সাহিত্যিকা

চেনা অচেনা – রমা জোয়ারদার

চেনা অচেনা
রমা জোয়ারদার, প্রবীর জোয়ারদারের স্ত্রী (৬৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং)

চার বছর বাদে আবার দিল্লি বিমানবন্দরে এসে নামল শালিনী। অ্যারাইভাল্‌ লাউঞ্জে ঢুকতেই সেই চেনা দৃশ্য, চেনা গন্ধ – হঠাৎ-ই ওর বুকের মধ্যে একটা কান্নার ঢেউ ছলাৎ করে উঠল। কিন্তু কান্নাটাকে ও চোখ পর্যন্ত আসতে দিল না। এধার ওধার চোখ ঘুরিয়ে ও মনটাকে অন্যদিকে সরাবার চেষ্টা করছিল। আশ-পাশে তাকিয়ে ওর নজরে পড়ল যে এখানে সবকিছুতেই বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসে গেছে! লাগেজ্‌ বে’ থেকে বেড়িয়ে আসতেই সে দূরে পী্যুষ আর তটিনীকে দেখতে পেল। ওদের দুজনের চোখও উদ্‌গ্রীব হয়ে শালিনীকেই খুঁজছিল। দেখা হতেই পীযুষ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই যেন মেয়েকে দেখার মূহূর্তে সে স্ত্রী শ্রীলার অভাবটা বড় বেশী করে অনুভব করল। শালিনীর হাত থেকে ট্রলিটা টেনে নিয়ে বোনকে একটু আদর করেই তটিনী বলল – ‘কিরে? চার বছরে একটুও পাল্টাস্‌নি! সেই একই রকম রোগা টিং-টিঙে আছিস!’
– ‘তুইও তো একই রকম আছিস দিদি-ভাই !’ হাসিতে মুখ ভরিয়ে শালিনী বলল।
– ‘কি যে বলিস্‌, এই দেখ, অনেক মোটা হয়ে গিয়েছি।’
– ‘অনেক নয়, একটু। দেখতে ভালই লাগছে, একটা বাচ্চার মা বলে একেবারেই মনে হচ্ছে না। কুট্টুস্‌কে কোথায় রেখে এলি?’
– ‘বাড়িতে রে, উদয়ের কাছে। এখন নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে দেখাশোনা করার জন্য একজন বয়ষ্কা মহিলাও আছে।’
ট্রলি ঠেলে নিয়ে কথা বলতে বলতেই ওরা গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল। মালপত্র গাড়িতে ওঠানোর পর শালিনী বলল – ‘কাল সকালে কুট্টুস্‌ কে নিয়ে আসবি তো? উঃ ! আমার আর ধৈর্য থাকছেনা। মনে হচ্ছে এখনই ওটাকে ধরে খুব চট্‌কাই !’

মাঝ রাতের ফ্লাইট্‌, কিন্তু এয়ারপোর্টে লোকের ভীড় আর কর্ম ব্যস্ততা দেখলে মনে হয়, যেন সবে সন্ধ্যে। কিন্তু ওই এলাকাটা পেরিয়ে গেলেই মোটামুটি সবই ফাঁকা রাস্তা। মোটামুটি – কারণ দিল্লির রাস্তায় প্রায় সারারাতই গাড়ি চলে। সেই রাস্তার দিকে চোখ রেখে শালিনী বলে – ‘সবই যেন কেমন অন্য রকম লাগছে। অনেক কিছুই পালটে গেছে।’
– ‘হ্যাঁ, তা’তো পাল্টেছেই! দেখছিস্‌, রাস্তা কত চওড়া হয়েছে, কত ফ্লাই-ওভার হয়েছে; এয়ারপোর্টটাও তো কতটা রেনোভেট করেছে!’ গাড়ি চালাতে চালাতেই পীযূষ বলল।
– ‘দিল্লি কত ঝক্‌ ঝকে হয়ে গেছে, তাই না ? তোর ভাল লাগছে শালু?’ তটিনী খুশি খুশি চোখে বলে ওঠে।
– ‘তা লাগছে। কিন্তু …’ বলতে গিয়েও কেমন থমকে যায় শালিনী।
– ‘কিন্তু কী ?’
– ‘কিন্তু আমার চেনা সেই আগের দিল্লিকে ঠিক খুঁজে পাচ্ছিনা !’

