পাঁচটি ছোট গল্প
অনিরুদ্ধ রায়, ১৯৮৩ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
১।
রাত্রি তখন দশটা। কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে নিরিবিলিতে এক সাধু বসে আছেন, কিছুক্ষণ বাদেই আর একজন সাধু সেখানে উদয় হয়ে তার পাশে বসে সম্ভাষণ করল – ওঁ নমঃ নারায়ণায় ।
প্রথম সাধু দ্বিতীয় সাধুকে বলল – নমঃ নারায়ণায়, আপনি কোন সম্প্রদায়ের?
– গিরী, আপনি?
– আমি পুরী সম্প্রদায়ের। আপনি কোন আখড়ার?
– জুনা, মহামন্ডলেশ্বরের প্রেসিডেন্ট মহারাজ,
খানিক থেমে বললেন, “১০০৮ শ্রী শ্রী গীরিজা মহারাজের কাছে আমার দীক্ষা। আপনি?”
– আমি অগ্নী আখড়ার সাধু, ওখানে সেক্রেটারি নির্বাচনে সাধুদের মধ্যে ভীষণ খাওয়া খাওয়ির আচরণ, তাই আমার সাথে এই আখড়ার এখন কোনো সম্বন্ধই নেই। আমি এখন রমতা যোগী। আজই কাশীতে এসেছি।
– ভোজন করেছেন? মণিকর্নিকা ঘাটে জলসত্রের পাশে আজ সাধু ভান্ডারা আছে।
– না। ওদিকে বড্ড ভিড়। আমি সূর্যাস্তের পর ফলাহার করেছি,রাতে আর কিছু খাব না।
– তা, আপনার কাছে কি গঞ্জিকা আছে?
– হ্যাঁ, আছে।
তারপর কল্কে বার করে দুই সাধু গাঁজা সেবন করতে লাগলেন।
এদিকে একটা ছিঁচকে চোর পেছন থেকে সব দেখছিলো আর সাধুদের সব কথাই কান খাড়া করে শুনছিল। সে গৃহস্থদের ঘরেই চুরি করে, সাধুদের মাল কোনোদিন ঝাড়েনি কারণ তার সাধু-সন্তদের ওপর ভয়-ভক্তি বিদ্যমান। চোর ভাবলো – গৃহস্থদের যেমন পদবী, গোত্র, বংশমর্যাদা দিয়ে পরিচয়, এই সাধুদেরও তো দেখছি সঙ্ঘ, আখড়া দিয়েই পরিচিতি। এরাও তো খায়, দায়, নেশা করে আর গাল-গপ্প মারে। তাহলে তফাৎটা কোথায়? এরা তো আর দিব্যি পাঁচ জনের মতোই সাধারণ মানুষ!
গাঁজা খেয়ে ওঠার পরে সাধুরা দেখে তাদের কমন্ডলু দুটো নেই।
এক সাধু বলে – আমার কমন্ডলুর মধ্যে আশি টাকা ছিল।
দ্বিতীয় জন বললো – আমার কমন্ডলুতেও টাকা পঞ্চাশেক ছিল। যাক ব্যাটার একটা দিন তো চলে যাবে।
******
২।
প্রেমাকে আমার বেশ লাগতো, মনে হতো ওরও আমাকে নিশ্চয়ই ভালো লাগে। তাই একদিন সুযোগ বুঝে প্রোপোজ করেছিলাম। ও বললো – তোমার সাথে আমার হবে না। আমার ভালোবাসার যোগ্য তুমি নও। তুমি তো অতি সাধারণ।
আমি আহত হলাম। আর একটিবারের জন্যও সাধাসাধিতে যাইনি। মানে মানে সরে পড়লাম। কিছুদিন বাদে প্রেমার মাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। ওদের বাড়িতে গেলাম। উনি বললেন, তুমি প্রেমাকে প্রোপোজ করেছিলে? শোনো,তোমার আর ওর লেভেল আলাদা, তুমি ওর যোগ্য নও। তাই বলছি ভালোয় ভালোয় কেটে পড়।
– হ্যাঁ, সে কথা প্রেমা আমাকে বলেছে।
– তবুও বলি। ও ছেলেমানুষ। কখন আবার তোমার চাপে হ্যাঁ বলে বসবে। তা বাপু আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি একদম ওর সাথে মিশবে না।
আমি আর প্রেমার সাথে কথা বলারও সাহস করিনি।
এরপর প্রেমার বাবাও আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু আমি ওদের বাড়ি যাইনি।
তারপর অনেকদিন বাদে প্রেমার সাথে হাজরা মোড়ে দেখা।
বিবাহিত প্রেমা খুবই বিধ্বস্ত, চেহারায় কোনো চাকচিক্য নেই। জিজ্ঞেস করলাম- প্রেমা কেমন আছো?
