সাহিত্যিকা

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক)

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক) 
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি।। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।
————————————————

রবীন্দ্রনাথ সকলের

রবীন্দ্রনাথ নোবেল জয়ী বিশ্বকবি, শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। পৃথিবীর বিভিন্ন খ্যাতনামা পন্ডিতরা তাঁর বক্তৃতা শুনতে চান, তাঁর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে আগ্রহী। বিরাট বংশে তাঁর জন্ম। অন্যদিকে তিনি আবার জমিদার। মজা হল, এইরকম একজন উচ্চমার্গের মানুষ কিন্তু ‘হরিপদ কেরানির’ মত মানুষের সুখ দুঃখের কথা শুনতেন, তাঁদের কাছে তিনি হৃদয় মেলে দিতেন অকাতরে। এর স্বপক্ষে ভুরি ভুরি প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে।

সুধীরচন্দ্র কর তাঁর ‘কবিকথা’য় বলেছেন : রবীন্দ্রনাথের মহাদেব নামে এক হিন্দুস্থানী পরিচারক ছিল। মহাদেবকে জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘বড়বাবু লিখতেন আর শুনতেন। আমরা তাঁর কাছে বসে নিজেদের ঘরের কথা বলতুম। লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করতেন, মহাদেব, দেশে তোর কে আছে, কী কী পরব হয়? ভারী আনন্দ লাগতো শুনে। আমরাও বকবক করে বলে যেতাম।‘ মহাদেব আরও বলেছে, ‘শীতের দিনে তিনি আমাকে বাইরে শুতে দিতেন না, বলতেন, ঠান্ডা লাগবে। পাশের ঘরটাতে শুতে বলতেন। শুতে যেতাম, রাত্রিবেলায় চুপি চুপি এসে দেখে যেতেন কেমন করে শুলাম, গায়ে কম্বল দিয়েছি কি না। গরমের দিনে শুতাম বাইরের বারান্দায়। এক-একদিন ঘুমের মধ্যে দরজা জুড়ে শুয়ে থাকতাম। রাত তিনটেয় উঠতেন বড়বাবু , বাইরের বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসে থাকতেন। কোনওদিন আমরা দরজা জুড়ে শুয়ে থাকলে ঘরে জানলা খুলে বসে থাকতেন। তবু ডাকতেন না, পাশ কেটে ডিঙ্গিয়ে যেতেন না। পরে শুধু বলতেন, জায়গা রেখে শুতে পারিসনে?’

মহাদেবকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, হ্যাঁরে তোর বড়বাবু তোকে বকতেন না? মহাদেবের উত্তর : ‘হ্যাঁ, বকতেন বই কি। একবার বড়বাবু বেলের শরবত খাবেন, বেল আনতে বললেন। আশ্রমেরই এক বাসা থেকে না বলে-কয়ে চার-পাঁচটা বেল পেড়ে এনেছিলাম। কথাটা কেমন করে বড়বাবুর কানে উঠল। ডাকিয়ে নিয়ে সেদিন যা বকুনি দিলেন, মনে হল জবাব হবে। অনেক করে ক্ষমা চেয়ে তবে রেহাই পাই। আশ্রমেরই জিনিস, আর তাঁর কাজে লাগবে বলেই এনেছিলাম। – কিন্তু এদিকে যে এমনি কড়াক্কর, তা কে জানত!’

এবার দেখুন রানী চন্দ তাঁর ‘গুরুদেব’ প্রবন্ধে কি বলছেন : “সকাল থেকে একদিকে চলত গুরুদেবের লেখার কাজ, আর একদিকে বইত লোকজনের অনবরত আসা-যাওয়ার স্রোত। বিরাম ছিল না এর। অবারিত দ্বার, কেউ দেখা করতে এসে ফিরে গেছে, শুনি নি কখনো। আশ্রমেরও ছোটবড়ো সকলে কাজে অকাজে দিনে কত বার আসছে যাচ্ছে, কখনো বিরক্ত হতে দেখি নি তাতে। দূরদূরান্ত দেশদেশান্ত হতেও কতশত জন আসতেন। সময় নেই অসময় নেই হাঁসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা করেছেন, ভালো বেসেছেন। তাঁরা আসতে তিনি হাতের কলম ক্ষণে ক্ষণে বন্ধ করছেন, চলে গেলে পর আবার লিখেছেন। ……সেইদিন সন্ধেবেলা গুরুদেব দুঃখ করে বললেন, সবারই সময়-অসময় আছে, নেই কেবল আমারই। আমার নিজের বলে দিনের একটুখানি সময়ও আমি পাই নে কখনো।

