চিকিৎসা সংকট ও আরও কিছু গপ্পো
সুদীপ রায়, ১৯৭০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
ছোটবেলার বন্ধু প্রাণতোষ হঠাৎ দু’দিন অসুখে ভুগে মারা যাবার পর ত্থেকেই বিমানবাবুর শরীরটা আজকাল ভালো মালুম হচ্ছে না। সব সময়ে কেমন যেন গা ছেড়ে দেওয়া ভাব। অত্যন্ত দুর্বল লাগে। না না এসব সিম্পটম ইগনোর করা উচিত নয়। কে জানে তাঁর নিজের শরীরেও প্রাণতোষের মত ভেতরে ভেতরে আবার কোনো কালরোগ বাসা বাঁধছে কিনা। বিমানবাবু তাই আজ পাড়ার ন্যাড়া ডাক্তারের চেম্বারে এসেছেন ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে।
ন্যাড়া ডাক্তার বিমানবাবুকে পরীক্ষা করে বললেন ‘চিন্তা করবেন না, এমনি সবই ঠিক আছে। জেনারেল উইকনেস থেকেই এমনটা হচ্ছে। একটা মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল দিচ্ছি। তিন মাস ব্রেকফাস্টের পরে নিয়ম করে খাবেন। তাহলে দুর্বল লাগা ভাবটা কেটে যাবে।‘ ডাক্তারবাবু খস খস করে প্রেসক্রিপশন লিখে তিনশ টাকা ফী নিয়েই কালব্যয় না করে ঘন্টি মেরে আওয়াজ করে ডাক ছাড়লেন ‘নেক্সট’।
বিমানবাবু খুশী মনে ভাবলেন ‘যাক, শুধু একটা মাল্টিভিটামিনের ওপর দিয়েই গেল।‘ আজকাল তো ডাক্তার দেখালেই ওঁরা একগাদা ওষুধপত্র লিখে দেয়। আর তেমন শাঁসালো খদ্দের পেলে তো আর কথাই নেই। রাজ্যের টেস্ট লিখে দেবে। ন্যাড়া ডাক্তারকে সেদিক দিয়ে ভালই বলতে হবে। একটা ক্যাপসুলেই কেস সেটল করলেন।
মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল দিন তিনেক খাওয়ার পরে বিমানবাবুর এক নতুন উপসর্গ দেখা দিল। এক্যুইট কন্সটিপেশন। কোষ্ঠকাঠিন্যের চুড়ান্ত। বড় বাথরুম করতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে অস্থির। মারা যাবার আগে প্রাণতোষেরও এমনটাই হয়েছিল না ?
বিমানবাবু ঘাবড়ে গিয়ে ছুটলেন ন্যাড়া ডাক্তারের কাছে।
‘দাদা, চিন্তা করবেন না। মাল্টিভিটামিন খেলে অনেকেরই এমনটা হয়। আয়রন আছে না? আমি লিনেক্লোটাইড পাউডার লিখে দিচ্ছি। রোজ রাতে শোওয়ার আগে খেয়ে নেবেন এক চামচ করে। সব ঠিক হয়ে যাবে।‘
একসপ্তাহ কোষ্ঠকাঠিন্যের ওষুধ খাওয়ার পরে বিমানবাবু দেখলেন কোষ্ঠকাঠিন্য কিছুটা কমল। কিন্তু নতুন উপসর্গ এল পেটে অসম্ভব গ্যাসের সমস্যা। অস্থানে্ কুস্থানে সশব্দে বায়ূ নিষ্ক্রমণ হচ্ছে। কেলেঙ্কারির একশেষ।
আবার ন্যাড়া ডাক্তার।
‘গন্ধ আছে?’ ন্যাড়া ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন’
– আছে।
– হুঁ … তার মানে মিথেন, সালফার কম্পাউন্ডের আধিক্য।
– তাতে কী হয়?
