো বখতিয়ারের। তবে কি এই সোনালী সাম্রাজ্যের অধীশ্বর সেই মুকুটহীন রাজা সোমনাথ যার এক ডাকে হাজার হাজার মানুষ জীবন বাজি রাখতে পারে? এই সূর্যালোকিত প্রত্যূষে যেন নিশির ডাক শুনতে পায় বখতিয়ার।
খানিকটা পথ এগিয়ে ডানদিকে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে একটা রাস্তা। এই রাস্তা নিশ্চয়ই গেছে সোমনাথের প্রাসাদের দিকে। এই পথেই যেতে হবে তাকে। এই সাম্রাজ্য তাকে জয় করতেই হবে। ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় বখতিয়ার। একবার মনে হল কেবলমাত্র একটা অসি সম্বল করে রাজপ্রাসাদে সোমনাথের মুখোমুখি হওয়াটা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো, যে দেশের মাটিতে এমন সোনার ফসল ফলে, যে দেশের দীঘির জল এত মধুর, যে দেশের গাছে গাছে এমন ফুলের বাহার সে দেশের রাজা আর যাই হোক নিষ্ঠুর হতে পারে না। গুপ্তচরদের থেকেও সোমনাথ সম্বন্ধে এমনই একটা ধারণা পেয়েছে সে। তবুও ঝুঁকি একটু আছেই। তার অভিপ্রায়ের সামান্য আঁচ পেলেই সোমনাথ যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে না সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কিন্তু নিজের বুদ্ধির ওপর ভর করে ঝুঁকি এখন নিতেই হবে। সঙ্গে লোকজন থাকলে সন্দেহও বাড়বে বই কমবে না। তাছাড়া হাতে সময়ও কম।
লাগামের আলতো টানে গতি বাড়াবার ইঙ্গিত পায় বখতিয়ারের বাহন। বেশ কিছুক্ষণ পরে পথের ধারে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের সামনে এসে দাঁড়ায় বখতিয়ার। বেশ কিছু মানুষের জমায়েত সেখানে। অপরিচিত বখতিয়ারকে দেখে একজন লোক এগিয়ে আসে ওর দিকে। জিজ্ঞাসা করে, ’কাউকে খুঁজছেন?’
বখতিয়ার উত্তর দেয়, ’এটাই কি স্বর্ণভূমি?‘
লোকটা উত্তরে ঘাড় নাড়ায়।
বখতিয়ার শুধোয়, ‘রাজা সোমনাথের প্রাসাদটা কোথায় বলতে পারেন?’
লোকটা হয়ে বলে, ’প্রাসাদ! আমাদের স্বর্ণভূমিতে কোনও প্রাসাদ নেই। আপনি সোমনাথকে খুঁজছেন? সে এখানেই আছে। কাল নবান্নের অনুষ্ঠান। এখানে তারই প্রস্তুতি চলছে।‘
সোমনাথ এখানে আছে শুনে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে বখতিয়ার। আস্তে আস্তে আসে লোকটার পিছু পিছু। লোকটা এসে থামে এক দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ, সুপুরুষ যুবকের সামনে। যুবকটির চোখ দু’টি উজ্জ্বল এবং মুখে মৃদু হাসি। পরণে সাধারণ কিন্তু পরিপাটি পোষাক।
লোকটা বখতিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে,’ ইনিই সোমনাথ। ‘সোমনাথ, ইনি তোমার সন্ধান করছিলেন।‘
সকলকে অবাক করে দিয়ে সোমনাথ বলে, ’আমি আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। আপনি আসবেন আমি জানতাম। আপনাকে স্বর্ণভূমিতে স্বাগত। কাল আমাদের ধানকাটা আর গোলায় ধানতোলার উৎসব। এই প্রাঙ্গনে তারই প্রস্তুতি চলছে। এখানে আপনার উপযুক্ত বসার জায়গা নেই। আসুন আমার সঙ্গে আমার কুটিরে। রঞ্জন, ওনার অশ্বটিও পথশ্রমে ক্লান্ত মনে হয়। ওর পরিচর্যা এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করো।‘
বখতিয়ার সত্যিই অবাক হয়ে যায়। পথ চলতে চলতে জিজ্ঞাসা করে, ’আপনি কী করে যে জানলেন আমি আসবো?’
