সাহিত্যিকা

সানতানার কড়চা – শান্তনু দে

সানতানার কড়চা
শান্তনু দে, ১৯৮৯ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

১. বি ই কলেজের হাতখরচা
টমাস হার্ডির, ‘জিউড দ্য অবসকিয়র’ বইয়ের নায়ক জিউড ফলি অক্সফোর্ডে গিয়ে পড়তে গিয়ে নিদারুণ অর্থকষ্টের সম্মুখীন হয়েছিল, অনেকটা আমাদের অপরাজিত’র অপু যেমন কলকাতায় পড়তে এসে অথৈ জলে পড়েছিল, সে রকম…বা তারও বেশী।

আমি যখন বি ই কলেজে ঢুকলাম আমার অবস্থা ঠিক অত করুণ না হলেও বেশ সঙ্গিন ছিল। থাকা, খাওয়ার প্রবলেম ছিল না, প্রবলেম ছিল হাত খরচের। আমার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী ছিলেন … আমার হাত খরচটাকে ভাবতেন মহার্ঘ্য ভাতা। তাছাড়া হাতে বেশী টাকা পয়সা পেলে ছেলে বখে যাবে সে ভাবনাটা তো ছিলোই। সেটা খুব একটা অমূলক নয়, কারন আমি ক্লাস এইটেই সিগারেট, টেনে বিয়ার ধরেছিলাম। বাড়িতে কেউ ঠিক জানতো না, তবে কিছুটা আঁচ করতে পারতো বোধ হয়।

যাই হোক ফার্স্ট ইয়ারে সপ্তাহে পেতাম পয়তিরিশ টাকা। বছরে বছরে মহার্ঘ্য ভাতার মতই বেড়ে বেড়ে ফোর্থ ইয়ারে পঁচাত্তর টাকা হয়েছিল। সেই সীমিত পুঁজিতে কি ভাবে চালানো যায়, দিনে এক প্যাকেট সিগারেট আর সপ্তাহে তিনটে সিনেমা দেখে, তার মধ্যে একটা অন্ততঃ এস্প্ল্যানেড-এ…এই কথা ভাবতে ভাবতেই কলেজ লাইফটাই শেষ হয়ে গেল।

দু একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তার মধ্যে একটা হলো, বই খাতার পিছনে অযথা পয়সা নষ্ট করবো না। চার বছরে কোনো বই কিনবো না, কিনিও নি, এমন কি ক্যালকুলেটর, ড্রইং বোর্ডও কিনি নি।…একদম শেষে মানে কলেজ জীবনের গোধূলি লগ্নে, ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার আগে, কোনো একটা কুইজে জিতে কিছু প্রাইজ মানি পেয়ে, দুটো গাবদা বই কিনেছিলাম। জানাদার দোকান (আমাদের কলেজের বুক স্টোর) থেকেই কিনেছিলাম…জানাদা গুনগুন করে গান গাইছিল, “কত যে দিন বসেছিলাম পথ চেয়ে আর দিন গুনে,দেখা পেলাম ফাল্গুনে।”

সেই বইদুটো অনেকদিন শো কেসে সাজানো ছিল, তারপর আমারই কোনো কলিগ পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয় নি। স্টীল প্ল্যান্টে চাকরি করতে গিয়ে, মেটালার্জির বই কী কাজে লাগতে পারে সেটা এখনো ভেবে পাই নি। বই না কিনলেও বাড়ি থেকে বই-এর জন্য টাকা তো নিতাম। সেটাই সারা বছর একটু একটু করে ভাঙিয়ে খেয়েছি। যারা আমার খুবই নিম্নমানের মনোবৃত্তির কথা ভেবে আমাকে মনে মনে তিরস্কার করছেন, তাদের জানিয়ে রাখি বি ই কলেজের প্রাচীন অরণ্য প্রবাদানুসারে আমাদের এক সিনিয়র, লগ টেবিল কেনার জন্য বাড়ি থেকে অনেক টাকা জোগাড় করে বোম্বে আর গোয়া ঘুরতে গেছিল। বাড়িতে বলেছিল,লগ টেবিল মানে কাঠের বড় টেবিল।

আর একটা যুগান্তকারী ডিসিশ ছিলো যে, কোনদিন বিড়ি না কেনা। চাইলে সিগারেট কেউ দিত না,কিন্তু নিতান্তই অমানুষ টাইপের হাড় কেপ্পন না হলে, বিড়ি দিতে কাউকে কার্পণ্য করতে দেখি নি।

