কিছুই তো বুঝিনা।
অর্ণব চ্যাটার্জী, ১৯৮৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
আজ সকাল আটটা নাগাদ সাঁত্রাগাছি কেদারনাথ ইনস্টিটিউশন এর পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। আমি এখানে পড়তাম, বাবাও পড়তেন। তাঁর বাবা পড়তেন কিনা জানি না।
সেই সাত সকালেই ঘুম থেকে তুলে গিন্নী হাতে বাজারের দুটি ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে – একটা মাছের আর একটা সবজি, ফল ইত্যাদি কেনার জন্য। তারপর কি কি সবজি ফল কিনতে হবে বলে দিয়েছিলো, রাস্তায় যেতে যেতে ভুলেই গিয়েছি। যাই হোক, আন্দাজে একটা কাতলা মাছের আদ্ধেক ল্যাজের দিকটা, আর যা যা ফল সবজি কিনে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। আমি দেখেছি, আমি বাজারে গেলেই দোকানীরা ভয়ানক রকমের ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। আমাকে খুব আপ্যায়ন করে ডেকে দোকানের সেরা মাছ, সেরা ফল সবজি ধরিয়ে দেয়। অনেকসময় আদর করে চা খাওয়ায়, শরীর স্বাস্থ্য কেমন আছে খোঁজ নেয়। কিন্তু বাড়ি ফিরলেই তুলকালাম, আমি নাকি বাজার নয়, সারা সাঁত্রাগাছি শহরের সবথেকে পচা মাছটার সবথেকে পচা লেজটা কিনে নিয়ে এসেছি। আর ফল সবজি থেকে নাকি গন্ধ বেরোচ্ছে। আমি এতদিনে, মানে এই গত তেত্রিশ বছরে বুঝে গিয়েছি, আমার গিন্নীর দ্রব্যগুণ বিষয়ে কোন ধারণাই নেই, তাই একদমই তক্কাতক্কি করি না।
বাড়ি ফিরে আসছি, দুই হাতে বাজারের দুটি ব্যাগ, একটা মাছের আর একটা সবজি, ফলের। চোখে পড়ল অনেক মহিলা– পুরুষ আমার কেদারনাথ ইনস্টিটিউশন স্কুলটির সামনে জমায়েত হয়েছে। প্রত্যেকের চোখে মুখে কেমন যেন একটা উদ্বিগ্নতা। স্কুল ছুটি থাকলে অনেক সময়ই এই স্কুল প্রাঙ্গনে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড আর লক্ষী ভাণ্ডারের ফর্ম দেওয়া বা জমা নেওয়ার কাজ হয়। ভাবলাম সেরকমই কিছু হচ্ছে। এক ভদ্রলোককে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – ভাই এত লোকের ভিড় কেনো ? ভদ্রলোক বললেন- আরে আপনি জানেন না? আজ থেকে তো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। আমাদের ছেলেরা পরীক্ষা দেবে তাই আমরা এখানে। আমার হঠাত মনে পড়ল- আরে আমিও তো এবারের পরীক্ষার্থী, গতকালই আমাদের অঙ্কের টিউশন মাস্টার খগেন মৌলিক বাড়ি এসে বকাবকি করলো। আমি জানতাম আজ ভূগোল পরীক্ষা, খগেন মৌলিক এসে আজকের অঙ্কের পরীক্ষা না জানালে আমার কি যে হতো? এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় -বেমালুম ভুলে গেলাম কি ভাবে?
কোনও ক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে স্কুলের বিশাল লোহার গেটে ধাক্কা দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দারোয়ান বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল – কি ব্যাপার?
