কুড়োনো নুড়ি স্মৃতির ঝুড়ি
সুদীপ্ত চক্রবর্তী, স্থাপত্যের অপত্য ৮২
হঠাত হঠাত বিদ্যুৎ চমকের মতন মনে পড়ে নানান কিছু প্রাচীন কথা, অজান্তেই এক্টু আলগা হাসি বুঝিবা ছুঁইয়ে যায় ঠোঁটের কোণায়, একটু বা কষায় স্বাদ কভু আর ক্কচিত কিছু মৃদু বেদনা। সেই সব রসকষসিঙ্গাড়াবুলবুলি নিয়ে মস্তকে একটা ক্ষণিক আন্দোলন আসে, ভাবনার ঢেউগুলি ওঠে, আবার মিলায় অল্পকালের অবসরেই। সেই সব নিয়ে মিষ্টিনোন্তাটকঝাল কিছু পলাতকা কথামালাকে বন্দী করার বাসনা এইমাত্র।
নুড়ি ১ – স্পোকেন ইংলিশ
অনেক ন্যায্য কারণেই বিখ্যাত ছিলেন, শুধু আমাদের কালেরই নয়, দুই দশকের প্রোফেসর ডঃ সনৎ বিশ্বাস, যাঁকে আপামর বিক্কলেজী জানে পাইপ বিশ্বাস। ওই কোটপ্যান্টুল, ওই পাইপ, ওই চলাবলা, আবার পরে কলকাতার শেরিফ হওয়া, আবার বিখ্যাত সেতারবাদিকা জয়া বিশ্বাসের স্বামী। কিন্তু মনে হয় কলেজ ওঁকে ঠিকমতন ভাবে কাজ করার সুব্যবস্থা দেয় নি, তাই আমাদের “ট্রেনিং এ্যান্ড প্লেসমেন্ট” বিভাগ তার পূর্ণ মহিমায় কাজ করে নি। আবার, তখন মনেহয় বিক্কলেজ থেকে পাস করা ছাত্রদের এমনিতেই লুফেই নিতো নানান শিল্পে বাণিজ্যে, কাজেই খুব বেশী দায় তো ওই বিভাগের ছিলোও না। আমরা কলকাতায় এবং কোলকাতার বাইরেও রিইউনিয়নের চাঁদা তুলতে গিয়ে দেখেছি, কেবল উদ্দিষ্ট প্রাক্তনীরা নন, সব বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানেই সব বড় বড় পদেই একচেটিয়া বিক্কলেজ। আর কী তাঁদের ভালোবাসা ! কলেজের উপর কলজের টান আর অপোগন্ড ভাইদের উপর মায়ার বান।
তা যাই হোক, সেকালে অনেক অনেক কারিগরি কলেজ না থাকায় আর এখানকার পড়াশুনো নিশ্চিতভাবেই অতি উত্তম হওয়ায়, চাকরীর আকাল ছিলো না বিক্কলেজীদের। তবুও, তবুও, তবুও, পাতি বাঙ্গালী মেঠো মানবকদের একটা ক্ষোভ খুব ছিলই, আর খুবই কথিত ছিলো যে কথ্য ইংরেজীটে আরিট্টুক জানিলে কীজানিকী তীর আরো কয়টি মেরে দিতেম। hi, hello, arrey yaar, buddy, bro, lol, RIP, HBD, এই সব শব্দ তখন কোথায়!
