পরীর পরীক্ষা
লেঃ জেনারেল প্রদ্যোত কুমার মল্লিক, ১৯৭৮ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
সেটা ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি। আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে। আমাদের ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র কয়েকদিন বাকী। কয়েকদিন মানে সত্যি কয়েকদিন। আমরা শেষ মুহুর্তে যারা যারা স্টেজে মেরে দেওয়ায় বিশ্বাসী তাদের এখন নাওয়া- খাওয়ার সময় নেই। —– উল্টে আমাদের পড়াশোনা চলছে।
হঠাৎই খবর এলো যে পরী ফিরে এসেছে। এই পরী মানে প্রণব ব্যানার্জী। কেন, কি কারণে যে তাঁর নাম প্রণব থেকে পরী হয়ে গেলো সেটা আজ ইতিহাস ঘেঁটেও পাওয়া যাবে না।
পরী, মানে আমাদের প্রণব গ্রীষ্মের ছুটিতে সেই যে দূর্গাপুর বাড়ী গিয়েছিল, আর ফেরেনি। উড়ো খবর এসছিলো যে পরী নাকি ভীষণ হোমসিক হয়ে পড়েছে। তাই বাড়ী থেকেই যাতায়াত করতে পারবে বলে সে দুর্গাপুরে R E College এ ভর্তি হয়ে গেছে। এখন তো R E College. এর গালভরা নাম National Institute of Technology (NIT), standard ও অনেক ভালো, তখন আমরা B E College এর ছেলেরা R E College কে খুব একটা পাত্তা দিতাম না।
সেই পরী তো শশরীরে উপস্থিত, এবং সে নাকি আমাদের সাথে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় বসতে চায়। খানিক পরে বোঝা গেল যে সে আমাদের সাথে ঠাট্টা ইয়ার্কি মারছে না, সত্যি সত্যি বিই কলেজের পরীক্ষায় বসতে চায়। কিন্তু সে কি করে সম্ভব? এক, সে এতদিন ক্লাসে এবসেন্ট, পরীক্ষার ফর্মই সে জমা দেয় নি। ইতিমধ্যে আমরা যারা ফর্ম জমা দিয়েছিলাম, তাঁরা পরীক্ষার এডমিট কার্ডও পেয়ে গেছি। মানে এই অবস্থায় ওঁকে রেগুলার করা আর কলেজের হাতে নেই, ইউনিভার্সিটি গিয়ে কারণ দর্শিয়ে আর ফাইন দিয়ে রেগুলার হয়ে তারপর এডমিট কার্ড পেয়ে পরীক্ষায় বসতে পারবে। পরীর তো যাকে বলে জীবন মরণ সমস্যা। পরীক্ষা তাঁকে দিতেই হবে।
বিই কলেজ থেকে উধাও হয়ে বাড়িতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দুর্গাপুরে গিয়ে ভর্তি হয়েছে। এবার এতদিন পরে কি জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন হয়েছে জানি না, এবার বাড়িতে বুঝিয়ে দুর্গাপুর R E College থেকে না জানিয়ে পালিয়ে এসেছে, বিই কলেজের পরীক্ষা দেবে বলে। মোদ্দা কথা, এতগুলো মাস আমাদের পরী শিবপুর আর দুর্গাপুর দুটো কলেজেরই রেজিস্টার্ড ছাত্র ছিলো, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে যায়নি। সুতরাং গোটা ব্যাপারটাই জালি। আর পরী বলছে দুর্গাপুরে ফিরে যাবে না, বাড়িতে সেরকমই বলে এসেছে, সুতরাং পরীক্ষা না দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলে প্রেস্টিজ বিলা। তাহলে??? একমাত্র কলেজের examination ডিপার্টমেন্টই যদি এব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারে।
সময় একেবারেই নেই। কিন্তু examination ডিপার্টমেন্ট গিয়ে যদি জানতে চায় কেন এমন হলো, তখন কি বলবো? সত্যি কথা তো বলা যাবে না। ঠিক হলো, জানতে চাইলে বলবো, মা খুব অসুস্থ, এক্কেবারে শয্যাশায়ী, একমাত্র সন্তান, মাকে রেখে আসতে পারছিলো না। আরেকদল আইডিয়া দিলো, না না, মাকে মেরে ফেল। অন্যদল হাঁ হাঁ করে উঠলো।
– মেরে ফেল? বললেই হলো? যদি ডেথ সার্টিফিকেট চায়?
