শিব ঠাকুরের আপনদেশে
আশিক মহম্মদ, ১৯৯৮ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
আইন কানুন যে সর্বনেশে হবে সেটাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? সুকুমার রায় তো সেই কবেই আমাদের সাবধান করে দিয়ে গেছেন।
বেনারস শহরে ঢোকা মাত্র বেশ টের পেলাম, যান এবং জান দুটোই হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। যানবাহনের আকার, মাপ আর গতির রকমফেরের কথা বলছি না মোটেই। একই রাস্তায় বাস, ট্রাম, ট্রাক, টোটো, অটো, ঠেলা, ভেলা, রিক্সা, ট্যাক্সি, বাইক, পাইক বরকন্দাজ, পথচারী, পায়চারি এবং আরও হাজার রকম বাহনের সঙ্গে চাকায় চাকা মিলিয়ে, আর পায়ে পা মিলিয়ে মিশিয়ে চলার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু এদের গতির তারতম্যের সঙ্গে যদি এদের গতি-প্রকৃতির আকস্মিকতা যোগ হয় তা হলে ব্যাপারটা বেশ আতঙ্কের। মানে সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে যেকোনো যান যেকোনো দিক দিয়েই আসতে যেতে পারে। এমন কি কিছু আবার উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারে। শুধু মাটি ফুঁড়েই কিছু উঠে আসতে দেখি নি। তবে কিছু দিন থাকলে সেটাও দেখা যেত বলে মনে হয়। ব্যাপারটা অনেকটা any way is my way ! অনেক আগে থেকে ডানদিকে বা বাঁদিকে ঘোরার সিগন্যাল দিয়েও বেশ কয়েকবার বাইকওলার ধমকানি চমকানি খেয়ে থমকে গেলাম। মানেটা এরকম যে, কোথায় চোখ কান বুজে সোজা যাবেন তা না করে আবার ডায়ে-বাঁয়ে ঘোরার চেষ্টা। আপনার সাহস তো কম নয় ! এক সময় মনে হচ্ছিল গাড়ির সব পার্টস অক্ষত রেখে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছতে পারবো তো? দু-চারটে ঝরে যাক ক্ষতি নেই শুধু ইঞ্জিন আর চাকা চারটে থাকলেই হবে। বাড়ি ফিরতে হবে কিনা !
দশাশ্বমেধ ঘাট এবং সন্ধ্যা আরতি
বারাণসীর ৮৪ টি ঘাটের মধ্যে দশাশ্বমেধ ঘাটকেই সব থেকে পবিত্র বলে মনে করা হয়, যে ঘাট স্বয়ং ব্রহ্মা শিব’কে স্বাগত জানাবার জন্য তৈরি করেছিলেন এবং দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন সেই ঘাটের মহিমা আলাদা হবারই কথা। তল্লাটের সব থেকে জনবহুল, যানবহুল এবং শব্দবহুল জায়গা হল গোধুলিয়া বা গোদোলিয়া মোড়। মোড় থেকে একটা রাস্তা হরিশ্চন্দ্র ঘাট হয়ে অসি বা আস্সি ঘাট চলে গেছে। উল্টো দিকে রয়েছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির বা জ্ঞান বাপি মসজিদে যাবার রাস্তা। আরও যে দুটো রাস্তা আছে মোড় থেকে তার একটি শহরের দিকে আর অন্যটা সোজা গঙ্গা পাড়ের দশাশ্বমেধ ঘাটে এসে পৌঁছয়।
বারাণসীতে পর্যটনের মূল আকর্ষণ এই দশাশ্বমেধ ঘাট। সন্ধেবেলার গঙ্গা আরতি চলে সন্ধে ৬:৩০ থেকে শুরু করে ৪৫ মিনিট মতন, আর সে দেখতে বহু মানুষের ভিড় হয়। সময়ের অনেক আগে থেকেই লোক জড়ো হতে শুরু করে। ৫:২৫ নাগাদ পৌঁছেও আমরা দেখলাম বসার জন্যে যে ছোট বড়ো মাঝারি চৌকির ব্যবস্থা আছে সবকটাতেই মানুষ চড়ে বসেছে। ঘাটের সিঁড়িতেও বসে রয়েছে কাতারে কাতারে মানুষ। নামা ওঠার জায়গাও প্রায় বন্ধ বললেই চলে। তারই ফাঁক দিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে চললাম আরতি স্থলের দিকে। আশেপাশে ফুল, রঙ্গিন কাপড়, আলোর চাঁদোয়া আর নানারঙের মানুষে সেজে উঠছে আরতি চত্বর। মূল চাতাল থেকে গঙ্গায় নেমে গেছে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি। সেখানে সারি সারি নৌকা আর বজরা। উৎসাহী মানুষজন উপচে পড়ছে সেখানেও।
