সাহিত্যিকা

আমার যে দিন – বন্দনা মিত্র

আমার যে দিন
বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

বর্ষা এখনও বিদায় নেয় নি, কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা স্থান পরিবর্তন করেছে। বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, উত্তরাষাঢ়া, পূর্ব আষাঢ়া, শ্রবণা ভদ্রা পেরিয়ে সাতাশ ভগিনীর একমাত্র প্রিয়তম চন্দ্রদেব পা রেখেছেন অশ্বিনী নক্ষত্রে। তাঁর মরিমরি রূপ সোনার থালা বেয়ে, রূপার মুদ্রার মত ঝলকে ঝলকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে মহাবিশ্বে , মহাকাশে এবং আমাদের এই সুজলা, সুফলা, শ্যামলিনী, চিরকিশোরী বঙ্গদেশের মাটির আঁচলে। রোদে লেগেছে সোনার ছোঁয়া, শিউলির গন্ধে ম ম করে গদাই দা’র বিশুদ্ধ পাঁঠার মাংসের দোকানের গলি। সল্টলেকের ফাঁকা প্লটে আধা খ্যাঁচরা উঠতে উঠতে থেমে যাওয়া ইঁটের খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে কাশফুলের শুভ্র তুলির দোলা, যেন প্লটের একদা মালিক বিধানবাবুর শুভ্র কেশর – বিধানবাবু , যিনি কাঁচিয়ে তোলা প্রভিডেন্ট ফান্ড ও এন আর আই ছেলের ভরসায় ছোট্ট একতলা বাড়ি তুলতে তুলতে একসময় হিসেব মেলাতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছিলেন – ছেলে গ্রীন কার্ড নিয়ে সাগর পাড়ে থেকে গেছে, ভদ্রলোক পিস হেভেনে কিছুদিন কাটিয়ে এখন কোথায় বলতে পারব না। সরকার শেষমেশ ভাঙা রাস্তার খানা খন্দ ইঁটের চোকলা দিয়ে ভর্তি করার কাজে নেমে পড়েছেন। আকাশে বর্ষার মেঘের সঙ্গে টুকি টুকি খেলতে খেলতেই কখন অমল ধবল পালে মন্দ মধুর হাওয়া লাগিয়ে নৌকা খুলে বেড়িয়ে পড়েছে চির হুজুকের দল।
বাঙালি জাতি, তার দৈনন্দিন অবসরযাপন – যে পলকা শাখায় স্বয়ং উপবিষ্ট, তাহাকেই সানন্দে করাত কর্তনের সাধুকার্যে স্বল্প বিরতি দিয়ে এবং প্রাত্যহিক পরনিন্দা পরচর্চা, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, লাল, সবুজ, গেরুয়ার বর্ণহীন মারামারি কাটাকাটি আপাতত থো করে অস্বস্তির সঙ্গে ভাবছেন – “ আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে কি জানি পরাণ কি যে চায়”। কর্মপিপাসীর কর্ণকুহরে কে যেন বলে গেছে – “ওরে বেলা যায়”। গত তিন মাস দারা পুত্র কলত্র যে অসম্ভব সাধন করতে পারে নি, আশ্বিনের এই মিঠে রোদটুকু সেই কাজ হেলায় করে ফেলেছে। অমুক বাবু প্রোমোশনের লোভ, পিংক স্লিপের ভয়, ইনক্রিমেন্টের টোপ সব অগ্রাহ্য করে পনের দিনের ছুটির আবেদন করে নেটে মেক মাই ট্রিপ খুলে বসেছেন, চুলোয় যাক করপোরেট ল্যাডারের সাবধানী পদক্ষেপ, কলকাতা যাওয়ার শেষ ফ্লাইটের শেষ টিকিটটা না ছুটে যায়। কি প্যাডে দ্রুত হাত চালাতে চালাতে কোথাও কিছুনা, ভাবনা ভেসে আসে – “ মাকে কতদিন দেখি নি! ভিডিও কলে কি মন ভরে!” কি প্রচন্ড মনখারাপের মেঘ হঠাত ছেয়ে ফেলে অফিসের নিরাসক্ত কিউবিকল।