বাড়িতে ঢুকেও শালিনীর এই কথাটাই বড় বেশী করে মনে হল – অনেক কিছুই পাল্টে গেছে! চার বছর আগে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ও যখন ছুটে-মুটে দিল্লিতে এসেছিল, তখন বাড়িময় মায়ের সব জিনিষ-পত্র ছড়ানো ছিল। মনে হচ্ছিল – মা যেন কোথাও গেছে, এক্ষুনি আবার ফিরে আসবে। ড্রেসিং টেবিলে সিঁদুর কৌটো, মোটা দাঁড়ার চিরুণী, ছোট্ট ঠাকুরঘরে প্রদীপ, ধূপ্‌কাঠি, গোপাল ঠাকুরের খাবার থালা-গেলাস্‌, শোবার ঘরের টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখা দেশ আর ফেমিনার ছোট্ট একটা স্তুপ, দেরাজে মায়ের সেলাই-এর সরঞ্জাম – ছোট খাট আরো এমন কত কিছু, শুধু মায়ের জন্যই যেগুলো ছিল, কোনটাই আর এখন নেই !

পরদিন তটিনী ছুটি নিয়েছিল – অফিসে গেল না! ঘুম থেকে উঠে সকাল বেলাতেই সে বাড়িতে গিয়ে কুট্টুস্‌কে নিয়ে আবার বাপের বাড়ি ফিরে এল। কুট্টুসের থুপ্‌ থুপে দৌড় আর আধো-আধো কথার সাথে সাথে ঘরের মধ্যে এক ঝলক্‌ খুশির হাওয়া, আর বাচ্চাটাকে নিয়ে শালিনী একেবারে মেতে উঠল! সন্ধ্যে বেলা একটু দেরীতে উদয় আসায় আড্ডাটা জমে ওঠার সময় পেল না। ন’টা না বাজতেই তটিনী বলল –‘আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড় শালু, তোর উপর যা ধকল গেছে!’

ওরা চলে যাবার পরে ঘরে শুধু পীযূষ আর শালিনী! শালিনী এসে ওর বাবার কাছ ঘেঁসে বসল। মেয়ের মাথায় ডান হাতটা রেখে পীযূষ স্নেহের স্বরে জিজ্ঞাসা করে – ‘কি রে, কিছু বলবি ?’
শালিনী ধীরে মাথা নাড়ে, হেসে বলে – ‘না, এমনিই। তোমার কাছে বসতে ইচ্ছা করল। তুমি কি এখনই ঘুমোবে?’
– ‘না না, আমি সাড়ে দশটা-এগারোটার আগে শুই না।’
– ‘কি কর অতক্ষণ ?’
– ‘টিভি দেখি, বই পড়ি …’
– ‘তোমার বইগুলো আমিও পড়ব। তারপর সেগুলো নিয়ে তোমার সঙ্গে ছেলেবেলার মত তেড়ে তর্ক করব।’ কথা বলতে বলতে বাবা আর মেয়ে একই সঙ্গে জোরে হেসে উঠল।

জেট্‌ ল্যাগ্‌ কাটাতে আর নতুন রুটিনে অভ্যস্থ হতেই শালিনীর তিন-চারটে দিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে কুট্টুসের সাথে ওর ভীষণ ভাব হয়ে গেছে। তটিনীর বাড়িটাও খুবই কাছে – হেঁটেই যাওয়া-আসা করা যায়। বার দুয়েক সেখানে একলাই গেছে শালিনী। কিন্তু এর বেশী একলা ঘোরাফেরা করতে ওর এখন অসুবিধাই হচ্ছিল। রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট সব কিছুই যেন পাল্টে গেছে। ভাবতে অদ্ভুত লাগছিল – দিল্লি তার নিজের জায়গা, এখানেই তার বড় হওয়া, এখানেই তার পড়াশোনা – অথচ এখন সেই দিল্লিতেই তার একলা ঘুরে বেড়াতে অসুবিধা হচ্ছে!

