একার জীবন
রমা সিনহা বড়াল, ১৯৭৬, স্থাপত্য বিভাগ।
সন্ধ্যাবেলায় ছোট জা মিত্রার ফোন এল,
“দিদিভাই কেমন আছো? কাল একবার দেখা করতে যাব বাড়ি থাকবে?” কাবেরী বলে।
জবাবে বলি,”হাঁ রে বাড়িতেই আছি। এই গরমে কোথায় আর যাবো? বাড়িতেই আছি , চলে আয়।”
এখনকার দিনে না জানিয়ে কেউ অন্য কারোর বাড়ি যায় না। সকলেরই ছোট ছোট সংসার কিন্ত দায়িত্বভার অনেক। মিত্রা গৃহবধূ, তাঁদের একই মেয়ে, পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করছে। আর কাবেরী পঁয়ত্রিশ বছর সরকারি অফিসে উচ্চপদে চাকরি করে সম্প্রতি অবসর নিয়েছে। তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে, দুজনেই চাকরি করে, তাঁদের বিয়েও হয়ে গেছে। দুজনেই নিজেদের অফিসের বন্ধুকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছে।
পরদিন বিকেলে মিত্রা এলো। নানান কথার পর মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা হল। মেয়ের অফিসের এক কলিগ’কে তার ভালো লাগে কিন্ত ছেলেটির মনের কথা সে বুঝতে পারে না। তাই সে তাঁর বিয়ের পাত্র ঠিক করার দায়িত্ব নিজের মাকেই দিয়ে দিয়েছে। আর মিত্রা মেট্রিমনিয়ালে যোগাযোগ রেখেছে ঠিকই, কিন্ত একটাও পছন্দ মতো পাত্র পাচ্ছে না। কাবেরী সব শুনে বললো, মেয়েকে বল তার কলিগ’কে মনের কথা বলতে। কথাটা মিত্রার পছন্দ হলো না। বললো ,”না, আমার মেয়ে কেন নিজেকে ছোট করবে?” কাবেরীর মাথায় এলো না এতে ছোট করার কি হলো?
আসলে মিত্রার নিজের স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট এক সংসার। ভীষণই আত্মকেন্দ্রিক। তাঁরা যা কিছু করে বা ভাবে সব এই তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কাবেরী আজ অবধি মিত্রাকে কারোর জন্য কিছুই করতে দেখেনি। অথচ তাঁদের জন্য সবসময় অন্য সবাই কিছু করবে সেটাই সে আশা করে। ফলে বাপের বাড়ি , শ্বশুর বাড়ি কোথাও সে তার এই স্বভাবের জন্য প্রাধান্য পায় না।
অবশ্য শুধু একা মিত্রা কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আগে যৌথ পরিবারে সবাই সকলকে নিয়ে থাকতো। কিন্ত এখনের এই ছোট ছোট সংসারে পারিবারিক সম্পর্ক গুলি ব্রাত্য হয়ে গেছে। তার ফলে আমাদের এখনের সমাজের গঠন এমনই হয়ে গেছে যে চারপাশে শুধু প্রতিযোগিতার পরিবেশ। ফলে এখনকার বাচ্চারা হয়ে উঠছে জেদী, স্বার্থপর, ও আত্মকেন্দ্রিক। এই অবস্থার জন্য দায়ী বাচ্চারা নয়, দায়ী তাঁদের মা, বাবারা। যৌথ পরিবারের আবহাওয়াতে বড়ো হওয়া এই অভিভাবকেরা যখন নিজেরা ছোট ছোট পরিবার সৃষ্টি করলো, তখন তাঁদের অনেকেই হয়ে উঠলো স্বার্থপর। আর তাঁদের সংস্পর্শে বড় হয়ে ওঠা তাঁদের সন্তানরাও সেইরকমই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
কাবেরীর জন্ম ছোট শহরের এক বনেদী যৌথ পরিবারে। তাঁর বাবারা ছিলেন ছয় ভাই, চার বোন, সকলেই একই বাড়ির, একই ছাদের নীচে একসঙ্গে থাকতেন। এমনকি সে সময় একটা পাড়ার জন্যও অনুভূতির প্রকাশ ছিল। কেউ মারা গেলে বা অসুস্থ হলে পাড়া প্রতিবেশীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে শ্মশানে বা হাসপাতালে রাত কাটানোর জন্য সাহায্য করতেন। কিন্ত এখন বাড়ির অভিভাবকরাই সে কাজে নিজেদের সন্তানদের যেতে বাধা দেন। এখন সেই আগের মতন “ফেলো ফিলিংস বা অপরের কথা একটু ভাবো,” ব্যাপারটাই অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাই তো আজ মা বাবার বৃদ্ধ বয়সে ঠাঁই হয় বৃদ্ধাবাসে। তবে সবাই যে বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাবাসে থাকেন তাও নয়। কিছু মানুষ সংসারের মানুষদের স্বার্থপরতায় বিরক্ত হয়ে বৃদ্ধাবাসে ঠাঁই নেন।