কুমোরটুলি বরাত গোণে। পুজোর আগে এ পাড়ায় ক্যামেরা কাঁধে আনাগোনার ভিড় হয় আজকাল। প্রতিমার সৃষ্টিপর্বটিও চড়া দামে বিক্রি হয়। দুগগা ঠাকুর এখন ইন্টারন্যাশনাল, সাগর পাড়ি দিয়ে পুজো নিতে যান। হক কথা যে তিন বাঙালি এক জায়গায় হলে দুটো দল করে। কিন্তু চার পাঁচ বাঙালি এক জায়গায় হলেই যে দুর্গা পুজোর প্ল্যান করতে বসে, সঙ্গে সুরে বেসুরে গানের আসর, কাঁচা পাকা হাতে গল্প, অখাদ্য বা অসাধারণ কবিতা সম্বলিত ক্রোরপত্র এবং অবশ্যই ভোগের খিচুড়ি ও লাবড়া, পাঁঠার মাংস ও লুচি, শেষ পাতে রসগোল্লা ও পায়েস এবং last but not the least – বিজয়ার কোলাকুলি, শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সেটাও তো হক কথা, সেটাও তো বলতে হয়।

আমাদের একমেবাদ্বিতীয়ম ঠাকুর, সেই রবিঠাকুর বলেছিলেন “দুর্গা পূজা বাঙ্গালীর অম্বিকাপূজা”। দুর্গা পূজার আদি ও অকৃত্রিম থিম ছিল বছর শেষে মাত্র কয়েকটি দিনের জন্য গেরস্স্থ ঘরের বাঙালি কন্যার সংসার থেকে ছুটি নিয়ে বাপের বাড়ি আসা। মহিষাসুরমর্দিনী, দশভূজারূপে সংসারের গুরু দায়িত্বভারে, কর্তব্যভারে ক্লান্ত মেয়েটির মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য আবার সেই গৌরী কন্যকারূপে দায়ভারহীন চপলচরণে চেনা উঠানে খেলে বেড়ানো। দুর্গাপূজায় উমা তাই আমাদের ঘরের মেয়ে, যাকে ভক্তিভরে প্রণাম না করে মুখে তাম্বুল সন্দেশ ভরে কানে কানে বলি – আবার এসো মা, পুনরাগমনায়চ।

তবে কিনা – “বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আরাম।” তাই এখন তো থিম বদলে গেছে। দিনকালও পালটে গেছে। দুর্গাপূজা এখন আর উমা তার চার সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ি আসার গল্প নয়। সারা বছর অপেক্ষা করে পঞ্চমীর দিন নতুন জামা নতুন জুতো হাতে পাওয়ার গল্প নয়। ভোর চারটের সময় বোধনের ঢাকে কাঠি পড়লে তড়াক করে লাফিয়ে কলাবউ চান দেখতে যাওয়া নয়। ষষ্ঠীর সন্ধে বেলা পুরুতমশাইএর চারদিকে জড়ো হয়ে মায়ের অস্ত্রদান, নেত্র দান দেখা নয় – নিজেদের মধ্যে বলাবলি “দেখ দেখ মায়ের চোখটা কেমন জ্বলজ্বল করছে, যেন সত্যি।” বয়সে সামান্য বড় দিদিভাই ধমক দেয় -”যেন মানে? ওতো সত্যিই।”