সোমনাথ উত্তর দেয়, ’যেমন করে আপনি জানলেন এই ভূখন্ডের নাম স্বর্ণভূমি আর আমি সোমনাথ।‘
– খুব অদ্ভুত মানুষ আপনি। আপনাকে দেখে মনেই হয়না আপনি স্বর্ণভূমির রাজা। আপনি সাধারণবেশে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনায়াসে মিশে যেতে পারেন দেখে খুবই অবাক হয়েছি।
– বখতিয়ার খলজি, প্রথমেই বলে রাখি আমি কোনও রাজা নই। আমি মূলত কৃষক। আমি একজন অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। আপনি হয়তো জানেন না যে, স্বর্ণভূমিতে কোনও রাজা নেই বা বলা যায় স্বর্ণভূমিতে সবাই রাজা।
– আপনার প্রাসাদ কত দূর?
– স্বর্ণভূমিতে কোনও প্রাসাদ নেই। ঐ যে কুটির দেখছেন সামনে ওটিই আমার নিবাস। স্বর্ণভূমির যে কোনও গৃহেই আপনি অতিথি। তবে আজ অনুগ্রহ করে আমার কুটিরেই আতিথ্য গ্রহণ করুন। জানি এই কুটির আপনার মতন সন্মানীয় মানুষের বাসের উপযোগী নয় তবুও কয়েকটা দিন এখানেই থাকুন। আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, যে আপনার যত্নের কোনও ত্রুটি হবে না।
– সোমনাথ, একথা বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি ভেবেছিলাম আর পাঁচজন ভূস্বামীর মত আপনিও রাজবেশধারী, আপনিও প্রাসাদনিবাসী এক রাজা। এত ঐশ্বর্যের মালিক হয়েও আপনার এই নিরারম্বড় জীবনযাপন সত্যি আমাকে বিস্মিত করেছে।
– বখতিয়ার, আবার আপনি ভুল করছেন। আমি কোনও ঐশ্বর্যের মালিক নয়। স্বর্ণভূমির সমস্ত সম্পদে স্বর্ণভূমির সমস্ত মানুষের সমান অধিকার। আমরা সবাই সাম্যের এবং একতার পূজারী।
– সোমনাথ, আপনাকে আমি যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম আপনি যদি আমার পরিচয় এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পূর্বেই অবগত থাকেন তাহলে হয়ত দেখামাত্রই আমাকে হত্যা করবেন অথবা খোলা তরোয়াল হাতে নিয়ে আমাকে স্বাগত জানাবেন। আমি যুদ্ধ করি, তাই হয়তো সদা সন্দেহগ্রস্থ মন আমার। বিশ্বাসই হয় না যে আপনার পরম শত্রু জেনেও আঘাত করা দূরে থাক আপনি আথিতেয়তার কোনও ত্রুটি রাখছেন না। এক একবার মনে হচ্ছে কোনও গভীর চক্রান্তের শিকার তো হয়ে গেলাম না আমি?
– এ আপনার মনের ভ্রম, বখতিয়ার। সত্যাচরণ আমাদের শক্তি। দুর্বলেরাই মিথ্যাভাষণ, ছলনা এবং অতর্কিত আক্রমণের আশ্রয় নেয়। আপনি ক্লান্ত। নির্দ্বিধায় স্নান সেরে, বসন পরিবর্তন করে, আহার গ্রহণ করে বিশ্রাম নিন। বাকি কথা বিকালে হবে। আমি এখন আসি। আমার ভাই সতীনাথ আপনার দেখাশোনা এবং পরিচর্যার জন্য এখানে রইল। কোনও সঙ্কোচ করবেন না।
– সোমনাথ, আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই।
অজস্র প্রশ্ন মাথার মধ্যে আলোড়িত হতে থাকে বখতিয়ারের। কিছুতেই স্থির হতে পারে না সে। সোমনাথের কথার জালে বিভ্রান্ত না হয়ে স্বর্ণভূমির অস্ত্রাগার এবং কোষাগারের সন্ধান চাই তার। জানা প্রয়োজন সৈন্যবাহিনীর বিশদ খুঁটিনাটি। গুপ্তচরেরা এখনও এই সব প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করতে পারেনি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার মূল্যবান পুরস্কারের লোভ দেখিয়েও স্বর্ণভূমির কোনও মানুষের কাছ থেকে কোনও খবর সংগ্রহ করা যায়নি। একজন নাগরিকও শিকার হয়নি প্রলোভনের। অধিকতর বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে গুপ্তচরের উপস্থিতি এবং পরিচয় সম্পর্কে অবগত হয়েও তাদের বন্দি বা হত্যা করার কোনও চেষ্টা করেনি সোমনাথ। নিজের মনের মধ্যে এই সব নানাবিধ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর চিন্তা করতে করতে সুস্বাদু মধ্যাহ্নভোজের পর ঘুমিয়ে পড়ল বখতিয়ার।
ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বেশ চনমনে লাগলো বখতিয়ারের। মস্তিষ্কের মধ্যে আবার বেজে উঠলো রণদুন্দুভি। নরম তুলোর বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দেখলো প্রাঙ্গনেই অপেক্ষা করছে সোমনাথ। বখতিয়ারকে দেখে দ্বিপ্রাহরিক অভিবাদন জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,’ আহার, নিদ্রার কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি তো। আমাদের আয়োজন স্বল্প। তবুও আথিতেয়তার কোনও ত্রুটি হয়নি তো?’
