সাহিত্যিকা

হে মহাজীবন – হেলেন চ্যাটার্জি

হেলেন চ্যাটার্জি, প্রফেসর পিএন চ্যাটার্জির কন্যা

‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না, কিন্ত যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে।’ বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।’

‘জীবনস্মৃতির’ এই প্রথম লাইনগুলো পড়তে পড়তে মনে হল আজ আমিও এক ছবি আঁকব।সে ছবির নাম ‘আমার রবীন্দ্রনাথ ‘।

বঙ্গে এখন শ্রাবণ মাস।এমনই এক শ্রাবণের বাইশ তারিখে তেরশ আটচল্লিশ  বঙ্গাব্দে গুরুদেব গিয়েছিলেন অনন্তযাত্রায়। যে ঐশ্বর্য তিনি আমাদের  জন্য রেখে গেছেন তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ আমরা  সারাজীবন ধরে লালন করে নিজেদের সমৃদ্ধ করে চলেছি।

বি ই কলেজের ক্যাম্পাসে আমাদের বাড়ি ছিল একেবারে গঙ্গার ধারে। দক্ষিণের ঘরের জানালা থেকে আমি দেখতাম মাঝি খড়ের গাদা নিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছে। গঙ্গায় জোয়ার-ভাঁটা আসত। পড়াশোনা ছেড়ে আমার বেশিরভাগ সময় কাটত জানালার ধারে,প্র কৃতিকে অবলোকন করে। ছোটবেলায় আমরা রেডিওতেই গান শুনতাম। তখন তো দূরদর্শন ছিল না। হঠাৎই একদিন রেডিওতে শুনলাম ‘নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি’। তখন আমার একটু বোধবুদ্ধি হয়েছে।আমি চমকে উঠলাম। আমার সারা শরীরে শিহরণ। এ গান কে লিখেছেন? সে এক অনন্য অনুভূতি। সেই সুর,সেই গান আমার শ্রবণে মননে আবেশ ছড়িয়ে দিল।

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। ‘সহজ পাঠের’ সাথে হল আমার নিবিড় বন্ধুত্ব। ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে’, ‘কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি’। এই সোনার বাংলাকে তিনি তুলি দিয়ে এঁকেছেন সোনার রঙে। ছোট ক্লাসে পাঠ্য ছিল ‘শিশু’। ‘খোকা মাকে শুধায় ডেকে’, ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।’

বাড়িতে ছিল ‘সঞ্চয়িতা’। যখন ভাল করে বাংলা পড়তে শিখলাম, তখন কবিতাগুলো পড়তে শুরু করলাম। মনে হত তাঁর তাঁর লেখা সব কবিতা পড়ি। বাড়িতে ছিল রবীন্দ্ররচনাবলীর শতবর্ষ সংস্করণ। ‘গল্পগুচ্ছের ‘ছোটগল্প পড়ে মনে হত এ তো শব্দ দিয়ে ছবি এঁকেছেন এক মহান প্রতিভাবান চিত্রকর! ‘দেনা পাওনা, গুপ্তধন, নষ্টনীড়, পোস্টমাস্টার’। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? আরও বড় হয়ে চমকে উঠেছিলাম ‘ঘরে বাইরে’ ‘চোখের বালি’,’শেষের কবিতা’ উপন্যাস পড়ে। কি সূক্ষ্ম চরিত্রচিত্রণ!

ভারতী স্কুলে আমরা নাচগান শিখতাম। ‘শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’। বৃষ্টির ঐ রিমিঝিমি ধ্বনি আমার কানে বাজত, প্রাণেও বাজত। ইনস্টিটিউট হলে একটা বার্ষিক অনুষ্ঠান হত। শ্যামা, কালমৃগয়া, চণ্ডালিকা, ভানুসিংহের পদাবলি- নৃত্যনাট্য  হয়েছিল। সেই প্রথম শুনলাম ব্রজবুলি ভাষায় রচিত ‘গহনকুসুমকুঞ্জ মাঝে,’ ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান ‘।তাসের দেশে আমি ও জোনাকি প্রধান চরিত্রে। ‘যাবই আমি যাবই,বাণিজ্যেতে যাবই আমি যাবই’।রাজপুত্র, সওদাগরপুত্র চলেছে নূতন দেশের সন্ধানে।

বাড়িতে রেকর্ডে বাজত শাপমোচন, শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা,চণ্ডালিকা। হৃদয়ে মনে তখন এক অপরিসীম আনন্দযজ্ঞ!

এইভাবেই একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথ আমার   শিরায় ধমনীতে, অণু পরমাণুতে প্রবাহিত হতে লাগল। রবীন্দ্র চেতনায় আমি তখন আচ্ছন্ন। তাঁকে আমি ধূপের ধোঁয়ায়,ফুলের মালায় ঢেকে রাখি নি। তিনি হলেন আমার পথচলার সঙ্গী। আমার পরম অন্তরঙ্গ, মনের মানুষ, এক সহচরের মত।সুখে দুঃখে আমি তাঁর কাছে আশ্রয় নিলাম।

এই অসুন্দর,হিংস্র, কুৎসিত,নিষ্ঠুর পৃথিবীর বাইরে যে এক অতি সুন্দর অপরূপ, ঐশ্বর্যময় পৃথিবী আছে, তা তিনিই আমাদের চিনতে শিখিয়েছিলেন। ‘নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলাকে, পাতায়,পাতায় বিন্দু বিন্দু জলকে’ আমরা অন্য চোখে দেখতে শিখেছি। তাঁর কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম। কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, চিত্রকর, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক রবীন্দ্রনাথ সূর্যের মত আমাদের জীবনের সকল আঙিনাকে স্পর্শ করেছেন।

ঋণ আমাদের সবুজ শ্যামল কলেজ ক্যাম্পাসের কাছেও। ক্যাম্পাস আমাদের চিনতে শিখিয়েছিল ‘বাদলদিনের প্রথম কদমফুল,আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়া’।

হে কবি,হে মহাজীবন,লহ প্রণাম।

মধুর তোমার শেষ যে না পাই।

 

এটি বিই কলেজের ক্যাম্পাসে থাকাকালীন আমার অনেক পুরনো একটি লেখা

Sahityika Admin

Add comment