ঠিক সময়েই আরতি শুরু হলো। এদিকে ভিড় বেড়েই চলেছে ক্রমশ। চারিদিকে থিকথিক করছে কালো কালো মাথা। কিছু আবার রঙ্গিন মাফলার টুপিতে মোড়া। ভক্তির আলো আর উত্তেজনায় উজ্জ্বল সকলের মুখ। গঙ্গা আরতি দেখতে গিয়ে গঙ্গা প্রাপ্তির হাত থেকে বাঁচতে আরতি শেষ হবার খানিক আগেই আমরা ফেরার পথ ধরলাম। যদিও পথ বলে কিছু ছিলনা তেমন। ফিরতি মানুষের ভিড়ে নিজেদের সঁপে দিয়েছি। লম্বা উঁচু সিঁড়ি বেয়ে অগুনতি মানুষের সঙ্গে একটু একটু করে ওপরে ওঠার চেষ্টা। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল চারপাশের ভিড়ের চাপে এমনিতেই ওপরে উঠে যাচ্ছি, সিঁড়িতে পা পর্যন্ত ঠেকাতে হচ্ছে না। আসলে একেই বলে ভক্তি আর ভক্ত সাগরে অন্তরাত্মাকে ভাসিয়ে দেওয়া। কে না জানে নিজেকে ঠিকঠাক ভাসাতে পারলে তলিয়ে যাওয়ার কোনও ভয় থাকে না আর !
মাতাল টোটো এবং ট্রমা সেন্টার
ভক্ত ভিড়ে ভাসতে ভাসতে গোধুলিয়া মোড়ে পৌঁছনো গেলো। আর একটু হেঁটে গেলেই টোটো, অটো মিলবে। আমাদের হোটেল আস্সি ঘাটের কাছে। দূরত্ব খুব বেশি নয়, ৫.৫ / ৬ কিলোমিটার হবে। উল্টো দিক থেকে একটা খালি টোটো আসছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম যাবে কিনা। এক কথায়, এক ভাড়ায় রাজি। একটু অবাক হয়েই তিনজনে চেপে বসলাম। “হর হর মহাদেব” বলে হুঙ্কার দিয়ে এমন ভাবে গাড়ি ইউ-টার্ন করলো আর একটু হলে এসকেপ ভেলোসিটিতে বেরিয়েই যাচ্ছিলাম। তারপরে শুরু হল এক শ্বাস রুদ্ধকর রোমাঞ্চে ভরপুর সফর। ভাবলাম ভক্তিরস বা ভক্তিধোঁয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে আর কিছু না ! আগে ভক্তি রসে ভাসছিলাম এবার না হয় উড়বো। ছোটো বেলায় টিভিতে দেখা “স্ট্রীট হক” সিরিয়াল মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমাদের গল্পের হিরোও অনেকটা সেরকম স্টাইলেই তার যান নিয়ে উল্কার গতিতে এগিয়ে চলেছে আশেপাশের গিজগিজে ট্র্যাফিক আর থিকথিকে পথচারীকে তোয়াক্কা না করে। বেশ কয়েকবার ধাক্কা লাগতে লাগতে বাঁচলাম। কয়েকজন অটো, টোটো ওলা ধমক দেবার চেষ্টা করলো। বিন্দুমাত্র লাভ হল না তাতে। মাঝে মাঝেই তারস্বরে “হর হর মহাদেব” বলে চেঁচিয়ে উঠছে ! খেয়াল হলো টোটোর সামনের কাঁচটা পুরোটাই ভাঙ্গা। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া গালে থাপ্পড় মেরে চলেছে ক্রমাগত। এক হাতে প্রাণ আর অন্য হাতে টোটোর হ্যান্ডেল চেপে ধরে বসে আছি আমরা। রোগা, কালো, লিকলিকে চেহারার মানুষটা এবার শিববন্দনা ছেড়ে হিন্দি গান ধরেছে। বেশ জোরেই গাইছে। আশে পাশের দোকানদার, চলতি মানুষ আর গাড়ির লোকজনের মুখে কৌতুকের হাসি। এবার “টোটো সামলাও” টাইপ বক্তব্য। হঠাৎ গান থামিয়ে টোটো ওলার প্রশ্ন, “সাহাব জানা কাঁহা হ্যায় ?” সর্বনাশ ! এ হতভাগা কী শুনে কোথায় নিয়ে চলেছে তাহলে? মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো “ট্রমা সেন্টার”। এরকম একটা জার্নি তো ট্রমা সেন্টারেই শেষ হবার কথা। আমাদের হোটেল থেকে ৭০/৮০ মিটার দূরত্বে এই নামকরা ল্যান্ডমার্ক ট্রমা সেন্টার। অন্তত ৮০ মিটার আগে তো বিপন্মুক্ত হওয়া যাবে। নেমে তখনো ঘোর কাটেনি। বাকি পথটা হেঁটে আসতে আসতে ছোটবেলায় মায়ের বলা কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। দিনরাত টো টো করে ঘুরে বেড়ালে জীবন উচ্ছন্নে যাবে !
