সাহিত্যিকা

দুর্গা দুর্গতিনাশিনী – বিজিত কুমার রায়

দুর্গা দুর্গতিনাশিনী
বিজিত কুমার রায়, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

মহিষাসুর বধ-এর তত্ত্বকথা

পৌরাণিক উপাখ্যানে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। এই মহিষাসুর আমাদের অপরিচিত। প্রকৃত পক্ষে মহিষ হলো একপ্রকার পশুর নাম। আর অসুর কথার অর্থ সুর-বিরোধী। যে দেবদেবী কিছুই মানে না। শক্তি আছে যা অসৎ পথে পরিচালিত। পুরাণে রম্ভাসুরের পুত্র। তিনি ঘোরতর কঠিন তপস্যা করে ব্রহ্মার বলে বলীয়ান এক অসুর। যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মায়াজাল বিস্তার করে বিভিন্ন রকম ভয়ঙ্কর রূপ ধরে দেবী দুর্গার সাথে যুদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন রূপের মধ্যে তিনি মহিষের রূপও ধারণ করে দেবীকে আক্রমণ করেছিলেন। একাধারেই মহিষ এবং অসুর। তাই নাম মহিষাসুর।

যারা আসুরি অবস্থা লাভ করেছে তাদের মধ্যে দেখা যায়— ধর্মধ্বজিত্ব, ধন ও স্বজননিমিত্ত দর্প, অহঙ্কার, ক্রোধ, কর্কশ ব্যবহার, কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে অবিবেক। আসুরিক এবং পাশবিক এই দুটি ভাব-শক্তিতে বলীয়ান মহিষাসুর। দেবী দুর্গাকে বিভিন্ন মায়াজালে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে দশদিক থেকে আক্রমণ করেছিলেন। তাই দেবীদুর্গাও দশ হাতেই যুদ্ধ করে দুর্দমনীয় মহিষাসুরকে পরাজিত করেন।

উপরোক্ত উপাখ্যানটি গভীরভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায় দেবতাদের ও অসুরের মধ্যে-সংগ্রাম চিরকালের। যেন সু এবং কু-এর মধ্যে লড়াই। মানবের অন্তরেও দৈবশক্তির সঙ্গে আসুরিক শক্তির লড়াই সর্বদাই লেগে আছে। প্রতিটি মানবের মধ্যে এই মহিষাসুরের গুণাবলি বিদ্যমান। মানব মন তিনটি গুণে গুণান্বিত। তমোগুণ, রজোগুণ এবং সত্ত্বগুণ। দেখা যায় তমোগুণের অধিকারীদের মধ্যে পাশবিকতা অর্থাৎ পশুর ভাবগুলো বেশি বিদ্যামান—আহার, নিদ্রা, মৈথুন এদের সর্বস্ব। আবার রজোগুণ প্রধান মানুষে দেখা যায় তারা কর্মের প্রতি আসক্ত। কিন্তু সে কর্ম নিষ্কাম নয়, সকাম কর্ম। যা মানবকে মুক্তির পরিবর্তে বন্ধনের কারণ হয়। আমরা এটি অসুরের মধ্যে দেখতে পাই।

যাঁরা দৈবী সম্পদলাভ করেছে তাঁদের ভয়শূন্যতা, ব্যবহারকালে পরবঞ্চন ও মিথ্যাকথন-বর্জন, জ্ঞান ও যোগে নিষ্ঠা, সামর্থ্যানুসারে দান, বাহ্যেন্দ্রিয়ের সংযম, যজ্ঞ, স্বাধ্যায়, তপস্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্য, ক্রোধহীনতা, ত্যাগ, শান্তি, পরদোষ প্রকাশ না করা, দীনে দয়া, লোভরহিত্য, মৃদুতা, অসৎ চিন্তা ও অসৎ কর্মে লজ্জা, অচপলতা, তেজ, ধৈর্য, বাহ্যাভ্যন্তর শৌচ, অবৈরভাব, অনভিমান, ক্ষমা, পরোপকার, নিরহংকারিতা ও ঈশ্বর প্রণিধান। এগুলি দৈবশক্তি। মানবমনে আসুরিক ভাব এবং পাশুবিক ভাব প্রবল থাকায় দৈবীভাবগুলি যা সত্ত্বগুণজাত তা প্রকাশিত হতে পারে না। কিন্তু সাধনার মাধ্যমে আসুরিক, পাশুবিক ভাবগুলো দূরীভূত করতে পারলে দৈবভাবগুলির স্ফূরণ ঘটে। তখনই মানুষ প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়। সে ভগবান লাভের যোগ্য হয়ে মানব জীবন সার্থক করে।

দুর্গাপূজার কাঠামোয় দেখা যায়, দেবী দুর্গার পদতলে মহিষাসুরের অবস্থান। যুদ্ধের পূর্বে অসুরের ধারণা ছিল দেবী দুর্গা সামান্য অবলা নারী, যা পুরুষের ভোগের বস্তু। কিন্তু মহিষাসুর পরাজিত হয়ে উপলব্ধি করেছেন—দেবী দুর্গা নারী হলেও ভোগের বস্তু নয়, অবলা সামান্য নয়, কামনা চরিতার্থ করার জন্য নয়। দেবী দুর্গার ত্রিশুল তার বক্ষে বিদীর্ণ হলে মহিষাসুরের মধ্যে আসুরিক এবং পাশবিক ভাব ত্রিশুলের দ্বারা বিনষ্ট হওয়ায় তার মধ্যে দৈবীভাবগুলো জেগে উঠেছে। তাই সে দেবী দুর্গাকে জগজ্জননী সম্বোধন করে স্তব শুরু করলেন। মূলত একই মায়ের দুটি সন্তান একটি দেবতা অন্যটি অসুর। মহিষাসুরের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা অসুরকেও নিজ সন্তান জ্ঞান করে তাঁরই পদতলে স্থান দিয়েছেন। শ্রীমা সারদা দেবী বলতেন, সন্তানের যদি ধুলো কাদা গায়ে লাগে তাতো মা-ই সেই ধুলো ঝেড়ে, কোলে তুলে নেয়। ফলে মহিষাসুর এখন আর অসুর নয়। দেবতার আসনে স্থান লাভ করে ভক্তের নিকট পূজনীয় হলেন।

মানবের মধ্যেও তমোগুণজাত, রজোগুণজাত, পাশবিক আসুরিক ভাবগুলো বিদ্যমান। সাধনার মাধ্যমে এগুলি দূর করতে পারলে মানব যোগ্যতা অর্জন করে দেবতার আসনে উন্নীত হতে পারে। যে যত সৎচন্তা, সৎধ্যন, সৎকাজ করবে ততই তার ভিতর থেকে অসৎভাবনা তিরোহত হবে। অর্থাৎ আসুরিক ভাব দূর হবে দৈবীভাব প্রবল হবে। তখন কাম—ক্রোধাদি হ্রাস পেয়ে তার মধ্যে জাগ্রত হবে জীবের প্রতি ভালোবাসা, প্রেম, ক্ষমা, দয়া, পরোপকার, অহিংসা। প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি। আনন্দ। যা মানবের কাম্য। ফলে আসুরিক ও পাশবিক সম্পন্ন ব্যক্তিও ক্রমে সৎ মানুষে পরিণত হতে পারে। সমাজের নিকট গ্রহণীয়, আদরণীয়, স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে।

দেবীদুর্গা যুদ্ধক্ষেত্রে মহিষকে এবং অসুরকে বধ করেন ত্রিশুলরূপ অস্ত্র দিয়ে। মহিষাসুরের এই ভাবদুটি মানব মনেও বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞানীরাই নিম্নস্তরের প্রাণী। তাদের মধ্যে পাশবিক, আসুরিক ভাবই প্রধান। আর সেগুলি দূর করতে দেবী প্রয়োগ করলেন জ্ঞানরূপ ত্রিশুলকে। কারণ প্রকৃত জ্ঞান হলে কু-ভাব দূর হয়ে সু-ভাবে পূর্ণ হয়। অজ্ঞানরূপ দূর হয়। সিংহের পিঠে এবং অসুরের দেহে দু’পা সজোরে চেপে রেখে যুদ্ধ করেছেন অসুরের সাথে। মানব মনের পাশবিকতা ও আসুরিকতা দূর করতেও তদ্রুপ শক্তভাবে মানসিকতা বা পুরুষকার নিয়ে কু-ভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করে সদভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। এরূপে মানব মনেও দৈবী শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে মানুষ দেবভাবাপন্ন হতে পারে।

