সুধীন বাঁড়ুজ্যের কৌতূহল
নীলাদ্রি রায়, ১৯৮৩, ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
সুধীন বাঁড়ুজ্যের কৌতূহল রোগটার শুরু ছেলেবেলা থেকেই।
বালক বয়সে – যখন গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন – তখন মুরগির ঘরে উঁকি দিতে গিয়ে নাকে মোরগের ঠোকর খেয়েছেন। প্রদীপের শিখার ভেতরে কি আছে জানতে গিয়ে আঙ্গুল পুড়িয়েছেন। আর একবার তো গাছে ভিমরুলের চাক হয়েছে শুনে, রুল বস্তুটি কী এবং কেন যে তা ভীমতুল্য, সে বিষয়ে কৌতুহলী হয়ে… সে কথা নাহয় থাক!
তবে এসবে সুধীনবাবুর শিক্ষা হয় নি। হবার প্রবৃত্তিও ছিলনা। প্রাইমারি শেষ করে গঞ্জের হাই স্কুলে পড়ার সময় হেড-স্যার ইংরিজি পিরিয়ডে পড়িয়েছিলেন, “কিউরিওসিটি কিলড দি ক্যাট।” সুধীনবাবু তা শুনে পরম সন্তোষে নিজের মনে ভেবেছিলেন – ‘তাতে আমার কি? আমি তো আর বেড়াল নই!’
মোদ্দা কথা, বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহল কমে তো নি-ই; অনুসন্ধিতা বরং বেড়েই চলে এসেছে। রাস্তা চলতেও নিজের চরকায় তেল দিয়ে সোজাসুজি চলতে পারেন না। যেখানে-সেখানে এতটুকু ভিড় দেখলেই হাঁচোড়-পাঁচোড় করে, কনুই ঠেলে, অন্য লোকের পা মাড়িয়ে, নিজের গলাটি বাড়িয়ে, নাকখানা গলিয়ে দেন। কী হচ্ছে সেটা না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই।
এহেন কৌতুহলী মানুষের জ্ঞানের ভান্ডার যথাসম্ভব পরিপূর্ণ থাকবে এটাই আশা করা যায়। সুধীনবাবুর মায়েরও তাই আশা ছিল। জ্ঞানের ভান্ডার ভরাই ছিল – অগাধ বই পড়তেন; দরকারি-অদরকারি নানান হাবিজাবি তথ্য গিজগিজ করতো মাথার ভেতর। কিন্তু মায়ের আশায় ছাই দিয়ে সুধীনবাবু কর্মজগতে বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। কলকাতায় চলে আসার পরেও, ছোট-খাটো চাকরি যদি বা জোটে, কোনোটাই বেশিদিন টেঁকে না। কেন, তা সুধীনবাবু জানেন না। নিন্দুকেরা বলে এর জন্য ওঁর অতি-কৌতূহলই দায়ী। সুধীনবাবুর তা মনে হয় না। এই তো সেদিন – এই আগের চাকরিটায় – বড় সায়েব পি জি বিশ্বাসের টেবিলে রাখা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশানটা পড়ে নিয়েছিলেন বলেই না ফ্র্যাঙ্ক-রশে হজমের ওষুধ কেনবার সময়ে সায়েবকে ঢুকতে দেখে তরিঘরি গলা চড়িয়ে ঝন্টুকে হাঁক পাড়তে পেরেছিলেন, “ওরে! স্যারের প্রিপ্যারেশান-এইচ মলমটা আগে পেড়ে দে!”