অলকানন্দায় গঙ্গা দর্শন
বেনারসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই গঙ্গার বুকে সাজিয়ে রাখা পাশাপাশি ঘাট গুলো। ঠিক যেন এক একটা ইতিহাসের পাতা। ইট-পাথরের খাঁজে জমে থাকা কত না কিংবদন্তী গল্প। একটু একটু করে পড়ে পড়ে এগোতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। গঙ্গার পাড় ধরে ছড়িয়ে থাকা রং বেরঙের নৌকাতেও ভেসে যাওয়া যায় আবেগের স্রোতে। রয়েছে ক্রূজ সফর। অলকানন্দা ক্রূজলাইনের তত্ত্বাবধানে, সকাল সাড়ে সাতটায় অলকানন্দা ক্রূজ আর বিকেল সাড়ে পাঁচে ক্রূ ভাগীরথী। দুটোই সন্ত রবিদাস ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে প্রায় ৯০ মিনিটে ৮৪ টা ঘাটের গল্প শুনিয়ে ফেরত আনে সেই রবিদাস ঘাটেই। এক সফরে কি আর তিন হাজার বছরের ইতিহাস ছুঁয়ে ফেলা যায়? তাই একই যাত্রায়, সকাল আর সন্ধের দুই পৃথক ফলের আশায় আমরা দু বার ভাসলাম সেই গঙ্গায়। শীত সকালের ডেক-জোড়া রোদ গায়ে মেখে সিগালের ওড়াউড়ি দেখা আর বজরার নরম সোফায় বসে ঘাট বিহার করতে করতে গরম কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় নিজেকে বেশ মগনলাল মেঘরাজ মগনলাল মেঘরাজ লাগছিলো। যদিও মগনলাল বাবু ছিলেন আরাম কেদারা আর শরবতের দলে। সন্ধেবেলার বাড়তি পাওনা ছিল জাহাজ থেকেই গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গা আরতি দেখা। মনে হল, ভেসে থাকবো ভাবলেই যে সব সময় ঠিকঠাক ভেসে থাকা যাবে এমন কথা নয়। কিছু কিছু অনুভবের তীব্রতা মানুষকে যে কোথায় তলিয়ে নিয়ে যায়, তার খবর কী সে রাখে ?
যুগে যুগে আর কালে কালে কত জল গেছে ঘাট ছুঁয়ে
কত গুণীজন, সাধক পুরুষ, রেখেছেন পা এ ভুঁয়ে
শিবপ্রেম মাখা পথ-ঘাট গলি, লোভনীয় পিনা খানা
ভোরের ভজন, সান্ধ্য ঠুংরি, বিসমিল্লার সানাই ..
হাসতে হাসতে মরে যায় কেউ, কারো প্রাণ যায় কাশি।
ভালবেসে কেউ জান দিয়ে দেয় – গল্প শুনতে আসি !
কারো বা মৃত্যু থমকিয়ে থাকে ঘাটের কাছে, কাশীর।
লঘু গুরু পাপ ধুয়ে নিতে আজ আমরাও কাশীবাসি !