দেবী দুর্গার আরেক নাম—‘ত্রিনয়নী’, তিনটি নয়নের অধিকারিণী। আমরা দুটো চোখে জাগতিক জ্ঞান লাভ করি। আমাদের তৃতীয় নয়ন নেই, তবে সাধনার মাধ্যমে তা লাভ করা যায়। তৃতীয় নয়ন দ্বারা আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ হয়। দেবী দুর্গা তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করে জীবের অজ্ঞানরূপ আসুরিকতা দূর করেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন—হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে দেশলাই জ্বালালে মুহূর্তেই সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়। তদ্রূপ আমাদের মনের অজ্ঞানতাও দেবী দুর্গার কৃপায় তাঁর পূজা করে, ধ্যান করে, মনের মলিনতা দূর করে, শুদ্ধতায় ভরে উঠে পূর্ণাঙ্গ মানবে পরিণত হতে পারি। সমাজের অসুর শ্রেণির মানবের পরিবর্তন হয়ে সব দেবমানব হবে, সমাজ হবে সত্যযুগের। বিশ্ব হবে আনন্দময়।

নবদুর্গা ও সাধনাস্তর
মহালয়ার পর থেকেই শুরু হয় নবরাত্রি। এই ন’দিন মা দুর্গা আবির্ভূত হন নয়টি বিভিন্ন রূপে।
নবদুর্গা (দেবনাগরী: नवदुर्गा ) অর্থে আভিধানিকভাবে দেবী দুর্গার নয়টি রূপকে বোঝানো হয় ৷ হিন্দু পুরাণ অনুসারে এগুলি দেবী পার্বতীর নয়টি ভিন্ন রূপ, যথাক্রমে – শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী৷ প্রতি শরৎকালে নবরাত্রির নয় দিনে প্রতিদিন দেবী দুর্গার এই নয় রূপের এক একজনকে পূজা করা হয়৷ কিন্তু মায়ের এই রুপগুলির অর্থ কি? তাৎপর্য? এরই মাঝে লুকিয়ে আছে শক্তি-সাধনার ন’টি স্তর। এক-এক স্তরে এক-এক অনুভূতি।

প্রতিপদে শৈলপুত্রী ¤ শিলা’র অর্থাৎ হিমালয়ের কন্যা। পাহাড় জড়, কিন্তু তারই ভেতরে আছে খনিজ পদার্থে ভরা রত্ন-ভাণ্ডার। অর্থাৎসাধনার প্রথম অবস্থায় মানুষ জড় বা তামসিক যদিও তার মধ্যে রয়েছে অসীম সম্ভবনা।

দ্বিতীয়ায় ব্রহ্মচারিণী ¤ ব্রহ্মে যিনি পদচারণা করেন বা থাকেন। সাধনার দ্বিতীয় স্তরে সাধক তামসিক অবস্থা থেকে উঠে ঈশ্বরচিন্তা শুরু করেছেন।

তৃতীয়ায় চন্দ্রঘন্টা ¤ মায়ের মাথায় চাঁদ, হাতে ঘন্টা। এই স্তরে নানা অনুভূতি হয় সাধকের। সাদা উজ্জ্বল জ্যোতি দর্শন (চাঁদ), দিব্য শব্দ (ঘন্টা) ইত্যাদি অনুভব হতে থাকে।

চতুর্থীতে কুষ্মান্ডা ¤ কু(খারাপ)+উষ্ম(গরম)+অন্ড(পেট) অর্থাৎ সাধকের যে কষ্ট (কু) সেই অসহ্য (উষ্ম) যিনি খেয়ে ফেলেন বা দূর করেন তিনিই কুষ্মান্ডা। প্রাথমিক সংগ্রামের পর সাধকের গতি এই স্তর থেকে দ্রুত হতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি দিব্যশক্তির সাহায্য উপলব্ধি করছেন।

পঞ্চমীতে স্কন্দমাতা ¤ স্কন্দ অর্থাৎ কার্তিকজননী। দেবদেবীদের সেনাবাহিনীর (শক্তির) যিনি প্রধান শক্তি সেই শক্তিমানের মা। সৃষ্টির আদি শক্তি। এই স্তরে সাধক নিজেকে অনুভব করেন চেতন শক্তি রুপে। দেহ ও মনকে অতিক্রম করে তিনি নিজ অস্তিত্বের গভীর চেতনায় চলে যান। দেহ বোধ আর নেই, মনের চিন্তা ও আবেগ শান্ত। সাধক নিজেকে অনুভব করছেন স্থির চেতনা হিসেবে, বুঝতে পারছেন যে দেহ ও মন যেন দুই পর্দা যা চেতনাকে ঢেকে ছিল এতদিন।

ষষ্ঠীতে কাত্যায়নী ¤ কাত্যায়ন ঋষি মা দুর্গাকে নিজ কন্যা রুপে সাধনা করতেন (বাৎসল্য ভাব)। মা তাই তাঁকে ঐ রূপেই দেখা দিয়েছিলেন। তিনি কাত্যায়নের মেয়ে কাত্যায়নী। অন্য অর্থে, কাত্য=ব্রহ্মজ্ঞানী। অয়ন=পথ। কিভাবে লোককল্যাণ করতে হবে এটা যিনি ব্রহ্মজ্ঞানীদের বলেন, সেই মা দুর্গা। এই স্তরে সাধক তার নতুন অর্জিত শক্তির অপপ্রয়োগ না করে যাতে দিব্য সত্বার নির্দেশে চলেন তারই চেষ্টা। কারণ না হলে সাধ্কের পতন হতে পারে।

সপ্তমীতে কালরাত্রি ¤ মা ঘন কৃষ্ণ বর্ণ নিয়ে আবির্ভুতা। কালী রুপে দেখা দেন। সাধনার এই স্তরে পুরনো জগত্ বিলীন হয়ে গেছে। যে জগতে সাধক এতকাল অসংখ্য জন্ম কাটিয়েছেন তা যে অন্ধকারের মধ্যে থাকা সেটা বুঝতে পারছেন। বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড যেন পরিণত হয়েছে বিশাল সর্বগ্রসী ব্ল্যাক-হোলে। সাধকের কাছে সর্বশুন্য অনুভব।

অষ্টমীতে মহাগৌরী ¤ মা এখানে আবির্ভূত হন সর্বব্যাপী আলোরুপী হয়ে। কালী রুপের পর মা দেহ দেন দুর্গা রুপে। কালী রুপে মা পরীক্ষা করেছেন সাধককে, সে কি চরম সত্য বা ঈশ্বরের জন্য সব আকর্ষণ ত্যাগ করতে পারে? এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই মা আসবেন তাঁর অসীম ঐশ্বর্য নিয়ে। সাধক উত্তীর্ণ। মা তাই মহাগৌরী রুপে আবির্ভূত।

নবমীতে সিদ্ধিদাত্রী ¤ মা এবার সিদ্ধি দান করার জন্য উপস্থিত। সাধক এতকাল শক্তির নানা রুপ দেখেছেন। এই স্তরে তিনি অনুভব করেন মায়ের অব্যক্ত সত্তাকে। এত্দিন সাগরের ছোট-বড় অসংখ্য ঢেউ দেখেছেন, এবার সাগরকে অনুভব করার সময় এসেছে।

