এলোমেলো বেড়ানো: ১ (ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী)
অমিতাভ রায়, ১৯৭৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
ভূত দেখেছেন? বিগত সময় বা ফেলে আসা অতীত অর্থে বলছি না কিন্তু। বলছি সেই সব ভূতের কথা, যারা জল জমে বরফ হওয়ার মতো অন্ধকার জমে তৈরি হয়। না, না– লজ্জা পাবেন না। সকলেই জানে, আর পাঁচজনের মতো আপনিও সরাসরি নিজের চোখে কখনও ভূত দেখেননি। এমনকী ভূতের পাল্লায়ও পড়েননি। আসলে ভূতের গল্প তো শুধু শোনা যায়। একবার মনে করে দেখুন না কেন, সেই ছোটঠাকুরদার বড়ো শ্যালিকার শ্বশুরমশাইয়ের ভূত দর্শনের গল্পটা, যা সেই শৈশব থেকে এতবার শুনেছেন যে মাঝেমধ্যেই ভুল করে ভেবে বসেন সত্যি সত্যি ভূতটা আপনিই দেখেছিলেন। বিয়ের পরে জেনেছেন, আপনার পিসশাশুড়ির মাসতুতো দেওর কবে যেন ভূতের পাল্লায় পড়েছিল। এখনও পর্যন্ত যতবার শ্বশুরবাড়ি গেছেন তার থেকেও অনেক বেশিবার এই কাহিনিটা শোনার পরে এখন মাঝেমধ্যেই আপনার মনে হয়, বোধহয় কোনও এক অজানা জায়গায় আপনিই একদা ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন।
আর ভূতের গল্প? খোঁজ করলেই জানতে পারবেন, বাজারে পড়তে পায় না। তা সে যে ভাষাতেই ছাপা হোক না কেন, লোকে হুড়মুড়িয়ে পড়ে ফেলে। গল্পের বাঁধুনি ভালো হলে অন্য ভাষায় ভাষান্তরিত হতেও সময় লাগে না। ভূত সংক্রান্ত সিনেমা-থিয়েটারেরও একইরকম চাহিদা। সব ভাষায়, সব যুগে ভূত-ভিত্তিক সিনেমা-থিয়েটার জনপ্রিয় । সত্যি বলতে কী, এই পৃথিবীতে যে কয়েকটি জিনিস দেখতে পাওয়া যায় না তাদের একটা তালিকা বানানোর প্রস্তাব দিলে দেখবেন সকলেই সবার আগে ভূতের কথা বলবে। ঠিকই তো, ভূত অর্থাৎ অতীত অথবা তেনারা, কিছুই তো দেখা যায় না।
জানি জানি। এক্ষুণি বলবেন ভবিষ্যৎও তো দেখা যায় না। ঠিকই তো, ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে কত শত ঐতিহাসিক অঘটন এবং দুর্ঘটনা এড়ানো যেত! তা তো করা যায় না। আর অদৃশ্য তালিকার তিন নম্বরের জায়গাটা নিশ্চয়ই দখল করে রয়েছে– কালো টাকা। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি কালো টাকা নাকি সবসময়ই বাজারে খাটছে। অথচ তার মধ্যে থেকে একটা টাকাও কেউ কখনও খুঁজে পেয়েছে কি? এমনকী বছর পাঁচেক আগে কালো টাকা খুঁজে বের করার জন্য বিভিন্ন অঙ্কের টাকার নোট রাতারাতি বাতিল করা হল। তারপর এল নানা রঙের নতুন নতুন নোট। কিন্তু কালো টাকা এল না। এখনও নাকি কালো টাকা স্বমহিমায় বিরাজমান।
না দেখা আরও অনেক কিছুর মধ্যে রয়েছে— নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। প্রতিবেশীর সুখ আমাকে-আপনাকে বিব্রত করে। সহকর্মীর স্বাচ্ছন্দ্যে গায়ে জ্বালা ধরে। কিন্তু ভুল করেও একবারের জন্যেও নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখার কখনও সুযোগ-সময় হয় কি? আজ্ঞে না। এই তালিকা আসলে অন্তহীন। আহা, ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি বলে রাগ করছেন? বেশ তো, ভূত নিয়ে কথার মাঝে না হয় কিঞ্চিৎ ভণিতাই হল। তাতে কী? ঠিক আছে বাবা, আপনার কথা মেনে বরং সরাসরিই প্রশ্ন করা যাক— ভূত দেখবেন? রাজি থাকলে আর দেরি করার কী দরকার! চলুন না, বেরিয়ে পড়া যাক! কোথায়? ভানগড়ের পরিত্যক্ত কেল্লার দিকে!
