সাহিত্যিকা

ঘন্টাখানেক জংলী লেপার্ডের কাছাকাছি

ঘন্টাখানেক জংলী লেপার্ডের কাছাকাছি
তাপস চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

নভেম্বরের রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। রাজস্থানের জাওয়াই বেরা এলাকার শীত সূর্যাস্তের পরেই বেশ জাঁকিয়ে বসে। রিসর্টে নৈশভোজ সেরে শোয়ার আয়োজন করছি, পরদিন ভোরবেলা লেপার্ড সাফারিতে বেরোতে হবে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। মহারাণা প্রতাপ সিংয়ের চতুর্থ পুত্রের বংশধর রানাওয়াত সিং (যিনি জাওয়াই লেপার্ড সংরক্ষণের একজন প্রতিভূ এবং কপালগুণে আমাদের রিসর্টের মালিক ও) জানালেন যে সন্ধ্যেবেলা জিয়া নাম্নী একটা লেপার্ড বাছুর শিকার করেছে, আর একটু আগেই তাকে সেই শিকার খেতে দেখা গেছে। সিংজী নিজে যাচ্ছেন সেখানে, আর চাইলে আমরাও তাঁর সঙ্গে যেতে পারি।

হাড়কাঁপানো সেই শীতের রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মেওয়ারের রাজপরিবারের বংশজের সঙ্গে বাঁকা চাঁদের আলোয় লেপার্ডের নৈশভোজ দেখার এহেন রাজকীয় সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানেই হয়না। তাই কয়েক মূহুর্ত্তের মধ্যেই জ‍্যাকেট চাপিয়ে ক‍্যামেরা নিয়ে রেডি, জিপসি আসতেই চড়ে পড়লাম। রানাওয়াত সিংজী নিজেই ড্রাইভ করছেন, পাশে ওনার অনুচর। হাইওয়েতে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর জিপসি পাশের মেঠো রাস্তায় পড়ে অন্ধকার চিরে দূরের পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগলো।

জাওয়াই বেরা এলাকায় গাছ বলতে মূলতঃ বেশ বড়ো ক‍্যাকটাস আর কাঁটা ভর্তি বাবলা গাছ। মেঠো রাস্তায় জিপসি এগিয়ে চলার সময় একটু অসাবধান হলেই লম্বা ডালের কাঁটায় হাত মুখ ছড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিরানব্বই শতাংশ। এহেন কণ্টকসংকুল রাস্তায় এই গভীর রাতে একটু এগিয়ে গিয়েই সিংজী জিপসির হেডলাইট ডিমার করে দিলেন। নিকশ অন্ধকারের একটা সিরসিরানি অনুভূতি এবার আরো কাছে এসে ছুঁচফোটানো ঠান্ডার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আমাদের আঁকড়ে ধরলো। সামনে তিনফুট দূর অবধি আলো আর ওই আলোর রেখার বাইরে অবশিষ্ট জঙ্গল যেন প্রেতপুরী। জমাট অন্ধকার রাত্রির তমসায় আদিম প্রবৃত্তি সজাগ হয়ে উঠেছে চারিদিকে।মাঝেমধ্যে সিংজী বেশ হাইবিমের টর্চ ফেলছেন আশেপাশের পাহাড়গুলোতে আর ধূসর জমিতে। জমিতে একবার টর্চের আলো পড়তেই হটাত একটা নাইটজার পাখি ফড়ফড়িয়ে উড়ে গেল।

এইরকম জনমানুষহীন রুক্ষ পাহাড়ি জমি আর তারাভরা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল মানুষ হয়ে মিছিমিছি জন্মালাম। একটা পাখি যখন ডানা মেলে উড়ে যায়, একটা পাতা যখন হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে মাটিতে পড়ে, একগোছা ফুল থেকে যখন গন্ধ ওড়ে, যখন ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে হরিণী কালো চোখে একবার তাকিয়েই শুকনো পাতায় মচমচানি তুলে দৌড়ে পালায়, লেপার্ড যখন তার চিত্র-বিচিত্র শরীরে জঙ্গলের কিনারায় নিঃশব্দে দাঁড়ায়, সারাজীবন সারাশরীর মন দিয়ে তা অনুভব করার মত বনের প্রাণী না হয়ে শহরের প্রাণী হয়ে জন্মে জীবনটাই মাটি হয়ে গেলো।