পাজি বিশ্বাস তবুও যে কেন সুধীনবাবুর চাকরিটা খেলেন, তা ভগবানই জানেন! মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ।
শেষ-মেষ সুধীনবাবু ওঁর দূর সম্পর্কের এক উকিল-পিসেমশাইয়ের তদবিরে, আলিপুর কোর্টে পেয়াদার চাকরি পেলেন। কাজ গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে লোকজনকে আদালতের শমন ধরিয়ে দেওয়া। মহকুমা আদালতে ‘সুবিচার’ না মিললে গ্রামের লোকেও কলকাতায় মামলা ঠুকে দেয় বইকি। তবে সে মামলার প্রতিবাদী যদি দূর গাঁয়ের অধিবাসী হয়, তাকে শমন ধরাতে কেউ বড়-একটা যেতে চায় না। সুধীনবাবু পেটের দায়ে যান; তাই চাকরিটা তাঁর বজায় আছে।
তবে চাকরিটা সম্বন্ধে সুধীনবাবুর কোনো অভিযোগ নেই। শমন ধরাবার কোনো কোটা নেই; ধরাবার কোনো নির্ধারিত সময়সীমাও নেই। শমন ধরাবার নিয়ম হলো যে, যার জন্য শমন, তার হাতেই ধরাতে হবে। বাড়ির দাওয়ায় ফেলে আসা বা অন্য কারো হাতে দেওয়া চলবে না। সুধীনবাবু যদি বলেন যে প্রতিবাদী বাড়ি ছিল না, সেকথা সত্যি না মিথ্যে তা দেখবারও কেউ নেই। সময়ের যখন হিসেবে নেই, তখন কৌতূহলী মানুষের তো পোয়া বারো ! সুধীনবাবু নিজের হিসেব মতো কাজ করেন – পথে যা-ই তাঁর কৌতূহলী মনকে হাতছানি দেয়, উনি তার ডাকেই সাড়া দেন। কাজ যে করেন না তা নয়, তবে কৌতূহলকে বঞ্চিত করে নয়।
এমনি করেই দিব্বি দিন চলছিল। তারপর, হঠাৎ একদিন কাজ পড়লো নিশ্চিন্দপুর পেরিয়ে ঠগীরতলা গায়েঁ শমন পৌঁছে দেবার। বর্ধমান স্টেশনে নেমে আরো মাইল বিশেক বাসে গিয়ে নিশ্চিন্দপুর, তারপর ঝাড়া পাঁচ মাইলের হাঁটা পথ ঠগীরতলা। গায়েঁর নাম শুনে বহুদিনের পুরানো ঝানু পেয়াদা, পশ্চিমা রামভরোসে বললো, “থোড়া সামহালকে যাইবেন বাবু! হামি শুনিয়েছে, বড়ে বদমাশ ঠগী লোগোঁকে গাঁও আছে ওহ। ঠগী চিনেন তো? মুসাফির কো মার কর সামান লুট লেতে হ্যায়- সামান নহি রহনসে ভি কভি-কভি সির্ফ মজে লেনেকে বাস্তে মার দেতে হ্যায়! সাঁঝকে বাদ কভি না রহনা উখানে।”
সুধীনবাবুর ভেতরকার জ্ঞান-ভান্ডারটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। সুধীনবাবু ঠগী সম্বন্ধে অবশ্যই জানেন। এও জানেন যে শ্লীম্যান সাহেব ১৮৩৯ সালেই বাংলা থেকে ঠগী একেবারে নির্মূল করে ছেড়েছিলেন। মনে মনে ভাবলেন, ‘রামভরোসেটা কী অজ্ঞান লোক রে বাবা! তবে সাবধানের মার নেই, আমি বরং সকাল সকাল কাজ সেরে ফিরে আসবো।’
করলেনও তাই। হাওড়া থেকে ভোর ছটায় ট্রেন ধরে বর্ধমান। সেখান থেকে মেঠো রাস্তায় পৌনে ঘন্টা ঝরঝরে বাসে চড়ে, তারপর তিন ঘন্টা ধরে আলের রাস্তা ধরে হেঁটে, সাড়ে বারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেলেন ঠগীরতলা। প্রতিবাদী বেজন মল্লিকের বাড়ি খুঁজতে বিশেষ বেগ পেতেও হলোনা। তবে শমন হাতে পেয়ে বেজন মল্লিকের মুখের ভাব দেখে আর দাঁড়াতে সাহস করেন নি। কোনোমতে শমন হাতে গুঁজে দিয়েই উল্টোমুখো হলেন।
নিশ্চিন্দপুর থেকে বর্ধমানের বাস সন্ধে ছটায়। তিন ঘন্টার ফিরতি হাঁটা পথের জন্য প্রায় ডবল সময় হাতে। তবুও পা-চালিয়েই চললেন সুধীনবাবু। না, ঠগীর ভয়ে নয় – বেজন মল্লিক যদি তাড়া করে সেই ভয়ে। এই সমস্ত তেপান্তরের-পারের জায়গায় আদালতের পেয়াদার অন্য রকমের ভয় আছে বটে; খুন করে পুঁতে ফেললে প্রতিবাদী আর শমনকে ডরায় কেন? ‘কোন পেয়াদা? কিসের শমন? আমি তো কিছুই পাই নি!’