কখনও ভানগড়ে গেছেন?
চমকে উঠলেন কেন? জায়গাটার নামই শোনেননি? আশ্চর্য ব্যাপার! ভানগড় কিন্তু কোনও কল্পলোকের অচিনপুর নয়। ভূতের ভূত-ভবিষ্যৎ-অস্তিত্ব নিয়ে যাঁরা খোঁজ করছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু খবর রাখেন ভারতবর্ষে একেবারে সরকারি ছাপ মারা আগমার্কা ভূত কোথায় পাওয়া যায়। হ্যাঁ, সেই জায়গাটারই নাম ভানগড়। আলওয়ারের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। দিল্লি থেকে গুরগাঁও হয়ে জয়পুরের রাস্তায় মানে আট নম্বর জাতীয় সড়ক ছেড়ে রাজ্য সড়ক অর্থাৎ এসএইচ ধরুন। খেয়াল করে দেখুন, দিল্লি থেকে দারুহেরার দূরত্ব প্রায় সত্তর কিলোমিটার। দারুহেরা থেকে বাঁদিকের পঁচিশ নম্বর রাজ্যসড়ক ধরে কখনও ঝাঁ-চকচকে, কখনও এবড়োখেবড়ো চেহারার আশি-পঁচাশি কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এলেই এসে যাবে রাজস্থানের অন্যতম জেলা শহর আলওয়ার। হই-হুল্লোড়হীন শান্ত শহর আলওয়ার থেকে শুরু হয়েছে বিখ্যাত পাখিরালয় ‘সরিস্কা’ যাওয়ার রাস্তা, যার সরকারি নাম তেরো নম্বর রাজ্য সড়ক। কমবেশি চল্লিশ কিলোমিটার পথ পেরতে গাড়িতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে।
অনেকটা পথ চলা হয়ে গেছে। এবার একটু বিশ্রাম নিন। সরিস্কা ন্যাশনাল পার্কের সরকারি পান্থনিবাসে খাওয়াদাওয়া সেরে ইচ্ছে হলে একটু জিরিয়ে নিতে পারেন। না হলে আস্তে ধীরে সরিস্কার ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলুন। রাস্তার দু’ধারেই জালের ওপারে চোখে পড়বে হরিণ, ময়ূর, বানর, শুয়োর প্রভৃতি নিরীহ প্রাণি। বিজ্ঞাপনে বড়ো বড়ো করে বাঘের ছবি ছাপা থাকলেও জাতীয় পশুটি বোধ হয় সরিস্কায় অনুপস্থিত। বাঘের খাদ্য বলে পরিচিত প্রাণিগুলির নির্বিকার বিচরণ আরও একবার বুঝিয়ে দেবে যে বাস্তবের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের কত অমিল।
সরিস্কা ছেড়ে আসার মুহূর্তে বাঁ পাশে টাঙানো হলদে বোর্ডের ওপর চোখ রাখলে নজরে আসবে সত্যি সত্যিই ভানগড় বলে একটা জায়গা আছে। খেয়াল করে দেখুন এতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সড়ক-ফলকেই ভানগড় খুঁজে পাননি। অবিশ্যি ভানগড় পর্যন্ত পরের পঞ্চাশ কিলোমিটার পথেও আর কোথাও ভানগড় কথাটা দেখতে পাবেন না। কেন? আগমার্কা ভূতের আস্তানা বলে কথা! ও নাম মুখে আনতে আছে? ওই যে বলে না, তেনারা নাকি কারও নাম মুখে আনেন না। বোধহয় সেই যুক্তিতেই তেনাদের আস্তানার নাম মুখে আনতে নেই। এই পঞ্চাশ কিলোমিটারে পঞ্চাশ তো দূরের কথা গুটি পাঁচেক যানবাহনের মুখোমুখি হলেই ধন্য হয়ে যাবেন। পথচারী? পেলেও পেতে পারেন। তবে তাঁদের সামনে ভুল করেও ভানগড় উচ্চারণ করবেন না। সকালে বিকেলে তো নয়ই, এমনকী ভরদুপুরেও নয়। ভানগড়ের কথা জিজ্ঞেস করলেই দেখবেন তাঁরা কেমন উদাসীন মুখে তাকিয়ে রয়েছেন। তখন আপনার মনে হতেই পারে যে এঁরা সকলে কি আদৌ সত্যিকারের মানুষ?