মা দুর্গার আগমন-গমন নির্ণয় ও তার ফলাফল নির্ণয় :- ( হিন্দু শাস্ত্রানুসারে, হয়ত কুসংস্কার / ভিত্তিহীন, নিজস্ব মতামতের ব্যাপার ) কথায় বলে দুর্গতিনাশিনী মহামায়া দেবী দুর্গার আরাধনা করলে নাকি অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। তাই হয়তো রাজা সুরথও বসন্তকালের চৈত্র মাসে মহামায়ার অর্চনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। আবার শরৎকালের আশ্বিন মাসে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গাকে আরাধনা করে রাবণ বধ করতে সক্ষম হন। এবং লঙ্কা জয় করেন। এরপর থেকেই নাকি মর্ত্যলোকে মহামায়া পূজিত হন শরৎকালে এবং বসন্তকালে। তবে এই দুই কালের রূপ পৃথক। শরতে তিনি দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এবং বসন্তকালে বাসন্তী। দুই রূপেই তিনি সিংহবাহিনী। কিন্তু, উল্লেখযোগ্য যে মহামায়া দুর্গার বাহন সিংহ হলেও মর্ত্যে গমনাগমনের সময় তিনি ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কখনও তিনি গজে, কখনও ঘোটকে, কখনও দোলায়, কখনও আবার নৌকায়। কিন্তু, প্রশ্ন হল এত ছোটো যানবাহনে মা দুর্গা সপরিবারে আসেন কী করে? এখানেই তফাৎ মনুষ্য বুদ্ধি ও দেব মাহাত্ম্যের।

সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় যাঁদের পলকের নিমেষে ঘটে যেতে পারে তাঁদের পক্ষে তো অসম্ভব কোনও কিছুই নয়। তাই তো আমরা মহামায়াকে আবাহন করি “সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশানং শক্তিভূতে সনাতনী। / গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোহস্তুতে।।” শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “রবৌ সোমে গজরূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়ৌঃ।/ দোলায়ঞ্চ গুরৌ শুক্রে, নৌকায়ং বুধবাসরে।।” অর্থাৎ দেবীর গমনাগমন যদি রবিবার বা সোমবার হয় তাহলে তাঁর যানবাহন হয় গজ। আবার দেবীর গমনাগমন শনিবার বা মঙ্গলবার হলে তিনি চড়েন ঘোটকে। কিন্তু, বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার যদি দেবীর গমনাগমন হয় তাহলে তিনি দোলায় যাতায়াত করেন। আর বুধবার হলে তাঁর যাতায়াতের যানবাহন হয় নৌকা।

শাস্ত্র বলে ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’। অর্থাৎ দেবী যদি গজে গমনাগমন করেন তাহলে পৃথিবীতে জলের সমতা বজায় থাকে ও শস্যর ফলন ভালো হয়। সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ থাকে মর্ত্যভূমি। শাস্ত্রে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। তবে পার্থিব সম্পদের মধ্যে ‘গজ’ একটি বড় সম্পদ। প্রাচীনকালে রাজা মহারাজাদের বৈভবের পরিমাপ ছিলো হাতিশালের হাতির সংখ্যা বিচার করে। তাই ‘গজ’ হল সমৃদ্ধির প্রতীক। অন্যদিকে, হাতি অন্নপূর্ণা এবং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার বাহন। অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে এই বসুন্ধরা। শস্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন পরিমিত জল। অন্যদিকে, কৃষিকাজের পাশাপাশি প্রয়োজন শিল্পের। বিশ্বকর্মার বাহন যেমন গজ তাই, তেমনই বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পের দেবতা। তাই গজে গমনাগমনের ফলে পৃথিবীতে কৃষিকাজের পাশাপাশি শিল্পের উন্নতি ও প্রসার হয়। আবার বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী পুজোর শ্রেষ্ঠ দিন। কিন্তু, শাস্ত্রমতে বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী পুজোর যোগ্য তিথি-নক্ষত্র যুক্ত রবি বা সোমবার লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করা যেতে পারে। সুতরাং, বলা যায় রবিবার ও সোমবার হল ধনসম্পদ লাভের উত্তম দিন।

“দোলাং মড়কাং ভবেৎ”। অর্থাৎ দেবী দুর্গা যদি দোলায় গমনাগমন করেন তার ফল মর্ত্যে বহু মৃত্যু। এই মৃত্যু হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কিংবা যুদ্ধে হানাহানির কারণে। দোলা হল পালকির মতো একটি যান। যার স্থিরতা কম, সব সময় দোদুল্যমান, অল্পে ভঙ্গুর এবং অনেক সময়ই বিপদের কারণ। তাই দুর্গার দোলায় গমনাগমনে মর্ত্যভূমির স্থিরতা ব্যাহত করতে পারে। দুর্গা যদি বৃহস্পতি বা শুক্রবার গমনাগমন করেন, তাহলে তাঁর যানবাহন হয় দোলা। সূত্র ধরে বিচার করা যেতে পারে – দেবগুরু বৃহস্পতি হলেন বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং চিন্তাশীল। ফলে ভবিষ্যতের ভালোমন্দ ভাবতে তিনি এতটাই বিভোর হয়ে পড়েন যে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নিয়ে নেন। শাস্ত্র বলে, অতি বিলম্বের ফল ভালো হয় না, বহুবিধ বিঘ্ন-বিভ্রাট এসে উপস্থিত হয়। অন্যদিকে, শুক্রাচার্য হলেন দৈত্য গুরু। তিনিও বিদ্বান ও তেজস্বী। কিন্তু, তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ এতটাই দ্রুততার সঙ্গে হয় যে প্রায়শই তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয়। অতিবিলম্বের সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন সুফল দেয় না, তেমনই অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণও কুফলের কারণ হয়। আর এই দুই গুরুর চারিত্রিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে দেবীর গমনাগমনের প্রভাব পড়ে মর্ত্যলোকে।

শাস্ত্র মতে দেবী দুর্গার গমনাগমন ঘোটকে হলে চরম বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষয়ক্ষতি দেখা দেয়। এককথায় বলা হয় ‘ছত্রভঙ্গন্তরঙ্গমে’। ঘোড়া অত্যন্ত ক্ষিপ্র, বুদ্ধিমান ও প্রভুভক্ত। তবুও কখনও কখনও তার আচরণে উদভ্রান্ত ভাব লক্ষ্য করা যায়। তাকে বাগে আনতে বেগ পেতে হয়। ঘোড়ার এই স্বভাবের প্রভাব পড়ে মর্ত্যের উপর। এ ছাড়া আরও একটা দিক আছে। দেবী ঘোড়ায় যাতায়াত করেন মঙ্গল অথবা শনিবার। মঙ্গলগ্রহ তেজস্বী ও বীরদর্পী। আর শনি হল কূট বুদ্ধিসম্পন্ন। প্রায়শই অনিষ্টকারী। তাই দেবীর ঘোড়ায় গমনাগমন হলে এই দুই গ্রহাধিপতির প্রভাব পড়ে মর্ত্যভূমিতে।

‘নৌকাং জলবৃদ্ধিশ্চ শষ্যবৃদ্ধির্ভপেৎ সদা’। যার অর্থ দেবী দুর্গা নৌকায় গমনাগমন করলে মর্ত্যভূমিতে শস্য ভালো হয়। কিন্তু, অতিবৃষ্টি বা বন্যার আশঙ্কাও থাকে। এক কথায় – জল বৃদ্ধির প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে মর্ত্যভূমিতে। নৌকা কোনও উৎকৃষ্ট জলযান নয়। বিপদের ঝুঁকিযুক্ত দোদুল্যমান একটি জলযান। ফলে মায়ের আগমনের পর জলের একটা প্রভাব দেখা দেয় প্রকৃতিতে। যেমন অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি । দুর্গা বুধবার যাতায়াত করলেই তার যানবাহন হয় নৌকা। বুধবার হল সৌম্যবার। খুব শান্ত সৌম্য, শান্তিপ্রিয়। অথচ বালক স্বভাবের। তাই বুধ সরল কিন্তু চঞ্চল। তিনি চিন্তাভাবনা না করেই কাজ করে বসেন আর তার সৌম্য স্বভাবের প্রভাবে মর্ত্যে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করে, শস্যে-সম্পদে-সুখে ভরে থাকে বসুন্ধরা। পাশাপাশি তার বালখিল্য আচরণের প্রভাবে মর্ত্যে দেখা দেয় অনাবৃষ্টি, জলবৃদ্ধি, ক্ষয়ক্ষতি। পরিশেষে বলা যায় দেবীদুর্গার যাতায়াতের সঙ্গে প্রকৃতির যোগ প্রবল।