ঘাট থেকে ঘাটে ভক্তিপ্রবাহ অনঘ একশো আটে
মোক্ষলাভের মণিকর্ণিকা জ্বলন্ত চিতাকাঠে
আমাদের নাও ভিড়েছে সেতারে শঙ্কর রবি ঘাটে
দেবী গিরিজার ঠুংরি আমেজে সূর্য গিয়েছে পাটে …
আস্সি ঘাটে ভোরের আরতি এবং সুবহ-এ-বনারস
বেনারসে আমাদের প্রতিদিনের রুটিন ছিল খুব ভোর ভোর উঠে পড়া। সারাদিন এটা সেটা করে (টো টো করে আর নয়) আক্ষরিক অর্থেই পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো আর এটা ওটা চেখে বেড়ানো। সূর্য নিভলে হোটেলে এসে চিৎপাত। চাখার গল্পে একটু পরে আসছি। শীতের ভোরে লেপের তলা থেকে নিজেকে টেনে বের করতে গেলে বেশ মানসিক জোর লাগে। তার উপর বেনারসের ঠাণ্ডায় ভোর চারটের সময় বিছানা ছাড়ার কথা স্রেফ ভাবলেই নিজেকে মেডেল দিতে ইচ্ছে করে। আস্সি ঘাটের ভোর ৫ টার গঙ্গা আরতি দেখতে গেলে মেডেল তো পরতেই হবে তা সে যতোই আপত্তি থাক। হোটেল থেকে আস্সি ঘাট খুব দূরে নয়। মাত্র ১.৫/২ কিমি রাস্তা। এমনিতে পা চালিয়ে গেলে গা গরম হয়ে যাবে। তবে অন্ধকার, কুকুর, মাতাল আর ভয়ংকর টোটোর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে অগত্যা গাড়ি বের করতেই হলো। শীতকালে আরতি ৩০ মিনিট পরে শুরু হয়। ভাগ্যিস সেটা জানতাম না। তাই আগেভাগে পৌঁছনোর ফল পাওয়া গেলো হাতেনাতে। একেবারে প্রথম সারির প্রথম পুরুষ হিসাবে পাকাপাকি দাঁড়াবার জায়গা পেলাম। আস্তে আস্তে লোকজন আসতে শুরু করেছে। রঙ্গিন কাপড়ে, ফুলে সেজে উঠছে পাশাপাশি রাখা আরতি মঞ্চের বেদিগুলো। সারি সারি সাজানো চেয়ার সেজে উঠছে দর্শনার্থীতে। তার পিছনে সিঁড়ির ধাপে ধাপে এসে বসছে মানুষ। আরতি স্থলের আশে পাশে জড়ো হচ্ছে ভক্তরা। তবে কোথাও কোনো হুড়োহুড়ি নেই। মারামারি নেই। এমন শান্ত, সুন্দর পরিবেশে মন এমনিতেই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। অন্যদিকে ঠাণ্ডা হচ্ছে টুপি আর মাস্কের আওতার বাইরে থাকা আমাদের মুখের খোলা অংশও, গঙ্গার বাতাসে।
ঠিক সময়েই শাঁখ বাজিয়ে শুরু হল আরতি। চারপাশে ঘন অন্ধকার। তার মাঝখানে ভক্তির আলোয় উজ্জ্বল মুখগুলো। প্রদীপ আর ধূপের ধোঁয়া মিলেমিশে একাকার। নিঃঝুম চরাচর ছাপিয়ে জেগে থাকে শুধু মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ আর ঘণ্টার ধ্বনি।
আরতি শেষ হতে না হতেই কানে ভেসে আসে রাগ ভৈরবের আলাপ। আরতি স্থলের পাশেই রয়েছে বাঁধা মঞ্চ। সেখানেই তানপুরা, হারমোনিয়াম, তবলা যোগে বসেছে রাগাশ্রিত সঙ্গীতের আসর – সুবহ -এ-বনারস। কোমল ঋষভ আর কোমল ধৈবত ছুঁয়ে শুদ্ধ স্বরের সুনিপুণ চলন ভেতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন তুলছে। ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছে অন্ধকার। শিল্পী এবারে গেলেন রাগের বিস্তারে। আকাশ জুড়ে ডানা বিস্তার করেছে সিগালের দল। শিল্পীর তানে তানে সূর্যের আলোর বিস্তার ঘটছে গঙ্গার জলে। আলোর স্রোতে ভাসছে নৌকা। ভোর হচ্ছে। মনে এসে পড়ছে আলো।