একের পর এক পেরিয়ে আসা সড়ক-ফলকে লেখা ‘গোলা-কী-বাস্’ দেখে নিশ্চিত হতে পারেন যে ঠিক পথেই চলেছেন। হঠাৎ করে কোনও মানবসন্তানের সাক্ষাৎ পেলে সাহস করে ‘গোলা-কী-বাস্’ সম্পর্কে খোঁজ নিন। হতাশ হবেন না। আঙুল উঁচিয়ে সামনের দিকে যাওয়ার কথা বলে তাঁরা জানাবেন যে একটু এগোলেই রাস্তার ডান পাশে ‘গোলা-কী-বাস্’ এসে যাবে। ‘গোলা-কী-বাস্’ শূন্য লেখা সড়ক-ফলক চোখে পড়া মাত্রই ডানদিকে তাকিয়ে দেখুন। ভাঙাচোরা মোরামের রাস্তাটা যেন একটা টিলার দিকে এগিয়ে চলেছে। আর তার উপর দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এক পাথুরে ধ্বংসাবশেষ। সেখানে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক প্রাচীন কেল্লার কাঠামো। বিধ্বস্ত এলাকাটি বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনও একদিন এখানে ছিল এক বর্ধিষ্ণু জনপদ। ছিল প্রাণের কোলাহল। গাড়ি নিয়েই এগোতে থাকুন। না হলে প্রায় আড়াই কিলোমিটার চড়াই পেরোতে হবে।
বেশি দূর অবিশ্যি এগনো যাবে না। কয়েক মুহূর্ত বাদেই হঠাৎ দেখবেন পথ অবরুদ্ধ। একটি লোহার ফটক বুঝিয়ে দিচ্ছে গাড়ির পথ এখানেই সমাপ্ত। ফটকটির পাশেই রয়েছে নীল রঙের ধাতব বোর্ডের উপর সাদা হরফে স্পষ্ট দেবনাগরী লিপিতে বিজ্ঞাপন। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছে ভানগড় পরিদর্শনের সময় কী কী করণীয়। তাকে বাংলায় তর্জমা করলে এরকম দাঁড়াবে।
ভারত সরকার
ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ ভানগড়
আবশ্যিক নির্দেশিকা
১। সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পরে ভানগড়ে প্রবেশ নিষেধ।
২। কাঠুরে এবং রাখালদের ভানগড়ের চৌহদ্দিতে প্রবেশাধিকার নেই।
৩। ভানগড়ের কেওড়া গাছগুলি ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের সম্পত্তি। এই গাছগুলির কোনওরকম ক্ষতিসাধন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
উপরোক্ত নির্দেশিকা অমান্য করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আজ্ঞানুসারে
অধীক্ষক প্রত্নতত্ত্ববিদ
ফটকের পাশেই রয়েছে পাথুরে প্রাচীর। কোনও এককালে হয়তো এই পাঁচিল দুর্গরক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করত, এখন কিন্তু সারি দিয়ে পড়ে থাকা একরাশ প্রস্তরখণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে গোরু ছাগল ভেড়া মহিষ অনায়াসে তাদের জন্যে নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করে। ওদের অবিশ্যি কোনও দোষ নেই। ওরা তো আর দেবনাগরীতে লেখা সরকারি বিজ্ঞাপন পড়তে পারে না। ওদের যারা দেখভাল করে সেই রাখালেরাও কি পারে? আপনি-আমি অবিশ্যি নিয়ম মেনে ফটক পেরিয়েই ভেতরে ঢুকব। দুর্গের ভিতরে প্রবেশের এই প্রধান ফটকের নাম হনুমান দরওয়াজা। খেয়াল করুন, ঢোকার মুখে কোনও গাইড কিন্তু আপনাকে দেখেই ছুটে এসে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেনি। চারপাশে ভিডিয়ো ক্যামেরা কাঁধে ঝোলানো একজনও বিদেশি পর্যটক চোখে পড়বে না। এমনকী দেশের যে-কোনও প্রত্যন্ত প্রান্তে বেড়াতে গেলে যার দেখা অবশ্যই পাওয়া যায়, সেই বাঙালি পর্যটকও এখানে অনুপস্থিত। সত্যি বলতে কী নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো দর্শনার্থীকে আপনি দেখতে পেলে সেটা হবে নেহাতই এক বিরল ঘটনা।