স্পোকেন ইংলিশ না জানার চাপ যখন আমাদের মুড়ি-বিড়ি মহলে খুব বেড়ে উঠলো, এক ক্লাবই খুলে দেয়া হলো এক ছাত্রাবাসে, আপনা হাথ জগন্নাথ করে নিজেরাই শিখবো স্পোকেন ইংলিশ। ধারেকাছে কোনো ব্যবস্থাই ছিলো না ওসব শেখার, যদিও গাঁজাগুলি ভাং চারু ব্ল্যাকে ফিলমিটিকিট চাপানবিড়ি ঘুগনী-পাঁউরুটি মায় পাস্পোর্ট সাইজের ফটো তোলা সবই ছিলো। দানেশ শেখ লেনের সোচ্চারণ সুন্দরীরাও ছিলো, লাইটার সারানোর দোকান ছিলো, ঘোর লোডশেডিং ছিলো, জ্যাঠামশায়ের দানাদার ছিলো, কিন্তু স্পোকেন ইংলিশের দোকান ছিলো না।
নিয়ম হল, উদ্দাম খেলাধূলা করে হোস্টেলে ফেরার পর ঠ্যাং ধুয়ে সন্ধে ছটার পর আর দুঘন্টা কোনো বাংলা নয়, সব কথাই চালাতে হবে ইংরেজীতে। কিম্বা ক্যান্টিনে এককাট্টা হয়ে ফুরসৎ পেলেই।বাংলা বললেই, প্রতি শব্দে পাঁচ পয়সা ফাইন। পাঁচ পয়সা মানে চারমিনার।
এর ফলে এবার কিছু কিছু বাচাল ছোকরা ওই সময়ে বোবা হয়ে গেলো। আবার ভয়ানক দরকারী কিছু কথা বলে ফেলে কিছু বা ফাইনও দিতো কেউ কেউ। সেই ক্লাবেরই কোনো এক সন্ধ্যার আলাপ এই প্রকার (অকথ্যকথনপিয়াসীদের নামগুলি বদলে দেয়া হল)।
Gajen – “What played today afternoon?”
Rajen – “I go Oval Sunil digen exectra play cricket don’t take me.”
Brajen – “Then what you play? Tell tell.”
Jiten – “What and do, go fast gate, eat a Charminar, eat tea and leRo, come back hostel.”
ব্যস! এই লেড়ো শুনেই সমবেত জনতা হৈ হৈ করে উঠল। হৈ হৈ টা আবার বাংলায় করলে ফাইন, ইংরেজীতে কীভাবে করা যাবে জানা নেই, তাই সমবেতভাবে মুখ দিয়ে একটা গুঁ গুঁ উঁ উঁ আওয়াজ বার করা হত। খাতায় লিখে পাঁচ পয়সা ফাইন হল তার, এসব পয়সা খুব সাবধানে রেখে গ্র্যান্ড ফিস্টের দিনে গাঁজা আনা হত।
অমল এরমধ্যে ফিরে এসেছে জিম থেকে। মনোতোষ রায় হবার আশা, কিন্তু আজ লড়বড়ে ঢালু বেঞ্চের কারণে ষোলো কেজির লৌহপাটালি পায়ে পড়ায় লেংচে লেংচে হস্টেল ফিরে আসতে আসতে বেশ দেরি হয়েছে, তাই আশা করেনি যে গোয়ালা আজ দুধ দিয়ে যেতে পারবে। ভেবেছিল গোয়ালা ফিরে গেছে। কড়া আদেশ আছে অন্যের হাতে দুধ একদম নয়। কিন্তু ওমা! পাশের নরেন এনে দিলো একটা মস্তো বড়ো এ্যালুমিনিয়ামের মগের তলায় এক আঙ্গুল দুপোয়া দুধ!
Amal (আপ্লুত বিস্মিত) – “Milk milk! How milk?”
নরেন চুপ, এক্কেবারে স্পীকটিনট।
Amal– “Milk milk! When milk?”
নরেন চুপ, এক্কেবারে স্পীকটিনট। আকাশে শিবনেত্র করে বিড়বিড় করে ভাঁজছে, ইংরেজিতে বলতে হবে তো, নইলে ওই ফাইন। কিন্তু ইংরেজি বাক্য আর গড়েই উঠতে পারছে না যে!
Naren – “Yes milk”
Amal– “Milk milk! Who milk?”
হঠাত্ যেন হাতে চাঁদ, একগাল হাসি, পেয়েছে পেয়েছে সমাধান পেয়েছে একেবারে খাঁটি ইংরেজি।
Naren – “Milk God!”
কারোই বিশ্বাস হতে চায় না, ভগবান নিজে এসে অমলের বরাদ্দ দুধটুকু দিয়ে গেছেন।
Amal (চরম উৎকণ্ঠা) – “What God milk ??”
Naren (বিরাটভাবে হাঁফ ছেড়ে) – “Cooking god, cooking god, he take your milk and give me!”
Kamal – (আর থাকতে না পেরে) শালা ফিসফিস করছিস কেন বলনা ব্বে!”
ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে প্রায় এক টাকা ফাইন।
কাতলা মাছের ইংরেজি কি? অনেক ভেবেচিন্তে বের হল কাতলার সঙ্গে কেতলির মিল আছে। তাহলে কেট্ল শব্দটাও ইংলিশ তাই কেটল ফিশ বলে দেয়া যাক। কিংবা ক্যাটল ফিশ……
Ratan – “Kettle fish or cattle fish” (এটা সবাই চেপে গেল ফাইন আর নিলো না)
Naren (আকুল মাংসাশী প্রাণী) – “No flesh? No flesh?”