সিনেমা দেখতাম বেশির ভাগ নিউ এম্পায়ার-র চারতলার ব্যালকনিতে। একটাকা থেকে শুরু হয়ে,বেড়ে বুরে সেটা বোধ হয় দেড় টাকা অবধি হয়েছিল। অতিরিক্ত বেনিফিট ছিল, সিগারেট খেতে খেতে সিনেমা দেখতে পারার সুযোগ। সেই একই সময় গ্লোব, লাইট হাউজ, যমুনা এই সব হলে ফ্রন্ট স্টল ছিল চার টাকা। খেতাম নিজামের বিফ রোল বা লাইট হাউজ থেকে গ্লোব যেতে গেলে রাস্তাটা টার্ন নিলে যে চানা বাটুরার দোকান আছে সেটায়। যমুনার সামনেও একটা দোকানে ভাল বিফ রোল বানাতো।

প্রেম করা বেশ খরচাপাতির ব্যাপার ছিল, তাই ওই পথে ভুলেও পা বাড়াই নি। তবে আমার মত পাগল-ছাগলের সাথে কেই বা ওই সব করবে।

যাই হোক এই ভাবে প্রবল আর্থিক কষ্টে চার বছর কাটিয়ে, বি ই কলেজ লাইফ শেষ হয়েছিল।

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আরেকটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিলো, সেটা অবশ্য বন্ধুদের পরামর্শে। সেই কঠোর জীবনের প্রবল আর্থিক কষ্টের চাপ নিতে না পেরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই অনেকগুলো দিন পরম শান্তিতে কেটে গেলো।

২. লক ডাউনে পল্টুবাবু
পল্টুবাবুরা চার পুরুষের মাতাল।
চার পুরুষটা ঠিক নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না,তার বেশীও হতে পারে কিন্তু কম নয়। তবে পল্টুবাবুর প্রপিতামহ দারুকেশ্বরবাবু বরিশালের জমিদারি বিক্রি করে সেই টাকায় উৎকৃষ্ট আইরিশ জেমসন হুইস্কি ও শ্যাম্পেন কিনে সেলারে ভরেছিলেন। বঙ্গদেশে প্রথম সেলার উনিই বানিয়েছিলেন। এসব ঐতিহাসিক তথ্য অবশ্য আপনি ইতিহাসে পাবেন না। আরো অনেক প্রবাদপ্রতিম বাঙালির মত দারুকেশ্বরবাবুর নামও আত্মবিস্মৃত বাঙালি ভুলে গেছে।

গেছে কী! না,যায় নি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ চিরকুমার সভায়,খোদ দারুকেশ্বরবাবুর গলায় গান বসিয়েছেন…
“কতকাল রবে বলো ভারত রে
শুধু ডাল ভাত জল পথ্য করে।” বা
“দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন,
ধরো হুইস্কি সোডা আর মুর্গি-মটন।”
দারুবাবু (বার বার দারুকেশ্বর লিখে লিখে আঙুলে ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। তাই এবার থেকে দারুবাবুই লিখবো) মাতাল হলেও বেশ হিসেবি ও দূরদর্শী লোক ছিলেন। শোনা যায়,’জাতে মাতাল,তালে ঠিক’ প্রবাদ বাক্যটি ওঁকে নিয়েই বানানো। তা উনি অনেক মাথা খাটিয়ে বুদ্ধিবিবেচনা করে হিসেব করে দেখেছিলেন, যা মদের স্টক আছে তাতে ওঁনার তিন পুরুষ হেসে খেলে খেতে পারবেন।

তবে এ ক্ষেত্রে ওঁনার হিসেবে একটু ভুল হয়েছিল। দারুবাবুর ছেলে সোমকান্তিবাবুর পান করার ক্ষমতা সম্বন্ধে ওঁনার কোনও ধারনাই ছিল না। তাই মাত্র দুই পুরুষেই সেই সেলার খালি হয়ে গেলো। ফলস্বরূপ সোমকান্তিবাবুর ছেলে, জনিকুমারবাবুকে বাড়ির বাইরে অভিজাত বারে গিয়েই মদ খেতে হত। সকালে পাড়ার বন্ধুদের সাথে ওলি পাব আর সন্ধ্যেবেলা স্কুলের বন্ধুদের সাথে ট্রিনকাস। শোনা যায় কেজরিওয়াল দিল্লিতে যে অড-ইভেন ফর্মুলা লাগিয়েছিলেন, তার বেসিক আইডিয়াটা উনি জনিকুমারবাবুর থেকেই পান। আরও একটা ট্রিভিয়া এখানে দিয়ে দিই, অমিতাভ বচ্চনের শরাবি গল্পের স্ক্রিপ্ট নাকি প্রকাশ মেহরা জনিবাবুর থেকেই পান, মানে বেসিক আইডিয়াটা আর কী।