“রবি-শশী গজারূঢ়া শনি ভৌমস্তুরঙ্গমে।
গুরৌ শুক্রে চ দোলায়াং বুধে নৌকা প্রকীর্তিতাঃ।।”
দেবীর আগমন বা গমন রবি বা সোমবার হলে গজে, শনি বা মঙ্গলবার হলে ঘোটকে, বুধবার হলে নৌকায়, বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দোলায় হয়।
“গজে চ জলদা দেবী ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে।
নৌকায়াং সর্বসৌখ্যানি দোলায়াং মরকং ভবেৎ।।”
দেবীর আগমন বা গমন গজে হলে সুবৃষ্টি হয় ফলে পৃথিবী শস্যে পূর্ণ হয়, ঘোড়ায় হলে ছত্রভঙ্গ, নৌকায় হলে মিত্রতা বৃদ্ধি, দোলায় হলে মরক হয়।।

বোধন (রামকৃষ্ণ মিশনের শ্রদ্ধেয় মহারাজদের বক্তৃতামালা থেকে উধৃত)

‘বোধন’ কথাটির অর্থ জাগরণ। শরতের দুর্গাপূজায় বোধনের নিয়ম থাকলেও বাসন্তী দুর্গাপূজায় নেই, কারণ শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস সূর্যের দক্ষিণায়নের সময় দেবতাদের রাত্রিকাল। এই সময়ে দেবতাদের পুজো করতে হলে জাগরণ প্রয়োজন। শ্রীরামচন্দ্র রাবণবধের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মার পরামর্শে শরৎকালে অকালবোধন করে দেবীর পূজা করেন। এই পূজাই শারদীয়া দুর্গাপূজা।

শঙ্কা হয়, দেবতার আবার নিদ্রা-জাগরণ কী? তিনি সর্বদাই জাগ্রত থাকেন। তাঁর বিরাট সত্তা, অসীমিত পূজার প্রয়োজন নেই। কারণ ‘তাঁহাকে আরতি করে চন্দ্র তপন’। কিন্তু সেই বিরাট সত্তাকে ধারণা করা সীমিত বুদ্ধিতে সম্ভব নয়। সেজন্য আমরা নিজেদের অভাবকে তাঁর ওপর আরোপ করে সেই ভাবেই ভাবিত হবার চেষ্টা করি। আমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন, সুপ্ত; তাই ভাবি মাও সুপ্ত। সেই মাকে ‘জাগ মা, জাগ মা’ বলে আমরা কার্যত নিজেদেরই জাগাতে চেষ্টা করি।
“ষষ্ঠ্যাং বিল্বতরৌ বোধং সায়ং সন্ধ্যাসু কারয়েৎ” —-ভবিষ্যপুরাণের এই বচনানুসারে যেদিন সন্ধ্যায় ষষ্ঠীতিথি থাকে, সেদিন ‘বোধন’ করণীয়। সপ্তমীর পূর্বসন্ধ্যায় ষষ্ঠী না থাকলে তার পূর্বের সন্ধ্যায় বোধন কর্তব্য — “অহমপ্যাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়ামি তে।”
সাধারনত শারদীয়া দুর্গাপুজাকেই আমরা অকাল বোধন বলি।

এবার জানা যাক এই পুজাকে আমরা অকাল বোধন কেন বলি।
এবার আসা যাক মুলতত্বে। আমাদের বছরগুলি দুটি অয়নে বিভক্ত যথা উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন।পয়লা মাঘ থেকে আষাঢ় সংক্রান্তি অবধি উত্তরায়ন ও পয়লা শ্রাবন থেকে মকর সংক্রান্তি অবধি উত্তরায়ন দেবতাদের দিবাকাল ও দক্ষিণায়ন দেবতাদের রাত্রীকাল। শারদীয়া পুজা দক্ষিণায়নে পড়ায় দেবী নিদ্রামগ্ন থাকেন তাই দেবীকে অকালেই বোধন করতে হয় তাই এই পুজা অকাল বোধন নামে খ্যাত।

মহাসপ্তমীর সকালে সর্বপ্রথম চক্ষুদানের মধ্যদিয়ে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। হিন্দু পুরাণ মতে, মহাসপ্তমীতে ভক্তদের কল্যাণ ও শান্তির আশীর্বাদ নিয়ে হিমালয় নন্দিনী দেবী দুর্গা পূজার পিঁড়িতে বসবেন। আজ শারদীয় দেবী দুর্গার নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন করা হবে। এরপর সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমী বিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হবে। দেহ শুদ্ধি, অঙ্গ শুদ্ধি সেরে শুরু হয় পূজা-অর্চনা। ঢাকঢোল, শঙ্খ ধ্বনি-উলু ধ্বনি, খোল-কাসাসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যবাজনা বেজে উঠবে।

আজ মহাসপ্তমী পুজোর অঙ্গই যখন কলাবউয়ের স্নান :-
শুদ্ধ ভাষায় যা নবপত্রিকা সেটাই চলিত ভাষায় পরিচিত কলাবউ রূপে৷ এই কলাবউ বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। আর নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। যদিও বাস্তবে এই নবপত্রিকা নটি পাতা নয় আসলে ৯টি গাছ। মূলত এটি কলাগাছ তার সঙ্গে থাকে কচু, বেল, হরিদ্রা (হলুদ), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান জয়ন্তী এবং ধান গাছ৷ কলাগাছের সঙ্গে একেবারে মূল থেকে উৎপাটিত করে তা বেঁধে দেওয়া হয় এবং গণেশের ডান পাশেই বসানো হয় এই নবপত্রিকাকে ও লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়িয়ে ঘোমটা পড়া কলাবউয়ের রূপ দেওয়া হয়৷ এই নবপত্রিকা দেবী দুর্গার ছেলে মেয়ে এবং মহিষাসুরের সঙ্গে পুজো পায়। কথিত আছে এই নবপত্রিকার ৯টি গাছ দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীক, রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী৷ অর্থাৎ এরাই যেন একত্রে নবদুর্গা রূপে পূজিত হয়৷

কলাবউয়ের স্নান দুর্গাপুজোর এক বিশেষ অঙ্গস্বরূপ৷ দেবীপক্ষের সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে মহাস্নান করাতে কোনও নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ তাই সপ্তমীর দিন সকালে কলকাতায় গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে ঘাট পুরোহিতদের উপস্থিতিতে কলাবউদের নিয়ে পুজোর উদ্যোক্তারা ও বাড়ির লোকেরা সমবেত হন৷ পাশাপাশি চলতে থাকে ঢাকির বাজনা৷ তখনই শাস্ত্রবিধি মেনে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরানো হয় নবপত্রিকাকে৷ তারপর তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় বাড়ির পুজোর দালান অথবা বারোয়ারি পুজোমণ্ডপে৷ সেখানে নবপত্রিকা প্রবেশের পরই দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। এই নবপত্রিকা প্রবেশের পরই দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমা দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়।

মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গা প্রতিমার সামনে একটি দর্পণ বা আয়না রেখে সেই দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন উপাদানে স্নান করানো হয়৷ মহাস্নানের সময় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, ফুলে দ্বারা ছেটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল ইত্যাদি দিয়ে দুর্গাকে স্নান করানো হয়। ধরা হয় এই সব ক্রিয়ানুষ্ঠানের মাধ্যমে সকল কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জলজসম্পদ, প্রাণীজসম্পদ, ভূমিসম্পদ ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়। নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোধ্বারের ভাবটিও ফুটিয়ে তোলা এই মহাস্নানের উদ্দেশ্য।

সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ যেমন ব্রাহ্মণ, মালি, কুম্ভকার, তন্তুবায়, নরসুন্দর, ঋষি, দাস প্রভৃতি সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়বার্তা প্রেরণ করে। এককথায় সার্বিক ভাবে সমাজ কল্যাণের চিন্তা ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে।