রতন হাফ ছেড়ে বাঁচল একেবারে কারণ কিছুতেই এতক্ষণ মাংসের সঠিক ইংরেজিটা মনে করতে পারছিল না এবার সেটা পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে এগিয়ে গেল
Ratan (আশ্বস্ত করার বরাভয় ভঙ্গীতে) – “Yes yes goat flesh”
যদিও উদ্দেশ্য ছিল ইন্টারভিউতে সকাসক ইংরেজি ফাটিয়ে বেশি মাইনের চাকরি জোগাড় করা, ওই প্রবল প্রচেষ্টার অকালমৃত্যু হয়ে যায় খেলাঘর আর রান্নাঘরেই। যাইহোক সকলের সৌভাগ্যে এবং ইংরেজি ভাষার সৌভাগ্যে ইংরেজি নিয়ে স্পোকেন ইংলিশ নিয়ে এই ধস্তাধস্তি কুস্তাকুস্তি খুব বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি কারণ যে উদ্দেশ্যে এই ক্লাব খোলা হয় অর্থাৎ ইংরেজিতে চমৎকার ইন্টারভিউ দেয়া সেই ইন্টারভিউতে ইংরেজিতে কী ধরনের প্রশ্ন করা হয় এবং কি ধরনের জবাব দিতে হয় সেগুলি সকলেরই অগোচর ছিল তাই সেই অব্দি আর পৌঁছানো যায়নি, খেলাধুলা আর রান্নাঘর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরেই কথ্য ইংরেজি শিক্ষার অকথ্য কাহিনীর শেষ হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ ঘটনা একেবারেই সত্য, মায় ইংরেজি কথাগুলি।
খুবই আনন্দের কথা, স্পোকেন ইংলিশ না শিখেও সবারই বেশ ভালো ভালো চাকরী জুটে যায় এবং কিমাশ্চর্যমতঃপরং, সকলেই সারা দেশে এমনকি বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে বেশ তাড়াতাড়িই লেবার-খ্যাদানো আর বস-ত্যালানো স্পোকেন ইংলিশ চমৎকার শিখে ফ্যালে। জয় জয় বিক্কলেজের জয়!!!
নুড়ি ২ – শ্রীচৈতন্য
লিকপিকে প্যাংলা চেহারার জন্যেই হোক আর চরমরকম ভীতু স্বভাবের জন্যেই হোক, খেলাধূলো থেকে সদাই শত হাত দূরে থেকেছি ছোটবেলার পর থেকে। কিন্তু বিক্কলেজে গস্ত হবার পর, আর পড়াশুনোতেও একইরকম বৃহস্পতি হবার জন্যেই হয়তো বা, আড্ডা দেয়া ইত্যাদি ছাড়া আর কী কী করা যায় সেই খোঁজ করে দেখলাম যে এখানে তো খেলাধূলার বিরাট কান্ডকারখানা। আর দেখতে-না-দেখতে প্রিয় বন্ধুরা প্রায় সক্কলেই কেউ ফুটবলে কেউ ক্রিকেটে কেউ টেনিসে কেউ ব্যাডমিন্টনে কেউ সাঁতারে কেউ বক্সিঙে কেউ এমনকি ক্যারামে আর কেউবা জিমনাশিয়ামে প্রবল উৎসাহে ভীড়ে গেল, কেউ কেউ তো আবার সব কটাতেই দক্ষ দেখেছিনু। এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, ‘সবই তো ফ্রী, লুটে লিচ্ছি আর কি!’