‘এ কথা বলে আমায় লজ্জা দেবেন না।‘ বললো বখতিয়ার।
– আসুন বখতিয়ার। বসুন। এবার বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি?
– সোমনাথ, আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে গতকালই নবদ্বীপের রাজা লক্ষণসেনের সৈন্যবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমার গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাত্র আঠারোজন ঘোড়সওয়ার আমার সঙ্গে নবদ্বীপ পৌঁছতে পেরেছিল। লক্ষণসেন গোপনে নবদ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আমি একাই গৌড়ের পথে যাচ্ছিলাম। একজন অশ্বারোহী সৈনিকও আমার গতির পাল্লা দিতে পারেনি। আমার কাছে সংবাদ ছিল যে পথিমধ্যে স্বর্ণভূমি পড়বে। কাল সারারাত ঘোড়া ছুটিয়ে আজ ঠিক সূর্যোদয়ের সময়ে আমি এসে পৌঁছই আপনাদের এই স্বর্ণভূমির দ্বারপ্রান্তে। সুজলা সুফলা বঙ্গদেশ জয় করার এই অভিযানে আমি একাই স্বর্ণভূমি জয়ের উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। আপনি বুদ্ধিমান এবং আপনার দেশব্যাপী বিছানো গুপ্তচরজাল মারফৎ এই সংবাদ যে অনেক আগেই আপনার কাছে এসে পৌঁছেছে সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু আমি বিস্মিত এবং কিছুটা চিন্তিত এই ভেবে যে সবকিছু অবগত হয়েও আপনি আমাকে অতিথি হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি রাখেন নি।
– বখতিয়ার। আমি স্বর্ণভূমির জনসাধারণের প্রতিনিধি মাত্র, এবং স্বর্ণভূমির নীতি অনুযায়ী আমি আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। সে কথা থাক। আপনি স্বর্ণভূমির কী কী জয় করতে চান?
– সবকিছু। সবকিছু। স্বর্ণভূমির অস্ত্রাগার, কোষাগার, রাজপ্রাসাদ …
– আপনার আবার ভ্রম হচ্ছে বখতিয়ার। আমাদের কোনও অস্ত্রাগার, কোষাগার এবং রাজপ্রাসাদ নেই। স্বর্ণভূমির প্রতিটি গৃহই আমাদের অস্ত্রাগার, কোষাগার এবং রাজপ্রাসাদ।
– আমি অনেক রাজ্য জয় করেছি সোমনাথ। কিন্তু এমন রাজ্য কোনওদিন দেখিনি। এখন বুঝতে পারছি শত অনুসন্ধান করেও আমার গুপ্তচরেরা কেন অস্ত্রাগার, কোষাগার এবং রাজপ্রাসাদের খোঁজ পায়নি।
– এটাই সত্য। যার প্রয়োজন এবং অস্তিত্ব দুটোই নেই তাকে কী করে খুঁজে পাবে? আপনি মিথ্যাই ওদের বরখাস্ত করতে চেয়েছিলেন।
– কী অদ্ভুত! তাহলে যুদ্ধ হবে কার সঙ্গে? কী করে আমি জয় করবো এই সোনা ফলানো মাটি, ভূগর্ভস্থ মূল্যবান ধাতু এবং স্বর্ণভূমির মানুষের প্রতি আমার একচ্ছত্র অধিকার?