– কিছু না … আপনাকে এন্টি ফ্ল্যাটুলেন্স ট্যাবলেট লিখে দিচ্ছি। নিয়ম করে ব্রেকফাস্টের আগে খান। সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনশ … ‘
এবারে এক সপ্তাহ পরে বিমানবাবু দেখলেন আজকাল প্রায়ই মাথা ঘুরছে, কন্সটিপেশন ফিরে এসেছে।
অতএব চল পানসী বেলঘরিয়া। মানে অগতির গতি … আবার সেই ন্যাড়া ডাক্তার।
ন্যাড়া ডাক্তার বললেন ‘চিন্তা করবেন না আমি আছি না …’ ওষুধ লিখে দিলেন, বললেন ‘আপনার শরীরটাকে একেবারে রোগের ডিপো বানিয়ে রেখেছেন দাদা। ভাগ্যে আমার মত ভালো ডাক্তারের হাতে পড়েছিলেন। তাই সব কিছু সুন্দরভাবে সামলে দিচ্ছি। যেতেন ওই হতভাগা বোচা ডাক্তারের কাছে। ধনেপ্রাণে মারা যেতেন এতদিনে।‘
একমাস পরে বাজারে বিমানবাবুর সঙ্গে ন্যাড়া ডাক্তারের দেখা। ন্যাড়া ডাক্তার দেখলেন বিমানবাবু একেবারে চনবনে ফিট।
– কেমন আছেন বিমানবাবু … আমার ওষুধে তো বেশ কাজ হয়েছে দেখতে পাচ্ছি।
– কী জানি। আপনার ওষুধ কেমন ছিল কে জানে ? তবে গেলবার আপনাকে দেখিয়ে আসার পরে আমি একটা ভালো ডিসিশন নিয়েছিলাম। যত নষ্টের মূল আপনার দেওয়া ওই গোড়ার ভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়াটা বন্ধ করে দিলাম। তার পর থেকে ফার্স্ট ক্লাস আছি। না আছে দুর্বলতা, না কোষ্ঠকাঠিন্য। গ্যাসের সমস্যাও নেই, মাথা ঘোরা উধাও। দিব্যি আছি। আপনার লেখা কোনো ওষুধই আর খাওয়ার দরকার পড়ছে না।‘
*****
ঘুম
হারান দাসের রাতে ঘুম আসে না। শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবে আর ভাবে, রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। শেষ রাতে ঘুম এলেও একটু পরেই মোরগ ডেকে ওঠে, পূব আকাশ লাল হয় আর হারান ডান হাতের চেটোয় দু’চোখ ডলে তার হাঁসের খোঁয়াড় থেকে হাঁসের দলকে বাইরে বার করে এনে হাঁস চরাতে বেরোয়। হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে হেলেদুলে দীঘির পানে চলে আর হারান পেছনে পেছনে ছড়ি হাতে হাঁটতে হাঁটতে হাই তোলে।
তা এরকমই একদিন প্রাতর্ভ্রমণের সময় পাড়ার মুখুজ্জে ডাক্তারের সঙ্গে একদিন হারানের পথে দেখা।
‘পেন্নাম হই ডাক্তার বাবু।‘ হারান বলে।
– আরে হারান না। তা মুখ খানি অমন শুকনো করে কোথায় চললি রে হতভাগা?
– রাতে ঘুম হয় না গো ডাক্তার বাবু। সারাদিন গা খান ম্যাজম্যাজ করে যে।
– হুঁ … তা আমার চেম্বারে আসিস আজ বিকেলে। ওষুধ লিখে দেব খন।
– সে ওষুধ কেনার পয়সা আমি পাব কোথ থিক্যা ? তার চে এমন কোনো উপায় করেন যাতে ব্যরামও কমে আর পয়সাও খরচা করতি না হয়।
– তাহলে এক কাজ কর। এক থেকে একশ গুনতে তো পারবি হারামজাদা।
– তা খুব পারব।
– ‘তাহলে রাতে শোওয়ার পরে চোখ বুঁজে একশ থেকে এক পর্যন্ত উলটো করে গোন। একশ, নিরানব্বই, আটানব্বই এই ভাবে। দেখবি তিরিশ গুনতে গুনতে চোখে ঘুম এসে যাবে।
তিন চার দিন পরে ডাক্তারের সঙ্গে হারানের আবার দেখা রাস্তায়।
‘পেন্নাম হই ডাক্তার সাহেব।‘
– কেমন আছিস রে হারান। আজকাল তোর রাতে ঘুম আসছে তো ঠিক ঠাক?
– না কত্তা, ঘুম আর আসে কই ?
– ‘সে কী, একশ থেকে উলটো তিরিশ গুনেও ঘুম আসছে না?