দর্শনার্থীর সন্ধান না করে বরং মন দিয়ে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ প্রদর্শিত মানচিত্রটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুন। রাজস্থানের অন্যান্য দুর্গ-শহরের মতো এখানেও একে একে খুঁজে পাবেন সদ্য পেরিয়ে আসা হনুমান দরওয়াজা থেকে শুরু করে লাহোরি, আজমেরি, ফুলবাড়ি এবং দিল্লির নামাঙ্কিত ফটক। হনুমান, মঙ্গলাদেবী, গণেশ, গোপীনাথ, কেশবরাই এবং সোমেশ্বরের মন্দিরের অবস্থান মানচিত্রে দেখতে পাবেন। বাস্তবে এখন অবশ্য অধিকাংশই ধ্বংসস্তূপ। মানচিত্র আপনাকে জানাবে এককালে এই দুর্গশহরে কোথায় ছিল বাজার আর কোথায়ই বা ছিল মদন-কী-হাভেলি, স্নানাগার, কুয়ো, নজরমিনার, পুরোহিত-কী-হাভেলি এবং রাজপ্রাসাদ।
আপাতদৃষ্টিতে মোরাম বিছানো মনে হলেও দুর্গের ভেতরের দিকের এগিয়ে যাওয়া রাস্তাটা আসলে একেবারেই সাদামাটা কাঁচা রাস্তা। পাথুরে জমিকে রাঙামাটির পথ বলার চেষ্টা করলেও আসলে পাহাড়ের ওপরে তৈরি পথটা দেখে মনে হবে রাস্তাটা কোনও এককালে পাথরে বাঁধানো হয়েছিল। এখন পুরোপুরি ভাঙামাটির পথ। পথের দু’পাশে তো বটেই, অন্যত্রও ছড়িয়ে রয়েছে শুধু অসংখ্য কেওড়া গাছ। উপলসমৃদ্ধ ঊষর ভূমিতে সবরকমের গাছ কি টিঁকে থাকতে পারে? পাথুরে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে পায়েচলা পথ ধরে এগোতে থাকলে প্রথমেই চোখে পড়বে দু’পাশেই সাজানো রয়েছে একই আকার-আয়তনের সারিবদ্ধ ঘরের ধ্বংসাবশেষ। পাথরের তৈরি দেওয়াল এবং ঘরগুলির চেহারা বুঝিয়ে দেবে যে এককালে এগুলি দোকানঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত।
বাজার ঘোরা শেষ করে আস্তে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দে বুঝতেই পারবেন না পাহাড়ি পথের চড়াই ধরে পায়ে পায়ে কতটা উঁচুতে চলে এসেছেন। চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য স্থাপত্যের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন যে এখানে সত্যি সত্যি এককালে একটা সমৃদ্ধ জনপদ ছিল! চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ এবং এখনও পর্যন্ত টিকে থাকা কতিপয় মন্দির-প্রাসাদ-বাসগৃহ বিস্মিত নয়নে পর্যবেক্ষণের পর হঠাৎ বাঁদিকে তাকালেই নজরে আসবে পাথর বিছানো এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নিষ্পৰ্ণ বৃক্ষ। জাতে কেওড়া হলেও এ গাছের যেন মাথা উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার স্পর্ধা নেই। মাটি থেকে শুকনো কাণ্ডটা কিছুটা সোজা হয়ে থাকলেও তারপরেই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সমান আকারের আঁকাবাঁকা আকৃতির দুটি শাখা দু’দিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে মনে হতেই পারে কোনো এক দক্ষ ভাস্করের নিপুণ হাতে রচিত হয়েছে মানুষের অবয়বের এক নিখুঁত ভাস্কর্য।