পরদিন হতে সেক্রেটারি তাঁর অলক্ষ্যে নিয়ম বাঁধলেন, যখন-তখন গুরুদেবের কাছে যাওয়া চলবে না কারো। আশ্রমের লোকের কথা আলাদা, তবে বাইরে থেকে যাঁরা আসবেন তাঁদের জন্য সময় স্থির করা রইল ঘড়ির এতটা থেকে এতটা। দুদিন বেশ লোক আটকানো গেল। তিন দিনের দিন একটি লোককে বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখে গুরুদেব বুঝলেন কিছু-একটা হয়েছে যাতে করে এদের সহজ আসার পথ বন্ধ। সেক্রেটারিকে ডেকে তিনি বললেন, তোরা কি ভাবিস আমি একটা কেউ-কেটা, নবাব-বাদ্শা? আমার কাছে আসতে হলে সেপাই-সান্ত্রী পেরিয়ে তবে আসতে হবে? আহা বেচারারা – দূর দূর হতে আসে, কি, না – আমায় একটু দেখে যাবে, কি, প্রণাম করবে – না হয় দুটো কথাই বলবে। তার জন্যে এত কি কড়াকড়ি? দোর আমার খোলা থাকবে, যার যখন মন চায় আসবে আমার কাছে, কাউকে বাধা দিস না আর কখনো।

সেক্রেটারি ইতস্তত করেন। বলেন, আপনার লেখার সময়ে বিরক্ত করলে আপনার অসুবিধে হতে পারে –
তিনি বললেন, তা হয় হোক, তবু কেউ এসে দূরে বসে অপেক্ষা করবে এ ভারি অন্যায়।”
এই হলেন আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
———————————————

পরিচয়পত্র
সেবার অর্থৎ ১৯১২ সালের মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিকল্পনা ছিল তিনি য়ুরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে শেষে ইংল্যান্ড যাবেন। রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল প্রাইজ পান নি, বিশ্বদরবারে তাঁর পরিচিতি খুবই সামান্য। তবে ইংল্যান্ডে রবীন্দ্র-খ্যাতির ভূমিকা করে রেখেছিলেন প্রমথলাল সেন (কেশবচন্দ্র সেনের ভ্রাতুষ্পুত্র, যিনি লন্ডনের ‘হ্যারিস ম্যানচেস্টার কলেজে’ পড়তে যান)। কিন্তু সমস্যা হল ফ্রান্সে তখন রবীন্দ্রনাথের সেভাবে পরিচিতি ছিল না।

এ ব্যাপারে এগিয়ে এলেন ফরাসি পরিব্রাজিকা ও লেখিকা আলেকসাঁদ্রা দাভিদ-নেল (Alexandra David-Néel, 1868-1969)। ভারত-তিব্বত-জাপান-চীনের এবং বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি, বিকাশ এবং দেশান্তরে তার প্রকাশ নিয়ে বিশাল কাজ করেছিলেন প্রাচ্যবিদ্যার অনুরাগিণী বিদূষী এই মহিলা। ইনি ভারতে আসেন ২রা জানুয়ারী, ১৯১২ তারিখে। তাঁর ভ্রমণকাহিনী L’Inde où j’ai vécu (ভারতবর্ষ, যেখানে আমি থেকেছি) থেকে জানা যায় যে তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। শান্তিনিকেতনের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে বড়ো বড়ো গাছের ছায়ায় পঠন-পাঠন তাঁকে মুগ্ধ করে। অধ্যয়ন ও মননের পক্ষে এই পরিবেশ তাঁর কাছে আদর্শ বলে মনে হয়। তাঁকে মুগ্ধ করেছিল ব্রহ্মচর্যের সেই নিয়ম যেখানে শহর থেকে অনেক দূরে গুরু তাঁর শিষ্যের সঙ্গে একসাথে থাকবে (তাঁর ভাষায় : la cohabitation de l’élève avec son maître.)। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে আকর্ষণ করেছিল।