একজন মাত্র সমঝদার বুদ্ধিমান সঙ্গের সঙ্গী পেয়েছিলাম, যে কিনা আমারি মতন, কোনো খেলাধূলার মধ্যে নেই। তার সেই না থাকার কারণটি শুনে অবশ্য প্রায় ভিরমি খেয়েছিলাম, সে বলে কিনা ‘খেলেটেলে কাজ নেই। খিদে বেশী পাবে টিপিন খাবার বিল বেড়ে যাবে।‘ সে মোট্টেও গরীব ছিল না, ছিল হাড় কেপ্পন। হাতের তালুতে অল্প এক কোষ শ্যাম্পূ নগদ দশ নয়ায় আর কোয়াটার ইঞ্চি টুথপেস্ট নগদ পাঁচ নয়ায় বিক্রি করত। দানেশ শেখ লেন বা বটসে মেয়ে তোলার অভিযানে যাবার জন্য অন্যদের নিজের জামা ভাড়া দিত। একবার একজন মার খেয়ে তার জামা ছিঁড়ে আনার পর থেকে কশন মানিও রাখত।
ক্লাসের শেষে ব্যারাকের প্যাটিস খেয়ে যখন কটা চোঁয়া ঢেঁকুর তুলে গোধূলি বেলার ঝুঁঝকো আলোয় কিম্বা সপ্তাহের মাঝের কোনো আলটপকা ছুটির সকালে, জেবনটা একেবারে শূন্য অর্থহীন মনে হোতো, তখন লেডিস হোস্টেলের পানে হতাশ চোখে চাইতে চাইতে ওভাল বা লর্ডসের পানে ঠ্যাং নাড়তাম, যেখানে আমার সব গোদা গোদা মুষকো বান্ধবরা হয় চামড়ার এক গোলোক নিয়ে কাড়াকাড়ি পেটাপেটি করছে অথবা আপেলের মতন লাল টুকটুকে এক বলকে ঠেঙ্গিয়ে বেড়া পারের সাধনায় মেতে আছে। জিমের জানালা দিয়ে দেখতাম হুম হাম আওয়াজ করে দত্যি দানোরা সব লোহার ডাম্বেল বারবেল তোলাতুলি করছে। সংগ দেবার কেউ নেই, কেউ না। অগত্যা ব্যাজার মুখে মাঠের ধারে গিয়ে বসতাম, কোনো বিকেলে নেতাজী ভবনে আর কোনো ছুটির সকালে বা ওভালে।
এমনি দুই দিনে আমার দুই মহান বেইজ্জতি ঘটে।
প্রথম দিনে ক্রিকেট টীমে লোক কম পড়ায় আমায় যাকে বলে বলপূর্বক টেনে নামায়ে ফিল্ডিং করতে দাঁড় করায়ে দেয়া হয়। একেবারে এক মোক্ষম জায়গায়, যে জায়গার নাম কখনো ধারাভাষ্যকারেরা নেন না। ডীপ মিডউইকেট আর লং অনের এক্কেরে মাঝামাঝি সে জায়গার নাম হোলো গিয়ে “কাউ কর্ণার”। যোগ্য নামই বটে! তা আমি বেশ আরামে আলস্যে অইখানে দাঁড়ায়ে গোটা দুই বোল্ড আউট আর একখানি স্লিপে ক্যাচ আউট প্রায় দর্শকের মতই দেখতেছিলাম, হায় হায় কী আপদ এরপর এলো এক লম্বু অলম্বুষ দানব ব্যাটসম্যান, সে ব্যাটা দেখি মুখ খিঁচিয়ে সকল বলই তেড়ে মেরে হুস হাস আকাশপথে উড়ায় চারে ছয়ে। তার মারা এক বল হা কপাল আমার দিকেও ধেয়ে এলো। যদিও সে বল হেলিকপ্টারের উচ্চতা দিয়ে পার হচ্ছিলো, আমি একাধিকবার শূন্যে লাফিয়ে দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে আকাশে খাবলা মেরেছিলাম। ব্যস আর যায় কোথায়, সে আমায় সার চেনা চিনে নিলো। আমার জায়গা দিয়ে চার ছয়ের বন্যা শুরু হোলো। ক্যাপ্টেন তড়িঘড়ি আমায় ডীপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে নির্বাসন দেয়ার পরেও অন্যদিকের ব্যাটসম্যান বেঁটে বরকন্দাজটা সুইপ পুল বা তাড়ু ইত্যাদি মেরে মেরে আবার আমার জায়গা দিয়ে রানের জোয়ার এনে ফেলল। আর আমি প্রতিটা ধেয়ে আসা বলেই ওই একই ভাবে দুই হাত শূন্যে তুলে দু তিনবার করে নাচতে লাগলাম। আমাকে লং অফ বা লং লেগে দিয়েও ফলং তথৈবচ, আমার জায়গা দিয়েই রানের স্রোত।
গোদের উপর বিষফোঁড়া হোলো এই, যে কলেজী সুন্দরীদের শত সাধনাতেও টিকিটির দেখা পাইনি কোনোদিনো, আজ তাঁদের গোটা এক ঝাঁক দেখি কখন এসে ওভালে গ্যালারিতে বসে আমার খেলা উপভোগ করছেন আর মাঝে মাঝেই সমবেত কন্ঠে “চৈতন্য চৈতন্য শ্রীচৈতন্য” বলে আওয়াজ দিচ্ছেন। বল আসার আগে এবং বল চলে যাবার পিছে আমার ওই উদ্দাম উদ্বাহু নেত্য দেখে তাঁরা যে ভুল বলেছেন তাও তো নয়!