বন্ধুরা অনেকেই বিয়ে করে অথবা চাকরি নিয়ে নানা জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। দুজনের সাথে ফোনে কথা হল – যে যার কাজ-কর্ম, ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। একদিন তটিনীর সাথে সে আলো ঝল্‌মল্‌ মলে শপিং-এ গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ভাবছিল – আমেরিকা আর দিল্লির লাইফ্‌ স্টাইলে এখন আর আগের মতন সেই বিরাট পার্থক্যটাই নেই! অনেকটাই যেন একই রকম! দু-বোনে কেনা কাটা যত না করল, তার থেকে অনেক বেশী ঘুরেই বেড়াল। তারপর একটা সিনেমা। তারপর মলের ফুড্‌ কোর্টে চাট্‌ আর কফি খেয়ে খুশীতে একেবারে উচ্ছল হয়ে উঠল। বাড়ি ফেরার পথে তটিনী বলল – ‘এবার বিয়েটা করে নে শালু! জয়ন্তকে আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবি?’
একটু সময় চুপ করে থেকে তটিনী বলল – ‘জয়ন্তের সাথে বিয়েটা হবে না রে দিদিভাই ! …’
– ‘সে কিরে ? কেন ? – তটিনী প্রায় আঁত্‌কে উঠল। – এত কালের সম্পর্ক ! হঠাৎ কি হল ?’
– ‘হঠাৎ নয়, একটু একটু করেই হয়েছে। কিন্তু এখন থাক, পরে বাড়ি গিয়ে সব বলব। বাবাকেও তো সব জানাতে হবে !’

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ওরা তিনজনই ড্রইংরুমে বসেছিল। উদয়কে ফোন করে তটিনী জানিয়ে দিয়েছিল যে সে রাতে বাড়ি ফিরবেনা, বাবার কাছেই থেকে যাবে। একটু কিন্তু কিন্তু কোরে শালিনী বলল – ‘বাবা, একটা কথা ছিল।’
– ‘কি কথা, মা ?’
– ‘কথাটা জয়ন্তর ব্যাপারে।’
নড়ে চড়ে বসল পীযূষ। – ‘ভাল হয়েছে , কথাটা তুমিই তুললে। আমি ভাবছিলাম, জিজ্ঞাসা করব। তা হলে, কি প্ল্যান তোমাদের ? বল, কবে তোমরা বিয়ে করতে চাও ?’
তটিনী বসে আছে টান্‌ টান্‌ হয়ে , চোখে মুখে উৎকন্ঠা আর চাপা উত্তেজনা। বাবা আর দিদির মুখের দিকে একবার ভাল করে দেখে নিয়ে শালিনী বলল – ‘জয়ন্তর সাথে বিয়েটা হবেনা বাবা। ওর সাথে আমার সম্পর্কটা কেটে গেছে !’

ঘরের মধ্যে সবাই চুপ। ঘড়ির কাঁটা টিক্‌ টিক্‌ করে এগিয়ে চলে। বাইরে একটা গাড়ির হর্ণ বাজল। কিছু ছেলেমেয়ের কন্ঠস্বর শোনা গেল, আর তারপর ওদের তুলে নিয়ে গাড়িটা আবার চলেও গেল। চারদিক আবার নিস্তব্ধ নিঝুম ! নীরবতা ভেঙ্গে পীযূষ প্রশ্ন করল – ‘কতদিন হয়েছে এটা ?’
– ‘দু’বছরের উপর।’
– ‘তা হলে এখন?’ পীযূষ প্রশ্নটা শালিনীর দিকে গড়িয়ে দিল। শালিনী নিরুত্তর। বাবার দিকে তাকিয়ে। পীযূষ আবার বলল – এখন কি করবে ?’
– ‘ভাবিনি।’ দেওয়ালের দিকে চোখ রেখে উত্তর দেয় শালিনী।
তটিনী হঠাৎ উৎসাহ ভরে বলে ওঠে ‘ছেলে দেখব? চাইলে এখনও তোর জন্য অনেক ভালো পাত্র পাওয়া যাবে।’
– ‘না, দিদি-ভাই !’ হেসে ফেলে শালিনী।
– ‘না কেন ?’ চোখ কুঁচ্‌কে পীযূষ বলে – ‘সারা জীবন একলা থাকবে না কি? অথবা আর কারুকে পছন্দ করেছ?’
পীযূষ প্রশ্নটা করতেই আলেক্সের কথা মনে হল শালিনীর! আলেক্স তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। শালিনী বলেছিল – ‘আমার জন্য অপেক্ষা কোর না আলেক্স। আমি আদৌ বিয়ে করব কি না তারই কোন ঠিক নেই।’ খুব স্বাভাবিক ভাবে হেসেই আলেক্স উত্তর দিয়েছিল ‘সেটা তোমার ব্যাপার। আমার সেখানে কোন জবরদস্তি নেই। কিন্তু, আমি তোমাকে ভালবাসব, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব – সেটা আমার ব্যাপার ! সেখানে তোমার কোন জোর খাটবেনা।’