– তবে বলি বখতিয়ার। আমাদের এই স্বর্ণভূমির মাটি, খনি এবং মানুষ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় যে যুদ্ধ করে তার অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। এই মাটি এবং ভূগর্ভস্থ আকরিকের অধিকার আমাদের মত আপনারও আছে। তার জন্য যুদ্ধের কোনও প্রয়োজন নেই। আপনি যত খুশি মাটি এবং খনিগর্ভস্থ আকরিক সংগ্রহ করতে পারেন। আমরা কোনও বাধা দেব না। কিন্তু এই সব সংগ্রহ করে আপনি কী করবেন? আপনার আসল অভিপ্রায় কী?
– আমার উদ্দেশ্য অস্ত্র, অর্থ এবং সম্পদ সংগ্রহ। কিন্তু কার সঙ্গে যুদ্ধ করবো আমি? তোমাদের কোনও সৈন্যবাহিনী নেই, সেনাপতি নেই। কাকে বন্দি করবো আমি? তোমাদের তো কোনও রাজাই নেই।
– স্বর্ণভূমির প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই সৈনিক। তবে মাসমাইনের সৈনিক নয় ওরা কেউ। ওরা কেউ কৃষক, কেউ কুমোর, কেউ কামার, কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ শ্রমিক। ওরা সবাই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। স্বর্ণভূমির কোনও মানুষ যুদ্ধ করে সংসার প্রতিপালন করে না। এখানকার জল, মাটি এবং খনিগর্ভের অধিকার এখানকার সমস্ত মানুষের। এখানে কোনও খাজনাপ্রথা নেই তাই কোনও রাজাও নেই। তাই রাজকোষাগারও নেই।
– আশ্চর্য্য? এমন সঙ্কটে আমি তো আগে কোনওদিন পড়িনি। সাধারণ যুদ্ধের ব্যাকরণ এখানে অচল। স্বর্ণভূমির মাটি, খনি এবং সম্পদ যেহেতু সমবন্টিত তাই সকলকে হত্যা করা ব্যতীত এই ভুখন্ডের উপর একচ্ছত্র অধিকালাভের আর কোনও উপায় নেই।
– বখতিয়ার। ভেবে দেখুন তো। এই সকলকে হত্যা করে এক জনমানবহীন রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে আপনি কী করবেন? কাদের রাজা হবেন আপনি? মানবসম্পদ ব্যতীত আর সমস্ত সম্পদ মূল্যহীন। শ্রমই একমাত্র সম্পদ। মানুষের শ্রমই সৃষ্টি করে সোনার ফসল, আর মাটির নিচের মূল্যহীন আকরিক থেকে তৈরি করে মূল্যবান ধাতু, ধাতুকে পরিণত করে অলঙ্কারে এবং প্রয়োজনীয় অজস্র উপাচারে। প্রতিটি মানুষই তাঁর সমাজের সম্পদ সৃষ্টি করে। তাই প্রতিটি মানুষকে শিক্ষিত এবং কুশলী করে তোলাই সম্পদ সৃষ্টির একমাত্র পথ। একটি মানুষের মৃত্যুর অর্থই একটি সম্ভাবনার বিনাশ, প্রকৃত সম্পদের হ্রাস।
খানিক থেমে বখতিয়ার বললো,
– শুনুন সোমনাথ। মানবসম্পদই যে একমাত্র সম্পদ সে কথা অনস্বীকার্য। সে সত্য বৈজ্ঞানিক এবং চিরন্তন। তাই গণহত্যা নয়, রাজাকে নিধন করে মানুষের প্রতি নিজের অধিকার কায়েম করাই রাজ্যজয়ের প্রথাগত উপায়। কিন্তু আজ আমি স্বীকার করি, যে স্বর্ণভূমিতে সে উপায় অবলম্বন করার কোন পথই নেই। স্বর্ণভূমির শক্তি তাঁর বলশালী রাজা বা বিশাল সৈন্যবাহিনী নয়। স্বর্ণভূমির শক্তি তার ঐক্য এবং সমবন্টন ব্যবস্থা। সাম্যনীতিই স্বর্ণভূমির আসল শক্তি সে সত্য আমি নিজে এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না। কিন্তু তবুও আমাকে স্বর্ণভূমি জয় করতেই হবে। তা না হলে আমার দিল্লীর মসনদে বসার উদ্দেশ্য সফল হবে না। যুদ্ধ নয়, স্বর্ণভূমিকে জয় করার অন্য রাস্তা আমায় বের করতেই হবে।