খেলা শেষের পরে দুটি জিনিষ হয়েছিল, সুন্দরীদের সার্টিফিকেট পেয়েছিলাম যে এত মজাদার আর আনন্দদায়ক খেলা তাঁরা কদাপি কুত্রাপি আর দ্যাখেননিকো। আর আমার বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন আমাকে তাঁর দলের সেরা রান-সংগ্রাহকের তকমা দিয়ে জোর করে সেকেন্ড গেটের বৃহৎ সিঙ্গাড়া দুইখানা খাইয়েছিলেন। সেই থেকে আমি শ্রীচৈতন্য নামে মেয়েমহলে জোর জনপ্রিয় হয়ে পড়ি।
পরে আর একবার কাদাকালে লর্ডসে আমায় ফুটবলে টেনে নামিয়ে বারপোস্টের তলায় দাঁড় করিয়ে দেয়। আমাকে বোঝালো, আমি গোলকিপার, আমি দলের লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স। খুব গুরুত্বপূর্ণ পজিশন। সেবার গন্ডা কয় গোল খাবার পরে এবং প্রতিটি বল, তা সে উঁচু বা নিচু বা মাঝখান দিয়ে আসুক না কেন, আমি জমিতে খলবলে কই মাছ কুড়ানোর ভঙ্গিমা করার পরে, আমার নাম আরো কলেবরে বেড়ে “কই-কুড়ানো- চৈতন্য” এবং তা থেকে ক্রমে “কৈচৈতন্য” তথা “কৈচৈ”তে পরিণত হয়। হায় কী সেসব দিন ছিলো!
নুড়ি ৩ – সেই হাসি
কোনো কোনো বার দোলের সময় কলেজেই রয়ে যেতাম। বাড়ি গেলে একেবারেই নিরিমিষ্যি, কলেজে তবু দোলের আমোদ কিছুবা উপভোগ করা যেত। সুখী ভাগ্যবান প্রেমিক প্রবরেরা তাদের রাধিকাদের নিয়ে কোথায় যে বেপাত্তা হোতো জানিনা, তবে সংখ্যাগুরু হতভাগা হতাশ ষাঁড়েরা ঢোল খোল কত্তাল কাঁসর কালি ঝুলি রঙ আবীর সব কোত্থেকে যেন যোগাড় করে এক মহাহইহই উল্লাসকর যূথবাঁধা ক্যাওতালি ঘনিয়ে তুলতাম উৎকট চিৎকারে উদ্দাম দৌড়াদৌড়িতে ধাঁইধপাস বাজনে রঙ্গবেলুনে গানেগানে উড়ৈল ফাগুয়ায় মাতোয়ালা মাতামাতি আর ন্যক্কারী নাচের নটোখটো নষ্টামি দিয়ে। একান্তই নারীবিবর্জিত দুরাশায় দমে থাকা সেই রাধাহীন রাস হতাশ তাও চলেছে প্রায় ঘন্টা চারেক। প্রেম ছাড়া সকলি হয়েছে, এমনকি বড়বাবুর বাড়ির নাড়ুর লাইনে দাঁড়ানো, যদিও তা শুধু নাড়ুর লোভে নয়। আবার দারোয়ান ভায়ার ঘোঁটা সিদ্ধির প্রসাদও পাওয়া হয়েছে। শেষে বিবশে দেহ টেনে হস্টেলে এসে বিশদে স্নানের পালা।
চানের পর শরীরে এক বিপুল বিহ্বল তৃপ্তিময় ক্লান্তি, এক আচ্ছন্নকারী অবসাদ, ঘুমের টান, ভাঙ্গের নেশা, প্রবল খিদে ইত্যাদির বোঝা টেনে বারান্দা দিয়ে ঘরে ফেরার সময় অকস্মাৎ দেখা গেল সামনের নিমঝিলের মাঝখানে একেবারে একা একা মৃত্যু ডুবে যাচ্ছে।