আমি বললাম ভাই আমি পরীক্ষা দেব।
দারোয়ান কিছুটা হতচকিত হয়ে বলল – আপনি? আর পরীক্ষা তো শুরু হয়ে গেছে প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল। আপনাকে তো ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
বললাম- ভাই, আমার একটা বছর নষ্ট হওয়া মানে অনেক ক্ষতি।
কি ভাবল জানি না। সে আমাকে বলল – জেঠু আপনি এই লোহার গেটের বাইরের দিকে পরীক্ষার্থীদের নামের তালিকায় আপনার নাম আছে কিনা দেখুন।
দেখলাম দরজার উপর সাঁটানো একগাদা বিজ্ঞাপন – সুবীর স্যারের কোচিং, অর্শের চিকিৎসা, মহা মিছিল, শনিবারের বিশাল জন সমাবেশ, সহজে বশীকরণ, নেশা মুক্তির সহজ উপায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের ভিঁড়ে পরীক্ষার্থীদের তালিকা আর চোখে পড়ে না। গিয়ে দরোয়ানকে বললাম, কোথায় লিস্ট? তখন পাশের বাড়ির জগন্নাথবাবু বললেন, “দাদু, ঐখানে লিস্ট টাঙানো আছে।“
আমাকে জগন্নাথবাবু দাদু বলে ডাকছে? এই একগাদা লোকের মাঝে? পরীক্ষা আছে। ছোটবেলায় বাবা মা বলতেন পরীক্ষার আগে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। অনেক কষ্ট নিজেকে সামলে, সেই লিস্টে নিজের নাম দেখে দারোয়ান কে বললাম- ভাই আমার নাম তো আছে দেখছি।
দারোয়ান ভিতরে ঢুকতে দিল।
আমি সোজা পরীক্ষার হলে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক মহাশয়কে বললাম, “স্যার আমি এসেছি, আমি পরীক্ষার্থী।“
উনি তো আমাকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন আপনি এত দেরিতে এসেছেন, আপনাকে কিছুতেই পরীক্ষায় বসতে দেওয়া যাবে না।
অনেক অনুরোধ করার পর উনি বললেন- আপনার অ্যাডমিট কার্ড দেখান।
বললাম- আনতে ভুলে গিয়েছি।
উনি আরও বিরক্ত হয়ে বললেন – আপনাকে একদমই বসতে দেওয়া যাবে না।
বললাম – স্যার, আমি বয়স্ক লোক, দয়া করে এভাবে ফেরাবেন না।
আরও বললাম- আমি সাদা কাগজে একটা অঙ্গীকার দিয়ে দিচ্ছি যে আগামীকাল আমি আপনাকে অ্যাডমিট কার্ড দেখাবো।
বয়স্ক মানুষ দেখে উনি আমার কথা ফেলতেও পারছেন না আবার গিলতেও পারছেন না। বললেন” এই ব্যাগে কি আছে? নকল টুকলি করার কাগজ?”
আমি বললাম, “না, না। মাছ আর কিছু ফল সবজি।“
উনি গেলেন ক্ষেপে। “আপনি ভেবেছেন কি? মাছের বাজার নিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছেন?’
আমি ব্যাগ খুলে মাছ দেখাতেই পাশের একজন পরীক্ষার্থীই হবে মনে হয়, বলে উঠলো, আরে দাদু, উফ!!! কি মারাত্মক দুর্গন্ধ, কোথায় পেলেন এই পচা মাছ?
ভাবলাম, দি দুই থাপ্পড় ছেলেটিকে। কিন্তু ছোটবেলায় বাবা মা বলে দিয়েছেন পরীক্ষার আগে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।
তত্ত্বাবধায়ক মহাশয় নাকে ডবল রুমাল চাপা দিয়ে বললেন, মাছের ব্যাগটা আমার টেবিলে রাখবেন না- আমি শুদ্ধ শাকাহারি। ওটা অবশ্যই বাইরে কোন জায়গায় রেখে ভিতরে ঢুকে চেয়ারে গিয়ে বসুন।
এদিকে হঠাৎই মনে হলো বাড়িতে তো জানেই না যে আজ আমার পরীক্ষা। আমি যদি পরীক্ষা দিতে বসে যাই তাহলে দেরি দেখে তো চিন্তা করবে। আবার ভাবলাম পরীক্ষা না দিয়ে ফিরে গেলে তো লাঞ্ছনা গঞ্জনার সীমা থাকবে না। জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, খগেন মৌলিক স্যারও কান টেনে ছিঁড়ে দেবেন। উনি নাকি আজ পর্যন্ত এগারোটা ছেলে আর চার চারটে মেয়ের কান টেনে ছিঁড়ে দিয়েছেন। আমি আর কি করি? পরীক্ষা না দিয়ে ফিরে এলে-আরও কত কিছু যে হবে। সাথে মোবাইলও নেই যে একটা খবর দেব।
পড়লাম এক উভয় সংকটে।
সাত পাঁচ ভেবে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। দেখলাম মাথার উপর পাখাটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। একটি ছেলে এসে বলল- দাদু আপনি সিনিয়র সিটিজেন আপনি আমার সীটে গিয়ে পাখার তলায় বসুন। আমি আপনার সীটে বসছি। আমার পাখা লাগবে না।
ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম মানবিকতা আজও বেঁচে আছে। ইতিমধ্যে প্রায় আধ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। খাতা আর প্রশ্ন পত্র দেওয়া হল। বাংলা দেখি প্রথম পত্রের পরীক্ষা। পাশের ছেলেটিকে ফিশফিশ করে বললাম, “আজ অঙ্কের পরীক্ষা ছিলো না?”