– তিরিশ পর্যন্ত গুনতি পারি কই? পত্থম রেতে আশি পর্যন্ত গুইনাই মনে পড়ি গেল খগেনকে ধার দেওয়া আশি টাকা এখনো পর্যন্ত খগেন আমারে ফেরত দেয় নাই। ব্যস মাথা গরম হইয়া ঘুমের দফারফা হইয়ে গেল। কাল রাত্তিরে কষ্ট করে সাতচল্লিশ পর্যন্ত গুনিছি, কী রান্নাঘরে মেনি বিড়ালটা ঢুকি ম্যাঁও কইরা ডাক ছাড়ল। রাতে ঠান্ডা ছিল জবর। তাই মাছ ভাজা বাইরে রাখা ছিল। হুড়মুড় কইরা রান্নাঘরে ঢুইক্যা বিড়াল তাড়াইলাম। ব্যস ঘুমও চোখ ছাড়ি পলাইল।‘
খানিক ভেবে এবার হারান ডাক্তার বললেন, ‘এক কাজ কর দেখি, তোর খোঁয়াড়ে হাঁস আছে কটা?’
– ‘তা ষাট সত্তর খান আছে তো নিচ্চই।
– হাঁসগুলার নাম আছে নাকি?
– কয়েকটার আছে।
– না আজ্ বাড়ি ফিরে সবকটার নাম দে আলাদা আলাদা। রাতে শুয়ে চোখ বুঁজে চিন্তা কর, তুই হাঁস চড়িয়ে বাড়ি ফিরে হাঁসগুলানরে একটা একটা করে খোঁয়াড়ে ঢোকাচ্ছস … একটা একটা করে নাম ডেকে ডেকে। দেখবি সবকটারে ঢোকাবার আগেই তর ঘুম আসব।‘
দুদিন পরে হারানের সঙ্গে আবার দেখা।
‘কী আর কমু ডাক্তারবাবু, পথম আট দশটারে তো ঢুকাইতে কোনো রকম অসুবিধাই হয় না। কিন্তু যেই ওই সাদা ধলেশ্ব্বরীটারে ঢুকাইতে যাই, হতচ্ছাড়ি যে কী ঝামেলাই করে। কিছুতেই ঢোকে না। এদিক ওদিক তুরতুর কইরা পালায়। অর পিছনে পিছনে দৌড়াইয়া আমি আর রাতে দুই চোখের পাতা এক করতি পারি না।‘
– বুঝেছি রে হতভাগা, তোর ঘুমের অসুখ সারানো কোনো ডাক্তারের কম্ম নয়। যা গিয়ে কোনো ঝাড়ফুঁক করার ওঝাকে বাড়িতে নিয়ে আয়।
মুখুজ্জে ডাক্তার মুখ ব্যাজার করে হাঁটা দিল।
এক সপ্তাহ পরে আবার দেখা। হারানকে যেন বেশ হাসিখুশী, চনমনে দেখাচ্ছে।‘
– হারান যে রে, আজকালও কি রাতে না ঘুমিয়ে কাটাচ্ছিস নাকি?
– পেন্নাম হই গো ডাক্তারবাবু। আজকাল খুব ঘুমাই গো রেতের বেলায়।
– সে কী রে, ধলেশ্বরীর কী হল?
– আর পারতিসিলাম না, ওটারে বিক্রি কইরা দিলাম। তারপর থিক্যা আর কোনো সমস্যা নাই। বাকি হাঁসগুলানরে খোঁয়াড়ে ঢূকাইয়া আজকাল রেতের বেলা নাকে তেল দিয়া ঘুমাইতিসি।
আজকাল সকালে হারান দাস দিব্য খোসমেজাজে হাঁস চরাতে বেরোয়। হাঁসেরা প্যাঁক প্যাঁক করে হেলেদুলে চলে। পেছনে পেছনে হারান চলে ছড়ি হাতে চটি ফটফটিয়ে।
*****
প্রেম – ২০২২
রাত সাড়ে এগারোটা …
এপার্টমেন্টের দরজা খুলে ঘরে ঢুকে সুমি ব্যাগটা খাটের ওপর একপাশে ছুঁড়ে দিল। ওয়াশ রুমে যাওয়ার আগে টু সীটার সোফাটার ওপর গা এলিয়ে বসল সুমি। মাথাটা টিপ টিপ করে ধরে আছে। আই থিঙ্ক টুডে শী হ্যাড ওয়ান পেগ টূ মেনি। সুমির রেন্টে নেওয়া ওয়ান বিএইচকে এপারটমেন্ট শহরের আপমার্কেট এরিয়ায়।
বসতে না বসতেই মোবাইলটা বেজে উঠল।
‘রোমু বলছি’
সুমির বুকটা ধড়াস করে উঠল। ‘বল … হঠাৎ এ’সময়ে?’