কচৌড়ি গলি ও মিল্কি ওয়ে
বেনারসের বাহারি আহারের ব্যাপারে আগে থেকেই ধারণা করে গিয়েছিলাম। কী কী খাব, কোথায় খাব, কখন খাব। কোনো কিছুই বাদ দেওয়া যাবে না। সেই মতো দিন আর সময় মেপে খাদ্য মানচিত্রও তৈরি। শহরে ঢোকার মুখেই বিখ্যাত বেনারসের বেটিয়ো কা বাটি চোখা রেস্তোরাঁ। বেলা হয়েছে। পেটে বেশ চনমনে খিদে। সোজা ঢুকে পড়লাম। বেশ বড়ো জায়গা। লম্বা সবুজ ঘাসের লন। চারদিক ফুলের গাছ আর নানারকম হস্তশিল্প দিয়ে সাজানো। কাঠের সূক্ষ্ম কাজ করা বিশাল দরজা ঠেলে বাইরে জুতো খুলে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতে হবে। গ্রামীণ পরিবেশে মাটির বাড়িতে কাঠের চৌকিতে খাবার দেওয়ার রেওয়াজ। মাটির দালানে পাতা মাদুরে বাবু হয়ে বসে খাওয়াই দস্তুর। দেওয়ালে নানা রকম হাতে আঁকা নকশা আর কারুকাজ। বাঁশের কাঠামোতে টাঙ্গানো হ্যারিকেনের আলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো থালি। মাটির থালায় পাতা শালপাতার ওপরে গরম গরম লিট্টি। কোনোটায় ছাতুর পুর। কোনোটায় পনিরের। পাশে দু-তিন রকমের আচার আর চাটনি। পাঁচমিশালি ডাল আর পিঁয়াজ-ধনেপাতা-কাঁচালঙ্কা দিয়ে তৈরি বেগুন ভর্তা। একটা ছোটো ঘিয়ের বালতিও বসিয়ে দিয়ে গেলো। যত খুশি ছড়াও, ছিটোও, মাখাও। স্থান, কাল ছাপিয়ে পাত্র নিয়ে আমরা তখন অন্য দুনিয়ায়। হাতে এখনো ঘিয়ের গন্ধ লেগে। মনে হল বেনারসে এসে অন্য কিছু না করে শুধুমাত্র লিট্টি চোখা খেয়ে গেলেও কম পুণ্য অর্জন হবে না। খাদ্যপথে সেই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। তারপরে নানা দিনে নানান সময়ে শহরের অলি গলি চষে ফেলা নানান খাদ্যের সন্ধানে। লম্বা লাইন দিয়ে টোকেন নিয়ে রাম ভাণ্ডারের স্পেশাল বড় কচুরি, সবজি, জিলিপি, অনেক খোঁজাখুঁজির শেষে হাতে পাওয়া লক্ষ্মী চায় ভাণ্ডারের মালাই টোস্ট, মাখন টোস্ট, মালাই চা, কাশী চাট ভাণ্ডারের টম্যাটো চাট, পালক চাট, চক থানার ঠিক পিছনে মাজারের পাশের দোকানের রাবড়ি, ব্লু লস্যি থেকে ড্রাই ফ্রুট, মিক্সড ফ্রুট লস্যি এমনি আরো কত কি ! গোদোলিয়া মোড় ছাড়িয়ে চক থানার দিকে যেতে কচৌড়ি গলি। তারই আশেপাশে ছড়ানো এমন খাদ্যরত্ন ভাণ্ডার। কোনো কোনো দোকানের ঐতিহ্য প্রায় ১০০ বা ১৫০ বছর। কচুরির জন্যে কচৌড়ি গলি নাম হলেও পাওয়া যায় হরেক রকমের খাবার। বেনারসতো শুধু ঘাটের শহর নয়, দুধের শহরও বটে। এইসব গলি যতটা ষাঁড়ের ততটাই দুধেল গাই এর। জাফরানি দুধের গন্ধ নাকে নিয়ে হরেক রকম দুগ্ধজাত খাবার চাখতে চাখতে আর দেখতে দেখতে মিল্কি ওয়ে ধরে ছিল আমাদের যাওয়া আসা। ঘন করে ফোটানো দুধে মেশানো হয় ক্রিম, চিনি, জাফরান। তারপরে সারারাত খোলা আকাশের নীচে ফেলে রাখা হয় শিশিরের মাধুর্যে