আজ আত্মকেন্দ্রিক মানুষদের বাড়িতে সবকিছুই আছে, নেই খালি পরম আত্মীয়র ভালবাসা ও সহমর্মিতা। তাই তো আজ মিত্রার আশি বছরের বিধবা মা রাজারহাটের নামী বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। অবশ্য সেই কারণে মিত্রা বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়। মিত্রার বাবা মারা যাবার পর ওর মা যখন ক্রমশই দুর্বল ও বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন, তখন মিত্রার বিরক্তি দেখে কাবেরী খুবই অবাক হতো। কতবার ছোট জা’ কে সংযত হতে বলেছে, ও শোনেনি। কাবেরীকে বলে দিয়েছিলো, তাঁর ব্যাপারে যেন মাথা না ঘামায়।
মিত্রার বাবা সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। একমাত্র মেয়ে মিত্রাকে ভালভাবেই পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করেছিলেন। চেয়েছিলেন বিয়ে করলেও সে যাতে স্বনির্ভর হয়। কাবেরীর দেওরের সে ব্যাপারে আপত্তি ছিলো না। কিন্ত আত্মসুখী মিত্রা তার বরকে নিয়ে আলাদা সংসারে থাকাই পছন্দ করলো। অশান্তি এড়াতে বর সেটা মেনেও নিল। মিত্রার মেয়ে সুনেত্রার জন্ম হবার পর বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য প্রায়ই নিজের মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতো। আর মিত্রার বাবা অবসর নেওয়ার পরেই মিত্রা দুজনকেই নিজেদের কাছে এনে রাখলো। আর সেই মা, বাবা বাচ্চার সব দায়িত্ব নিজেদের কাঁধেই তুলে নিলেন। মিত্রাও সন্তানের সব দায়িত্ব মা ,বাবার উপর অর্পণ করে দিলো। আর সে বাচ্চার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ক্লাব, পার্টি , শপিং ইত্যাদিতেই ব্যাস্ত হয়ে উঠলো। সুনেত্রা ধীরে ধীরে বড়ো হলো, স্বাবলম্বী হলো নিজের দাদু, দিদার সাহচর্যে। অন্যদিকে বয়সজনিত কারণে দাদুভাইরাও অসুস্থ হতে লাগলেন, আর মিত্রারও বিরক্ত হওয়া বাড়তে লাগলো।
বাড়িতে তাঁর নিজের বাবার শরীর খারাপ। ডাক্তার, ওষুধের খরচ বাড়ছে, যদিও সেই খরচ তাঁর বাবাই বহন করতেন। মা, বাবার প্রতি মিত্রার এই আচরণ কাবেরীকে খুব কষ্ট দিতো। কিন্ত কিছু বলতে গেলেই তাঁর নিজের ছোট জা পরিবর্তে অনেক কথা শুনিয়ে দিতো।
বছর খানেকের মধ্যেই একদিন ঘুমের মধ্যেই মিত্রার বাবা মারা গেলেন। মিত্রার মা নিজেকে খুব একলা ও অসহায় বোধ করতে লাগলেন। কারণ মিত্রা তাঁর মা সুনয়নী দেবীকে খুবই মানসিক যন্ত্রণা দিতো। অসহায় সুনয়নী দেবী কাবেরীর সাহায্য নিয়ে “আলোর ঠিকানা” নামে এক বৃদ্ধাশ্রমে যোগাযোগ করলেন। শহরের উপকন্ঠে নিরিবিলি এই পুকুর, ফুলের বাগান ঘেরা একতলা বাড়িটি খুব পছন্দ করে সেদিনই ঘর বুক করে এলেন।