ফ্রান্সে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ১৬ই ও ১৭ই মার্চ চারটি পরিচয়পত্র ফরাসি ভাষায় লিখে দেন। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে এই চারটি পরিচয়পত্র রাখা আছে। এরমধ্যে দুটি পরিচয়পত্র লেখা হয় অভিজাত মাসিকপত্র Mercure de France-এর প্রতিষ্ঠাতা Alfred Valette ও সাহিত্যপত্রিকা Les Decouments du Progrès-এর পরিচালক Borda-কে।

বিশ্বভারতীর ফরাসি অধ্যাপক নন্দদুলাল দে মহাশয় তাঁর ‘আলেকসাঁদ্রা দাভিদ-নেল ও রবীন্দ্রনাথ : একটি অজ্ঞাত ইতিবৃত্ত’ প্রবন্ধে এই পরিচয়-পত্রগুলির বাংলা অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সহজ কথা নয়। উদাহরণ স্বরূপ Alfred Valette-কে লেখা কয়েক ছত্র দেখা যেতে পারে : ” যেসব মানুষের সুপারিশের প্রয়োজন হয় ইনি তাঁদের দলের নন। এবং আমি জানি, …সমসাময়িক ভারতীয় কাব্যজগতে সবচেয়ে বিশিষ্ট ও বন্দিত প্রথম সারির কবিদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনি আমার কাছে প্রীতিপূর্ণ কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ থাকবেন।”

তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সেবার রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপ ভ্রমণ পন্ড হয়ে যায়, শেষ মুহূর্তে শরীর অসুস্থ হওয়ায় তাঁর যাত্রা বাতিল হয়। রবীন্দ্ৰনাথ ২১শে মার্চ ডঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লেখেন, “আমার কপাল মন্দ – কপালের ভিতর যে পদার্থটা আছে, তারও গলদ আছে – নইলে ঠিক জাহাজে ওঠবার মুহূর্তেই মাথা ঘুরে পড়লুম কেন? অনেক দিনের সঞ্চিত পাপের দণ্ড সেই দিনই প্রত্যূষে আমার একেবারে মাথার উপর এসে পড়ল। রোগের প্রথম ধাক্কাটা তো একরকম কেটে গেছে, এখন ডাক্তারের উৎপাতে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।….”

এর কিছুদিন পরে ১৫ই জুন, ১৯১২ সালে, তিনি তৃতীয়বারের জন্য ইংল্যান্ড যান, তবে প্যারিসে ছিলেন মাত্র একদিন। দাভিদ-নেল আরও পরিচয়-পত্র রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন কিনা আমরা জানি না। তবে প্যারিসে ঐ একদিন থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ হয়তো তাঁর কোন একটি পরিচয়-পত্র ব্যবহার করে সুইডিশ প্রাচ্যবিদ্ Esaias Tegnér-এর সঙ্গে পরিচিত হন। অধ্যাপক তেগনের (TEGNÉR, Esaias Henrik Vilhelm, ১৮৪৩-১৯২৮) বাংলা জানতেন ও সুইডিশ আকাদেমির একজন বিশিষ্ট সদস্যও ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার-প্রাপ্তির ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন।

নোবেল পুরস্কারের আগে অর্থাৎ বিশ্বখ্যাতি লাভের আগেই রবীন্দ্রপ্রতিভাকে এই ফরাসি পরিব্রাজিকা স্বদেশের সারস্বত সমাজে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। ভারতপ্রেমী প্রাচ্যবিদ্ ‘আলেকসাঁদ্রা দাভিদ-নেল’-কে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
—————————————————–

তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১. কবিকথা – সুধীরচন্দ্র কর। প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।
২. গুরুদেব – রানী চন্দ। প্রকাশক : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা।
3. রবিজীবনী – ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা – ২৮০, প্রশান্তকুমার পাল। প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
4. L’Inde où j’ai vécu – Alexandra David-Néel

Sahityika Admin

Add comment