ঘন্টাখানেক হনহন করে হাঁটার পর সুধীনবাবু খানিকটা আস্বস্ত বোধ করলেন। বেজন মল্লিক পিছু নেয় নি; আশঙ্কা অমূলক। স্বস্তির নিঃশাস ফেলে তাঁর বরং রামভরোসের ওপর রাগ হতে লাগলো, অহেতুক ঠগী-ভয় দেখানোর জন্য। তবে রাগ করতে গিয়ে নিজেই নিজের ওপর হেসে ফেললেন – তিনিও তো এই একবিংশ শতাব্দীতে ঠগীর ভয়ে সেই কোন কাক-ভোরে বাড়ি ছেড়ে বার হয়েছেন!
আল-বরাবর পাঁচ মাইল পথে একটিমাত্র স্থান, যেখানে দুই ক্ষেতের মাঝে প্রায় আধ মাইল লম্বা একটি জলা। ক্ষেত নেই, তাই আলও নেই। জলার ধার দিয়ে সরু রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে সুধীনবাবু হঠাৎই অনুভব করলেন যে চারিদিক যেন ভীষণ গা-ছমছম নীরব হয়ে উঠেছে। মনে পড়ে গেলো যে ঠগীরতলা যাবার সময়ও এই জায়গাটিতে ঠিক এই রকমটাই মনে হয়েছিল। তখন তাড়া ছিল, তাই বিশেষ ভাববার সময় পান নি। ভাবলে তখনই খেয়াল করতে পারতেন যে বাকি পথে সর্বক্ষণ গাছের পাতার ভেতর দিয়ে, ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে, হালকা হাওয়া বইবার যে একটা আবছা, অস্পষ্ট মর্মরধ্বনি শোনা যায়, এখানে তা একেবারেই অনুপস্থিত।
ভর দুপুরেও সুধীনবাবুর গা-টা কেমন শিরশির করে উঠলো। সকালে, যাবার পথে, বড়জোর দু-তিনটি লোকের দেখা পেয়েছিলেন। হঠাৎই অনুধাবন করলেন যে ঠগীরতলা ছাড়ার পর থেকে একটি জনমনিষ্যিও চোখে পড়েনি। সুধীনবাবুর হৃদস্পন্দন ধাপে ধাপে দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগলো। মাথার ভেতর কে যেন বার বার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে লাগলো, “ঠিক দুপ্পুর বেলা – ভূতে মারে ঢেলা!”
আর বেশিক্ষন এভাবে চললে কি হতো তা বলা মুশকিল, কিন্তু আর দু-পা এগোতেই সুধীনবাবু যেন ধরে প্রাণ পেলেন। ঐতো, জলার ধারে একটি লোক! চেনা বা অচেনা, কাউকে দেখে সুধীনবাবু কোনোদিন এতো খুশি হয়েছেন কিনা মনে করতে পারলেন না। খুশির সঙ্গে সঙ্গে নিজের ওপর আবার রাগও হলো একটু – কেন মিথ্যে অমন ভয় পাচ্ছিলেন ! পরক্ষনেই অবশ্য সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়লো রামভরোসের উপর। হতভাগা খোট্টাটা খামোকা ভয় ধরিয়ে না দিয়ে থাকলে এমনটা কখনো হয় !
অন্য প্রয়োজন না থাকলেও, কেবল হৃদ্স্পন্দনটিকে কায়েদা করার অভিপ্রায়ে গলা খাঁকারি দিয়ে লোকটিকে আওয়াজ দিলেন সুধীনবাবু, “ও ভাই, শুনছেন?”