আমন্ত্রণ
বোধনে দেবী জাগ্রত হলে অতঃপর পূজা গ্রহণ করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে তাঁকে যেমন অভ্যর্থনা করে ভোজনাদি গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, মা যেমন অন্ন দিয়ে সকলকে খেতে আসার জন্য ডাকেন; তেমনি দেবীকেও পূজা গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। কারণ তিনি যে বড় আপন, আমাদের অতি প্রিয়জন। তাঁকে ডাকলেই তিনি আসবেন।
“বিল্ববৃক্ষমূলে পাতিয়া বোধন,
গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন।”
সপ্তমীর পূর্বসন্ধ্যায় বেলগাছের পাশে নবপত্রিকা স্থাপন করে দেবীকে পূজা করে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

সপ্তমী প্রাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা : প্রতিমা নির্মিত হয় নানা জড়বস্তু সমন্বয়ে। উপাদান জড় তাই প্রতিমাও জড়। তাকে পূজার উপযোগী করতে, দেবত্ব সম্পাদন করতে যে প্রক্রিয়া তা প্রাণ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই প্রাণপ্রতিষ্ঠা হলে প্রতিষ্ঠাতার প্রাণ থাকা প্রয়োজন। প্রাণ বোঝাতে উপনিষদে পরমাত্মার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সাধক বা পূজারী হবেন সেই প্রাণে বা পরমাত্মায় অধিষ্ঠিত। তাই পূজারীকে আত্মশুদ্ধি দেহশুদ্ধি দ্বারা নিজ অন্তরে সেই দেবত্ব কে অনুভব করে নিজের চেতনায় প্রতিমাকে চেতন করে তুলতে হয়। প্রাণ প্রতিষ্ঠার মন্ত্র উচ্চারণে জড় প্রতিমা জীবন্ত দেবী রূপে প্রকাশিত হন।
সেই প্রতিমাকেই আমরা পূজা করি সাক্ষাৎ জীবন্ত দেবী জ্ঞানে।

ভোগ প্রসাদ

অষ্টমীর অঞ্জলি ছাড়া যেমন পুজো সম্পূর্ণ হয় না, তেমনই সম্পূর্ণ হয় না পূজার ভোগপ্রসাদ ছাড়া। পূজার ভোগের অমৃতসম সেই ছোট্ট তালিকায় সাধারণত থাকে খিচুড়ি বা নিরামিষ পোলাও, লাবড়া, কিছু ভাজা, তরকারি যেমন আলু ফুলকপির, চাটনি, পায়েস, দই মিষ্টান্ন, ছোলার ডাল (সাধারণত লুচির সঙ্গেই খাওয়া হয়), ইত্যাদি।

কুমারী পূজা
তন্ত্রে কুমারীকে সাক্ষাৎ যোগিনী, পরমদেবতা বলা হয়েছে—
“কুমারী যোগিনী সাক্ষাৎ কুমারী পরদেবতা।”
স্কন্দপুরাণের কুমারীকাখন্ডের দেবী মহামায়া পার্বতীর কুমারী রুপের এক বর্ননা পাওয়া যায়। দেবী সেই কন্যাকুমারীর রূপে অভিনব অবতার ধারন করেণ ও অত্যাচারী বাণাসুর কে বধ করেণ।

কুব্জিকাতন্ত্র ,বৃহৎতন্ত্রসার, যোগিণীতন্ত্র, দেবীভাগবতপুরাণ সহিত নানান তন্ত্র ও পুরান গ্রন্থাদিতে দেবী পুজার অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ হিসেবে কুমারী পুজার কথা বলা হয়েছে। তন্ত্রে বলা হয়েছে যে দেবীপুজার সম্পুর্ন ফললাভ সম্ভব ঐ কুমারীর আরাধনায়। কুমারীকে নিবেদিত একটি ফুল নাকি সুমেরুসদৃশ। কুমারীকে ভোজণ করালে নাকি সমস্ত দেবী দেবতারা ভোগ গ্রহণ করেণ।

দেবী আদ্যাশক্তির সম্যক প্রকাশ দেবী কুমারীর মধ্যে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ” কুমারীপূজা করে কেন? সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ।” কুমারী অবস্থায় বালিকাদের শুদ্ধ আধারে দেবী অবস্থান করেন। তাঁকে আরাধনা করলেই দেবী মহাসন্তুষ্টা হন ও ভক্তকে সকলপ্রকার ভোগ ও মোক্ষের ফলদান করেন। কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ বলা হয় এই শারদীয়া দুর্গা পুজাকে।আর এই দেবী পুজার অপরিহার্য অঙ্গই হলো কুমারীপুজা।

পূজয়েৎ ব্রাহ্মণাঞ্ছক্র কন্যাং বালাং তথৈব চ।” এইপুজা মহাষ্টমী বা মহানবমীর সকালে সাড়ম্বরে আয়োজিত হয়। ভক্তপ্রান নরনারী এই মহাপুজা দর্শণের জন্য অনেক আশা ণিয়ে ভিড় জমায় যেখানে এই কুমারী দেবীর আরাধনা হয়। কুমারীপুজা চলাকালীন সেই বালিকারুপী কন্যার আধারে দেবী প্রবিষ্টা হন, তাই নরনারী এইসময় যে যার মণোবাসনা অনুযায়ী দেবী মায়ের কাছে বাসনাপূর্তির কামনা জানান।

এই কুমারীপূজাকে এই যুগে সবচেয়ে সুন্দর রূপ দেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি একবার ভারতের কন্যাকুমারীর দর্শনে যান দক্ষিণে। সেখাণে তিনি দেবী কন্যাকুমারীকার বিগ্রহ দর্শণ করে ভাববিহ্বল হন ও বহুকুমারীর নিজহাতে পুজা করেন। এমনও শোনা যায় তিনি নাকি একবার এক অন্তজ মুসলমান কন্যাকেও কুমারীর রূপে আরাধনা করেন কেদারনাথে। বেলুড়মঠের দুর্গাপুজায় তিনি এই কুমারী পুজার সার্থক আয়োজন করেছিলেন। যা আজ এই ভারতের সমস্ত দুর্গাপুজাগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি একবার বেলুড়মঠে স্বহস্তে এক কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করার সময় ভাবাবিষ্ট হয়ে যান, কপালে সিঁদুর পড়াবার সময় বলেন, ” আহা! দেবীর তৃতীয় নেত্রে আঘাত লাগেনি তো?”

তন্ত্রে কুমারী নির্বাচনে জাতপাতের বিচার নিষিদ্ধ। সাধারণত ৫ থেকে ১২ বছরের কন্যাকে কুমারী রূপে পুজা করা হয়। যে কুমারী নির্বাচনে জাতিভেদ বিচার করে সেই দুর্ভাগা নরকে পতিত হয় ও কল্পকাল পর্যন্ত নরকবাস করতে হয়। মহাষ্টমীর মহাপুন্যলগ্নে মহাদেবীর সামনে আসনে দেবী কুমারী কন্যাকে দেবী রূপে সজ্জিত করে বসানো হয়।পূজক পাদ্য অর্ঘ্য আসণ স্বাগত বসন ভূষণ নৈবেদ্য পুষ্প চন্দন ধুপ দীপ ভোজ্য পানীয় সহিত ষোড়োশোপচারে মহাপুজা করে থাকেন এই কুমারী দেবীর। প্রকৃত শুদ্ধহৃদয় পূজক তখণ ভাবাবিষ্ট হন ও প্রতিমাস্থ দেবী মায়ের প্রকাশ সেই পূজিতা কুমারীর মধ্যে দর্শন করে ধন্যাতিধন্য হন।