যাই হোক, এ হেন গ্লোরিয়াস উত্তরধিকার পল্টুবাবুও বেশ কিছুটা ধরে রেখেছেন। তবে পূর্বপুরুষদের মত, আইরিশ, স্কচ বা বার্বন হুইস্কি উনি এফোর্ড করতে পারেন না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উনি রোজ সন্ধ্যেবেলা (বা কখনো কখনো দিনের বেলা) গড়িয়ার এক প্রায়ান্ধকার বারে বসে ব্লেন্ডার্স প্রাইড খান।

তা একদিন এই পল্টুবাবুর কিডনিতে স্টোন ধরা পড়লো।
ডাক্তারবাবু সব দেখে অভিমত দিলেন, “পালং শাক একদম বন্ধ। আর প্রত্যেক দু ঘন্টা পরপর এক গ্লাস জল খাবেন।”
পল্টুবাবু অবাক। “জল খাবো!! জল খাবো আমি!!আপনি জানেন আমি কে? আমার চার পুরুষে কেউ জল খায় নি। শুধু জল খেলে আমার পূর্বপুরুষরা আমায় ক্ষমা করবেন ভেবেছেন! ডাক্তারবাবু আপনি, জলটা চেঞ্জ করে বিয়ার করে দিন আর আইস কিউব করে দিন। আর প্রেসক্রিপশনেও লিখে দিন। লক ডাউনের মার্কেটে বাড়িতে বসেই মাল খেতে হচ্ছে, বউ বহুত হজ্জুত করছে স্যার। এবার থেকে দিনের বেলা ঘন্টায় ঘন্টায় বিয়ার আর সন্ধ্যে বেলা আইস কিউব দিয়ে ব্লেন্ডার্স প্রাইড। বউ যদি কিছু বলে, তাহলে আপনার প্রেসক্রিপশনটাই দেখিয়ে দেবো।”

৩. বোরোলিনের সংসার
অনেক অনেক দিন আগে রিগলি সাহেব তো শিকাগোয় এক কাপড় কাচার সাবানের দোকান খুলে বসলেন। তা সে সাবান আর বিক্রি হয় না। তা উনি ঠিক করলেন সাবান কিনলে, বেকিং সোডা ফ্রি। কিন্তু দেখা গেল বেকিং সোডার ডিম্যান্ডটাই বেশী। তখন সাবানের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে উনি শুরু করলেন, বেকিং সোডার ব্যবসা।

কিছুদিন পরে আবার ব্যবসায় মন্দা এলে উনি বেকিং সোডার সাথে চিউইং গাম ফ্রি দিতে শুরু করলেন। ব্যাস!! সেই চিউইং গাম একদম সুপার হিট। বাকিটা যাকে বলে ইতিহাস।

তা বাংলায় কি কেউ কোনদিন কিছু ফ্রিতে দেয় নি? গৌর মোহন দত্ত, জি ডি ফার্মার প্রতিষ্ঠাতা, চ্যাম্পিয়ন শুটার সোমা দত্তের দাদু,শোনা যায় ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার খুশিতে এক লক্ষ বোরোলিনের টিউব ফ্রিতে বিলিয়ে দেন। বাকিটা ইতিহাস। এত ভালো মার্কেটিং স্ট্রাটেজি বাংলায় বিরল। বোরোলিন বাংলা বিজ্ঞাপনের জগতে যাকে বলে কিংবদন্তি। সে শ্রাবন্তী মজুমদারের বোরোলিনের সংসার বা অতীব ক্যাচি jingle…’সুরভিত এন্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন’ থেকে শুরু করে ঋতুপর্ণের ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ‘ বা ‘জীবনের ওঠা পড়া যেন গায়ে না লাগে’… একের পর এক ইতিহাস তৈরী করে দিয়েছে। কিন্তু বেসিক ব্যাপার হলো, এটি অতি জঘন্য, দুর্গন্ধময় প্রোডাক্ট। কিন্তু মার্কেটিং এর জোরে উৎরে গেলো।

