সাহিত্যিকা

ডাইরীর ছেঁড়া পাতা, থাইল্যান্ডের ক্যারাওকে – ময়ূখ দত্ত

ডাইরীর ছেঁড়া পাতা – থাইল্যান্ডের ক্যারাওকে…
ময়ূখ দত্ত, ১৯৯০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

এই দেশটাতে ক্যারাওকে গানের খুব চল আছে (ব্যাকগ্রাউন্ডের রেকর্ডেড ইন্সট্রুমেন্ট ট্র‍্যাক বাজিয়ে নিজের গলায় গান গাওয়া)।

জাপানে তৈরী হওয়া এই বিনোদনের বয়স খুব বেশী বছরের হয়ত নয় (সাতের দশকে), কিন্তু শুধু এই দেশটাতে নয়, আশেপাশের সবকটা দেশেই, (মানে জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া..) এই ক্যারাওকে সংস্কৃতিটা সমাজের সর্ব স্তরেই আছে খুব জনপ্রিয় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে।

তবে এই বিনোদনের মধ্যেও আবার রকমফের আছে!! পয়সাওয়ালা মানুষদের জন্য বা ট্যুরিস্টদের জন্য অনেক “ক্যারাওকে বার” আছে, যেখানে অন্য যে কোনো আধুনিক শহরের মত গান-বাজনা ছাড়াও পানীয় ইত্যাদির ঢালাও ব্যাবস্থা থাকে, সুন্দরী, স্বল্পবসনা ‘ওয়েট্রেস’ রা আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে…এটা নতুন কিছু নয়!! যেটা থাইল্যান্ডে আমাকে একটু অবাক করল সেটা হল থাইল্যান্ডে সাধারন সরকারী আউটডোর পার্কেও প্রতি সন্ধ্যেবেলা একদল মানুষ স্পীকার, মাইক্রোফোন ইত্যাদি নিয়ে এসে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে নিজেরাই ক্যারাওকে ট্রাক বাজিয়ে গানবাজনা করছে…. অধিকাংশই অত্যন্ত বেসুরো, তালের কোনো হয়ত ঠিক নেই, ক্যারোওকের বাজনা যদি কাশ্মীরের দিকে তো গায়কের গান হয়ত কন্যাকুমারীর দিকে চলছে, কিন্তু তাতে কারুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই!!

বেশীরভাগই বয়স্ক/ মধ্যবয়সী মানুষ!! কেউ কেউ আবার হাতে লাঠি ধরে হাঁটাহাঁটি করছেন…কিছু কিছু মানুষ আবার নিজেরাই জুটি বেঁধে বেসুরো গানে নিজেরাই ছন্দ খুঁজে নিয়ে নাচছেন বা বলা ভাল, হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টা করছেন!! অনেকে তো বাড়ি থেকে টিফিনবক্স ভরে খাবার নিয়ে এসে সেই বেসুরো গান শুনতে শুনতে পার্কের বেঞ্চে বসে নিজের মনে তাল ঠুকতে ঠুকতে সংগীর সাথে ডিনার করছে। ওদের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সময়েই ওই বেসুরো, অসহ্য গানের গুঁতোর থেকে এড়াতে আমি কানে গুঁজে দিই আমার ইয়ারবাড!!

এভাবেই চলছিল, একদিন হঠাত শুনতে পেলাম এক সুরেলা গলা, কি মনে হতে আমিও সেদিন বসে পড়লাম পার্কের একটা বেঞ্চে…. সাধারনত এখানকার স্থানীয় মানুষ ছাড়া কেউ এই পার্ক ক্যারাওকে গান মন দিয়ে শোনে না, তাই হয়ত আমাকে বেঞ্চে বসে গান শুনতে দেখে পাশে এক মধ্যবয়সী থাই ভদ্রলোক একটু যেচেই আলাপ করতে এলেন…তারপরে আমার থাই ভাষাতে কথাবার্তা চালানোর অক্ষমতা আর ওনার ইংরেজির সীমাবদ্ধতাতে অনেককিছু বোঝা বা জানার ইচ্ছে থাকলেও বেশীক্ষন কথাবার্তা চালানো গেল না… আধা ইংরেজী, আধা আভাসে ইংগিতে এটুকুই শুধু বুঝলাম – জীবনের হাজার প্রতিবন্ধকতার মাঝে এই মানুষগুলো অনেক দূর দূর থেকে বিকেলবেলা এই পার্কে ছুটে আসে আরো কিছু সমমনষ্ক মানুষের সাথে নিজেদের সুখ-দুঃখের কিছু কথা শেয়ার করার জন্য, কিছু সহমর্মিতার জন্য!! কিছুটা সময় অন্যভাবে কাটানোর জন্য… ক্যারাওকে গান তো একটা বাহানা মাত্র!!

এই যে দু-তিন ঘন্টার বেসুরো গান, অক্ষম, বেতালা নাচ – এসবই ওদের এই শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুক্ষনের জন্যে হলেও হয়ত জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে… চরৈবতি… আরও একটা কথা মনে এল- জীবনের সুর, তাল মেলানোর জন্য বাইরের দুনিয়া কি সুরে গাইছে, গানের স্কেল কি, কার কি যায় আসে? সেটা কি খুব দরকারী? অতি সাধারন ছন্দের দলবদ্ধ সাঁওতালি নাচকে কি কোনোদিন আমরা ব্যালে, জ্যাজ বা আমাদের নিজেদের কত্থক, ভারতনাট্যমের সাথে তুলনা করতে পেরেছি? অতি সাধারন কথায়, খুব বেশী হলে হয়ত “আদিবাসী নৃত্য” ক্যাটাগরিতে ফেলে রেখেছি!! কিন্তু, সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে মহূয়ায় মাতোয়ারা ধামসার ড্রিম ডিমাডিম গম্ভীর আওয়াজের সাথে সেই নাচ দেখতে দেখতে আমার মত অনেক বেতালা, বেসুরো মানুষজনও প্রতিসময়েই হয়ত পা নাচাতে আরম্ভ করি, নিজের অজান্তেই জীবন উদযাপন করি, উদযাপন করি প্রতিটি শ্বাস নেওয়ার সবথেকে দামী মুহূর্ত টা, সেই সাফল্যটা…!!

শিল্প, সাহিত্য, গান-বাজনার মূল উদ্দেশ্য যদি মানুষের মনকে ছুঁতে চাওয়া হয়, যদি দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে ভুলে কিছুটা সময় আনন্দ করে কাটানো হয়, সমাজের ভ্যালু সিস্টেমকে জানা-বোঝা-জানানো হয়, নিজেকে সেই সমাজে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে থাইল্যান্ড পার্কের এই বেসুরো, বেতালা গানও হয়ত উদ্দেশ্য সাধনে করে চলেছে প্রতিদিন…

ক্যারাওকের বেসুরো গান শুনতে শুনতে আমার কাছে কোথাও যেন ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, মুরগুমা, থাইল্যান্ড মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়!!

– ময়ূখ /২০২৩

Sahityika Admin

Add comment