এরমধ্যেই বেশ কিছুক্ষণ জিপসি এই টিলা থেকে ওই টিলা ঘুরে বেরিয়েছে লেপার্ডের খোঁজে। একটা ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে বাঁক নিতেই হঠাৎই নাকে একঝলক দুর্গন্ধ এসে লাগলো, টর্চের আলোয় দেখতে পেলাম মৃত আধখাওয়া বাছুরটাকে। শিকার তো খুঁজে পাওয়া গেল, কিন্তু যেরকম আশা করেছিলাম যে শিকার আর শিকারীকে একসাথেই পাওয়া যাবে, তেমনটা হলোনা। ভোজনের একপ্রস্থ শেষ করে শিকারী ফিরে গেছে ততক্ষণে। শিকারের আশেপাশে পায়ের ছাপ দেখে বোঝা গেল যে শিকারী একা নয়, তার সঙ্গী তার দুই শাবক। জানা গেল যে শাবকদের বয়স চার মাস, মাংস খেতে শিখেছে হয়তো বা মাসখানেক আগে। এইসময়টা লেপার্ড এর বাচ্চাদের জন্যে বেশ বিপদজনক, কারণ শিকারের গন্ধে হায়না বা অন্য পুরুষ লেপার্ড কাছে চলে এলে বাচ্চাদের মেরে ফেলতে পারে। তাই মা লেপার্ড জিয়া তার শাবকদের নিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে পাহাড়ের ওপ‍রে উঠে গেছে। হয়তো আবার ফিরতে পারে শিকারের কাছে, কিন্তু ফিরলেও তা প্রায় শেষরাতে। চারপাশে একটা আশ্চর্য স্তব্ধতার মধ্যে এই অরণ্য নিশ্বাস বন্ধ করে যেন কোনো নিশ্চিত মূহুর্ত্তের প্রতীক্ষায় রয়েছে।

জাওয়াই বেরার এই জঙ্গলভরা পাহাড়ি এলাকা এখনকার দুই রাজ‍্যের, অর্থাৎ রাজস্থান আর গুজরাটের দুই রাজধানীর মধ‍্যিখানে। স্বভাবতই ১৫শ-১৬শ শতাব্দীতে এই দুই এলাকার বণিকদের মধ্যে পণ্য বিনিময়ের প্রধান পথ ছিল এই জাওয়াই হয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই এই জঙ্গলমহলে ডাকাতদের উৎপাত শুরু হয়, যারা বণিকদের পণ্য লুট করতো। ক্রমে এক ডাকাত সর্দার বলিয়ার ক্ষমতা এমন বেড়ে ওঠে যে সে নিজেকে ঐ এলাকার রাজা ঘোষণা করে। এরপরই আশেপাশের রাজাদের টনক নড়ে, আর তাদের অনুরোধে মহারাণা প্রতাপ তার সৈন্য পাঠিয়ে ডাকাতদের ভবলীলা সাঙ্গ করেন, আর তারপর তাঁর চতুর্থ সন্তান শেখা সিংকে এই এলাকার ঠাকুর করে পাঠান। এই শেখা সিং এর বংশের উত্তরাধিকারীরাই এখন বেরার এবং আশেপাশের গ্ৰামের জমিদার। তাঁদেরই একজন রানাওয়াত সিং, যার ভরসায় এই নিকষ কালো কনকনে শীতের রাতে হেডল‍্যাম্প আর টর্চের ভরসায় আমরা সেই বাচ্চাসমেত ভয়ংকর লেপার্ডিনীর খোঁজে এই পাহাড় ওই পাহাড় ঘুরে বেড়াচ্ছি।

মাঝেমধ্যে বহুদূর থেকে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ আসছে, সাথে আশেপাশে প‍্যাঁচার ডাক আর ময়ুরের পাখা ঝাপটানি। সিংজীর সেই পাহাড়ে পাহাড়ে হাইবিমের টর্চ ফেলার কথা আগেই বলেছি। উনি তাড়াতাড়ি এক একটা পাহাড়ের গায়ে টর্চের আলো এলোপাথাড়ি বুলিয়েই নিভিয়ে দিচ্ছিলেন, আর তাতে আমার মনে হয়েছিল যে এই ঘন অন্ধকারে এত দ্রুত টর্চের আলো জ্বালিয়েই নিভিয়ে দিলে লেপার্ড দেখতে পাওয়ার কোন আশা নেই। ভুল ভাঙ্গল অচিরেই। টর্চের আলো এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হটাত থেমে গেল, আর চাপা গলায় সিংজি বললেন, ‘ও রাহা বাঘেরা!’ চমকে উঠে দেখলাম দূর পাহাড়ের এবড়োখেবড়ো খাঁজে যেখানে টর্চের আলো পড়ে স্থির হয়ে রয়েছে, সেখানে এক অদ্ভুত আলো আঁধারি তৈরি হয়েছে আর সেই ঘন আঁধারির মধ্যে জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ, লেপার্ড, স্থানীয় ভাষায় বাঘেরা। বুঝলাম পাহাড়ে এলোপাথাড়ি টর্চ ফেলার উদ্দেশ্য আলোতে গোটা লেপার্ড দেখতে পাওয়া নয়, শুধু চোখ দেখতে পাওয়া, কারণ আলো ফেললেই লেপার্ড আলোর উৎসের দিকে তাকাবে আর ঘন অন্ধকারেও তার দুই জ্বলজ্বলে চোখ জানান দেবে প্যান্থারের উপস্থিতি।