কন্যা যতোকাল ঋতুমতী না হয় ততোকালাবধি তাকে কুমারী রূপে পুজা করা যায়। তন্ত্রে একাদশ বর্ষ পর্যন্ত কুমারীর পুজার বিধান রয়েছে। আবার বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন নামে অবিহিত ও পুজা করা হয় এই কুমারী দেবীকে।
“একবর্ষা ভবেৎ সন্ধ্যা দ্বিবর্ষা সা সরস্বতী।
ত্রিবর্ষা চ ত্রিধামূর্ত্তিশ্চতুর্বর্ষা চ কালিকা।।
সুভগা পঞ্চবর্ষা তু ষড়বর্ষা উমা ভবেৎ।
সপ্তভির্মালিনী সাক্ষাদষ্টবর্ষা তু কুব্জিকা।।
নবভিঃ কালসন্দর্ভা চ দশভিশ্চাপরাজিতা।
একাদশে চ রুদ্রাণী দ্বাদশাব্দে তু ভৈরবী।।
ত্রয়োদশে মহালক্ষ্মী দ্বিসপ্তা পীঠনায়িকা।
ক্ষেত্রজ্ঞাপঞ্চদশভিঃ ষোড়শে চাম্বিকা স্মৃতা।
এবং ক্রমেণ সম্পূজ্যা যাবৎ পুষ্পং ন বিদ্যতে।।”

যেখানে দেবী কুমারীর পুজা হয় সেখানে দেবী সহ সর্ব্বদেবদেবীর বাস হয়। সর্ব্বদেবদেবী পুজিতা হন ও প্রীত হন কেবলমাত্র এই কুমারী পুজায়।
আমাদের এই ভারতবর্ষের বহু প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র গুলিতে এই কুমারীপূজার প্রচলন রয়েছে। ভারতের শেষপ্রান্তে কন্যাকুমারী দ্বীপে যেখানে মাতৃ কন্যাকুমারিকা অবস্থান করেন সেখানে প্রতিনিয়ত কুমারীর আরাধনা হয়। এছাড়াও জাগ্রত সতীপীঠ ও শাক্তপীঠ কামাখ্যায় এই কুমারীপুজার বিশেষ প্রচলন রয়েছে। এই কামাখ্যাধামে প্রচুর নরনারী কুমারী পুজা করেণ দেবীর সন্তুষ্টি লাভ করে অভীষ্ট সিদ্ধ করার জন্য।

আমাদের এই পশ্চিমবাংলার বেশীরভাগ তীর্থক্ষেত্র ও মাতৃমন্দিরে এই কুমারীপুজা সমারোহে অনুষ্ঠিত হয়। আদ্যাপীঠে একত্রে একশো আট জনের কুমারীপুজা চৈত্রমাসের রামনবমীর দিন মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়। আজও এখানে সহস্রাধিক বা হাজার কুমারীর সেবাপূজা অনুষ্ঠিত হয় যা দর্শন করা দুর্লভ ও মহাসৌভাগ্যজনক। আবার দশমহাবিদ্যা ষোড়শী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী সদা কুমারী । তাঁকে বালাসুন্দরী, ললিতাম্বিকা, শ্রীবিদ্যা, রাজরাজেশ্বরী ইত্যাদি নামে সেই কুমারী রূপেই পুজা করা হয় ।

সন্ধিক্ষণ ও সন্ধিপূজা

অষ্টমী তিথির শেষে যখন নবমী তিথি শুরু হয় তখন সন্ধিপূজার মাধ্যমে মায়ের আরাধনা করা হয়। এই সন্ধিপূজা হল সেই সন্ধ্যার প্রতীক যখন মা দুর্গা চন্ড ও মুন্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুরকে বধ করেছিলেন। অষ্টমী তিথির শেষের ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথির শুরুর প্রথম ২৪ মিনিটকে বলা হয় সন্ধিক্ষণ। সেই সময়েই দেবী দুর্গা চন্ড ও মুন্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুরের নিধন করেছিলেন। এই ঘটনাটি মনে রাখার জন্যই প্রতি বছর অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধিক্ষণে এই সন্ধিপূজা করা হয়। চান্দ্রমাস ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সন্ধিপূজার সময়টি প্রতিবছরই পরিবর্তিত হতে থাকে।

সন্ধিপূজার পৌরাণিক কাহিনী মতে দেবী দুর্গা এক অপরূপা সুন্দরী রূপে দুর্দমনীয় মহিষাসুরের সামনে আবির্ভূতা হন। সেই সময় দেবীর গাত্রবর্ণ বা গায়ের রঙ ছিল স্বর্ণাভ বা সোনালী এবং তিনি হলুদ শাড়িতে সজ্জিতা। তাঁর দশ হাত সজ্জিত ছিল দশ ধরণের অস্ত্রে। যখন মহিষাসুরের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধে তিনি ব্যস্ত, সেইসময় মহিষাসুরের দুই মিত্র চন্ড এবং মুন্ড পিছন থেকে দেবীকে আক্রমণ করে। রণনীতির চুক্তি ভঙ্গ হওয়ায় দেবী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং রাগে তাঁর মুখ নীল হয়ে যায়। দেবী তাঁর ত্রিনয়ন উন্মীলিত করেন এবং চামুন্ডা রূপ ধারণ করেন। ঘনীভূত রক্তের কালীরই অন্য রূপ হল চামুন্ডা রূপ। চামুন্ডা রূপে দেবী দুর্গা চন্ড এবং মুন্ডের মাথা কেটে নেন তাঁর হাতের খড়গ দিয়ে। দেবীর এই চামুন্ডারূপেরই আরাধনা করা হয় সন্ধি পূজার মাধ্যমে।

সন্ধিপূজার নৈবেদ্য
নবমীর পূজাতেই মাকে নৈবেদ্য দেওয়ার শেষ সুযোগ। তাই সন্ধিপূজার আয়োজনও সাড়ম্বরে করা হয়। সন্ধিপূজায় দেওয়া হয় ১০৮টি পদ্ম এবং জ্বালানো হয় ১০৮টি মাটির প্রদীপ। নৈবেদ্যয় দেওয়া হয় গোটা ফল (লাল রঙের ফল থাকা বাঞ্ছনীয়), জবা ফুল, শাড়ি, সাদা চাল, গহনা (যদি কেউ দিতে চায়) এবং বেলপাতা। প্রতিটি পারিবারিক পুজোয় এবং বারোয়ারি পুজোয় যে যার নিজের মত করে সাজিয়ে দেন এই নৈবেদ্যগুলি, কিন্তু ১০৮টি পদ্ম এবং ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার নিয়মটি চিরাচরিত, এর কোনো অন্যথা হয় না।

সন্ধিপূজার আছে বিভিন্ন আচার এবং প্রথা। অতীতে রাজপরিবার এবং জমিদার পরিবারের দুর্গাপুজোয় সন্ধিপূজার সময়ে কামান দেগে তোপধ্বনি করা হত, অনেক জায়গায় সন্ধিপূজার সময় ঢাক বাজানো হত। এমনকি আজকের দিনেও সন্ধিপূজার সময়ে সবাই একটু ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, কারণ এই পুজোই মায়ের অন্যতম প্রধান পুজো, তাই কেউই এই পুজোর আয়োজনে কোনো ফাঁক রাখতে চান না। এই দুর্গোৎসব হল ব্রহ্মান্ডব্যাপী মাতৃশক্তির আরাধনা, অশুভশক্তির বিনাশ করে শুভশক্তির জয়।

নবমীপূজা ও বলিদান
‘বলি’ শব্দের অর্থ উপহার। জীবের অহঙ্কার, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি স্বস্বরূপ বোধের প্রতিবন্ধক। এগুলির বিসর্জনই বলির তাৎপর্য। তন্ত্রশাস্ত্রে আছে “কামক্রোধৌ ছাগবাহৌ বলিং দত্ত্বা প্রপূজয়েৎ”, অর্থাৎ কামক্রোধরূপী ছাগ ও মহিষকে বলি দিয়ে পূজা করবে। এই পূজার ক্ষণটিতে ভক্তেরা মায়ের চরণে স্ব স্ব অন্তরে স্থিত চন্ডমুন্ডরূপ কামক্রোধাদিকে বিসর্জন দিয়ে সেই মহাশক্তির কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকেন।

শ্রীশ্রীচন্ডীতে আছে, মহারাজ সুরথ ও সমাধি বৈশ্য নদীপুলিনে দেবীর পূজা করে নিজ গাত্রের শোণিতসিক্ত বলি দান করলেন। জীবশরীরে রক্ত মূল্যবান বস্তু । তাকে দান অর্থাৎ আত্মনিবেদন করলেন। দেবীর নিকট সম্পূর্ণ শরণাগত হওয়াই বলির তাৎপর্য