সম্পৃক্ত হবার জন্যে। তবেই তৈরি হয় সেই স্বর্গের অমৃত যার নাম মালাইয়ো। এই মহার্ঘ কিন্তু একান্তভাবেই শীতকালীন সম্পদ। খেয়েছি লঙ্কার পহেলবানের লস্যি। দেখেছি শীতের ভোর পাঁচটায় ঘুমন্ত মানুষের দীর্ঘ লাইন চাচীর কচুরির জন্যে। মনে হত যেন ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে উঠে কচুরি খেয়েই সোজা চলে যাবে বিছানায় ফেলে আসা বাকি ঘুম পূরণ করতে। খাদ্য সফরের শেষ পাতে থাক কেশব তাম্বুল ভাণ্ডারের মিষ্টি পান।
ব্লু লস্যি ও মোক্ষ লাভ
এ গলি সে গলি পেরিয়ে তস্য গলি নমস্য গলি হয়ে পৌঁছতে হয় ব্লু লস্যি শপে। ব্যাপারটা অনেকটা গোলোকধাঁধার মত। অনেক ধাঁধার সমাধান করার পরেই মিলবে গুপ্তধনের হদিশ। দোকানের চেহারা দেখে ভক্তি জাগবে না মোটেই। ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের ছোটো একটা ঘর। ভিড়ে ঠাসা। ১০০ এর কাছাকাছি লস্যির ভ্যারাইটি মেলে এখানে। জগতজোড়া খ্যাতি। ৭৫ বছর ধরে মানুষের মন জয়ের গল্পে এ দোকানের নাম ছিলো পান্নালালের লস্যির দোকান। বছর পঁচিশ আগে কোরিয়া থেকে আসা কিছু পর্যটক দেওয়ালের রং দেখে দোকানের নাম ব্লু লস্যি হিসাবে উল্লেখ করে। দেশে গিয়ে খুব সুখ্যাতি করে। দোকানের নাম ব্লু লস্যি শপ হিসাবেই ছড়িয়ে পড়ে দেশে বিদেশে। লস্যির রং থেকে কিন্তু দোকানের নাম হয় নি। গাঢ় নীল রঙে রাঙ্গানো দেওয়াল। সেই থেকেই দোকানের নাম ব্লু লস্যি।
বসার যা জায়গা আছে খালি থাকে না এক মুহূর্তের জন্যে। সারি সারি লস্যি পিপাসু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দোকানের ভেতরে এবং রাস্তাতেও। সমস্ত দেওয়াল জুড়ে অসংখ্য পাসপোর্ট সাইজের ছবি আঠা দিয়ে লাগানো। দেশ বিদেশের নানান মানুষ তাদের ভালোলাগার, ভালোবাসার ছোঁয়া রেখে গেছে ছবিতে, কেউ বা শব্দে। হিন্দি, ইংরেজির পাশাপাশি কোরিয়ান ভাষায় লেখা নাম চোখে পড়বে দোকানের বাইরে। বেনারসে ঘুরতে আসা দেশি বিদেশি কেউই এখানে ঢুঁ মারতে ভোলেন না।
বেশ খানিক অপেক্ষার পর হাতে এলো সেই অমৃত ভাণ্ড। চিনি আর সামান্য নুন মেশানো ঘন থকথকে দই, উথাল পাথাল ফেটানোর পর ভরিয়ে দেওয়া হল হরেক রকম ড্রাই ফ্রুটস আর জাফরান দিয়ে। অন্যটাতে উপচে পড়ছিল মিক্সড ফ্রুটের সম্ভার। একটা চামচ মুখে দেবার পরে চোখ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে আবেশে। সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
ব্লু লস্যি শপের সামনের সরু গলিটা সোজা চলে গেছে মণিকর্ণিকা ঘাটে। যেখানে চিতার আগুন নেভেনা কখনো। বিশ্বাস, এই পবিত্র ভূমে মৃত্যুবরণ আর মণিকর্ণিকা ঘাটে সৎকার হলে মোক্ষলাভ হয়। দোকানের সামনের এই গলিপথ এক অর্থে স্বর্গে যাবারই রাস্তা। লস্যি এবং ড্রাইফ্রুটের যুগলবন্দীতে মন যখন চুঁয়ে পড়ছে ভাঁড়ের গা বেয়ে, ঠিক তখনই জোর ঢাকের আওয়াজে দেখা গেল দোকানের গা ঘেঁষে মহাসমারোহে চলেছে মৃতদেহ। এ এক দারুণ সমাপতন। একদিকে চামচে চামচে মুখে উঠে আসা অমৃতের স্বর্গসুখে আমাদের চোখ বুজে আসে আবেশে। ঠিক একই সময়ে সামনে দিয়ে, চোখ বন্ধ করে মৃতদেহ চলেছে মোক্ষলাভের আশায়, ঘাটের পথে। স্বর্গ লাভের অনুভব দুপক্ষেরই। শুধু রাস্তাটাই যা আলাদা।