– দেখতেই তো পাচ্ছ কেমন আছি। তুমি তো আর আমায় বিয়ে করলে না?
– আরে বাঃ, সে কী কথা! তুমি আর তোমার মাই তো আমাকে বলেছিলে, তোমার আর আমার লেভেল আলাদা। আমার সরে যাওয়াই উচিৎ?
– কিন্তু বাবা যখন ডেকে পাঠাল তখন যাওনি কেন? আমাদের বাড়িতে বাবাই তো ফাইনাল কথা বলে।
*****
নিছক প্রেম করার পাত্র আমি নই, তবু জন্মদিনে সীমা যখন কাজের মেয়ের হাত দিয়ে খামের মধ্যে আমাকে একটা গোলাপ ফুল পাঠালো, আমি তখন প্রেমিক সুলভ ব্যবহারই করলাম। একটা টেক্সট্ মেসেজ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিলাম – তোমার ফুল আমার প্রেরণা, রূপে মুগ্ধ, গন্ধে পাগল, মনে হচ্ছে এক্ষুনি দৌড়ে তোমার কাছে গিয়ে তোমার গভীরে আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দি। অধীর আগ্ৰহে তোমার উত্তরের অপেক্ষায় আছি —-
সীমা সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট করল পরপর কটা ছবি, একটা টোপর পরা বরের মুখ, একটা কুঁড়েঘর, একটা ঘড়ি, আর শেষে SO লেখা।
মানেটা আমি যা বুঝলাম – বিয়ে করো, না হয় ঘরে বসে অপেক্ষা করো ভালো সময়ের জন্য।
পরেরদিন গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্ট্রিতে একটা কাজ ছিলো, সিকিউরিটির কাছে মোবাইল ফোন জমা রেখে সারাদিন ভেতরে থাকতে হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলায় মোবাইল হাতে পেয়ে দেখি সীমার টেক্সট। লিখেছে – সুযোগ দিয়েছিলাম, জানিয়েছিলাম যে বর বাড়িতে, কাল এসো। বোঝোনি, আমাকে বোঝার ক্ষমতা তোমার কোনোদিনই হলো না। আর কখনো যোগাযোগ কোরো না। বোকা হাবা লোক আমি সহ্য করতে পারি না ।
*****
৩।
এক মেস বাড়িতে একজন অবিবাহিত ঝি কাজ করতো। সেই ঝি একদিন পোয়াতি হয়ে গেলো। সবাই তাকে চেপে ধরলো, বল এ কার কীর্তি?
ঝির উত্তর – সব বাবুরাই তো পালা করে সঙ্গ দিয়েছে কার গুণে হয়েছে আমি কী করে বুঝব?