সুনয়নী দেবী এসে উঠলেন তাঁর নতুন ঠিকানা এক বৃদ্ধাশ্রমে, অবশ্যই মেয়েকে জানিয়ে। এতদিন বাদে অ্যাটাচ্ট বাথরুম দেওয়া দুশো স্কোয়ার ফিট এসি ঘরে তিনি এবার সেই মানসিক ও শারীরিক আরামটি পেলেন যার অভাব তিনি এতদিন নিজের মেয়ের বাড়িতে অনুভব করছিলেন। আশ্রমের পরিবেশ তাঁর একাকীত্ব ও একমাত্র মেয়ের, নাতনীর খারাপ ব্যবহার ভুলে গিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার রসদ দিলো। তাঁর ফ্যামিলি পেনশানের টাকাতেই নিজের খরচ চালাতেন। তাঁর জামাই মাঝে মাঝে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেত, কিছুক্ষন গল্প করে যেতো। মিত্রার হীন স্বভাব তাকে পীড়িত করতো, কিন্তু অশান্তি হবে, এই কারণে মিত্রাকে কিছুই জানাতো না। ক্রমশ সেও মিত্রা থেকে দূরে চলে যেতে লাগল। অফিস ট্যূরে বেশী সময় দিতে লাগল। কাবেরীর খুব খারাপ লাগতো কিন্ত কিছুই করার ছিল না। মিত্রা ক্রমে একলাই হয়ে গেলো। যেহেতু সে শুধু নিজেকেই ভালবাসতো তাই নিজের একাকীত্বটাও সে বুঝতে পারতো না। কাবেরীর কাছে ,মিত্রার এই জীবন যেন এক অভিশপ্ত জীবন বলে মনে হলো।
সুনয়না দেবী ধীরে ধীরে আশ্রমের পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। ভোর পাঁচটার সময় মহারাজের কণ্ঠে সুমধুর বেদগানে ঘুম ভাঙ্গে। তারপর আরো পাঁচজন আশ্রমবাসীর সাথে সামনের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে পূর্ব জীবনের সুখদুঃখের গল্প করেন। চারপাশের নানান পাখির ডাক, নানান ফুলের মিষ্টি গন্ধ, ভোরের ঠান্ডা বাতাস মনকে এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে তোলে। মাসখানেকের মধ্যেই তিনি নিজের পূর্ব জীবনের সকল তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে গেলেন।
আশ্রমের শৃঙ্খলা ও জীবন সুনয়না দেবীকে শারীরিকভাবে অনেকটাই সুস্থ করে দিলো। কর্মক্ষমতা বেড়ে গেল। তিনি মহারাজকে আশ্রমের কর্মীদের বাচ্চাদের পড়াবেন, এই প্রস্তাব দিতেই মহারাজ সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। আর সুনয়না দেবীও বেঁচে থাকার নতুন রসদ খুঁজে পেলেন।
একদিন কাবেরী দেওরকে নিয়ে আশ্রমের কাছে আসতে আসতে উদাত্ত কণ্ঠে কতদিনের পরিচিত সুনয়নী দেবীর গলায় শুনতে পেলো “চিত্ত যেথা ভয় শূণ্য, উচ্চ যেথা শির” খুবই অবাক লাগলো। হলঘরে পৌছে দেখে সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেই আরাধনায় মেয়ে, জামাই, নাতনী ও তার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন।
সেই পূজোর দিনে মিত্রা ছাড়া সবাই এলো।সুনয়নী দেবী জামাইকে বললেন যে মেয়ে মিত্রাকে নিয়ে আসতে। অনেক সাধ্যসাধনার পর মিত্রা এলো। বাড়ির সবাইকে কাছে পেয়ে সুনয়নী দেবীও খুব খুশী হলেন। বললেন “আমার যাবার সময় হলো, তোমরা সবাই আনন্দ করে একসাথে থাকো। জীবনে এর চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে পাবে না। ভাল থেকো সবাই। আমি মা, তাই সকলের ভালো চাই। আনন্দে থেকো, সুস্থ থেকো সবাই”।
মায়ের এই আর্শীবাদ মিত্রার চোখে জল এনে দিলো। সে কাঁদতে কাঁদতে মা’কে বলতে লাগল “আমাকে ক্ষমা করো মা, আমি আর একা থাকতে পারছিনা”।
মা হেসে বলেন, “পাগলী মেয়ে, একা কোথায়? এই তো সবাই রয়েছে। সবার সাথে থাক। দেখবি ভালো লাগবে।”
মিত্রা যেন এবার “নিজের একার, শুধুমাত্র নিজে জীবনের একাকীত্বের” কষ্ট বুঝতে পারলো।
প্রত্যেকটা গল্প খুব ভালো।