মহাপূজার শেষ পর্যায়ে নবমীপূজার অন্তে অনুষ্ঠিত হয় ‘হবন’। ‘হবন’ একটি সম্পূর্ণ পৃথক পূজা। দেবীর সম্মুখে তাঁর নামে অগ্নিস্থাপন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। পূর্বে প্রতিমাতে, ঘটে যে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তারই অনুষ্ঠান এখন অগ্নিতে। বৈদিক যুগের অনুকল্প হিসাবে এই ‘হবন’ কার্য হয়ে থাকে। অগ্নিকে সাক্ষী রেখে কল্পারম্ভে সঙ্কল্পিত কার্যের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় দক্ষিণা দানের মাধ্যমে।

দশমী’ কথাটির মধ্যে আছে বাঙালির আবেগ ও মনখারাপ মিশ্রিত একটি অনুভূতি। দশমী এলেই বাঙালির মনে আসে মায়ের ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা। অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও একটি বছর। সাধারনত দুর্গাপুজোর অন্ত হয় দশমীর মাধ্যমেই। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।

‘দশমী’ কথাটির সাধারন অর্থও খুবই সহজবোধ্য। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে দেবী পিতৃগৃহ ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে পাড়ি দেন। সেই কারণেই এই তিথিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয়। তবে দশমীকে ‘বিজয়া’ বলার কারণ খুঁজলে অনেক পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া যায়। পুরাণের মহিষাসুর বধ কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিলেনমা দুর্গা। তাই তাকে ‘বিজয়া’ বলা হয়। এছাড়াও শ্রীশ্রীচণ্ডী কাহিনী অনুসারে, দেবীর আবির্ভাব হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। পরে শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর বধ করেছিলেন তিনি। তাই অনেকেই বিজয়া দশমী এই বিজয়াকেই চিহ্নিত করেন।

উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়। তার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দশহর’ থেকে। যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। বাল্মীকি রামায়নে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করেছিলেন রাম। কথিত আছে, রাবণ বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, ও লক্ষণ। রাবণ বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যেই যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে।

তবে দুর্গাপুজোর শেষ দিন হিসাবে দশমী শোকের ছায়া বহন করলেও শাস্ত্রে এই বিষয়টিকে সেই ভাবে দেখা হয়নি। এই প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের একটি কাহিনী উল্লেখযোগ্য। রানী রাসমণীর জামাতা মথুরবাবু একসময় আবেগপ্রবন হয়ে দশমীর দিনেও মা দুর্গাকে বিসর্জন দেবেন না বলে জেদ ধরে বসেন। তখন রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বোঝান, বিজয়ার অর্থ দেবীমা ও সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। তিনি আরও বলেন যে, মা কখনও তার সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। এতদিন মা দালানে বসে পুজো নিয়েছেন এরপর মা হৃদয়মন্দিরে বসে পুজো নেবেন। এরপরেই মথুর শান্ত হন এবং প্রতিমার বিসর্জন হয়।

সনাতন ধর্ম বিশ্বাস করে, “মানুষের দেহ পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি”। যথা: আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি। তাই মৃত্যুর পর এই দেহ আগুনে দাহ করা হয় অথবা মাটি দেওয়া হয়। অর্থাৎ যে উপাদান দিয়ে এই দেহ তৈরি, মৃত্যুর পর আবার সেই একই উপাদানে মিশে যায়। তেমনি প্রতিমার ক্ষেত্রেও তাই, তা মাটি দিয়ে তৈরি। মাটির প্রাণহীন মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলে সেটি প্রতিমা হয়। আর পূজা শেষে দেবীকে বিদায়ের পর সেই প্রতিমাটি আবার প্রাণহীন মূর্তি হয়ে যায়। আর তাই তাকে আবার পঞ্চতত্ত্বের একটি, সেই জলেই বিসর্জন দেওয়া হয়।

এই প্রতিমা পূজার সর্বশেষ অধ্যায় বিসর্জন। জলের মাধ্যমেই যেমন মাটির প্রতিমা পুনরায় প্রকৃতিতে মিশে যায়, সেই জন্যই জলে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। যে নিরাকার ঈশ্বর রয়েছে, উপসনার জন্য মাটির প্রতিমা তৈরি করে তাকে “সাকার রূপ”দেওয়া হয়।

শুভ বিজয়াপর্বে মাকে অন্য দিনের মতই ভোগ নিবেদন করা হয় আর তার পর থাকে মিষ্টিমুখ। আর একটি বৈশিষ্ট যে কিছু বনেদি বাড়িতে মানা হয় “অরন্ধন”। কন্যা উমার শ্বশুরালয়ে যাওয়ার সময় যে দুঃখের ছায়া নামে সেই বেদনার প্রকাশ। যদিও দধিকর্মার রীতি সব বাড়িতেই আছে তবে বহু বনেদি বাড়িতে আজ পান্তা ভোগ হয়। কেউ শালুক শাপলা দিয়ে কেউ বা ইলিশের অম্বল দিয়ে কেউ কড়াইয়ের ডাল বা কচুর শাক দিয়ে এই ভোগ দেন। আপন ভোলা স্বামীর ঘরে ফিরে বাপের বাড়ির রাজসিক আপ্যায়নের কথা বলে যাতে দেবী স্বামীকে রুষ্ট না করে ফেলেন তাই এই সাবধানতা ।
চার দিনের আনন্দ উৎসবের পর এই পান্তা প্রসাদ যেন দেবীর বিচ্ছেদ বেদনার প্রতীক ।

****** কৃতজ্ঞতা স্বীকার
রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন মহরাজদের প্রদত্ত বক্তৃতার সারাংশ।
রামকৃষ্ণ মিশনের মুখপত্র উদ্বোধন পত্রিকাতে প্রকাশিত বিভিন্ন মহারাজদের লিখিত আখ্যানমালা ।

 

বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোতে মায়ের ভোগের বিভিন্ন পদ
বেলুড় মঠের দুৰ্গা পুজোতে মোট দশটি থালায় মাকে ভোগ দেওয়া হয়, আটটি আমিষের থালা ও বাকি দুটি অর্থাৎ নারায়ণ ও শিবের জন্য নিরামিষ ভোগ। আমিষ ভোগের প্রধান বড় থালাটি থাকে মায়ের জন্য আর বাকি গুলি থাকে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ, নবপত্রিকা, মহাসিংহ ও মহিষাসুরের জন্য। বেলুড় মঠের স্বতন্ত্র লক্ষ্মী ও সরস্বতী পুজোর ভোগে কিন্তু আমিষ দেওয়া হয় না তবে এই সময় যেহেতু তাঁরা মায়ের সহচরীরূপে উপস্থিত থাকেন তাই আমিষ ভোগ পরিবেষণ করা হয়।

সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর সকালে মায়ের প্রধান পুজো অর্থাৎ ষোড়োশপচারে পুজোর পর দেওয়া হয় বাল্য ভোগ। এই বাল্য ভোগে থাকে পিতলের এক বড় হাঁড়ি খিচুড়ি ও গোটা ইলিশ মাছ ভাজা মশলা দিয়ে। এই বাল্য ভোগ কেবল মায়ের জন্যই নিবেদিত হয়।