যা হবার হবে। সবাই ছুটলাম examination ডিপার্টমেন্টে। এই examination ডিপার্টমেন্টের লোকজনদের সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। ডিপার্টমেন্টের লোকেরা আমাদের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন। কিন্তু গিয়ে বুঝলাম যে অনেক দেরী হয়ে গেছে, আর এখন তীর examination ডিপার্ট্মেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে, অফিসিয়াল লিস্ট ইউনিভার্সিটি চলে গেছে। আর আমরা যারা সময়ে ফর্ম জমা দিয়েছিলাম, তাঁদের এডমিট কার্ডও এসে গেছে। সুতরাং এবার কলেজের রেজিস্ট্রারকে ফর্ম জমা দিতে না পারার কারণ দেখিয়ে এপ্লিকেশন দিয়ে তারপর উনার থেকে চিঠি নিয়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটির দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং এ গিয়ে এডমিট কার্ড নিয়ে আসতে হবে।
উনিও একই কথা বললেন। সুতরাং ইউনিভার্সিটি দৌড়ানো ছাড়া অন্য আর পথই খোলা রলো না।
পরদিন সকালেই আমরা কয়েকজন আমাদের নেতা শুভজ্যোতি চ্যাটার্জির নেতৃত্বে পরীর স্টুডেন্ট আইডি, ইত্যাদি সেই বিখ্যাত দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং এ গিয়ে দরবার করলাম। এই সেই বিখ্যাত দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং। এরই দোতলায় Controller of examination শ্রী গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশাল অফিস। পুরনো ব্রিটিশ আমলের বাড়ি, স্টিলের স্ট্রাকচার, চওড়া চওড়া সিঁড়ি, বিশাল উঁচু উঁচু দরজা। আমাদের মতন নতুনদের কাছে বেশ ভয় ভয় জাগানো ব্যাপার। তাঁর উপর সামনেই এক দারোয়ান। হুট করে ঢুকতে দেয় না। কি চাই? কেন এসেছো? নানান রকমের প্রশ্ন। আমরা দেখা করলাম গোপালবাবুর পার্সোনাল সেক্রেটারির (PA ) সাথে। উনি সবই শুনলেন, কিন্তু উত্তর এলো যে স্যার এখন ভীষণ ব্যাস্ত। বিনা এপয়েন্টমেন্ট দেখা করা যাবে না। আমাদেরও তখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। হুজ্জুতি করলে খুব বেশি পরীকে পরীক্ষায় বসতে দেবে না। সুতরাং অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, যা হবে হোক, দারোয়ানকে ঠেলে ঠুলে গোপালবাবুর অফিস কেবিনে ঢুকে পড়লাম। উনি একটু অপ্রস্তুত হলেন। আমরা এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে প্রায়কাঁদো কাঁদো হয়ে পরীর অবস্থা যতটা পারি সংক্ষেপে বোঝালাম। উনি সবই শুনলেন, বুঝলেন, কিন্তু জানালেন যে অনেক দেরী হয়ে গেছে। উনি কিছুই সাহায্য করতে পারবেন না। একমাত্র ভাইস চ্যান্সেলর যদি কিছু করতে পারেন।
সেদিন শনিবার, অফিসের অনেকেই হাফ ডে করে বাড়ি চলে যাচ্ছে। ঠিক হলো, এখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। ভিসি নিশ্চয়ই খুব ব্যাস্ত মানুষ। ওনার অফিসে দারোয়ানকে ঠেলে ঢোকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কাল রবিবার একদম ভোরবেলায় ওনার বাড়িতে গিয়ে ওনার চরণে লুটিয়ে পড়তে হবে। ফটাফট ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ সুশীল মুখার্জীর বাড়ির ঠিকানাও যোগাড় হয়ে গেলো।