কল্পনাবিলাসের সময় অবশ্য বাস্তবের মাটিতে একটু সতর্ক থাকা প্রয়োজন। চারপাশে ঘুরে বেড়ানো বানরের দল যে কোনও মুহূর্তে আপনার চোখের চশমা বা কাঁধের ঝোলা নির্বিকারচিত্তে ছোঁ মেরে উধাও হয়ে যেতে পারে। ডারউইনের তত্ত্ব অনুসারে মানুষের অতি প্রাচীন পূর্বসূরিরা কিন্তু উত্তরসূরিদের একটুও করুণা করবে না। আর রয়েছে ময়ূর। চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কেওড়া গাছের চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অজানা-অচেনা মানুষের উপস্থিতিকে মনে হয় না ওরা খুব একটা গ্রাহ্য করে। বর্ষাকাল তো দূরের কথা, আকাশে যখন মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই, এমন গনগনে রোদের দুপুরেও পেখম মেলে দিব্যি বিচরণ করছে। তবে সবাই নয়। ভাবখানা এমন যে যার যখন ইচ্ছে সে তখন পেখম মেলে দিচ্ছে।
ভানগড় কেল্লার ভাঙাচোরা অন্দরে
এবার গোপীনাথ মন্দিরের ভেতরে একটা চক্কর লাগানো যাক। মন্দিরটি এখনও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়নি। মন্দিরে বিগ্রহ নেই। তবে দেওয়ালে ছড়িয়ে রয়েছে গণপতি-সহ অনেক দেবদেবীর পাথর কুঁদে তৈরি করা প্রতিকৃতি। আপাতদৃষ্টিতে নড়বড়ে মনে হলেও একটু সাহস সঞ্চয় করে প্রাসাদেও ঢুকে পড়তে পারেন। পাথর খসে পড়বে না। সদর পেরিয়ে একটু এগোলেই একটা সুড়ঙ্গের আভাস পাবেন। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। হাতে টর্চ আর বুকে দম থাকলে ভেতরে যেতে পারেন। তবে কয়েক ফুট এগিয়েই পিছিয়ে আসতে হবে। ডান দিকে বেঁকে গিয়ে সুড়ঙ্গটা যেন এবার পাতালের দিকে এগিয়ে চলেছে।
বীরত্ব দেখিয়ে কাজ নেই বাবা। এইরকম ঘন অন্ধকার জমেই তো ভূত জন্মায়! তাদের বিরক্ত করার চেয়েও বড়ো কথা, গভীরতা জানা না থাকায় হঠাৎ করে না-জানা কোনও অতলে তলিয়ে যেতে পারেন। পথ পালটিয়ে বরং প্রাসাদের দোতলায় চলুন। চাই কী হাঁটুতে জোর থাকলে তিনতলার ছাদেও যেতে পারেন। সাবধান, পা যেন হড়কিয়ে না যায়। এ তো আর এখনকার বাড়ির একতলা-দোতলা নয়, যে ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে হাত তুলে দিলেই সিলিং ছোঁয়া যাবে। ভাঙাচোরা পাথরের সিঁড়ি বেয়ে একেকটা তলা উঠলেই মনে হবে এবার একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। তীব্র সোঁদা গন্ধ অবিশ্যি সে সুযোগ দেবে না। আর একবার ওপরের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন ঘরগুলির সিলিং জুড়ে চলছে বাদুড়-চামচিকের রাজত্ব। বোঁটকা গন্ধের সূত্র খুঁজে পাওয়ার পরে দম বন্ধ হওয়া পরিবেশটা যেন আরও বিশ্রী হয়ে উঠবে। ভেঙে পড়া পাথরের প্রাসাদ, পাতালমুখী সুড়ঙ্গ আর বাদুড়-চামচিকের বসবাস এককথায় ভূতের গল্পের আদর্শ আবহ। ভয় জয় করতে পারলেও দুর্বিষহ গন্ধে বমি চেপে রাখা বেশ কষ্টকর।
(চলবে)
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: banglalive.com;
*ছবি সৌজন্য: Hindu, Scrolldroll, Makemytrip
Add comment