– প্রে্মালাপ করার আবার কোনো সময় আছে নাকি?
– হঠাৎ মনে পড়ল? তুই কতদিন পরে ফোন করছিস সে খেয়াল আছে?
– ও ডীয়ার্, ডোন্ট সে লাইক দ্যাট। নতুন জায়গা, নতুন চাকরি। বুঝতেই পারছিস।
– বুঝলাম … এবারে আসল কথাটা কী বল। কী দরকারে ফোন করছিস?
– বললাম তো নিছক প্রেমালাপ।
– বাজে বকিস না। আই উইল বী দ্য লাস্ট পারসন টু বিলিভ দ্যাট ইউ আর অনেস্ট হোয়েন ইউ সে দ্যাট। খূলে বল কী ব্যাপার।
– মানে … ইয়ে … তুই কেমন আছিস?
– আমি ঠিক আছি , তুই?
– সো সো … কাইন্ড অফ আ … কী করছিস?
সুমির বুকটা আবার ধড়াস করে উঠল।
– ইটস সাচ আ কয়েনসিডেন্স … তোর কথাই ভাবছিলাম রে রোমু।
– রীয়েলি?
– ওহ এবসল্যুটলি সো। আফটার অল ইটস মোর দ্যান টূ মান্থস। আই এম মিসিং ইউ ব্যাডলি রোমু।
– … সুমি, তোকে একটা দরকারি কথা বলার ছিল।
আবার ধড়াস ধড়াস … সুমি যা ভাবছে আর চাইছে, তাই যদি হয় …
‘রাত বারটার সময়ে এত দরকারি কথা? ওকে … বল শুনি।‘ সুমির গলায় সংশয়।
‘মানে … ইয়ে … লেট মী বী অনেস্ট এন্ড ফ্র্যাঙ্ক …মানে কথাটা কী ভাবে যে তোকে বলি …’
সুমির বুকের ভেতরে যেন কেউ হাতুড়ি পিটছে। মুখে বলল, ‘কী ব্যাপার এত হেসিটেট করছিস কেন? হোয়াটস রং উইথ ইউ রোমু , ইজ এভরিথিং ওয়েল এট ইওর এন্ড ? … ভ্যানতারা না করে যা বলার বলে ফেল। ইট’স পাস্ট মিডনাইট নাউ এন্ড আই এম ফিলিং ড্যাম টায়ারড।‘
সুমি আর অপেক্ষা করতে পারছে না ওর হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে শরীরের বাইরে চলে আসতে চাইহে।
‘সুমি … মানে … কী করে যে বলি তোকে! ওহ শিট … আই কান্ট টেল ইট নাউ জাস্ট লাইক দ্যাট … আমি পরে তোকে ফোন করছি। দিস ইজ নট দ্য রাইট টাইম। দেয়ার’স এ ব্যাড নিউজ ফর ইউ।‘
ধড়াস … ধড়াস … ধড়াস … ‘ব্যাড নিউজ ফর মী?’
একটু চুপ করে থেকে সুমি বলল ‘মনে হচ্ছে আমি বুঝে গেছি। ইউ হ্যাভ পারহ্যাপস বেয়ারড ইট অল।‘
রোমু পাঁচ সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ‘মানে ? কী বুঝেছিস তুই ?’
– টেল মী হু ইজ শী।
সুমির আর তর সইছে না …
– উপস … না মানে …
– কী নাম মেয়েটার। তোর মতিগতি যে ভালো নয়, সেটা আমি বেশ কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম। নয়ডা তে নতুন চাকরিটা নিয়ে চলে যাওয়ার পরে তুই অনেক বদলে গেছিস রোমু … এন্ড দ্যাট ট্যু, ফর নো ফল্ট অফ মাইন। আই গেস ইউ আর ইন লাভ উইথ সাম আদার গার্ল। তাই তো? ফাইন … কিন্তু মেয়েটা কে ? ঘাবড়াস না, আমি গিয়ে বাগড়া দেব না।
– পিঙ্কি … পিঙ্কি সায়গল, নয়ডা অফিসে আমার কোলিগ।
– ইজ শী এট্রাকটিভ ?