মায়ের দ্বিপ্রহরিক ভোগে থাকে গোবিন্দভোগ চালের সাদা ভাত ও বাসমতি চালের পোলাও। এই চালগুলি বাছাই ও ঝাড়াই মহালয়ার দিন থেকে মঠের নবীন ব্রহ্মাচারীদের দায়িত্বে থাকে যাতে মায়ের ভোগে কোনো কাঁকর না পাওয়া যায়। অন্নভোগের থালায় স্তূপাকারে থাকে সাদা ভাত, পাশে বাটিতে দেওয়া হয় খিচুড়ি ও পোলাও। সঙ্গে পরমান্ন অর্থাৎ পায়েস। মায়ের পাতে থাকে পাঁচ রকমের সিদ্ধ যেমন কাঁচকলা সিদ্ধ, আলু সিদ্ধ, পটল, কুমড়ো ও উচ্ছে সিদ্ধ। ভাজার মধ্যে দেওয়া হয় আলু, পটল, বেগুন, উচ্ছে ও বড়ি। মায়ের জন্য মেদিনীপুর থেকে আনানো হয় গয়না বড়ি। বাজারে যত রকমের সময় অসময়ের সবজি পাওয়া যায় তার সব দিয়েই মায়ের জন্য তরকারি ও ডালনা প্রস্তুত করা হয়। বাঁধাকপি, ফুলকপি থেকে এঁচোড়, মোচা সবই থাকে মায়ের সবজি তরকারিতে। সবরকম ভাজা ও তরকারি সুন্দর ভাবে আলাদা আলাদা বাটিতে মায়ের জন্য সাজিয়ে নিবেদন করা হয়। আগে মাটির বাসনেই মায়ের ভোগ নিবেদন করা হতো প্রবীণ সন্ন্যাসীদের কথায় এই মাটির পাত্রগুলি স্তূপাকৃতি হয়ে যেত ভোগ নিবেদনের পর তাই মায়ের জন্য বড় কাঁসার থালা বাটির ব্যবস্থা করা হয়। এই বাসন মাজার জন্যই কয়েকজন সবসময় প্রস্তুত থাকেন। মায়ের ভোগের থালায় সব কিছুর সঙ্গেই দেওয়া হয় নুন, লেবু ও জল।

যেহেতু মায়ের ভোগ আমিষ দিয়েই নিবেদিত হয় তাই মাছের পদে থাকে বিশেষ আয়োজন। অন্তত পাঁচ রকমের মাছ প্রতিদিন দেওয়া হয় যদি তার থেকেও বেশি মাছ পাওয়া সম্ভব হয় তাহলে তাও দেওয়া হয়। পাঁচ রকমের বিশেষ মাছের মধ্যে রোজ থাকে ইলিশ, চিংড়ি, রুই, ভেটকি ও সরপুঁটি।

সন্ধিপুজোতে মাকে দেওয়া হয় বড় ভোগ। এর মধ্যে থাকে সব রকমের অন্ন ভোগ তরকারি ফল মিষ্টি ও মাছের নানা পদ, আর থাকে কালীঘাটের বলির মাংস। শ্রীশ্রী মায়ের নির্দেশে বেলুড় মঠে পশুবলি দেওয়া হয় না, বলির পাঁঠা দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজো, শ্যামাপুজো ও ফলহারিণী পুজোর দিন কালীঘাটে মাকে উৎসর্গ করে মঠে সেই প্রসাদী মাংস নিয়ে এসে রান্না করে ভোগ দেওয়া হয়। এক দেবীর কাছে উৎসর্গ করা প্রসাদ যখন আবার অন্য দেবীর পুজোতে ভোগ হিসাবে দেওয়া হয় তখনি তা হয়ে যায় মহাপ্রসাদ। যেমন পুরীতে জগন্নাথ দেবের প্রসাদ মা বিমলাকে নিবেদন করার পর তা মহাপ্রসাদ হয়ে যায়।

মায়ের জন্য রচনাভোগ মঠেই প্রস্তুত করা হয়, মহালয়ার দিন থেকেই এর তোড়জোড় হয়ে থাকে। প্রায় দুই হাজার নারকেল নাড়ু মায়ের জন্য তৈরী করা হয় সাথে মুড়কি ও অন্যান্য আয়োজন। মায়ের নৈবেদ্যের জন্য সব রকমের ঋতুর ফল মাকে দেওয়া হয়, সঙ্গে থাকে কাজু কিশমিশ খেজুর আমসত্ত্ব। মায়ের সামনে আখ, চালকুমড়ো ও কলা বলি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সকল দেবী দেবতা বাহন ও অঙ্গ দেবতার পুজোতে নৈবেদ্যের আলাদা আলাদা আয়োজন থাকে, প্রত্যেকের নৈবেদ্য নিবেদনের পর জায়গাটি মুছে অন্য নৈবেদ্য আনা হয়।

রাতে ভোগে দেওয়া হয় লুচি, ছোলার ডাল ও মুগের ডাল, তিন রকমের তরকারি ও পাঁচ রকমের ভাজা এবং মিষ্টি, ক্ষীর, রাবড়ি। রাতে মায়ের ভোগে আমিষ পদ থাকে না, সকলের ভোগই হয় নিরামিষ। দুপুর ও রাতে ভোগ নিবেদনের সময় থালার সামনে আসন পেতে দেওয়া হয় এবং নারায়ণের ভোগের উপর তুলসী ও মা দুৰ্গা সহ সকলের ভোগে দেওয়া হয় বেলপাতা। দুপুরে ঠিক ১২ টার সময় ভোগ দিয়ে ভোগারতি হয় এবং রাতে ভোগ দেওয়া হয় আটটার পর। সকালের বাল্য ভোগ দেওয়া হয় পূর্বাহ্নের পুজোর সময়ের মধ্যেই। অষ্টমীর দিন তিথি বারোটার আগেই ছেড়ে গেলে অষ্টমীর মধ্যেই একবার ভোগ দেওয়া হয় তারপর আবার যথারীতি দুপুরের ভোগ দেওয়া হয় সঙ্গে আরতি।

দশমীর দিন মায়ের সামনে বিসর্জনকৃত্য ভোগ হিসাবে দেওয়া হয় দধিকর্মা ভোগ যার মধ্যে মূলত থাকে চিঁড়ে ও দই, কিশমিশ, কাজু, নানা ফল, কলা, নাড়ু, সন্দেশ এগুলি।

মায়ের নামে প্রতিদিন মঠে খিচুড়ি ভোগ বিতরণ করা হয়। ভোগ রান্নার ঘরেই মায়ের ছবির সামনে এই ভোগ নিবেদন করে আরতি করা হয় তার পর দর্শনার্থী ভক্তদের পাতে তুলে দেওয়া হয় মায়ের মহাপ্রসাদ রূপে। চাল, ডাল ও সমস্ত রকম তরকারি দিয়েই এই খিচুড়ি প্রস্তুত হয়, আলাদা করে কোনো লাবড়া বা এই জাতীয় কিছু থাকে না সঙ্গে থাকে চাটনি ও মা অন্নপূর্ণার অপার আশীর্বাদ। মঠের খিচুড়ি ভোগ বিষয়ে বেলুড় মঠের এক সময়ের অধ্যক্ষ স্বামী বিরজানন্দের একটি চিঠিতে পাই “শুধু খিচুড়ি পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবস্থা হবে। তাতেই শাক-সবজি যা কিছু দেবে। অন্য তরকারি মিষ্টান্ন কিছু দরকার নেই। এ খিচুড়ি মায়ের সামনে হান্ডা হান্ডা করে বিরাট ভোগ দিয়ে তারপর সর্বহারা নারায়ণদের পরিবেশন করতে হবে। এইবার মা এইভাবে পূজাভোগ গ্রহণ করবেন ও আমাদের পূজা সার্থক হবে। আলাদা ব্যবস্থা কারো জন্য নয়। ”

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় যেমন “মা শতমুখে খান”। এই ভাবনাকে কাজে করে দেখানোর জন্যই রামকৃষ্ণ মঠের ভারত জুড়ে প্রতিটি শাখাই যেমন মায়ের ভোগের স্বতন্ত্র আয়োজন করেন তেমন তাঁর ছেলেমেয়েরাও যাতে পুজোর দিনে মায়ের করুণা ভরা প্রসাদ পান সে বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়িত করেন। আর মায়ের কৃপায় কেউ অভুক্ত ফেরে না মঠ মিশনের কোনো শাখা থেকেই।

কৃতজ্ঞতা- রামকৃষ্ণ মিশনের পত্রিকা উদ্বোধনের একটি লেখনের সংক্ষিপ্ত রূপ ।

Sahityika Admin

1 comment

  • ধন্যবাদ এডমিন কিছু বানান ভুল ঠিক করে দেওয়ার জন্য ।