সত্যি বলতে কি, ছোটবেলায় ওই জোড়া-হাতির লোগোওয়ালা ক্যাটক্যাটে সবুজ টিউবটার উপর আমার হেভি রাগ ছিল। শীতকালে খেলতে যাওয়ার আগে মা, প্রায় দুই মিলিমিটার পুরু, চ্যাটচ্যাটে বোরোলিন মাখিয়ে পাঠাতেন। আর খেলতে গিয়ে মাঠের যত ধুলো ওই বোরোলিনে চিপকে গিয়ে যাচ্ছেতাই ব্যাপার। বাড়ি ফিরে মুখ ধুয়ে আবার এক প্রস্থ বোরোলিন।

তবে বোরোলিনের বিভিন্ন অন্যরকম ব্যবহারও ছিল। ডাক্ট টেপ নাকি এত বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা যায় তাই নিয়ে দুই সাহেব সাত ভলিউম বই লিখেছেন। তার মধ্যে একটা হলো Apollo 13 মিশনে যখন কার্বন ডাই অক্সাইড কনভার্টার বলে একটা যন্ত্র খারাপ হয়ে যায়, তখন নাকি ডাক্ট টেপ দিয়েই ম্যানেজ করা হয়, আর তিন মহাকাশচারী বেঁচে বর্তে বাড়ি ফেরেন। তা এই বোরোলিন হচ্ছে বাংলার ডাক্ট টেপ।

আমি দু চারটে দেখেছি … মেয়েদের কপালের টিপের আঠা কমে গেলে একটু বোরোলিন লাগিয়ে টুক করে পরে নাও, সাইকেলে ছোট পাংচার হলে একটু বোরোলিন লাগিয়ে শুকিয়ে নাও, দু একদিন দিব্যি চলে যাবে, সাইকেলের চেন লুব্রিকেশন নেই বলে ঘরঘর শব্দ করছে ? একটু বোরোলিন লাগিয়ে,প্যাডেল হালকা হালকা ঘোরাও, ফুটবল জলে ভিজে তারপর রোদে শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে? একটু বোরোলিন মাখিয়ে নাও, বলের চামড়া একদম মাখনের মত নরম হয়ে যাবে। সে দিন প্ল্যান্টে একটা গিয়ার বক্স জ্যাম হয়ে গেছে। মেক্যানিকালের ছোকরা তেল টেল দিয়ে অনেক ট্রাই করছে…কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আমি বললাম, একটু বোরোলিন দিয়ে দেখ, ঠিক হয়ে যাবে। ছেলেটা পাশের দোকান থেকে সত্যি সত্যি দু তিনটে টিউব কিনে গিয়ার বক্সে লাগালো..
…………. বাকিটা ইতিহাস।

৪. স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কার ও কুমার গন্ধর্ব
কুমার গন্ধর্বের নাম তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু কুমার গন্ধর্বের কিংবদন্তি হয়ে পিছনে যাদের নাম স্মরণ করতে হয় তাদের মধ্যে একজন আলবার্ট স্কাটজ নামের এক আমেরিকান চাষীর ছেলে।

আলবার্ট ইসরায়েল স্কাটজ 1942 সালে Rutgers University থেকে সয়েল সাইন্স নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাস করে ওখানেই স্বনামধন্য প্রফেসর সেলম্যান ওয়াকসম্যানের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেন।

এর কয়েক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা জড়িয়ে পড়লো। আলবার্ট যুদ্ধে গেলেন, কিন্তু পিঠের ব্যাথায় কাবু হয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলেন। এসেই আবার গবেষণায় যোগ দিলেন। সেই সময় মার্ক কোম্পানি বিশ্ববিদ্যালয়কে অফার দিল, টিবির জন্য এন্টিবায়োটিক বের করতে হবে। যে সময়ের কথা হচ্ছে, সেই সময় টি বি একটা মারণ রোগ …প্রতি বছর, সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। এর ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে কাজ করাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। প্রফেসর সেলম্যান ওয়াকসম্যান মার্ক কোম্পানির প্রস্তাব পত্রপাঠ না করে দিলেন। কিন্তু আলবার্ট স্কাটজ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও রাজি হয়ে গেলেন।