– কী সেই রাস্তা? কোনও রাস্তা নেই বখতিয়ার। এই ব্যবস্থার শক্তিকে স্বীকার করে স্বর্ণভূমিতে একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকাই আপনার পক্ষে শোভন এবং উচিতকার্য হবে। কাল প্রাতে নবান্ন উৎসবে আপনি আমাদের অতিথি। আজ বিশ্রাম নিন, বখতিয়ার।
বখতিয়ার শুনলো। কিন্তু মন যে মানতে চায় না। প্রভু মহম্মদ ঘুরির আদেশ, এই স্বর্ণভূমি জয় করতেই হবে। খানিক দ্বিধা নিয়েই বললো,
– সোমনাথ। রাজ্য জয়ই আমার জীবনের একমাত্র ব্রত। ছলে বলে কৌশলে দিল্লীর মসনদ দখল আমাকে করতেই হবে। শত যুদ্ধে বিদীর্ণ আমার এই পাশবিক শরীর, অস্ত্রঘাতে ক্ষতবিক্ষত ,কুদর্শন এবং বিকৃত আমার মুখমন্ডল। কোনও নারীর এবং শিশুর হৃদয় আমার জন্য কোনওদিন বিগলিত হয়নি। আমার হৃদয় এবং মস্তিষ্ক সদাসর্বদাই আমাকে মসনদের দিকে টেনে নিয়ে চলে দুর্নিবার আকর্ষণে। আমার হাতে সময় কম। আমার আয়ু সীমিত কিন্তু জয়ের জন্য অপেক্ষা করছে আরও অনেক রাজ্য। আজ রাত্রেই আমাকে চলে যেতে হবে। কাল সূর্যাস্ত আমার গৌড়বিজয়ের পুর্বনির্দিষ্ট ক্ষণ। আমার দুঃখ রয়ে গেল এইজন্য যে আমার চলার পথে স্বর্ণভূমি জয়ের ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গেল। তবে যাবার আগে আর এক উপলব্ধ সত্যের কথা আপনাকে বলে যাই সোমনাথ।
– বলুন বখতিয়ার। স্বর্ণভূমিতে অধিষ্ঠানকালে যদি কোনও সত্যের উপলব্ধি আপনি করে থাকেন তবে সে তো আমাদের পরম গর্বের বিষয়। আপনি অনুগ্রহ করে আপনার সেই উপলব্ধির কথা বলুন, বখতিয়ার।
– আমি এখানে অযাচিত হয়ে এসে বুঝতে পারলাম যে, আপনাদের স্বর্ণভূমির অর্থনীতি এবং শাসনব্যবস্থা তাঁর ঐক্য এবং সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। সেই কারণে এই ব্যবস্থা অত্যন্ত দৃঢ় এবং এবং আপন মহিমায় বিরাজমান। এ আমি নিজের চোখে দেখে গেলাম। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই একমত হবেন যে এই ব্যবস্থার অধীনস্থ প্রতিটি মানুষই একে অপরের থেকে ভিন্ন। অর্জিত বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, অনুশীলিত পটুতায়, ধর্মবিশ্বাসে, মূল্যবোধে এবং যোগ্যতার আপেক্ষিকতায় প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র এবং একজন অপরের থেকে আলাদা। সম্পদ সৃষ্টির মাপকাঠিতেও সব মানুষ সমান নয়। সুতরাং ঐক্য, সাম্য এবং সম্পদের সমবন্টন যোগ্যতরদের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় নাও হতে পারে। প্রকাশিত না হলেও তাদের অন্তরে এই ক্ষোভ পূঞ্জীভূত হচ্ছে না এ কথা হলফ করে বলা যায় না। এই সত্যের উপর ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি এবং স্বর্ণভূমির বহু কষ্টার্জিত ঐক্য এবং সাম্যের দূর্গে ফাটল ধরানোই আমার যুদ্ধজয়ের চাবিকাঠি হতে পারে। এমন ভাবাও আশ্চর্য হবে না যে আপনার বিশ্বস্ত সহনাগরিকদের মধ্যেই কেউ হয়তো নিজেকে নেতা হিসাবে আপনার চেয়ে যোগ্যতর মনে করেন এবং মনে মনে নেতৃত্বলাভের আকাঙ্খাও করেন। সুযোগ বুঝে তিনি আপনার বিরুদ্ধাচরণ করলেও করতে পারেন।
এই কথা বলে আর কোনওদিকে না তাকিয়ে তীব্রগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে গৌড়ের পথে বিলীন হয়ে গেল বখতিয়ার খলজি।
Add comment