ছেলেটি কিরকম একটা যেন মুখ করলো, আজকালকার ছেলেমেয়ের মুখভঙ্গিতে নাকি অনেক ভাবের আদানপ্রদান হয়। আমি কিছুই বুঝলাম না।
এবার খেয়াল হলো পেনই তো নেই লিখব কি দিয়ে। অন্য পাশের মেয়েটি আমাকে লক্ষ্য করছিল। বলল- দাদু, আমার কাছে অতিরিক্ত পেন আছে আপনি নিন। বললাম – খুবই উপকার করলে বাবা।
বাংলা পাঠ্যপুস্তকের সাথে অনেকদিন কোনও যোগাযোগ নেই। গতকাল খগেন মাস্টার অঙ্ক করিয়েছে। তার আগে কয়েকদিন ভূগোল পড়েছি, কিলিমাঞ্জারো পর্বত, সাহারা মরুভূমি, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, এই সব। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা প্রশ্নের কিছুই বুঝতে পারছি না। খাতা একেবারে ফাঁকা রেখে উঠে যাওয়াটা প্রচন্ড অসম্মানের। তাই কবিগুরু, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ ইত্যাদি থেকে শুরু করে আজকের শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আর্যতীর্থ ইত্যাদি স্বনামধন্য সাহিত্যিকের লেখা যা যা পড়েছি এবং তার থেকে যেটুকু মনে ছিল তাই নিজের ভাষায় লিখে খাতা ভরাতে শুরু করলাম। মনে হলো বাল্মীকি রামায়ণ থেকেও কিছু লেখা উচিৎ, তাই অশোকবনের সীতা আর লবকুশের কাহিনীও কিছুটা লিখে দিলাম। একটা অতিরিক্ত পাতাও লেগে গেলো।
পরীক্ষা শেষে বাইরে বেরিয়ে দেখি বিদ্যালয় প্রাঙ্গন সাংবাদিকে ছেয়ে গেছে। বুঝলাম ষাটোর্ধ আমিই ওদের আজকের নিশানা। একজন অত্যন্ত পাকা টাইপের সংবাদিক এগিয়ে এসে বললেন দাদু, এই বয়সে পড়াশোনার ধকল নিচ্ছেন কি ভাবে?
আমি বললাম, কোন চ্যানেল থেকে এসেছেন আপনি ?
শোনার পর বললাম আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দেব না। আপনার চ্যানেল পক্ষপাতিত্ব করে। সারাদিন আমাদের মত বয়স্ক লোকেদের নিয়ে হাসি মজা করা ছাড়া কোনও কাজ নেই আপনাদের।
একজন মহিলা সাংবাদিক আবার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি সাহিত্য আর বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে ভেদাভেদ করেন- মানে বিজ্ঞানের বিষয় গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কি সাহিত্যের বিষয়গুলোকে অবহেলা করেন?
আমি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া চিরকালই এড়িয়ে চলেছি। ফলে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। বোধ হয় এরকম একটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কিছুটা মেজাজ হারিয়ে ভাষাও হারিয়ে ফেললাম – কোনও ক্রমে আমতা আমতা করে বললাম- আমি পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ করি না – সাম্যতা বজায় রাখা আমার মজ্জাগত।
মহিলা সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি হওয়ার ফলে প্রশ্ন উত্তরের পর্ব ধীরে ধীরে বেশ মনোরম হয়ে উঠছিল। ভাবছিলাম- এই প্রশ্নোত্তর যদি না শেষ হয়–
হঠাত কানের গোড়ায় তেত্রিশ বছরের সেই অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর বেজে উঠল – সকালে বাজারের থলে হাতে বেরোনোর সময় বলেছিলেন- আজ কিন্তু কারোর সাথে কথা বলতে দাঁড়িয়ে যেও না। তুমি বাজার থেকে আসলে রান্না চড়বে, ঘরে কিছু নেই – আর হ্যাঁ একটা ইলিশ মাছ অতি অবশ্যই আনবে- এই সিজনের প্রথম ইলিশ খাব। এত বেলায় শাক সবজি ইলিশ কিছুই পেলাম না। পরীক্ষার খাতায় অসংলগ্ন কিছু লেখা -হাজার চেষ্টা করেও পরীক্ষক পাশ করাতে পারবেন না – সাংবাদিক দের সামনে অপ্রস্তুত অবস্থা, যা টিভিতে সম্প্রচারিত হবে আর যা দেখে সকলে হাসবে- সর্বোপরি বাজারের থলে খালি দেখে গিন্নির কী অবস্থা হবে-
কুলকুল ক’রে ঘামতে আরম্ভ করলাম।
ঘুমটা হঠাৎই ভেঙে গেল – উঠে দেখি ঘড়িতে সকাল ছ’টা বাজতে পাঁচ।
Add comment