উত্তর পাওয়া গেল না। মায়, লোকটি যে ডাকটা শুনতে পেয়েছে, এমন কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া গেল না। ‘কালা নাকি রে বাবা !’ আরেকটু এগিয়ে গেলেন সুধীনবাবু। কী আশ্চর্য্য – এ যে গভীর মনোযোগ দিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে কি বলছে ! কী বলছে বুঝতে পারা না গেলেও এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে লোকটি যা বলছে তা এতোই নিবিষ্ট মনে বলছে, যে বেশ বাজখাঁই গরু-খোঁজা ধরণের ডাক না দিলে সাড়া পাওয়া অসম্ভব ! সুধীনবাবু এবার গলাটা কয়েক পর্দা চড়িয়ে হাঁক দিলেন:
– “ও মশাই, শুনছেন!”
– “বিড়বিড়, বিড়বিড়, বিড়বিড় …”
সুধীনবাবু এবার অপমানিত বোধ করতে শুরু করলেন । এতো জোরে ডাকলে শুনতে না পাওয়ার কথা নয়। তারপর, তাঁর মনে হলো, আচ্ছা, শুনতে না পাওয়াটা হয়তো শুধু তাঁকে অবজ্ঞা করার ব্যাপার নয় – ‘লোকটা যদি সত্যিই কালা হয়?’ কিন্তু সুধীনবাবু পড়েছেন, যে যারা জন্ম-কালা, তারা নাকি বোবাও হয়, কারণ, যে ভাষা তারা শুনতে পারে না, সে তারা বলতে শিখবে কী করে ! ‘তাহলে লোকটা কথা বলছে কি করে? আর ব্যাটা বলছেটাই বা কী?’ সুধীনবাবু কৌতুহলী হলেন। এগিয়ে গেলেন আরো দু পা ।
বিড়বিড়ানি এবার একটু স্পষ্ট হলো। সুধীনবাবু অবাক হয়ে শুনলেন যে লোকটি একাগ্রচিত্তে জলার জলের পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে চলেছে, “একুশ, একুশ, একুশ, একুশ, একুশ…”
‘পাগল নাকি রে বাবা?’
লম্বা, সিড়িঙে চেহারা, পরণে একটা শতছিন্ন খাটো মলিন ধুতি, একমুখ দাড়ি – আর চুলে যে কতদিন তেল-জল পড়েনি তার হিসাব নেই। বয়স পঞ্চাশ, না দুশো বছর, বোঝা দায়! ‘আর জলের দিকে তাকিয়ে একুশ-একুশ করে গুনছেটাই বা কী?’ সুধীনবাবু আরেকবার চেষ্টা করলেন। লোকটার প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন:
– “ও মশাই, একুশ একুশ করে কী গুনছেন – মাছ?”
– “একুশ, একুশ, একুশ, একুশ, একুশ…”
সুধীন বাঁড়ুজ্যের কৌতূহল আর বাঁধ মানলো না। লোকটির বিড়বিড়ানি অগ্রাহ্য করে নিজেই ঝুঁকে পড়লেন জলের কিনারায়।
বাতাসে ঝটিতি একটা তড়িৎগতি আন্দোলন। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন চোখের সামনে একহাত সাদা কাপড় বিদ্যুৎচমকের মতো ঝলসে উঠলো । পরমুহূর্তে অনুভব করলেন গলায় এঁটে বসেছে বজ্রফাঁস । পিছন থেকে, কোমরে হাঁটু গেড়ে দিয়ে কে যেন আসুরিক শক্তিতে টেনে ধরেছে গলায় পেঁচানো রুমালখানি ।
মট্ করে একটা শব্দ । তারপর নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।
ঝপাস !
জলার ধারের লোকটি তখনওজলের দিকে একাগ্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে নিবিষ্ট মনে বিড়বিড় করে বলে চলেছে, “বাইশ, বাইশ, বাইশ, বাইশ, বাইশ…
খুব ভালো লাগলো।