কাশী নরেশের টাটা
১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে, তখনকার বেনারসের মহারাজা বলওয়ান্ সিং তৈরি করেছিলেন রামনগর ফোর্ট। এখন কাশী নরেশ অনন্ত নারায়ণ সিং এর বাসস্থান এই প্যালেস। মাখন রঙের চুনারের বেলেপাথর দিয়ে, মুঘল শৈলী মেনে তৈরি এর আলংকারিক অলিন্দ, প্যাভিলিয়ন এবং সুদৃশ্য বিশাল চত্বর। ফোর্টের ভেতরে যতগুলো ভবন আছে তা জমি থেকে অনেকটা উঁচুতে তৈরি করা, যাতে বন্যার কবল থেকে ফোর্টকে রক্ষা করা যায়। একদিক সাধারণ মানুষের দেখার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে মহারাজের বাসভবন আছে বলে সাধারণ মানুষের ঢোকা বারণ। সাদা রঙের মিনারে শোভিত মহারাজের নিজস্ব বাসভবন। ঠিক এর অপর প্রান্তে রয়েছে দরবার হল। আছে ছোটো, বড়, মাঝারি নানা রকম ভিন্টেজ গাড়ির সম্ভার, পালকি, বিভিন্ন রত্নখচিত চেয়ার, সোনা রূপোর গয়না, বেনারসি ব্রোকেডের রাজকীয় পোশাক। এখানে একটা বিশাল অস্ত্রাগার আছে যা বিভিন্ন তলোয়ার, পুরনো বন্দুক, বিভিন্ন ধরনের খঞ্জর ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও বিরল জ্যোতির্বিদ্যাসংক্রান্ত ঘড়ি রয়েছে। ঘড়িটি একইসঙ্গে সময়, দিন, বছর, মাস, এবং সপ্তাহের পরিসংখ্যান বলে দেয়। তারই সঙ্গে সূর্য, চন্দ্র, ও বিভিন্ন গ্রহের বিবরণও দিয়ে থাকে, যদিও সেটা পড়া বেশ কঠিন ব্যাপার। চোখে পড়বে কারুকাজ করা হুকো, হরেক রকমের বাদ্যযন্ত্র। সংগ্রহশালার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বিষয় হল, তুলসীদাসের নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি।
ইতিহাসের পাতায় ঘুরতে ঘুরতে সময় বয়ে যায়। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই পরবর্তী চমক অপেক্ষা করছে প্যালেসের গেটে। কাশী নরেশ স্বয়ং। বিস্ময় সেটা না। রাজ-গ্যারেজ জুড়ে শোভা পাওয়া টি ক্যুপে, ফিটন, ফ্লিন্ট, পিয়াস অ্যারো, ক্যাডিলাকের মত গাড়ি ছেড়ে কাশীর রাজা ভারতীয় টাটা গাড়ি চড়ে বেরিয়ে গেলেন। একটাই কথা মনে হল, দেশে টাটার গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো প্রজাকুল নিজেদের স্বচ্ছন্দে মহারাজ ভাবতে পারে !
সারনাথ কথা
সারনাথ ঘুরে সার কথা যা বুঝলাম তার সারমর্ম এই যে বুদ্ধ ছিলেন, আছেন, থাকবেন আর ভাগ্য ভালো হলে সুজাতার দেখা মিললেও মিলতে পারে। তবে হাতে পায়েসের বাটি থাকবে কিনা তার কোনো গ্যারেন্টি নেই। আর বাকি কথা জানার জন্যে তো ইতিহাস বই আছেই। কিম্বা ইন্টারনেট।
Add comment