অবাক হয়ে আলেক্সের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল শালিনী। কোন কথাই আর বলতে পারেনি। খুব ইচ্ছা হয়েছিল তখন আলেক্সের কাছে, একেবারে খুব কাছে যায়। কিন্তু সেটাও পারেনি।

পীযূষের প্রশ্নের উত্তরে শালিনী আবার আলেক্সের কথা ভাবল – কিন্তু কিছু বলতে চাইল না, বা পারল না। ও মনে মনে জানে যে পীযূষ সহজে আলেক্সকে মেনে নিতে পারবে না। তা ছাড়া ওর নিজের মধ্যেও অনেক দ্বিধা, দ্বন্দ রয়েছে! কিছুতেই মন স্থির করতে পারছে না সে! ক্লান্ত ভঙ্গীতে শালিনী বলল – ‘এখন ও সব কথা থাক বাবা। তবে নিশ্চিন্তে থাক, কোন সিদ্ধান্ত নিলে তোমাকে নিশ্চই জানাব।’
– ‘বিদেশে একলা থাক; সব সময়েই চিন্তা হয়।’
– ‘চিন্তা করার কোন মানে হয় না বাবা।’ শালিনীর কন্ঠে উষ্মা ফুটে ওঠে ! – ‘আমার এখন আঠাশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে!’
– ‘জানি। আর সেই জন্যই আরো বেশী চিন্তা! কারণ আমার বয়স এখন একষট্টি, আর আমি তোমার বাবা।’
– ‘চিন্তা করে কি লাভ ? যার যার লাইফ্‌, তার তার নিজের।’
আহত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চাইল পীযূষ – ‘তোর লাইফ্‌ শুধু তোর? সেখানে আমরা কোথাও নেই? ’
– ‘বাবা, সব সময় এরকম সেন্টিমেন্টাল হওয়ার কোন মানে হয় না। ঐ দূর বিদেশে যে প্রচন্ড কষ্ট আর স্ট্রাগল্‌ আমাকে করতে হয়েছে, সেটা আমিই জানি। তখন তো তোমরা কেউ সেটা আমার সাথে শেয়ার করনি!’

অসহায় দেখাচ্ছিল পীযূষকে। সে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল! উল্টো দিকের সোফা থেকে উঠে এসে দু’হাতে শালিনীকে জড়িয়ে ধরে তটিনী – ‘চুপ্‌ কর শালু ; এসব কথা বলে বাবাকে আর কষ্ট দিস্‌ না।’
– ‘ও কে বলতে দে।’ পীযূষের কথাটা কানে যেতেই থম্‌কে চুপ করে গিয়ে বাবার দিকে তাকাল শালিনী। পর মূহূর্তে উঠে গিয়ে ছোট্ট মেয়ের মত বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল – ‘বাবা! বাবা !’

পরদিন সকালে শালিনী গিয়েছিল ওর বড় মাসীর সাথে দেখা করতে। সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ঢুকতেই দেখে আবহাওয়া থম্‌থমে। বাবা অসুস্থ! ডাক্তার এসেছে। তটিনী, উদয় দুজনেই গম্ভীর মুখে বসে আছে। ফ্যাকাসে মুখে শালিনী প্রশ্ন করল – ‘কি হয়েছে ?’
– ‘ব্লাড্‌ প্রেশার খুব বেড়ে গিয়েছিল। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল। এগারোটার সময় রান্নার মাসী আমায় ফোন করে জানায়।’ খুব অস্থির ভাবেই তটিনী বলল। যেন গুছিয়ে কথা বলতে পারছিল না সে !