সর্বনাশ! আটজন বোর্ডারই ফেঁসে গেল। কুকীর্তিটা কিন্তু বেহিসাবি একজনের, আর বাকি সাতজন হয়ে গেলো ভুক্তভোগী।
সবাই ঝিটাকে বোঝালো – তুই ঝামেলা খালাস কর। টাকা কড়ি যা লাগে আমরা দেব।
ঝি কিছুতেই মানে না,সে বাচ্চা বিয়োবেই। মেসের লোকেরা যাই বলুক পাড়ার লোকজন সবাই ঝিয়ের পক্ষে। অবশেষে ঝিয়ের একটা ছেলে হলো। সেই থেকে ঐ মেস বাড়িটার নাম হয়ে গেল আট-বাবা মেস বাড়ি।
আট বাপের হেপাজতে ছেলে মানুষ হতে লাগলো। বাবারা আদর করে তার নাম রাখল রাজা। তার বুদ্ধি তুখোড়, নীতিজ্ঞান অভিনব। সে আট বাপের যখন যার পদবী ব্যবহারে সুবিধা সেটাই করত।
সেই ছেলে আট আটজন বাপের তত্বাবধানে অল্প বয়সেই অর্থে-সামর্থ্যে প্রভাবশালী হয়ে তাঁবেদার বাহিনী জুটিয়ে বিখ্যাত হয়ে গেল।
*****
৪।
মা দুপুরে খাটে শুয়ে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। সোনা ফ্রিজ খুলে স্প্রাইটের বড়ো বোতলটা বার করে বসার ঘরের চৌকির ওপর বসে বাঁটুল দি গ্ৰেট সমগ্ৰটা নিয়ে পড়তে বসলো। মা দুপুরে বাড়ির বাইরে গেলে ভীষণ রাগ করে, চারদিকে ছেলেধরারা ওৎ পেতে আছে। খিড়কি পুকুরের কাছেও যেতে মানা করে, ওখানে নাকি জল দৈত্য আছে।
সোনা বাঁটুল দি গ্ৰেট পড়তে পড়তে পুরো স্প্রাইটটাই উদরসাৎ করে দিলো। হঠাৎ পুকুরে টুপ করে একটা আওয়াজ হতেই সোনা দরজা খুলে পুকুরপাড়ে এসে দেখে সন্তুর নীল দেড় তেল ঘুড়িটা জলে ভাসছে। ঘুড়িটা পুকুরপাড়ের কাছেই পড়েছে, পড়ন্ত দুপুরের সূর্যের আলোয় ঘুড়িটা ঝকঝক করছে। সোনা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, জলে নেমে ঘুড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো। কোমর জলে পৌঁছে দেখে কিসে যেন পা আটকে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছে না। কেমন জেলির মতো থকথকে কিছু যেন পাদুটোকে ধরে রেখেছে, আবার একটু একটু করে পুকুরের মাঝখানে টানছে।
হঠাৎ ঘুড়িটা বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল। এবার সোনার বেদম ভয় পেয়ে গেলো, গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোচ্ছে না। দেখে লালু আর ভুলু কোথা থেকে ছুটে এসে পুকুর পাড়ে ঘৌ-ঘৌ করে বিকট চেঁচাতে লাগলো। এঁদের আচমকা চেঁচামেচিতে বাঁধনটা যেই না একটু আলগা হয়েছে, সোনা এক ঝটকায় পা ছাড়িয়ে পাড়ে উঠে দেখে পেছন থেকে একটা জলের ঘুর্ণি ধাওয়া করছে। লালু, ভুলুও ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে দে দৌড়। সোনাও উঠে ছুটতে লাগল, ঘুর্ণিটাও ওর জলপায়ের ছাপ ধরে পেছন পেছন আসছে। বাগানের তালগাছটাকে সামনে পেয়ে সোনা সেটাতেই হ্যাঁচড় পাঁচড় করে উঠে পড়লো। সেই ঘুর্ণি জলের স্তুপও তালগাছের তলায় ঢিপি হয়ে স্থির হয়ে গিয়ে আর যেন সরে না। কেমন যেন হাত, পা ওয়ালা দৈত্যর মতো চেহারা !