‘ওয়েল … সুমি … মানে … ‘ রোমু তোতলাচ্ছে নাকি ?
‘মানে আবার কী? কোনো মানে নেই এতে। কী বলব। আই নিউ দিস ওয়াজ টু হ্যাপেন সাম ডে। তোকে তো চিনি। আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড।‘
– আই এম সরি সুমি, বাট …
– থাক … ইউ নীড নট এক্সপ্লেইন। আই ফীল চীটেড এন্ড ডিভাস্টেটেড।
– সুমি … আই এম একচুয়ালি ইন আ টাইট স্পট। শী এন্ড মী উই বোথ ওয়ের আনপ্রোটেক্টেড দ্যাট নাইট। আই হ্যাভ নো অপশন নাউ। তোকে পরে বুঝিয়ে বলব।
– প্লীজ রোমু প্লীজ। আই এম নট আ কিড। এসব শুনে এখন আমি তোর থেকে আর কী এক্সপেক্ট করতে পারি ? নেভার মাইন্ড, ইট উইল বী ডিফিকাল্ট ফর মী টু এডজাস্ট, বাট আই নো হাউ টু হ্যান্ডেল সাচ সিচ্যুয়েশন।
‘সুমি … ক্যান’ট উই রিমেইন গুড ফ্রেন্ডস ‘
– জাস্ট শাট আপ … এন্ড ডোন্ট এভার ট্রাই টু ফোন মী এগেইন … ইউ সন অফ এ বীচ।
সুমি ফোন কেটে দিল। বুকের ধড়াস ভাবটা কেটে গিয়ে এখন অনেকটা হাল্কা লাগছে।
এবারে দিবাকরকে ফোন করে বলে দিতে হবে … লাইন ক্লীয়ার।
*****
ঘড়ি
বীরেন্দ্রকিশোরের পারিবারিক জীবন সে অর্থে সুখময় নহে। বীরেন বিলাতের গ্লাসগোর পাশ করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়র। কলিকাতার ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। পিতার একান্ত ইচ্ছায় বীরেন্দ্রকিশোরের বিদেশে উচ্চশিক্ষা। বীরেনের ইচ্ছা ছিল বিলাতেই চাকরী করিয়া বাকি জীবন সেখানেই কাটায়। তার এক কারণ এক সুন্দরী ইংরাজ তনয়া। লণ্ডনে থাকাকালীন বীরেন ক্যাথীর সহিত ঘনিষ্ঠ হইয়াছিল। কিন্তু পাঁচ বৎসর লণ্ডনে চাকরী করিবার পরে পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে কলিকাতায় বিশাল ব্যবসায় সাম্রাজ্য সামলাইবার জন্য বীরেন্দ্রকিশোরকে দেশে ফিরিতে হইল। ক্যাথী নিজের দেশ ছাড়িয়া যাইতে চাহিল না। অগত্যা গার্লফ্রেন্ড কে লণ্ডনে চিরতরে ছাড়িয়া বীরেন বিষণ্ণ মনে একাই কলিকাতায় ফিরিল। দেশে ফিরিবার পরে বীরেন্দ্রকিশোরের বিবাহ হইল এক সুন্দরী বঙ্গললনার সহিত। কিন্তু বীরেনের বরাত মন্দ। স্ত্রী আভাময়ী বিবাহের দশ বৎসর পরে দুই পুত্র রাখিয়া স্বর্গবাসে যাত্রা করিলেন। বীরেন্দ্রকিশোর আর দ্বিতীয় বার দার পরিগ্রহ করে নাই। পৈত্রিক ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করিয়া ব্যবসার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি করিল। বীরেনের এক বিধবা ভগিনী বীরেনের বাড়িতে আসিয়া সংসার সামলাইল।
দুই পুত্রই শিক্ষান্তে পিতার সহিত ব্যবসায়ে যোগ দিয়াছিল। কিন্তু বিধাতা বীরেন্দ্রকিশোরের ভাগ্যে অন্য কিছুই লিখিয়া রাখিয়াছিলেন। দুই বৎসর তফাতে দুই পুত্রেরই বিস্ময়জনক ভাবে একইরকম দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে আকস্মিক মৃত্যু হইল। বিস্ময়জনক, কারণ দুই পুত্রেরই মৃত্যু হইল খাইবার সময়ে শ্বাসনলীতে মাংসের টুকরা আটকাইবার কারণে।