মৃত্যুঞ্জয় সেন, দারুন দামাল, উৎসাহী উদ্যোগী প্রাণময় তেজীয়ান দুষ্টুভালো রসিক ছেলেটা আমাদের। কয়েকজনের সাথে নাইতে নেমেছিল, নাকি একাই, জানা যায়নি আর। ডুবে যাচ্ছে, হাত দুটি উঠে বাতাস মুঠি করে ধরছে, আবার নেমে যাচ্ছে, আর মনে হল যেন সমানে হেসে যাচ্ছে। সে কি ভাঙের নেশার অবোধ অট্টহাসি নাকি ডুবে যাবার অন্তিম হাহাকার, সেও আর জানা যায়নি কোনোদিন।
সর্বনাশা পুরো ব্যাপারটি দেখা গেল মিনিট খানেকেরও কম। সে যুগ চলভাষের নয়, সবাই ক্লান্ত, বেশীর ভাগ লোক ছুটিতে, বাকীরা যে যার ঘরে, রাস্তায় কেউ নেই, যে কজন দেখতে পেল তারা কেউ সাঁতার জানেনা, সেই অবস্থায় নেমে গিয়ে পাগলের মত চেঁচিয়ে দৌড়িয়ে বাঁশ দড়ি আর সজ্ঞান সক্ষম সবল সাঁতারু জোগাড় করতে করতে সর্বনাশ হয়ে যায়। নিম ঝিলের গহন কালো নিতল শীতল জলের চিরবিশ্রামে চলে গেল সেই সদানন্দ কিশোর। পাড়ের হাজার হাহাকার তুচ্ছ করে সম্ভবপর সব চেষ্টা বিফল করে হায় ডুবে গেল সেই ছেলে, হাসতে হাসতে। কাঁদতে কাঁদতে তাকে ওঠানো হয় অনেক পরে।
সেই দুটি হাত আজো মনে পড়ে। আর সেই তার হাসির মত হাহাকার বা কান্নার মত হাসি। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়ে, আর মনে পড়তো গরম রুটি ঝোলাগুড় আর নারকোল কোরা দিয়ে খেতে গেলে, ওটি ছিল তার অতি প্রিয় খাদ্য, মাঝে মাঝেই উল্লেখ করত সে। ভাগ্যিস আজকাল ওসব খাবার উঠেই গেছে।
(শেষের এই উপাখ্যানটি অবশ্য নুড়ি নয়, বুকের এক বিশাল পাথর। এখানে সে মৃত্যুঞ্জয়ীর নামটি বদলে দেয়া হয়েছে। সঙ্গের ছবিতে অন্য কেউ নিমঝিলে আবার একা একা নেমেছে দেখা যাচ্ছে)
এটা ধারাবাহিক চলুক সুদীপ্ত।
তোর নিজস্ব স্টাইল ও শব্দভঙ্গিতে।
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো, তুই সামনে বসে আছিস। আর বকবক করছিস।
ভালো থাকিস ভাই
দাদার আদেশ শিরোধার্য, আরেকটি গপ্পো সম্পাদকের দরবারে জমা করেছি
হাসতে হাসতে কান্না, হাসির নুড়ি জমতে জমতে পাষাণ-ভারি…. দুলিয়ে দিয়ে গেলে।
ইংরেজি কথনের পর্বটি একটু কাটছাঁট করলেই –তোমাকে আর পায় কে?
ধন্যবাদ দাদা। কেটেছেঁটেই এই দাঁড়িয়েছে। দাদার উপদেশ অবশ্যই মনে থাকবে।
বেশ লাগলো
😍
খুব ভালো লাগলো, সুদীপ্তদা!
সেই সব স্মৃতিমেদুর দিনগুলি…….আমাদের একান্ত আপন সম্পদ!!
তুমি আরও লিখো, পড়বো!
কোন হোস্টেলে থাকতে? আমি ছিলাম সাতে আর সেনগুপ্ততে!
আমি 1983 এর ব্যাচ, মেকানিকাল 😄😄❤️❤️
ধন্যবাদ ভাই। ভালো লাগা পাঠকের নিজ গুণ, সেটা লিখে জানানো এক বড় উদারতা।আমি ১৩,৮, উল্ফ
ধন্যবাদ ভাই। ভালো লাগা পাঠকের নিজ গুণ, সেটা লিখে জানানো এক বড় উদারতা।আমি ১৩,৮, উল্ফ