সোনা বেশ শক্ত করে গাছের পাতা ধরে ঝুলে থাকলো। এবার কিছুক্ষন বাদেই সোনার প্রবল হিসু পেতে বেগ যেন আর সে ধরে রাখতে পারছে না। শক্ত করে তালপাতা আঁকড়ে ছড়ছড় করে হিসু করেই দিলো। এবার পেচ্ছাপ মাটিতে পড়তেই সেই জলদৈত্যটা পেচ্ছাপ বেয়ে ওপরে উঠে আসতে লাগলো। সোনা তখন হিসু চালু রেখেই আরো একটু ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। দৈত্য বেটাও উঠছে প্রায় ধরে ফেলল বলে এমন সময় একটা তাল ছিঁড়ে ধপ করে নীচে পড়ল, ভয়ের চোটে সোনার হিসুও বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাস, জলদৈত্যটা তখন অনেক উঁচু থেকে ঝপাৎ করে মাটিতে পড়ে জল হয়ে গেল, মাটি এখন সেই জল শুষে নিচ্ছে।
যাক বিপদ গেছে, কিন্তু এখন নামবে কী করে? কোথা থেকে একটা কাঠ ঠোকরা এসে কানে ঠুকরে দিচ্ছে – এই ভাগ, ভালো হবে না কিন্তু। এই বদমাইশ পাখি আবার কান ধরে টানে!
আরে পাখি কোথায়? এ তো মা !
মা চেঁচিয়ে যাচ্ছে – আধ দামড়া ছেলে, বিকেলবেলায় বিছানায় হিসু করে ভাসিয়ে দিলি ?
*****
৫।
আমাদের বন্ধুদের হোয়টস অ্যাপ গ্ৰুপে একশ জনের ওপর মেমবার, জন্মদিনে সবাই একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানায়। যে সব থেকে ইনএকটিভ মেম্বার সেও লেখে।
অথচ আমার আজকাল সব কিছুতেই চরম ল্যাদ, জন্মদিনের শুভেচ্ছা বাণী টাইপ করতেও ল্যাদ। গত বুধবার দেখি এক বন্ধুর জন্মদিনে গ্ৰুপে গুচ্ছ গুচ্ছ শুভেচ্ছা বাণী ঝড়ে পড়ছে। আমি চোখের সামনের একটা বাণী কপি পেস্ট করে শুভেচ্ছা জানিয়ে দিলাম। ব্যাস, জব ডান।
তারপর অনেকক্ষণ বাদে দেখি যাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি সেই আমাকে শুধাচ্ছে “কিরে তাপসের শুভেচ্ছা মেসেজটা কপি পেস্ট করলি কেন?”
তাপসটা যে শেষে নিজের নাম লিখে দিয়েছে সেটা আমি খেয়াল করিনি। রামছাগল একটা। শেষে একগাদা কথা লিখে তাপসকে ঝাড়লাম ,- অশিক্ষিতের মতো জন্মদিনের উইশে নিজের নাম লিখিস কেন? এই সব তুচ্ছ লেখায় কি তুই নোবেল প্রাইজ পাবি, কপি রাইট রাখছিস যে বড়ো ? এটা যে হোয়াটস্ অ্যাপ বিরোধী কাজ, জানিস না? সেই এতগুলো কথা লিখতেই হলো।
আজকে দেখি ওখানে জোড়া জন্মদিন। তাই আলাদা আলাদা উইশ করলাম। কারো কোনো পোস্ট কপি করিনি। কিন্তু তাড়াহুড়োয় জন্মদিন বানানটা জষ্ণদিন হয়ে গেছে। দুটো মেসেজেই, কারণ দ্বিতীয়টা কপি পেস্ট ,খালি নামটা ইরেজ করে আর একটা নাম টাইপ করেছি।
ওমা,এখন দেখি সেই তাপসটাও উইশ করেছে “শুভ জষ্ণদিন, বন্ধু”!
বদমাইশ ছেলে, আমার মেসেজটাই কপি পেস্ট করেছে। কোনো এথিক্স নেই মাইরি!
Add comment