ডঃ সুশীল মুখার্জী তখন একজন নামী ব্যাক্তিত্ব। ছাত্রজীবনে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক, সয়েল সায়েন্স, ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির পন্ডিত মানুষ। পাঁচ বছর ভারত সরকারের National Agricultural Commission এর সদস্য ছিলেন। বরিশালের লোক, অমায়িক, সজ্জন ভদ্রলোক। এবং সব থেকে বড় কথা অত্যন্ত ছাত্রবৎসল।
পরদিন, মানে রবিবার ভোরের ৫৫ নম্বর ধরে প্রথমে এসপ্লানেড, তারপর যোধপুর পার্ক। কলিং বেল বাজাতে নিজেই দরজা খুললেন। মানে আমরা আগে উনাকে দেখিনি, তবে মনে হলো ইনিই ডঃ মুখার্জী। আমরা বললাম, বিই কলেজ থেকে এসেছি। বললাম যে আর কয়েকদিন পরেই ফাইন্যাল পরীক্ষা, কিন্তু আইনি জটিলতায় পরীক্ষায় বসতে পারছি না। যথাসম্ভব সংক্ষেপে আমাদের দুর্দশা জানালাম। বললাম যে, কলেজে রেজিস্ট্রার, প্রিন্সিপ্যাল কিছুই করতে পারছেন না। গতকালের গোপালবাবুর সাথে কথাবার্তাও সব বোঝালাম।
উনি আমাদের ভেতরে এসে বসতে দিলেন। তখন একদম সকাল, মনে হয় ওনাদের চায়ের সময়। ওনার স্ত্রী নিজেই হাতে চা বিস্কুট নিয়ে এলেন।
কি ব্যাপার? শুভ খুব গুছিয়ে নিদারুণ অশ্রুসজল ভাবভঙ্গীতে পরীর করুণ অবস্থা বর্ণনা করলো। অম্লান বদনে পরীর মা’কে মেরেও ফেলা হলো। পরী জানতো যে ওঁর মা’কে মেরে ফেলা হবে, মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলো। ডঃ মুখার্জীকে গুছিয়ে বোঝানো হলো কেন পরীর মতন একজন সুশীল মনোযোগী ছাত্র অসুস্থ মা’কে ফেলে রেখে আসতে পারেনি, যার ফলে সে পরীক্ষার ফর্মও ফিলাপ করতে পারেনি। ছেলেটার একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে ইত্যাদি। ইতিমধ্যে পরী ডঃ মুখার্জীর চরণে লুটিয়ে পড়েছে। স্যার অপ্রস্তুত। তোমরা তো বড্ড দেরী করে ফেলেছ। পরীক্ষা শুরু হতে তো আর এক সপ্তাহও বাকী নেই।
স্যারের স্ত্রী, প্রফেসর K K Rohtagi Mukherjee, উনিও নামী বিজ্ঞানী। উনি সব শুনে আমাদের পক্ষ নিলেন। রীতিমতন উষ্মার সাথে স্যারকে বললেন, কি গো, দেখছ না ছেলেটার মা মারা গেছে, একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে, কিছু একটা করো। ডঃ সুশীল মুখার্জী আর কি করেন। নিজের অফিসিয়াল লেটার হেডে ইউনিভার্সিটির Controller of examination শ্রী গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখে দিলেন, see if you can allow Pranab Banerjee to appear in first year examination। আমরা স্যার আর উনার স্ত্রীকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম।
তারপর আমাদের আর পায় কে? পরদিনই ঐ চিঠি দেখিয়ে ডংকা বাজিয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে প্রভিশনাল এডমিট কার্ড পেলাম। আর আমাদের পরী ফাইন্যাল পরীক্ষায় বসে গেলো।
পুঃ – এই ঘটনা থেকে আমরা একটা জিনিষ শিখেছিলাম। সহজে হার মানা নেই। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাও। একটা না একটা উপায় বের হবেই। এবং অতি অবশ্যই বিক্কলেজের মতন বন্ধু বান্ধবদের সাথে থাকতে হবে।
Add comment