এই সেই জিয়া, যার খোঁজে আমাদের নৈশ অভিযান। টর্চের আলোয় তার দর্শন পেলেও একটানা গায়ে আলো ফেলে রাখলে জিয়া বিরক্ত হতে পারে, তাই মাঝে মাঝে নিভিয়ে আবার আলো ফেলা হচ্ছিল। আমাদের জিপসি থেকে জিয়া যে পাহাড়ে রয়েছে সেটা প্রায় ১০০-১৫০ মিটার দূরে, আর দুয়ের মধ্যিখানে ঘন গাছের জঙ্গল থাকায় কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়। টর্চের আলোয় দেখলাম জিয়া পাহাড় বেয়ে নেমে এসে একটা বড় পাথরের ওপরে বসলো। আবছা অন্ধকারে মনে হল পাথরটার পিছনে গুহা, যদিও এত দূর থেকে অন্ধকারে তা জোর দিয়ে বলা মুশকিল। একটু দূরে অনেকগুলো ময়ুর একসাথে তারস্বরে ডেকে উঠল, লেপার্ডের চলাফেরার জানান দিতে অ্যালার্ম কল।

রাতের অন্ধকারে লেপার্ড দর্শনের খুশির শিহরণ তখন আমাদের শরীরে মনে, কিন্তু চমকের তখনও অনেক বাকি। একবার বেশ কিছুক্ষণ আলো নিভিয়ে রেখে আবার জ্বালাতেই জিয়ার দুইপাশে আরও দু’জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, জিয়ার দুই বাচ্চা।

এই মা’র শরীরে গা ঘসছে, আবার পরমুহূর্তেই নিজেদের মধ্যে খেলার ছলে মারপিট করছে। একঝলক বাতাস গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতো কিছু বুনো ফুল উড়িয়ে নিয়ে গেলো কোথা থেকে, আর সাথে সাথে ভেসে এলো ময়ূরের তীক্ষ্ম চিৎকার। অভূতপূর্ব এই দৃশ্য, সমস্ত পৃথিবী যদি এখন গুঁড়িয়ে যায় তাও আমি একদৃষ্টিতে এ দৃশ্য দেখে যেতে পারি ঘন্টার পর ঘন্টা, জীবনের পর জীবন।

প্রায় সোয়া ঘণ্টা জিয়া ও তার দুই শাবকের সাথে কাটিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। মা এবং শাবক সবাই সুস্থ রয়েছে এটাই পাওনা। জাওয়াইএর লেপার্ডদের সুরক্ষার ভার এই রানাওয়াত সিং-এর মতন কিছু লোক নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এনাদের সাথে কথা বলেই জানা গেল যে রাজস্থান বনদপ্তরের এখানকার লেপার্ডদের নিয়ে কোন তেমন মাথাব্যাথা নেই। গ্রামের লোকজনের গবাদি পশু লেপার্ডের শিকার হলেও বনদপ্তর কোন ক্ষতিপূরণ দেয়না, তাই লোকাল লোকজন এনজিও তৈরি করে তাদের ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত করেছে, নাহলে হয়তো মাড়িতে মেশানো বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে এই অতিসুন্দর প্রাণীর। অদূর ভবিষ্যতে এখানে বেশ কিছু জমি কিনে নিয়ে সেখানে অভয়ারণ্য গড়ে তোলার পরিকল্পনাও আছে, যেখানে হরিণ ছাড়া হবে যাতে লেপার্ডের গবাদি পশু হত্যার সংখ্যা কমে। লেপার্ড পর্যটনের ব্যবসাকেন্দ্রিক উদ্দেশ্যই হোক না কেন, জাওয়াই বাঁধ ও বেরার মানুষজনের লেপার্ড সংরক্ষণের এই শুভ উদ্দেশ্যকে আমি স্বাগত জানাই, আর আশা রাখি যে সরকারের সহযোগিতায় এই উদ্দেশ্য সামগ্রিকভাবে সফল হবে।

Leopardess from Jawai Bandh, Bera, Rajasthan

Sahityika Admin

Add comment