বিস্ময়ের অন্য একটি কারণও আছে। একটু বিশদে বলি। বীরেনের শয্যাকক্ষের এক কোণে একটি পুরাতন ঘড়ি আছে। খুব সম্ভবত বীরেনের পিতার বিবাহে যৌতুকে প্রাপ্ত প্রায় ছয়ফুট উঁচু বিদেশী ম্যাকমিলান কোম্পানীর গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। সে ঘড়ির ঘন্টায় ঘন্টায় বাজিবার ঘণ্টাটি বহুদিনই অচল। ঘন্টা বাজিবার সময়ে স্প্রিঙের ঘন্টাটি বাজিবার আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু স্প্রিঙের কিছু অস্ফুট আওয়াজ ব্যতিরেকে আর কিছুই কর্ণগোচর হয় না। ঘড়ির পেন্ডুলাম মাঝে মাঝেই ধীরগতিতে চলে। তখন মেকানিক ডাকিয়া সারাই করিতে হয়।তবু বীরেনের শোওয়ার ঘরের কোণে ঘড়িটি পুরাতন আসবাবের ন্যায় শোভা পায়। ঘড়িটি বীরেনের পিতৃদেবের পছন্দের ছিল। তাই বীরেন ঘড়িটি সরায় নাই, যদিচ ঘরের দেওয়ালে হাল ফ্যাশণের ব্যটারি-ঘড়ি আসিয়াছে। তিন বৎসর পূর্বে এক রাত্রে এগারোটার সময়ে সহসা ঘড়িটির ঘন্টা বাজিয়া উঠিয়াছিল। বীরেন অবাক। অচল ঘন্টা কিভাবে সচল হইল বীরেন বুঝিতে পারিল না। কিয়ৎক্ষণ পরেই বীরেন তাহার কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পাইলেন পুত্রের এক বন্ধুর মারফৎ। শ্রীমান তিন বন্ধুর সহিত রেস্ট্যুরেন্টে নৈশাহারে গিয়াছিল। খাইবার সময়ে শ্বাসনলীতে মাংসের টুকরা আটকাইয়া ওই প্রাণঘাতী বিপত্তি। ওই একবার বাজিয়াই ঘড়ি পুনরায় নীরব হইল।
দ্বিতীয়বার ঘড়িটির ঘন্টা বাজিয়াছিল এক বৎসর পূর্বে। জ্যেষ্ঠ পুত্রের সহিত তিনি বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ করিতেছিলেন। বেলা দুটোর সময় ঘড়িটি হঠাৎ পুনরায় বাজিয়া উঠিল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুত্র মাংসের বিরিয়ানি খাইতে খাইতে ভীষণ বিষম খাইল। হাসপাতালে লইবার পূর্বেই সব শেষ। এক্ষেত্রেও শ্বাসনলীতে মাংসের টুকরা গিয়া আটকাইয়াছিল। বীরেন্দ্রকিশোর ঘড়িটির এই রহস্যজনক কাকতালীয় অশুভ ব্যবহারের কোনো সমাধান পায় নাই।
আজ রাত তিনটায় ঘড়িটি পুনরায় বাজিল। বীরেন্দ্রকিশোরের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। অজানা আশঙ্কায় তাহার বুক কাঁপিয়া উঠিল। কিন্তু তাহার নিকটাত্মীয় কেউই আর আজ জীবিত নাই। আর ঘড়ির ঘন্টার সহিত কাকতলীয় ভাবে মৃত দুইজনই বীরেনের পুত্র ছিল এবং বীরেনের আর কোনো সন্তান নাই। তাছাড়া রাত তিনটার সময়ে কাহারো মাংস খাইবার সম্ভাবনা কম। সুতরাং চিন্তার কোনো কারণ নাই ভাবিয়া বীরেন পুনরায় নিদ্রা গেলেন।
কঠিন এবং গোপন সত্যটি হইল যে ওইসময় সন্ধ্যায় লন্ডনে বীরেনের প্রাক্তন প্রেমিকা ক্যাথীর পুত্র উইলিয়ামের শ্বাসনলীতে মাংসের টূকরা আটকাইয়া মৃত্যু হইয়াছিল।
Add comment