ডাক্তারের কাছে কিছু না বললেও তটিনী আর উদয় দুজনেই শালিনীকে বুঝিয়ে দিল যে তার গত রাতের আচরণের জন্যই পীযূষ অসুস্থ হয়েছে। শালিনীরও মনে হল যে কথাটা সত্যি! দুঃখে আর অনুশোচনায় মরেই যেন যাচ্ছিল সে। সারা রাত সে তার মায়ের ছবির দিকে চেয়ে বসে রইল। ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে গাল, গলা ভিজে গেল।

দুদিন পর পীযূষ তখন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। শালিনী পায়ে পায়ে ওর বাবার বিছানায় গিয়ে অপরাধীর মত মাথা নীচু করে বসে রইল। পীযূষ জিজ্ঞাসা করল – ‘কি হল?’
মাথা নাড়ল শালিনী – ‘কিছু না।’ তারপর কান্না চাপা স্বরে বলল – ‘আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি বাবা। আমি তোমার বাজে মেয়ে বাবা।’
হেসে ফেলে পীযূষ, স্নেহের স্বরে মেয়েকে বলল – ‘দূর পাগলী, বাজে কেন হবে ? তুমি আমার খুব ভাল মেয়ে !’
– ‘তাহলে আমি তোমার কাছেই থাকব বাবা। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবনা।’
– ‘তাই কি হয় মা ? তুমিই তো বলেছ যার যার লাইফ্‌, তার তার! তোমার শেয়ারের কষ্টটা তুমি ভোগ করেছ, এবার আনন্দটাও খুঁজে নাও।’
– ‘রাগ কোরে বলছ ?’ শালিনীর মুখটা ম্লান হয়ে যায়!
মৃদু হেসে মেয়ের হাতের উপর দুটো ছোট চাপর মেরে পীযূষ বলে – ‘না, খুশী মনেই বলছি! তোমরা তোমাদের মত সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে, আনন্দে থাকবে – আমিও সেটাই চাই। তাতেই আমি ভাল থাকব।’

বাবার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। শালিনীর মনের মেঘটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছিল। আশার রূপালি রেখাটা দেখতে দেখতে সে ভাবছিল – আলেক্সের কথাটা বাবাকে বলে দেখলে হয়! হয়তো বাবা আলেক্সকে মেনেই নেবে। কিন্তু এখন নয়, আর ক’টা দিন যাক্‌।

পীযুষ ঘুমিয়ে পড়ার পর ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল শালিনী। তার শোবার ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দাটায় এসে দাঁড়াল। ধুসর আকাশে আধখানা চাঁদ। দূরে দুটো তারা মিট্‌মিট্‌ করছে। নিঝুম রাতে সবাই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছে চৌকিদারের লাঠির ঠক্‌ ঠক্‌ আওয়াজ। হঠৎ একটা কুকুর কেঁউ কেঁউ করে কেঁদে উঠল! ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, ঠান্ডাটা ভালই পড়েছে। কিন্তু শালিনীর শীত লাগছিল না – বরং আরামই লাগছিল তার! বারান্দায় একলা দাঁড়িয়ে তার সব কিছুই এবার খুব চেনা চেনা মনে হল ! ওই দূর আকাশের চাঁদ তারা, নিঝুম রাতের চৌকিদারের লাঠির ঠক্‌ ঠক্‌, কুকুরের ডাক, সামনের অন্ধকার পার্ক, এমনকি ল্যাম্পপোস্টগুলোও যেন তার বহুকালের চেনা! অদ্ভুত এক মায়ায় ভরে যায় তার মন। পুরানো দিনগুলো ফিরে পাবার একটা আকুলতা তার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে, কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ে চোখ থেকে! কষ্ট হয়, তবু ভালো লাগে! শীতের রাতের হাল্কা হাওয়া তার মুখে চোখে ঠান্ডা স্পর্শ দিয়ে যায়। শালিনীর মনে হল, জ্বর-তপ্ত কপালে যেন মায়ের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ! বারান্দার কোনে রাখা চেয়ারটাতে সে চুপ করে বসে রইল !

Sahityika Admin

Add comment