সেই সময় এলিজাবেথ বুগি নামের আর এক ছাত্রী সেই রিসার্চে যোগ দিয়েছিলেন। সাফল্য এলো বছর খানেকের মধ্যে। স্ট্রেপটোমাইসিন অবিষ্কার হলো আর যক্ষা ও প্লেগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিল। কিন্ত পেটেন্ট নেওয়ার সময় বুগির নাম বাদ পড়লো। তাকে বলা হলো, “বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করো, পেটেন্ট নিয়ে কি করবে? ”

প্রফেসর সেলম্যান ওয়াকসম্যান তখন আলবার্টকে বোঝালেন, “চলো ভাই পেটেন্টটা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করি। আমিও দিয়েছি।” কিন্তু আলবার্ট রাজি নয়। প্রফেসর ওয়াকসম্যান তখন আলবার্টকে ভয় দেখালেন যে ভবিষ্যতে চাকরি বাকরি হবে না। নিমরাজি হয়ে শেষ পর্যন্ত আলবার্ট রাজি হলেন।

পরে জানা গেল, সেলম্যান 20 পার্সেন্ট রয়ালটি নিজের জন্য রেখেছেন। পরে অনেক মামলা মকদ্দমা হওয়ার পরে আলবার্ট স্কাটজ 2 পার্সেন্ট ও এলিজাবেথ বুগি 0.2 পার্সেন্ট রয়্যালটি পান। কিন্তু বছর দশেক পরে স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কারের জন্য নোবেল প্রাইজ পেলেন সেলম্যান ওয়াকসম্যান। আলবার্ট স্কাটজ ও এলিজাবেথ বুগি বাদ। এদিকে ততদিনে ট্রাবল মেকার হিসেবে আলবার্টের প্রচুর বদনাম হয়ে গেছে। সারা জীবন সে রকম ভাল কিছুই করতে পারেন নি। যাই হোক,আবিষ্কারের ইতিহাস এরকম হাজার হাজার বঞ্চনার ইতিহাসে ভরা।

এদিকে দেখি ভারতে তখন কি হচ্ছে !
শিভাপুত্রা সিদ্ধারামাইয়া কমকালিনাথ কর্ণাটকের বেলগাঁওয়ের কাছে ১৯২৪ সালে জন্ম গ্রহন করেন। বাবা ছিলেন মারাঠি নাট্য-সঙ্গীতের প্রাণপুরুষ বাল গন্ধর্বের খুব বড় ফ্যান। পাঁচ বছর বয়সের আগেই বোঝা গেল, শিভাপুত্রা একজন মিউজিক প্রডিজি। বছর দশেক বয়সে উনি স্টেজে গান গাওয়া শুরু করলেন। নাম নিলেন কুমার গন্ধর্ব। বাবা পাঠিয়ে দিলেন তখনকার দিনের বিখ্যাত মিউজিক টিচার বি আর দেওধরের কাছে। কুড়ি বছর বয়স হওয়ার আগেই উনি রীতিমত স্টার, এমনকি দেওধরের স্কুলে ক্লাসও নিচ্ছেন।

বছর কুড়ি পরে, যখন তিনি খ্যাতির মধ্য গগনে, কুমারের যক্ষা ধরা পড়লো। চলে গেলেন অপেক্ষাকৃত শুকনো জায়গা মধ্যপ্রদেশের দেওয়াস-এ। গান গাওয়া একদম বারণ আর বাঁচার আশাও প্রায় নেই। কুমার গন্ধর্ব বিছানায় শুয়ে স্তব্ধতার গান শোনেন…ঝরা পাতার শব্দ,পাখির গান, ভ্রাম্যমান গায়ক ভিখারির গান শোনেন। নিজে গুনগুন করে গান করেন কিন্ত সেটা মাথার মধ্যেই থাকে।

বছর ছয়েক পরে যক্ষা রোগের প্রথম ঠিকঠাক ওষুধ স্ট্রেপটোমাইসিন ভারতে আসে। স্ত্রী ভানুমতীর সেবাশুশ্রূষায় ও স্ট্রেপটোমাইসিনের গুনে কুমার গন্ধর্ব ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। যদিও একটা লাংস পুরো অকেজো, কিন্তু আবার গান গাওয়া শুরু করলেন। গানের ধরণও বদল হয়ে যায় …লোকগীতির প্রভাব পরে গানের স্টাইলে।

শুরু হলো কুমার গন্ধর্বের সেকেন্ড ইনিংস, যা প্রথম ইনিংস এর থেকে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক, তাঁর অনবদ্য স্টাইলের জন্য।

Sahityika Admin

Add comment