পূজার আয়োজন- নীল পদ্ম – একশ আটটা! বেলপাতা – নিখুঁত তিন পত্র। আরতির ধোঁয়ায় জ্বালা করা চোখে পঞ্চপ্রদীপের ভাপ। চামর দোলানো – ঐটা ছিল ছোটদের কাজ। শাঁখ বাজানো মানে বড়দের দলে পারমিশন। সকাল থেকে উপোস করে অঞ্জলি দেওয়া? একে অপরকে টেক্কা দেওয়া “ আমি কিন্তু একফোঁটা জলও খাই নি, তুই তো সকালে চা খেয়েছিস।” বড়রা সবাই সমস্বরে বলে ওঠে – চায়ে দোষ নেই, চায়ে দোষ নেই। এমন কি পুরুত ঠাকুরও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সায় দেন। বছরে একটিমাত্র বার বাঙালি রক্ষণশীল পরিবারে শাসন শিথিল করে রাতভোর ভাইবোন মিলে অল্পবয়সী ছোটকাকা বা ছোটমামার অভিভাবকত্বে ঠাকুর দেখা । আমাদের ছোটবেলায় প্রতিটি উৎসব ছিল ভ্যালেন্টাইনস ডে – – দুগগাপুজো, সরস্বতী পুজো, দোল – অবেলায় শাড়ি পরলেই মুগ্ধ চোখের হা পিত্যেশ। সে মজার খবর এখন আর কেউ জানে না। আর ঢাকের বাজনা? বোধনে কাঠি পড়ত ,”মা এসেছে মা এসেছে, ঢ্যাম কুড় কুড় ঢ্যাম কুড়, গিজতা গিজাং ঢ্যাম কুড়কুড়, মা এসেছে ঢ্যাম কুড় কুড়।” সেই বোল পালটে যেত দশমী বিকেলে – “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ /ঠাকুর যাবে বিসর্জন।”

শ্মশানবাসী মহাদেব অধীর অপেক্ষায় আছেন কখন নীলকন্ঠ পাখি মর্ত্য থেকে উড়ে এসে জানাবে , “ঠাকুর, নেশার দ্রব্যি ছুঁড়ে ফেল, বাঘছালখানা জড়িয়ে সভ্যি ভব্যি হয়ে বসো দিকিনি, মা রওনা দিয়েছেন। এসে তোমার এই হাল দেখলে প্রলয় বাঁধাবেন।” আমাদের পাগলা ভোলা নন্দী ভৃঙ্গীকে নিয়ে কৈলাসের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন – শিবানী ঘরে না থাকলে তাঁর ঘর ছেড়ে বাউন্ডুলে হতে ভাল লাগে না। এসব আমাদের ছোটবেলার সাতপুরোনো বাসি গল্প। ঐ চারদিন মা দুগগা, তাঁর চার ছেলে মেয়ে, তাঁদের অস্ত্রশত্র, তাঁদের বাহন এমনকি গণেশদাদার কলাবউ, শৌর্যময় মহিষাসুর, জয়া বিজয়া -সকলে আমাদের বড্ড নিজের হয়ে যেত। বিজয়ার দিন আত্মীয়বিচ্ছেদের কষ্ট হত। দূরের আত্মীয়েরা একে একে ফেরত যেতেন, নতুন জামা পুরোন হয়ে যেত। দিন গুণতাম এই তো লক্ষীপুজো, তার পরেই কালী পুজো, তারপর ভাই ফোঁটা । তারপরেই ইস্কুল খুলবে, ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা। কি হবে! কিছুই তো পড়ি নি! নীচে রান্নাঘর থেকে মায়ের চিৎকার – “অনেকতো পুজো হয়েছে, আর কিছু নেই, এবার একটু পড়তে বসো। “বাবার মজার গলায় নিরীহ প্রশ্ন – বইগুলো আছে না ঠাকুরের সঙ্গে তাদেরও বিসর্জন দিয়েছিস?”

আমি বইপত্র ঝেড়েঝুরে পড়তে বসি – পড়ার বইএর তলায় রাজ্যের শারদীয়া – কিছু কেনা, কিছু জোগাড় করা, কিছু আবার নিষিদ্ধ, লুকিয়ে হাত সাফাই। পাশের বাড়ি চলতে থাকা বিবিধ ভারতী থেকে পুজোর গান ভেসে আসে – হেমন্ত, মান্না, কিশোর, শ্যামল মিত্র, লতা, আশা, সন্ধ্যা। এতদিনে লাইনগুলো মুখস্ত হয়ে গেছে। আমি মনে মনে গাইতে থাকি। গেয়েই চলেছি।
“আমার যে দিন ভেসে গেছে/ চোখের জলে।”

Sahityika Admin

1 comment

  • খুব ভালো লাগল । লেখার ভাষা , ভাবনা ও সব মিলে মনকে স্পর্শ করে ।